বিষয়বস্তুতে চলুন

ব্রেটন উডস সিস্টেম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মার্কিন ডলারে নির্ধারিত স্বর্ণের মূল্য ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি ব্রেটন উডস ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আধ পর্যন্ত স্থিতিশীল ছিল।

ব্রেটন উডস সিস্টেম ছিল একটি মুদ্রা ব্যবস্থাপনা কাঠামো, যা ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস চুক্তির পর থেকে ১৯৭৬ সালের জ্যামাইকা চুক্তি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পশ্চিম ইউরোপীয় দেশসমূহ এবং অস্ট্রেলিয়াসহ ৪৪টি দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের জন্য নিয়ম নির্ধারণ করে দেয়।[] এটি ছিল স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে মুদ্রাগত সম্পর্ক পরিচালনার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণরূপে আলোচনার ভিত্তিতে গঠিত প্রথম মুদ্রা সিস্টেম।

ব্রেটন উডস সিস্টেম অনুযায়ী দেশগুলোকে তাদের মুদ্রা এমনভাবে নির্ধারণ করতে হতো, যেন তা নির্দিষ্ট হারের মধ্যে ১% ভিন্নতার সীমায় মার্কিন ডলারে রূপান্তরযোগ্য থাকে। বিদেশি সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য ডলার স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্য ছিল, প্রতি ট্রয় আউন্স বিশুদ্ধ স্বর্ণের মূল্য ধরা হয়েছিল ৩৫ মার্কিন ডলার (অথবা প্রতি ডলারে ০.৮৮৮৬৭ গ্রাম বিশুদ্ধ স্বর্ণ)।

এই সিস্টেমের উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তীতে, সদস্য দেশগুলো যেন প্রতিযোগিতার জন্য ইচ্ছামতো মুদ্রার মান কমিয়ে না ফেলে, তা নিশ্চিত করা। এজন্য ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড (আইএমএফ) গঠন করা হয়, যা বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিনিময় হার ঠিক আছে কি না তা দেখে এবং যেসব দেশের রপ্তানি-আমদানির হিসাব (ব্যালান্স অব পেমেন্টস) ঠিকঠাক না থাকে, তাদের প্রয়োজনে রিজার্ভ বা মার্কিন ডলার ধার দেয়।[] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলমান অবস্থায়, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সিস্টেম নতুন করে গড়ে তোলার প্রস্তুতি হিসেবে, ৪৪টি মিত্র দেশের ৭৩০ জন প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রের ব্রেটন উডস, নিউ হ্যাম্পশায়ারের মাউন্ট ওয়াশিংটন হোটেলে জাতিসংঘের মনেটারি অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল কনফারেন্সে (যা ব্রেটন উডস কনফারেন্স নামেও পরিচিত) যোগদান করেন। তাঁরা ১ থেকে ২২ জুলাই ১৯৪৪ পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যান এবং শেষ দিনে ব্রেটন উডস চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য একটি নিয়ম, প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াভিত্তিক কাঠামো তৈরি করা হয়। এই চুক্তির মাধ্যমেই আইএমএফ এবং ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি) গঠিত হয়, যা বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ-এর অন্তর্ভুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র, যাদের কাছে তৎকালীন বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ স্বর্ণ মজুত ছিল, তারা নিশ্চিত করে যে ব্রেটন উডস সিস্টেম যেন স্বর্ণ এবং মার্কিন ডলারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। সোভিয়েত প্রতিনিধি দল সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও পরবর্তীতে তারা চূড়ান্ত চুক্তিতে সাক্ষর করেনি। সোভিয়েত প্রতিনিধিদের মতে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে ওয়াল স্ট্রিট এর শাখা মাত্র। ব্রেটন উডস সিস্টেমের প্রতিষ্ঠানগুলো ১৯৪৫ সালে কার্যক্রম শুরু করে। অর্থনীতিবিদ ব্যারি আইচেংগ্রিনের মতে, ব্রেটন উডস সিস্টেম সফলভাবে চলেছে তিনটি কারণে: আন্তর্জাতিক মূলধন চলাচলের সীমাবদ্ধতা, কঠোর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন ডলারের প্রভাবশালী অর্থনৈতিক অবস্থান।[][]

ইউরোডলার ব্যবস্থার বিস্তারে আন্তর্জাতিক মূলধনের প্রবাহ বেড়ে যায়, যা মূলধন চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন করে তোলে। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্র মার্কিন ডলারকে স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্য রাখার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়, যার ফলে ব্রেটন উডস সিস্টেম কার্যত শেষ হয়ে যায় এবং ডলার এক প্রকার ফিয়াট মুদ্রায় পরিণত হয়।[] এই ঘটনার পরপরই অনেক পূর্বনির্ধারিত মুদ্রা বিনিময় হার (যেমন পাউন্ড স্টার্লিং) ভাসমান হারে পরিণত হয়।[] এরপর শুরু হয় ভাসমান বিনিময় হারের যুগ, যেটা এখনো অব্যাহত।[] ১৯৭৬ সালের জামাইকা অ্যাকর্ডস-এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্রেটন উডস সিস্টেমের অবসান হয়।

উৎপত্তি

[সম্পাদনা]

ব্রেটন উডস-এর পরিকল্পনাকারীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তির অবস্থা যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, কারণ চুক্তিটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ রোধ করতে ব্যর্থ হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিপুল পরিমাণ ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময় ব্রিটেন তার মিত্র দেশগুলো, যেমন ফ্রান্সকে সহায়তার জন্য এই অর্থ ব্যয় করে। মিত্র দেশগুলো ব্রিটেনকে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি, ফলে ব্রিটেনও যুক্তরাষ্ট্রকে পরিশোধ করতে পারেনি। ভার্সাই চুক্তিতে ফরাসি, ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের সমাধান ছিল জার্মানিকে এই ঋণের দায়ভার চাপানো। জার্মানির কাছ থেকে অর্থে আদায়, এবং ফ্রান্সের পক্ষে ব্রিটেনকে এবং ব্রিটেনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ ফেরত দেওয়া, দুই-ই বাস্তবসম্মত ছিল না।[] ফলে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর ব্যালান্স শিটে থাকা অনেক "সম্পদ" মুলত পুনরুদ্ধারযোগ্য ছিল না, যা শেষ পর্যন্ত ১৯৩১ সালের ইউরোপীয় ব্যাংক সংকটে গিয়ে পৌঁছায়। মিত্র দেশের যুদ্ধ-সংক্রান্ত ঋণ ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে ঋণদাতা দেশগুলোর অনমনীয়তা এবং একই সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার প্রবণতা (আইসোলেশনিজম) আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার ভেঙে পড়া এবং একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনে।[] সংকট চলতে থাকায় কিছু বাণিজ্যনির্ভর দেশ এমন এক নীতি গ্রহণ করে, যাকে বলা হয় বেগার দাই নেইবার, যেখানে তারা নিজেদের রপ্তানি বাড়াতে ও আমদানি কমাতে মুদ্রার মান ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে দেয়, অর্থাৎ মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটায়। এর ফলে তারা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় (সেপ্টেম্বর ২০২৩ অনুযায়ী) দেখা গেছে, এই ধরনের ডি ফ্যাক্টো মুদ্রাস্ফীতিমূলক নীতিগুলো বিশ্ববাজারে মূল্যহ্রাসজনিত সংকোচনের কিছুটা ভারসাম্য তৈরি করতে পেরেছিল। (দেখুন: আইচেংগ্রিন, "How to Prevent a Currency War")।

১৯৩০-এর দশকে ব্রিটেনের একটি একচেটিয়া বাণিজ্যিক জোট ছিল, যা ব্রিটিশ কলোনি ও অন্যান্য অঞ্চলগুলোর সঙ্গে গঠিত হয়েছিল, যা স্টার্লিং এরিয়া নামে পরিচিত ছিল। এই জোটভুক্ত দেশগুলোতে ব্রিটেন যদি বেশি আমদানি করত আর কম রপ্তানি করত, তাহলে যেসব দেশ ব্রিটিশ পাউন্ড পেত, তারা সাধারণত সেই অর্থ লন্ডনের ব্যাংকগুলোতে জমা রাখত। এর মানে দাঁড়ায়—ব্রিটেন বাণিজ্যে ঘাটতিতে থাকলেও, তার আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত থাকত, ফলে সামগ্রিকভাবে লেনদেনের ভারসাম্য বজায় থাকত। ধীরে ধীরে এই ভারসাম্য ধরে রাখতে ব্রিটেনের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের সঞ্চিত অর্থ ব্রিটিশ ব্যাংকগুলোতেই রেখে দেওয়া। যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকার কেউ যদি র‍্যান্ড মুদ্রা জমা রাখতেন, তারা সেটা লন্ডনে পাঠিয়ে স্টার্লিংয়ে রূপান্তর করে রাখতেন, কারণ ব্রিটিশ পাউন্ডের মান ছিল তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। ১৯২০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্য ব্রিটেনের বেশ কিছু শিল্পের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, এবং বাণিজ্য ঘাটতি সামাল দেওয়ার একটি উপায় ছিল মুদ্রার মান কমিয়ে দেওয়া (ডিভ্যালুয়েশন)। কিন্তু ব্রিটেন সেটা করতে পারেনি, কারণ পাউন্ডের মান কমে গেলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দেশগুলো তাদের অর্থ ব্রিটেনের ব্যাংকে রাখা বন্ধ করে দিত, ফলে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ধস নামার ঝুঁকি তৈরি হতো।[]

১৯৪০ সালের মধ্যে নাৎসি জার্মানিও কিছু নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে একটি নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য জোট গঠন করেছিল। তারা যেসব বাণিজ্যিক অংশীদার দেশের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকত, তাদের সেই অর্থ দিয়ে জার্মানি থেকে পণ্য আমদানি করতে বাধ্য করত।[১০] অন্যদিকে ব্রিটেনের নীতি ছিল, যেসব দেশ স্টার্লিং ব্যবহার করবে, তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্রিটিশ ব্যাংকিং সিস্টেমে রেখে দিবে। আর জার্মানির নীতি ছিল, বাণিজ্যিক অংশীদার জার্মান পণ্য কিনতে বাধ্য থাকবে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় চিন্তা ছিল যে যুদ্ধ শেষ হলে এবং যুদ্ধ ব্যয় হঠাৎ কমে গেলে দেশ আবার ১৯৩০-এর দশকের মতো বেকারত্বে ডুবে যেতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছিল স্টার্লিং ব্যবহারকারী দেশগুলোসহ ইউরোপের সবাই যেন তাদের কাছ থেকে পণ্য আমদানি করতে পারে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত বাণিজ্য এবং মুদ্রাকে স্বর্ণ বা ডলারে রূপান্তরযোগ্য রাখার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সমর্থন করেছিল।[১১]

যুদ্ধ-পরবর্তী আলোচনা

[সম্পাদনা]

ব্রেটন উডস সম্মেলনে যাঁরা পরিকল্পনা করেন, তাঁদের অনেকেই ১৯৩০-এর দশকের আর্থিক সংকট দেখেছিলেন। তাই তাঁরা নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল নীতি ঠিক করেন,"আর যেন কেউ নিজের মুদ্রার মান কমিয়ে অন্য দেশের ক্ষতি না করে" এবং "বিপজ্জনক অর্থনৈতিক বিনিয়োগের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে"-এর ভিত্তিতে। তাঁরা চাচ্ছিলেন যেন মুদ্রার মান কমিয়ে প্রতিযোগিতা করার আগের ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়। তবে এই নিয়ম যেন এমন না হয় যাতে ঋণগ্রস্ত দেশগুলোকে সুদের হার বেশি রাখতে বাধ্য করে এবং তাদের কারখানা বা শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জন মেইনার্ড কেইনস এই নিয়ে ব্রিটেনের পক্ষে একটা প্রস্তাব দেন—যেসব দেশের হাতে অতিরিক্ত টাকা আছে, তারা যেন সেই টাকায় ঋণগ্রস্ত দেশ থেকে পণ্য কেনে, সেখানে কারখানা বানায়, অথবা অর্থসাহায্য করে।[১২][১৩] কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তাদের প্রতিনিধি হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট বলেছিলেন—এভাবে নয়, বরং এমন এক আন্তর্জাতিক তহবিল, আইএমএফ তৈরি করা হোক, যার নিজস্ব টাকা থাকবে। এই টাকা দিয়ে বিশ্বের যেসব জায়গায় বিপজ্জনক বিনিয়োগ প্রবাহ দেখা যাবে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।[১৪] আজকের আইএমএফের মতো না হলেও, হোয়াইটের প্রস্তাব ছিল, এই ফান্ড এমনভাবে কাজ করবে, যাতে রাজনৈতিক শর্ত ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ নিজেরাই থেমে যায়।[১৫] অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ ব্র্যাড ডিলং লিখেছেন—যেসব বিষয়ে আমেরিকানরা কেইনসের কথা শোনেনি, পরে সময়ই প্রমাণ করেছে যে কেইনস ঠিক ছিলেন।[১৬] তবে গবেষকরা ১৯৩০-এর দশকের ঘটনাগুলোকে একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন, যেমন, ব্যারি আইচেংগ্রিন-এর লেখা গোল্ডেন ফিটার্স এবং হাউ টু প্রিভেন্ট অ্যা কারেন্সি ওয়ার বইগুলোতে তিনি বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন যে আগে যেটাকে খারাপ বলে মনে করা হতো, এখন মুদ্রার মান কমানো (ডিভ্যালুয়েশন) কিছু ক্ষেত্রে দরকারি বলেই ধরা হয়।

এই বিষয়ে বেন বারনাঙ্কি বলেছেন:

...... বিশ্ব মন্দার বড় কারণ ছিল দুর্বল এবং খারাপভাবে পরিচালিত আন্তর্জাতিক স্বর্ণ মান। ... ১৯২০-এর দশকের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ স্টক মার্কেট ঠেকাতে সুদের হার বাড়ায়, যা অন্য অনেক দেশে অর্থ সংকোচনের কারণ হয়। এই সংকোচন স্বর্ণ মান ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পরে ১৯৩১ সালে ব্যাংক আর মুদ্রা সংকট শুরু হলে সবাই হুড়োহুড়ি করে স্বর্ণ জমা করতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র আর ফ্রান্সের মতো দেশগুলো স্বর্ণ জমা রেখে ব্যবহার না করায়, টাকার সরবরাহ আরও কমে যায়, যার ফলে দাম, উৎপাদন আর চাকরি—সবই পড়ে যায়। দেশেরা নিজেদের মতো করে স্বর্ণ মান ছেড়ে দিয়ে ঘরোয়া অর্থনীতি ঠিক করতে শুরু করে, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল ধীর আর অসামঞ্জস্যপূর্ণ।" — গ্রেট ডিপ্রেশন, বেন বারনাঙ্কি

১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস সম্মেলনে মিত্র দেশগুলোর প্রতিনিধি দল একমত হয় যে বিশ্বের সব মুদ্রার মান যেন নিয়ন্ত্রিত থাকে, আর মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের একটা সম্পর্ক থাকুক।[১৭][১৮] এই ব্যবস্থায় দেশগুলো তাদের মুদ্রার মান নিজে থেকে বেশি বাড়াতে বা কমাতে পারত না। মুদ্রার মূল্য ও আন্তর্জাতিক লেনদেন কড়া নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হতো। বড় বড় বিনিয়োগ শুধু কারখানা বানানোর মতো কাজে লাগানো যেত, কিন্তু মুদ্রা কেনাবেচা বা বন্ড বাজারে জুয়া খেলার সুযোগ ছিল না। যেভাবে এই নিয়মগুলো বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও সবাই একমত ছিলেন যে, এর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা

[সম্পাদনা]

মাঝযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা "অর্থনৈতিক নিরাপত্তা" নামে একটি ধারণা তৈরি করেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল—একটি মুক্ত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুললে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে শান্তি টেকসই হতে পারে।

এই ধারণার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন করডেল হাল, যিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।[note ১]

হাল বিশ্বাস করতেন—দুই বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বাণিজ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা। তিনি বলেছিলেন—

......মুক্ত বাণিজ্য ও শান্তি একে অন্যের পরিপূরক; আর উচ্চ শুল্ক, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা আর অন্যায্য প্রতিযোগিতা যুদ্ধের পথ তৈরি করে… যদি আমরা এমন একটা ব্যবস্থার দিকে যেতে পারি যেখানে বাণিজ্য আরও মুক্ত হবে—অর্থাৎ কম বৈষম্য, কম বাধা থাকবে—তাহলে এক দেশের প্রতি আরেক দেশের হিংসা কমবে, সব দেশের মানুষের জীবনমান বাড়বে, আর সেই সঙ্গে যুদ্ধের জন্ম দেয় এমন অর্থনৈতিক অসন্তোষও কমে যাবে। তখন হয়তো আমরা দীর্ঘস্থায়ী শান্তির একটি বাস্তব সুযোগ পেতে পারি।[১৯]

সরকারি হস্তক্ষেপের উত্থান

[সম্পাদনা]

উন্নত দেশগুলো একমত হয়েছিল যে, মুক্ত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কার্যকর করতে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। মহামন্দার পরিণতিতে অর্থনীতির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ উন্নত দেশগুলোতে সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। কর্মসংস্থান, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তখন থেকে সরকারি নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে ওঠে নাগরিকদের জন্য একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের জন্য যে অর্থনৈতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়, যেটাকে অনেক সময় ওয়েলফেয়ার স্টেট বলা হয়, তার শিকড় ছিল একদিকে মহামন্দার সময় জনমানুষের দাবি, আর অন্যদিকে কেইনসীয় অর্থনীতিবিদদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা—যারা বলেছিলেন, বাজারের সীমাবদ্ধতা মোকাবেলায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার। তবে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ বাড়লে, তা আন্তর্জাতিক অর্থনীতির জন্য কিছু সমস্যাও তৈরি করেছিল। তখন অনেক দেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা আলাদা আলাদা নীতির প্রবণতা দেখা দেয়। দেশের নিজস্ব লক্ষ্যগুলোই প্রাধান্য পায়, এবং অনেকেই বুঝতে পারেনি যে, এই লক্ষ্যগুলো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। যার ফলে সৃষ্টি হয় বেগার দাই নেইবার ধাঁচের নীতি—যেমন উঁচু শুল্ক আরোপ, মুদ্রার প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়ন, যা স্বর্ণনির্ভর আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধ। ব্রেটন উডস সিস্টেমের প্রধান স্থপতি এবং নিউ ডিলার হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট এই অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন—

নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে যদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা না থাকে, তাহলে অনিবার্যভাবে শুরু হবে অর্থনৈতিক যুদ্ধ, যা পরে আরও বড় মাত্রার সামরিক যুদ্ধের সূচনা করবে।”[২০]

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক শান্তি নিশ্চিত করতে, দেশগুলো একমত হয়েছিল যে, তারা একসঙ্গে কাজ করবে এবং তাদের মুদ্রার সরবরাহ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে যাতে দেশগুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার বজায় থাকে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ হবে। এটিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে মুক্ত বাণিজ্যের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি, যেখানে শুল্ক কমানো হবে এবং স্থির বিনিময় হারের মাধ্যমে বাণিজ্যের ভারসাম্য বজায় রাখা হবে—যা মূলত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য উপযোগী। ফলে উন্নত বাজার অর্থনীতির দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনায় একমত হয়, যেখানে একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা তৈরি ও রক্ষা করা হবে, এবং বাণিজ্য ও মূলধন প্রবাহে বাধা কমানো হবে। এক অর্থে, এই নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা ছিল পূর্বের স্বর্ণ মানের মতো একটি কাঠামোতে ফিরে যাওয়া, যেখানে ডলারকে বিশ্ব রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হতো, যতদিন না বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বর্ণ বিশ্বজুড়ে নতুনভাবে বণ্টিত হয়। সেই অনুযায়ী, নতুন এই ব্যবস্থায় শুরুর দিকে দেশগুলো তাদের মুদ্রার সরবরাহে রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করত না, যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দেখা গিয়েছিল। বরং তারা মনোযোগ দিত মুদ্রা তৈরি ও ব্যবস্থাপনার উপর কড়া নিয়ন্ত্রণে, যাতে কেউ ইচ্ছামতো মুদ্রার দাম বাড়াতে বা কমাতে না পারে। এইভাবে, ব্রেটন উডস ছিল এমন এক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া, যেখানে সরকারের বেশি হস্তক্ষেপ না করে একটি স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল।

ইউরোপের যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক ক্ষতি

[সম্পাদনা]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো—যুদ্ধের ফলে চরমভাবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল—তাদের নিজেদের উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিচালনা করতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। বাস্তবতা ছিল, এই সহায়তা ছাড়া তারা টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ত।[১১] যুদ্ধের আগেই ফ্রান্স ও ব্রিটেন বুঝতে পেরেছিলো যে, তারা আর খোলা বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পপণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটেন নিজস্ব একটি বাণিজ্যিক জোট গঠন করে, যাতে করে মার্কিন পণ্যের প্রবেশ বন্ধ রাখা যায়। চার্চিল বিশ্বাস করতেন না যে, যুদ্ধের পরে তিনি এই ইম্যুনিটি তুলে দিতে পারবেন। তাই আটলান্টিক চার্টারে মুক্ত প্রবেশাধিকার নিয়ে যে শর্ত ছিল, সেটিকে তিনি নমনীয় রাখার প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত বাণিজ্যিক মূল্য ছিল বিশ্বের মোট পণ্য বাণিজ্যের অর্ধেকেরও বেশি। তাই বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করতে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্রিটিশ (বাণিজ্যিক) সাম্রাজ্যকে ভাঙতে হতো। যদিও উনবিংশ শতকে ব্রিটেন অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বে প্রভাবশালী ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন—বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেই নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আসুক।[২১][২২]

যুদ্ধ বিধ্বস্ত ব্রিটেনের হাতে তখন বেশি বিকল্প ছিল না। দুইটি বিশ্বযুদ্ধে দেশটির প্রধান শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যায়—এই শিল্পগুলোই ছিল এমন আয়নের উৎস, যার মাধ্যমে ব্রিটেন তার মোট খাদ্যের অর্ধেক এবং কয়লা ছাড়া প্রায় সব কাঁচামাল আমদানি করত। এই অবস্থায় ব্রিটেনের আর উপায় ছিল না এবং তাদের সাহায্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হতে হয়। শেষ পর্যন্ত, ১৯৪৫ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনকে ৪.৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এরপরেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ব্রেটন উডস চুক্তি অনুমোদন করে—এটি ঘটে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে।[২৩]

আর্থিক ব্যবস্থার রূপরেখা

[সম্পাদনা]

মুক্ত বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজন ছিল মুদ্রার মুক্ত রূপান্তরযোগ্যতা এবং ১৯৩০-এর দশকের ভাসমান বিনিময় হার ব্যবস্থার বিপর্যয় মাথায় রেখে ব্রেটন উডস সম্মেলনের আলোচকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, বড় ধরনের মুদ্রা ওঠানামা মুক্ত বাণিজ্যের ধারাকে থামিয়ে দিতে পারে। নতুন এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মাধ্যম দরকার ছিল—যার মাধ্যমে বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং পরিশোধ কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। তবে জাতীয় অর্থনীতির মতো আন্তর্জাতিক অর্থনীতির কোনো কেন্দ্রীয় সরকার নেই, যে মুদ্রা ছাপাবে বা সেটির ব্যবস্থাপনা করবে। অতীতে এই সমস্যার সমাধান হতো স্বর্ণ মান ব্যবস্থার মাধ্যমে। কিন্তু ব্রেটন উডস-এর নির্ধারকগণ মনে করেছিলেন, যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনীতি ও অর্থনীতির বাস্তবতায় এই ব্যবস্থা আর টেকসই নয়। এর পরিবর্তে তারা একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করেন—যেখানে স্থির বিনিময় হার থাকবে, আর এটি পরিচালনা করবে কয়েকটি সদ্য গঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এই ব্যবস্থায় মার্কিন ডলারকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ধরা হয়, কারণ তখন ডলার ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য স্বর্ণ মানভিত্তিক মুদ্রা।

পূর্ববর্তী ব্যবস্থা

[সম্পাদনা]

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে স্বর্ণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। স্বর্ণ মান ব্যবস্থায় বিভিন্ন দেশের মুদ্রার পেছনে স্বর্ণ মজুদ থাকত। প্রতিটি মুদ্রার আন্তর্জাতিক মূল্য নির্ধারিত হতো স্বর্ণের সঙ্গে তার নির্দিষ্ট সম্পর্ক অনুযায়ী। আন্তর্জাতিক লেনদেন মেটানোতেও স্বর্ণ ব্যবহার করা হতো। এই ব্যবস্থায় স্থির বিনিময় হার বজায় থাকত, যা অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে ঝুঁকি কমিয়ে দিত বলে খুবই গ্রহণযোগ্য ছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঘাটতি বা উদ্বৃত্তের ভারসাম্য এই স্বর্ণ মান ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক হয়ে যেত। কোনো দেশে ঘাটতি হলে, তার স্বর্ণের রিজার্ভ কমে যেত, ফলে সেই দেশকে তার অর্থ সরবরাহ কমাতে হতো। এর ফলে চাহিদা কমে যেত, আমদানি হ্রাস পেত এবং দাম কমে যাওয়ায় রপ্তানি বাড়ত—এভাবে ঘাটতি পূরণ হয়ে যেত।একইভাবে, কোনো দেশে যদি মূল্যস্ফীতি হতো, তাহলে সে দেশ স্বর্ণ হারাত, আর সেইসঙ্গে খরচ করার মতো অর্থের পরিমাণও কমে যেত। এইভাবে অর্থ সরবরাহ কমে যাওয়া মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে দিত। স্বর্ণ ব্যবস্থার পাশাপাশি তখন ব্রিটিশ পাউন্ডকেও আন্তর্জাতিক লেনদেনে রিজার্ভ মুদ্রা ও হস্তক্ষেপমূলক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ব্রিটিশ অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে পাউন্ড তখন এই ভূমিকায় আসীন হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ অর্থনীতির দুর্বলতার কারণে পাউন্ড এই দায়িত্ব পালনে অযোগ্য হয়ে পড়ে। ব্রেটন উডস সিস্টেমের নির্ধারকগণ একটি এমন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছিলেন, যার মূল লক্ষ্য হবে বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা। কিন্তু তখনকার সময়ে যেহেতু সরকারগুলো অর্থনীতিতে বেশি সক্রিয় ছিল, তাই কেউ ১৯শ শতাব্দীর স্বর্ণ মানের মতো স্থায়ীভাবে স্থির বিনিময় হার ব্যবস্থায় আগ্রহ দেখায়নি। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছিল, কিন্তু স্বর্ণ উৎপাদন তার চাহিদা মেটাতে পারছিল না। তাছাড়া, পৃথিবীর একটি বড় অংশের স্বর্ণ মজুত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে—যা পরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। তাই তখন শুধু মার্কিন ডলারই ছিল এমন একটি মুদ্রা, যা আন্তর্জাতিক লেনদেনের বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনীতি, স্বর্ণের সঙ্গে ডলারের নির্ধারিত অনুপাত ($৩৫ প্রতি আউন্স), এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিশ্রুতি—এই হারে ডলারকে স্বর্ণে রূপান্তর করার—সব মিলিয়ে ডলার তখন স্বর্ণের মতোই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। মূলতা, ডলার ছিল স্বর্ণের চেয়েও স্থিতিশীল, কারণ ডলার থেকে সুদ পাওয়া যেত এবং এর তারল্য স্বর্ণের চেয়ে অনেক বেশি নমনীয় ছিল।

স্থির বিনিময় হার

[সম্পাদনা]
ব্রেটন উডস সিস্টেমে কিছু মুদ্রা একে অপরের বিপরীতে স্থির বিনিময় হারে চলত, যেমন: মার্কিন ডলার/স্টার্লিং পাউন্ড, মার্কিন ডলার/কানাডিয়ান ডলার, মার্কিন ডলার/ইউরো/, মার্কিন ডলার/জাপানি ইয়েন, মার্কিন ডলার/সুইডিশ ক্রোনা, মার্কিন ডলার/সুইস ফ্রাঁক

ব্রেটন উডস সিস্টেমের নিয়মগুলো নির্ধারিত হয় আইএমএফ ও ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি)-এর চুক্তির মাধ্যমে। এই নিয়ম অনুযায়ী একটি স্থির বিনিময় হার ভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থা গঠন করা হয়। এতে সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা নিজেদের মুদ্রা অন্য মুদ্রায় রূপান্তরযোগ্য রাখবে এবং মুক্ত বাণিজ্যকে উৎসাহ দেবে। এই ব্যবস্থায় একটি পেগড রেট বা নির্দিষ্ট হারে মুদ্রার মান স্থির করে দেওয়া হয়। সদস্য দেশগুলোকে বলা হয়—তারা যেন নিজেদের মুদ্রার মান একটি নির্ধারিত রিজার্ভ মুদ্রার (মূলত ডলার) সাথে স্থির রাখে, এবং এই মান থেকে ১% ওপরে বা নিচে ওঠানামা হলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করে (অর্থাৎ মুদ্রা কেনা-বেচা করে)। তত্ত্বিক ভাবে, এই রিজার্ভ মুদ্রা হওয়ার কথা ছিল "ব্যানকোর" নামের একটি বিশ্বমুদ্রা (যেটির প্রস্তাব দিয়েছিলেন জন মেইনার্ড কেইনস), কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ফলে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে নির্ধারিত হয় মার্কিন ডলার। এর মানে দাঁড়ায়, অন্যান্য দেশগুলো নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে স্থিরভাবে যুক্ত রাখবে এবং মুদ্রার বিনিময় হার যাতে নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকে, তা নিশ্চিত করতে মার্কিন ডলার কেনাবেচা করবে। ফলে, আগের স্বর্ণ মান ব্যবস্থায় যেভাবে স্বর্ণ কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করত, ব্রেটন উডস সিস্টেমে সেই ভূমিকা গ্রহণ করে মার্কিন ডলার।[২৪]

এর পাশাপাশি, ডলারের ওপর আস্থা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র আলাদাভাবে চুক্তি করে—যেখানে বলা হয়, ১ আউন্স স্বর্ণের বিনিময়ে ডলার বিনিময় করা হবে ৩৫ ডলারে। এর মাধ্যমে বিদেশি সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ডলার বিনিময়ে স্বর্ণ পেতে পারত। এইভাবে ব্রেটন উডস একটি অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা তৈরি করে, যেখানে সব মুদ্রার মান নির্ধারিত হতো ডলারের সঙ্গে, আর ডলার ছিল স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্য—অর্থাৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বর্ণের মতোই নির্ভরযোগ্য। তখন ডলারই ছিল এমন একমাত্র মুদ্রা, যার ক্রয়ক্ষমতা ছিল সর্বোচ্চ এবং যা সরাসরি স্বর্ণে সমর্থিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ইউরোপীয় দেশগুলো প্রচণ্ড ঋণের মধ্যে ছিল এবং বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করে। এই কারণগুলো মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং, বিশ্বের অন্যান্য দেশে ডলারের প্রতি আস্থা বেড়ে যায় এবং ডলার ব্রেটন উডস সিস্টেমের মূল মুদ্রায় পরিণত হয়।

সদস্য দেশগুলো চাইলে নিজেদের মুদ্রার নির্ধারিত মান ১০ শতাংশের বেশি পরিবর্তন করতে পারত, তবে সেটা আইএমএফ-এর অনুমোদন সাপেক্ষে। কোন দেশের অর্থপ্রদানের ভারসাম্য মূলগত অসামঞ্জস্য-এর মধ্যে পড়েছে, আইএমএফ-এর বিশ্লেষনে এই তথ্য পাওয়া গেলেই শুধু এই অনুমোদন দেওয়া হতো। তবে এই "মূলগত অসামঞ্জস্য" কাকে বলে, তা নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি—ফলে অনুমোদনের বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পরিণত হয়, এবং অনেক দেশ ১০%-এর নিচে বারবার মুদ্রার মান কমানোর চেষ্টা করে। যে দেশ অনুমোদন ছাড়া মান পরিবর্তন করত, কিংবা অনুমোদন না পাওয়ার সত্ত্বেও পরিবর্তন করত, তাকে আইএমএফ-এর সহায়তা প্রদান করা হতো না।[২৫] এই স্থির বিনিময় হার ব্যবস্থা বজায় রাখতে দেশগুলোকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখতে হতো, যাতে দরকার পড়লে বাজারে হস্তক্ষেপ করা যায় এবং মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখা যায়।[২৬](p220) এছাড়াও, এই ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক মূলধনের চলাচল সীমিত রাখা হতো। কারণ বড় অংকের মূলধন দ্রুত প্রবেশ বা প্রস্থান করলে মুদ্রার মানের ওপর বড় প্রভাব পড়ত, এবং সেটা নিয়ন্ত্রণে অনেক খরচ হতো, এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও শেষ হয়ে যেতে পারত।[২৬](p220)

আনুষ্ঠানিক কাঠামো

[সম্পাদনা]

ব্রেটন উডস সম্মেলনের অংশগ্রহণকারীরা একটি বিষয়ে একমত ছিলেন—১৯৩০-এর দশকের মতো বন্ধ বাজার এবং অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব যেন আর না ফিরে আসে। তাই তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিষয়ক সহযোগিতার জন্য একটি নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান দরকার, যেখানে দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতে পারবে। ইতিমধ্যেই ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস বলেছিলেন—"বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে সঠিক প্রত্যাশা তৈরির জন্য নিয়মভিত্তিক একটি কাঠামো অত্যন্ত জরুরি।" তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্রেটন উডস সিস্টেমের স্থির বিনিময় হার ব্যবস্থায় সমর্থন করেন। যুদ্ধকালের সময় মুদ্রা নিয়ে যে সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছিল, সেগুলো আরও খারাপ হয়েছিল কারণ সে সময় আন্তঃসরকার পর্যায়ে আলোচনার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি বা কাঠামো ছিল না। তাই যখন ব্রেটন উডসে দেশগুলো অর্থনৈতিক যোগাযোগের জন্য কিছু নির্ধারিত কাঠামো ও নিয়ম তৈরি করে, তখন অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে দ্বন্দ্ব অনেকটাই কমে আসে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকের গুরুত্বও কিছুটা কম মনে হতে থাকে।

কাঠামো

[সম্পাদনা]

ব্রেটন উডস সম্মেলনে আইএমএফ যে রূপে গঠিত হবে, তা নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল—ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক তারল্যে প্রবেশাধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? এই প্রবাহ একটি বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিজার্ভ তৈরি করবে, না কি এটি হবে সীমিত পরিসরের একটি ঋণ ব্যবস্থার মতো—এই বিষয়েই মূল বিতর্ক ছিল।

জন মেইনার্ড কেইনস (ডানে) ও হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট, ৮ মার্চ ১৯৪৬, আইএমএফ-এর বোর্ড অব গভর্নরসের উদ্বোধনী বৈঠকে

যদিও সম্মেলনে ৪৪টি দেশ অংশ নিয়েছিল, আলোচনার মূল দিকনির্দেশনা এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী পরিকল্পনা থেকে। কেইনস, যিনি সম্মেলনে ব্রিটেনের নেতৃত্ব দেন, ব্রিটিশ ট্রেজারিকে লেখা চিঠিতে মন্তব্য করেন—সব দেশকে যুক্ত করা প্রয়োজন নেই। তিনি মনে করতেন, উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশ দেশগুলোর কিছু দেওয়ার নেই, বরং তারা শুধু দায় বাড়াবে।[২৭] ১৯৪২–৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব তৈরি করেন, যা ব্রিটিশ ট্রেজারির পক্ষে কেইনসের প্রস্তাবের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়। হোয়াইটের পরিকল্পনা ছিল বিশ্বজুড়ে মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য উদ্দীপক নীতির দিকে ঝোঁক দেওয়া, অন্যদিকে কেইনসের লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। এই সম্মেলনের আগে দুই বছর ধরে প্রচুর দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বৈঠক হয়েছিল, যাতে ব্রেটন উডস সিস্টেমের মূলনীতিগুলো নিয়ে একটি সম্মিলিত সমঝোতা তৈরি করা যায়। তখন মনে হচ্ছিল, হোয়াইট ও কেইনসের পরিকল্পনার মধ্যে পার্থক্য বিশাল বিরাজ করছে। হোয়াইট চাচ্ছিলেন এমন একটি ফান্ড, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অস্থিতিশীল আর্থিক প্রবাহ ঠেকাবে। তাঁর প্রস্তাবিত স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড-এ নির্দিষ্ট পরিমাণ জাতীয় মুদ্রা ও স্বর্ণ রাখা হতো, যাতে রিজার্ভ ঋণ দেওয়ার পরিমাণ সীমিত রাখা যায়। অন্যদিকে কেইনস চাচ্ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র যেন ব্রিটেন ও ইউরোপের অন্যান্য দেশকে যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনে সহায়তা করে।[২৮]

১৯৪৪ সালের ২২ জুলাই সম্মেলনের সমাপনী বক্তব্যে কেইনস বলেন—

আমরা, এই সম্মেলনের প্রতিনিধি হিসেবে, অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ করার চেষ্টা করেছি… আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি এমন নিয়ম, এমন মানদণ্ড তৈরি করা, যা সবাই গ্রহণযোগ্য মনে করবে এবং কারও জন্য কষ্টকর হবে না।”[২৯]

কেইনসের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি বিশ্ব রিজার্ভ মুদ্রা তৈরি করা হতো—যার নাম হতে পারত “ব্যানকোর”—যেটা একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালিত হতো এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন অর্থ তৈরি করতে পারত। কেইনস বলেছিলেন, যদি কোনো দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টস ঘাটতি হয়, তবে শুধু সেই দেশের ওপর বোঝা চাপানো যাবে না। ঋণদাতা দেশগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে—যেমন ঘাটতি দেশগুলো থেকে বেশি পণ্য আমদানি করা, সেখানে কারখানা স্থাপন করা, কিংবা অর্থসাহায্য করা। যুক্তরাষ্ট্র একটি সম্ভাব্য ঋণদাতা দেশ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিল এবং বৈশ্বিক নেতৃত্ব নেওয়ার প্রস্তুতিতে ছিল এবং পরিশেষে হোয়াইটের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যদিও তারা কেইনসের কিছু মতামত বিবেচনায় নিয়েছিল। হোয়াইটের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যখন স্পেকুলেশন বা ফটকা পরিস্থিতির ভারসাম্য নষ্ট করে, তখনই বৈশ্বিক হস্তক্ষেপ দরকার। শেষ পর্যন্ত কিছু বিষয়ে সমঝোতা হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার কারণে ব্রেটন উডস সম্মেলনের অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী দেশ হোয়াইটের পরিকল্পনার পক্ষে একমত হয়। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান ও প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্রিটেনের অর্থনৈতিক প্রভাব যেন ক্রমে আন্তর্জাতিক কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যায়, সে দিকেও তাদের দৃষ্টি ছিল।[৩০]

কার্যক্রম
[সম্পাদনা]

ব্রেটন উডস সিস্টেমের আগে কখনও স্থায়ী কোনো আন্তর্জাতিক মুদ্রানীতির সহযোগিতা কাঠামো গঠনের চেষ্টা হয়নি। এর চেয়েও বড় পরিবর্তন ছিল ভোটাধিকার বণ্টনের নিয়ম। এক দেশ এক ভোট নয়, বরং সদস্যদের আর্থিক অবদানের ভিত্তিতে ভোটের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি অর্থ দিচ্ছিল, তাই নেতৃত্বে তার প্রভাব ছিল সর্বোচ্চ। এই আনুপাতিক ভোটিং ব্যবস্থায় শুরুতে আইএমএফ-এর মোট কোটার এক-তৃতীয়াংশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে—এতটাই যে, তারা চাইলে একাই আইএমএফ-এর গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন ঠেকাতে পারত। আইএমএফ-এর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি-তে এবং এতে মূলত মার্কিন অর্থনীতিবিদরাই কর্মরত ছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কর্মী আদান-প্রদান হতো।

১৯৪৬ সালে আইএমএফ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করলে, প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইটকে প্রথম মার্কিন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নিয়োগ দেন। তখনো কোনো ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদ তৈরি হয়নি, ফলে হোয়াইট মাঝে মাঝে অ্যাক্টিং ম্যানেজিং ডিরেক্টর-এর দায়িত্বও পালন করেন এবং প্রথম বছরে তাঁর প্রভাব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হোয়াইটকে চূড়ান্তভাবে আইএমএফ-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা বাদ দেন। কারণ, এফবিআই পরিচালক জে. এডগার হুভার ট্রুম্যানকে একটি রিপোর্ট দেন, যেখানে বলা হয়—হোয়াইট ছিলেন সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থার একজন সহায়ক, যিনি সরকারের ভেতরে সোভিয়েত-সমর্থিত লোক নিয়োগ করছিলেন।[৩১]

চুক্তিতে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ গঠনের কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ধারণা ছিল, নতুন স্বর্ণ উৎপাদন এই চাহিদা পূরণে যথেষ্ট হবে। যদি কোনো দেশে অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অসঙ্গতি দেখা দেয়, তাহলে সেটি নিজের মতো করে সমাধান করবে—যেমন মুদ্রার মান সামঞ্জস্য করা বা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানো। তবে আইএমএফ-এর হাতে খুব বেশি শক্তি ছিল না দেশগুলোকে এমন জাতীয় সমাধানের পথে উৎসাহিত করার জন্য। অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকেরা ১৯৪৪ সালেই বুঝেছিলেন—এই নতুন ব্যবস্থা কেবল যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে এলে কার্যকর হবে। আশা করা হয়েছিল, সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে এবং তখন পুরো সিস্টেম কার্যকরভাবে চালু হবে। বিশ্ব বাণিজ্যের প্রসার ও ইউরোপের যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন নিশ্চিত করতে, ব্রেটন উডস সম্মেলনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়—ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি)। এটি এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ-এর পাঁচটি সংস্থার একটি, এবং সম্ভবত বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। আইবিআরডি-র অনুমোদিত মূলধন ছিল ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি নিজস্ব তহবিল থেকে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি ঋণ নিশ্চয়তা দিত এবং নতুন তহবিল তুলতে সিকিউরিটিজ ইস্যু করত, যাতে দ্রুত যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনর্গঠন সম্ভব হয়। আইবিআরডি ছিল জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা, যার দায়িত্ব ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশগুলোকে ঋণ প্রদান করা।

ডলার ঘাটতি ও মার্শাল পরিকল্পনা

[সম্পাদনা]

ব্রেটন উডস সাক্ষরকারী দেশগুলোর সরকারগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ ও অনুমোদনকারী হিসেবে কাজ করত। ধারণা ছিল—দেশীয় মুদ্রার রিজার্ভ, আর প্রয়োজনে আইএমএফ-এর ঋণ মিলে অস্থায়ী ব্যালান্স অব পেমেন্টস ঘাটতি সামলানো যাবে। কিন্তু এই ব্যবস্থা ইউরোপের সংকট কাটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব পুঁজিবাদ এক ধরনের ডলার ঘাটতি-তে ভুগছিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত তৈরি করছিল, আর তাদের রিজার্ভ দ্রুত বাড়ছিল। এই প্রবাহ উল্টাতে হতো। সব দেশই মার্কিন পণ্য কিনতে চাইলেও, বাজারে ডলার না থাকলে সেটা সম্ভব হতো না। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রকেই বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি করতে হতো, যাতে করে তাদের রিজার্ভ থেকে ডলার বের হয়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহারযোগ্য হতো। এই ঘাটতি তৈরি করা যেত বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি, বিদেশে কারখানা তৈরি অথবা অর্থ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে। ব্রেটন উডস চুক্তিতে জুয়াভিত্তিক বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল, আর ১৯৫০-এর দশকে বিদেশ থেকে আমদানি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আকর্ষণীয় ছিল না, কারণ তখন তাদের প্রযুক্তি ছিল সর্বাধুনিক। তাই মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এবং বৈদেশিক সহায়তা দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে।[৩২] তবে, আইএমএফ-এর সীমিত পরিমাণ ঋণ ইউরোপের বিপুল পরিমাণ অর্থঘাটতি সামলানোর জন্য মোটেও যথেষ্ট ছিল না। সমস্যাটা আরও বাড়ে, যখন আইএমএফ-এর বোর্ড অফ গভর্নরস ব্রেটন উডস চুক্তির সেই ধারা পুনর্ব্যক্ত করে—যেখানে বলা হয়, আইএমএফ কেবল চলতি হিসাবে ঘাটতি মোকাবেলায় ঋণ দিতে পারবে, কিন্তু পুঁজিগত বা পুনর্গঠনমূলক কারণে নয়। আইবিআরডি (বর্তমানে বিশ্বব্যাংক) ঋণ দেওয়ার জন্য বাস্তবে যে অর্থ পায়, তা ছিল মাত্র ৫৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার—যা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অবদান। তার উপর, আইবিআরডি যে বন্ড ইস্যু করে নতুন অর্থ তুলতে পারত, তার বাজার ছিল কেবল রক্ষণশীল ওয়াল স্ট্রিট। ফলে আইবিআরডি খুবই সতর্ক ঋণ নীতি নিতে বাধ্য হয়—শুধুমাত্র তখনই ঋণ দিত, যখন ঋণ ফেরতের নিশ্চয়তা থাকত। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে, ১৯৪৭ সাল নাগাদ আইএমএফ ও আইবিআরডি নিজেরাই স্বীকার করে যে তারা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমস্যা সমাধানে অক্ষম।[৩৩] এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ পুনর্গঠনের জন্য একটি বৃহৎ আকারের অর্থনৈতিক সহায়তা কর্মসূচি চালু করে, যেটা মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনায় ঋণের বদলে অনুদান ভিত্তিক সহায়তা দেওয়া হয়। সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোকেও (যেমন: পোল্যান্ড) এই অনুদান পাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তারা পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমেকন থেকে সুবিধাজনক চুক্তি পায়।[৩৪] ১৯৪৭ সালের ৫ জুন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক বক্তৃতায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ মার্শাল বলেন:

ইউরোপের ব্যবসা-বাণিজ্যিক কাঠামো যুদ্ধের সময় একেবারে ভেঙে পড়েছে… পরবর্তী তিন-চার বছরের জন্য ইউরোপের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে—এত বেশি যে তাদের পক্ষে নিজের অর্থে কেনা সম্ভব নয়। তাই উল্লেখযোগ্য সহায়তা না পেলে ইউরোপকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে গভীর সংকটে পড়তে হবে।[৩৫]

১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পিতভাবে বিপুল পরিমাণ ডলার বিদেশে ছড়িয়ে দেয়। ১৯৫০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ব্যালান্স অব পেমেন্টস ঘাটতি তৈরি করে, যাতে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের তারল্য বজায় থাকে। এই ডলার বেরিয়ে যায় বিভিন্ন মার্কিন সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে, যেমন ট্রুম্যান ডকট্রিন, যেখানে গ্রিস ও তুরস্কের মার্কিনপন্থী সরকারগুলোকে সাহায্য করা হয় কমিউনিস্ট বিপ্লব দমনে, তৃতীয় বিশ্বের নানা মার্কিনপন্থী সরকারকে সহায়তা, এবং সর্বোপরি মার্শাল পরিকল্পনায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপের ১৬টি দেশকে মোট ১৭ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। দীর্ঘমেয়াদে ইউরোপ ও জাপানের অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশে প্রতিযোগিতামূলক রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানোর উপর জোর দেয়। পরাজিত অ্যাক্সিস দেশগুলোর ওপর থাকা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়। এই সহায়তার লক্ষ্য ছিল—উৎপাদন বাড়ানো এবং রপ্তানি সক্ষমতা গড়ে তোলা, যাতে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাজার সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যালান্স অব পেমেন্টস সংকট

[সম্পাদনা]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ছিল প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ রিজার্ভ, যা তখনকার মোট অনুমানিক বৈশ্বিক রিজার্ভের প্রায় ৬৫ শতাংশ। ১৯৫০-এর দশকে যখন বৈশ্বিক বাণিজ্য দ্রুত বাড়তে থাকে, তখন স্বর্ণভিত্তির পরিমাণ সামান্যই বাড়ে। ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যালান্স অব পেমেন্টস ঘাটতি শুরু হয়। এই সংকট মোকাবিলায় প্রথমে ১৯৫০-এর শেষ দিকে আইজেনহাওয়ার প্রশাসন তেল আমদানিতে কোটাসহ কিছু বাণিজ্য সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। আরও কড়া পদক্ষেপ প্রস্তাবিত হলেও বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ১৯৫৮ সালে এক গুরুতর মন্দা শুরু হলে এধরনের প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট প্রমাণিত হয় না। ১৯৬০ সালে জন এফ. কেনেডির প্রশাসন ব্রেটন উডস সিস্টেমকে প্রতি আউন্সে $৩৫ মূল্যে স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত রেখে ধরে রাখার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা শুরু করে।

ব্রেটন উডস ব্যবস্থার নকশা অনুযায়ী, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকেই স্বর্ণে রূপান্তরের জন্য বাধ্য করা হতো। ডলারকে স্বর্ণে রূপান্তর করার অনুমতি ছিল, কিন্তু সেটা বাধ্যতামূলক ছিল না। অন্য দেশগুলো চাইলে ডলার ধরে রাখতে পারত। পুরো রূপান্তরযোগ্যতার বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধোমে নির্ধারিত দামে লেনদেনের ব্যবস্থা রাখা হয়। তবে তখনও খোলা বাজারে স্বর্ণের বাণিজ্য চলছিল। এই ব্যবস্থাকে কার্যকর রাখার জন্য হয় ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের এই নির্ধারিত মান পরিবর্তন করতে হতো, নয়তো খোলা বাজারে স্বর্ণের দাম যেন $৩৫/আউন্সের কাছাকাছি থাকে, তা নিশ্চিত করতে হতো। যদি বাজার মূল্য ও নির্ধারিত মূল্যের মধ্যে ফারাক খুব বেশি হতো, তাহলে দেশগুলো ব্রেটন উডস দামে স্বর্ণ কিনে তা খোলা বাজারে বিক্রি করে নিজেদের আর্থিক সংকট সামাল দেওয়ার প্রলোভনে পড়তে পারত। ১৯৬০ সালে বেলজিয়াম-আমেরিকান অর্থনীতিবিদ রবার্ট ট্রিফিন লক্ষ্য করেন, ডলার ধরে রাখার অর্থ স্বর্ণের চেয়েও লাভজনক হয়ে পড়েছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বাণিজ্য ঘাটতি আসলে বিশ্বব্যবস্থায় তারল্য (তৈরি করছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চালু রাখছে।

এই পর্যবেক্ষণ থেকেই জন্ম নেয় ট্রিফিনের দ্বন্দ্ব, যেখানে বলা হয়, যদি যুক্তরাষ্ট্র ঘাটতি মেটাতে না পারে, তাহলে বৈশ্বিক তারল্য কমে যাবে এবং ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে, আবার ঘাটতি মিটিয়ে গেলেও একসময় ডলারের অবমূল্যায়ন ঘটবে এবং আর্থিক ব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি হবে।[৩৬] এই সংকট সামাল দিতে ১ নভেম্বর ১৯৬১ সালে আটটি দেশ মিলে লন্ডন গোল্ড পুল গঠন করে। ধারণা ছিল—লন্ডনের গোল্ড ফিক্সিং-এ যদি স্বর্ণের বাজার মূল্য হঠাৎ বেড়ে যায়, তাহলে এই পুল থেকে স্বর্ণ বাজারে ছেড়ে দাম কমিয়ে আনা যাবে এবং দাম কমে গেলে সেই স্বর্ণ ফেরত নেওয়া যাবে। তবে বিভিন্ন ঘটনায় (যেমন: কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকট) স্বর্ণের দাম বেড়ে $৪০/আউন্স ছাড়িয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে কেনেডি প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়াতে কর ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে, যার পরিণতিতে ১৯৬৪ সালের ট্যাক্স কাট প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত হয়। ১৯৬৭ সালে স্টার্লিং এরিয়া-তে পাউন্ডের ওপর চাপ ও স্বর্ণের সংগ্রহ শুরু হয়। ১৮ নভেম্বর ১৯৬৭ সালে ব্রিটেন সরকার পাউন্ডের মান কমাতে বাধ্য হয়।[৩৭] যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসনের সামনে তখন দুটো কঠিন পথ থাকে, হয় সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ নিতে হবে (যেমন: ভ্রমণ কর, রপ্তানি ভর্তুকি, বাজেট কাটছাঁট), না হয় ডলার ও স্বর্ণের ওপর আস্থা হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে।

জনসনের দৃষ্টিতে:

বিশ্বে স্বর্ণের মজুত এতটাই সীমিত যে বর্তমান ব্যবস্থা কার্যকর রাখা সম্ভব নয়—বিশেষ করে তখন, যখন ডলারকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করাটাই বিশ্ব বাণিজ্য ও প্রবৃদ্ধির জন্য তারল্য তৈরি করার মূল উপায়।[৩৮]

পশ্চিম জার্মানি ডলার ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও এবং স্বর্ণ না কেনার আশ্বাস দিলেও ডলার ও পাউন্ডের ওপর চাপ অব্যাহত থাকে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে জনসন প্রশাসন স্বর্ণ রপ্তানি বন্ধে এবং রপ্তানি বৃদ্ধিতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তবে মার্চ মাসে লন্ডনের মুক্ত বাজারে ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ কেনাবেচায় তীব্র চাপ পড়ে এবং লন্ডন গোল্ড পুল ভেঙে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে প্রথমে যুক্তরাজ্যে আদ-হক ব্যাংক ছুটি ঘোষণা করা হয়, পরে পুরো লন্ডন স্বর্ণ বাজার বন্ধ করে দেওয়া হয়—এরপর একাধিক আন্তর্জাতিক বৈঠক হয়, যাতে এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার বা সংস্কারের চেষ্টা করা যায়।[৩৯] ১৯৬৮ সালের নভেম্বর নাগাদ ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের নির্ধারিত সংযুক্তি বজায় রাখার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর একটি নতুন নীতি গৃহীত হয়—যেখানে ব্রেটন উডস ব্যবস্থাকে আর নির্ধারিত হারে স্বর্ণ সংযুক্তির ভিত্তিতে না রেখে সেটিকে ভাসমান হার বা নির্ধারিত সীমাবদ্ধ রূপান্তরের ভিত্তিতে পরিচালনার চেষ্টা করা হয়। ১৮ মার্চ ১৯৬৮ সালে মার্কিন কংগ্রেস ডলারের পেছনে ২৫% স্বর্ণ রিজার্ভ রাখার বাধ্যবাধকতা বাতিল করে।[৪০] এরপর যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয়—যেসব সরকার স্বর্ণ ব্যক্তিগত বাজারে কিনে-বেচে, তাদের কাছে আর স্বর্ণ বিক্রি করা হবে না।[৪১] ফলে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ বাণিজ্যে বেসরকারি বাজারের প্রভাব বেড়ে যায় এবং সেখানে স্বর্ণের দাম সরকারি ডলারের মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে ওঠে।[৪২][৪৩] যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণ রিজার্ভ ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে, কারণ ফ্রান্সসহ কিছু দেশ নিজস্ব স্বর্ণ মজুদ বাড়াতে থাকে।[৪৩]

কাঠামোগত পরিবর্তন

[সম্পাদনা]

রূপান্তরযোগ্যতায় প্রত্যাবর্তন

[সম্পাদনা]

১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে। এর একটি ছিল উচ্চ মাত্রার মুদ্রাগত আন্তঃনির্ভরতা-র উদ্ভব। ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে পশ্চিম ইউরোপীয় মুদ্রাগুলো এবং ১৯৬৪ সালে জাপানি ইয়েনের রূপান্তরযোগ্যতা ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে এই আন্তঃনির্ভরতার পথ তৈরি হয়। রূপান্তরযোগ্যতা ফিরে আসার ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং এর মাধ্যমে দেশগুলোর মধ্যে মুদ্রাগত সংযোগ আরও গভীর হয়। ইউরোডলার বাজার, যা ১৯৫৭ সালের আগে ছিল না বললেই চলে, ১৯৭২ সালে এসে পৌঁছে যায় প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারে। এই ইউরোমার্কেট গুলোর মাধ্যমে বৈশ্বিক ঋণ, তারল্য এবং অস্থিরতা বেড়ে যায়। এত বড় পরিসরে মূলধন লেনদেন শুরু হয় যে, দেশীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তা আর নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম ছিলনা।[৪৪]

আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের বিকাশ

[সম্পাদনা]

ব্যাংকিংয়ের আন্তর্জাতিকায়নের আরেকটি দিক ছিল আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং কনসোর্টিয়াম-এর উত্থান। ১৯৬৪ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যাংক একত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট গঠন করে, এবং ১৯৭১ সালের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাংকগুলোর তিন-চতুর্থাংশ এর অংশীদার হয়ে যায়। এই মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকগুলো শুধু বিনিয়োগের জন্যই নয়, বরং মুদ্রার দাম ওঠানামা থেকে লাভ করার জন্যও বড় অংকের টাকা এক দেশ থেকে আরেক দেশে সরাতে শুরু করে। এই নতুন আন্তঃনির্ভরতা বড় পরিমাণ মূলধন প্রবাহ সম্ভব করে তোলে। ব্রেটন উডস যুগে, কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা থাকলেও দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বিনিময় হার পরিবর্তনে অনীহা দেখাত। কারণ এতে দেশের নির্দিষ্ট কিছু অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ত এবং সেটিকে রাজনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ফলে বিনিময় হার অনেক সময় বাজার বাস্তবতার সঙ্গে আর মেলেনি। এতে করে স্পেকুলেটর বা জুয়াবাজদের জন্য এক ধরনের ঝুঁকিমুক্ত সুযোগ তৈরি হয়—তারা দুর্বল মুদ্রা থেকে শক্তিশালী মুদ্রায় চলে যেত এই আশায় যে, মুদ্রার মান পরিবর্তনের সময় লাভ করতে পারবে। আর যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক মান পরিবর্তন না করত, তাও তারা আবার আগের মুদ্রায় ফিরে যেতে পারত, কোনো ক্ষতি ছাড়াই। এইভাবে, ঝুঁকিমুক্ত জুয়া খেলার সুযোগ আর বিশাল অংকের অর্থের সহজলভ্যতা একত্রে মিলিয়ে পুরো ব্যবস্থাকে চরমভাবে অস্থিতিশীল করে তোলে।

যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রভাব কমে যাওয়া

[সম্পাদনা]

আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ওপর আরেকটি বড় আঘাত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব কমে যাওয়া। একসময় বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিউনিটি (ইইসি) এবং জাপান নিজেরাই বড় অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে। তাদের মোট রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি হয়ে যায়, প্রবৃদ্ধি ও বাণিজ্যের হার ছিল বেশি, এমনকি মাথাপিছু আয়ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এতে করে ইউরোপ ও জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফারাক দ্রুত কমিয়ে আনে। এইভাবে অর্থনৈতিক শক্তির ভারসাম্য যখন আরও ভাগাভাগি হতে শুরু করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের প্রতি অসন্তোষ বাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র কার্যত সারা বিশ্বের ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক’ হিসেবে কাজ করছিল এবং তাদের ঘাটতির মাধ্যমে বৈশ্বিক তারল্য নির্ধারিত হতো। বিশ্ব যখন ক্রমেই বেশি আন্তঃনির্ভর হয়ে উঠছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগুলো ইউরোপ ও জাপানের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলত। আর অন্য দেশগুলো যতদিন ডলার ধরে রাখতে রাজি ছিল, ততদিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, যেমন যুদ্ধ, সামরিক ব্যয় বা বৈদেশিক সাহায্য, বিপুল অর্থ কোনো ব্যালান্স অব পেমেন্টস চাপ ছাড়াই খরচ করতে পারত। মার্কিন ডলারভিত্তিক এই ব্যবস্থার রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে অসন্তোষ আরও বাড়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ডেটেন্ট বা উত্তেজনা প্রশমনের উদ্যোগ শুরু হয়। সোভিয়েত সামরিক শক্তির শঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থাকে ধরে রাখতে সহায়তা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা আশ্বাস ইউরোপ ও জাপানকে এই মার্কিন নেতৃত্ব মেনে নিতে সহায়তা করেছিল, বিশেষ করে তারা যখন যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছিল। কিন্তু যখন ইউরোপে উৎপাদন ও বাণিজ্য বাড়তে থাকে, এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ কমে, তখন এই নির্ভরতা আলগা হতে শুরু করে, আর অর্থনৈতিক অসন্তোষগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।

ডলার দুর্বল হয়ে পড়া

[সম্পাদনা]

যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ ও জাপানের মধ্যে এই ব্যবস্থার প্রতি অসন্তোষ বেড়ে যায়। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল ডলারের মান পড়ে যাওয়া, যা ছিল ১৯৪৫ সালের পর বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের প্রশাসন এই যুদ্ধ ও গ্রেট সোসাইটি কর্মসূচির খরচ কর বাড়িয়ে না দিয়ে চালাতে চেয়েছিল। ফলে ডলার বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটিতেও। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে ডলার বাজারে অতিমূল্যায়িত ছিল, অথচ জার্মান মার্ক ও জাপানি ইয়েন ছিল অবমূল্যায়িত। জার্মানি ও জাপান নিজেদের মুদ্রার মান বাড়াতে চায়নি, কারণ এতে তাদের রপ্তানি ব্যয়বহুল হয়ে যেত। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিশালী দেখাতে চেয়েছিল, তাই তারা ডলারের মূল্য কমাতে রাজি ছিল না।[৪৫] এর মধ্যে নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজার তৈরি হয়—যেখানে প্রচুর পরিমাণে জুয়াভিত্তিক পুঁজি ঘুরে বেড়াত দ্রুত মুনাফার খোঁজে।[৪৩] অন্যদিকে, যখন ব্রেটন উডস তৈরি হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের মোট উৎপাদিত পণ্যের অর্ধেক এবং রিজার্ভের অর্ধেকেরও বেশি অংশের অধিকারী। ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা ও ঠান্ডা যুদ্ধের দুই দায় একসঙ্গে পালন করতে পারছিল। ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ব্যালান্স অব পেমেন্টস ঘাটতি ধরে রাখে, যাতে মিত্র দেশগুলোকে ঋণ, সাহায্য এবং সৈন্য পাঠানো সম্ভব হয়। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে এসব খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৭০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বৈশ্বিক রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৬ শতাংশে। কিন্তু তখনও যুক্তরাষ্ট্র স্থির বিনিময় হার বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি ও চাহিদা অনুযায়ী ডলারকে স্বর্ণে রূপান্তরের দায়িত্ব নিয়ে বসে ছিল যা এই পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই ছিল না।

নিক্সন শক

[সম্পাদনা]

ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও গ্রেট সোসাইটি কর্মসূচির খরচ মেটাতে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয় এবং ফেডারেল রিজার্ভ প্রচুর অর্থ ছাপতে শুরু করে। এর ফলে ডলারের মূল্য ধীরে ধীরে অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ে।[৪৬] ১৯৬৮ সালে লন্ডন গোল্ড পুল ভেঙে পড়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণ রিজার্ভে ব্যাপক চাপ পড়ে।[৩৯] ১৯৭০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের সঙ্গে ডলারের কভারেজ ৫৫% থেকে কমে দাঁড়ায় মাত্র ২২%—যার ফলে অর্থনীতিবিদদের মতে, বিশ্ব আর ডলারের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। ১৯৭১ সালে মার্কিন সরকার ডলার ছাপানো অব্যাহত রাখে এবং তা বিদেশে পাঠিয়ে সামরিক ও সামাজিক ব্যয় মেটাতে থাকে। শুধু ১৯৭১ সালের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে যায়। এই পরিস্থিতিতে, ১৫ আগস্ট ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এক্সিকিউটিভ অর্ডার ১১৬১৫ জারি করে তিনটি বড় পদক্ষেপ নেন:

  • ৯০ দিনের জন্য মজুরি ও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ,
  • ১০% আমদানি শুল্ক, এবং
  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে—“গোল্ড উইন্ডো বন্ধ” ঘোষণা করেন, অর্থাৎ ডলার আর সরাসরি স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্য থাকল না (শুধু খোলা বাজারে বিনিময় সম্ভব ছিল)।

এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কোনো আন্তর্জাতিক সহযোগী দেশ, এমনকি নিজস্ব পররাষ্ট্র দপ্তরকে না জানিয়েই। পরে এটি নিক্সন শক নামে পরিচিত হয়।

স্মিথসোনিয়ান চুক্তি

[সম্পাদনা]

নিক্সন শকের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থায় সংস্কার আনার চেষ্টা শুরু হয়। ১৯৭১ সালের শেষ ভাগে গ্রুপ অফ টেন দেশগুলোর মধ্যে একাধিক দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক আলোচনা হয়, যাতে নতুন এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করা যায়। ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশন-এ বৈঠক করে গ্রুপ অফ টেন দেশগুলো স্মিথসোনিয়ান চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দেয় ডলারের মান প্রতি আউন্স স্বর্ণে $৩৮ রাখবে এবং ২.২৫% সীমার মধ্যে বিনিময় হার ওঠানামা করতে পারবে। অন্য দেশগুলো তাদের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কিছুটা বাড়াতে সম্মত হয়। এই পরিকল্পনায় শুধু স্পেশাল ড্রইং রাইটস বা এসডিআর ব্যবহার করে বৈশ্বিক আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখার প্রস্তাবও ছিল। তবে এই চুক্তি বাস্তবে খুব বেশি সফল হয়নি। ফেডারেল রিজার্ভ আশঙ্কা করেছিল—ডলারের মান কমালে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। ফলে তারা সুদের হার কমিয়ে দেয়, যাতে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বাড়ে। কিন্তু এতে বিদেশে ডলারের প্রবাহ বন্ধ হয়নি—বরং আরও বেড়ে যায়। বিদেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোতে ডলার জমা হতে থাকে, যা চুক্তির মূল লক্ষ্যকেই ব্যর্থ করে দেয়। এইভাবে ডলারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডলারের মূল্য ১০% কমানো ঘোষণা করা হয়। এরপরই জাপান ও ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিউনিটি দেশগুলো নিজেদের মুদ্রাকে ভাসমান বিনিময় হার-এ ছেড়ে দেয়। এই ঘটনাগুলোই ছিল ব্রেটন উডস সিস্টেমের পতনের সূচনা। ১৯৭৬ সালে জামাইকা চুক্তির মাধ্যমে এই ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে সব উন্নত দেশই ভাসমান মুদ্রা ব্যবস্থায় চলে যায়।[৪৭][৪৮]

  1. যুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক অর্থনৈতিক নীতিতে উদারনৈতিক ধারণা কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখতে পারেন, যেমন: Kenneth Waltz, Man, the State and War (নিউ ইয়র্ক: কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৯) এবং Yuvi.C. Calleo ও Benjamin M. Rowland, American and World Political Economy (ব্লুমিংটন, ইন্ডিয়ানা: ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৩)।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Ghizoni, Sandra Kollen (২০১৩-১১-২২)। "Creation of the Bretton Woods System"Federal Reserve History। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২২ 
  2. Edward S. Mason and Robert E. Asher, "The World Bank Since Bretton Woods: The Origins, Policies, Operations and Impact of the International Bank for Reconstruction". (Washington, DC: Brookings Institution, 1973), 29.
  3. Barry Eichengreen, |"Bretton Woods After 50". (Review of Political Economy, 2021), volume 33, issue 4, p552–569, doi=10.1080/09538259.2021.1952011
  4. Ghizoni, Sandra Kollen (২০১৩-১১-২২)। "Nixon Ends Convertibility of U.S. Dollars to Gold and Announces Wage/Price Controls"Federal Reserve History। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২২ 
  5. Eichengreen, Barry (২০১৯)। Globalizing Capital: A History of the International Monetary System (3rd সংস্করণ)। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 124, 127। আইএসবিএন 978-0-691-19390-8জেস্টোর j.ctvd58rxgডিওআই:10.2307/j.ctvd58rxg 
  6. Eichengreen, Barry (১১ জুন ২০২১)। "The Big Float" (ইংরেজি ভাষায়)। Project Syndicate। সংগ্রহের তারিখ ৯ আগস্ট ২০২১ 
  7. জন মেইনার্ড কেইনস, ইকোনমিক কনসিকুয়েন্সেস অব দ্য পিস, ম্যাকমিলান: ১৯২০।
  8. Hudson, Michael (২০০৩)। "5"। Super Imperialism: The Origin and Fundamentals of U.S. World Dominance (2nd সংস্করণ)। London and Sterling, VA: Pluto Press। 
  9. Keynes, John Maynard. "Economic Consequences of Mr. Churchill (1925)" in Essays in Persuasion, edited by Donald Moggridge. 2010 [1931].
  10. Skidelsky, Robert. John Maynard Keynes 1883–1946: Economist, Philosopher, The Statesman. London, Toronto, New York: Penguin Books, 2003.
  11. Block, Fred. The Origins of International Economic Disorder: A Study of United States International Monetary Policy from WW II to the Present. Berkeley: UC Press, 1977.
  12. Marie Christine Duggan, "Taking Back Globalization: A China-United States Counterfactual Using Keynes' 1941 International Clearing Union" in Review of Radical Political Economy, Dec. 2013
  13. Helleiner, Eric. States and the Reemergence of Global Finance: From Bretton Woods to the 1990s. Ithaca: Cornell University Press, 1994
  14. D'Arista, Jane (২০০৯)। "The Evolving International Monetary System"। Cambridge Journal of Economics33 (4): 633–52। ডিওআই:10.1093/cje/bep027অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  15. Gardner, Richard. Sterling Dollar Diplomacy: Anglo American Collaboration in the Reconstruction of Multilateral Trade. Oxford: Clarendon Press, 1956.
  16. "Review of Robert Skidelsky, John Maynard Keynes: Fighting for Britain 1937–1946"। Brad Delong, Berkeley university। ১৪ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুন ২০০৯ 
  17. Wang, Jingyi (২০১৫)। The Past and Future of International Monetary System: With the Performances of the US Dollar, the Euro and the CNY। Springer। পৃষ্ঠা 85। আইএসবিএন 9789811001642 
  18. Uzan, Marc। "Bretton Woods: The Next 70 Years" (পিডিএফ)Econometrics Laboratory - University of California, Berkeley 
  19. Hull, Cordell (১৯৪৮)। The Memoirs of Cordell Hull: vol. 1। New York: Macmillan। পৃষ্ঠা 81। 
  20. Robert A. Pollard, Economic Security and the Origins of the Cold War, 1945–1950 (New York: Columbia University Press, 1985), p. 8
  21. Lundestad, Geir (সেপ্টেম্বর ১৯৮৬)। "Empire by Invitation? The United States and Western Europe, 1945–1952"। Journal of Peace Research। Sage Publications, Ltd.। 23 (3): 263–77। এসটুসিআইডি 73345898জেস্টোর 423824ডিওআই:10.1177/002234338602300305 
  22. Ikenberry, G. John (১৯৯২)। "A World Economy Restored: Expert Consensus and the Anglo-American Postwar Settlement"। International Organization। The MIT Press। 46 (1): 289–321। এসটুসিআইডি 153410600জেস্টোর 2706958ডিওআই:10.1017/s002081830000151xKnowledge, Power, and International Policy Coordination 
  23. P. Skidelsky, John Maynard Keynes, (2003), pp. 817–20
  24. Prestowitz, Clyde (২০০৩)। Rogue Nationবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। Basic Books। আইএসবিএন 9780465062799 
  25. Eichengreen, Barry (১৯৯৬)। Globalizing Capital। Princeton University Press। আইএসবিএন 9780691002453 
  26. Lan, Xiaohuan (২০২৪)। How China Works: An Introduction to China's State-led Economic Development। Topp, Gary কর্তৃক অনূদিত। Palgrave Macmillan। আইএসবিএন 978-981-97-0079-0ডিওআই:10.1007/978-981-97-0080-6 
  27. Prashad, Vijay (২০০৮)। The Darker Nations। The New Press। পৃষ্ঠা 68আইএসবিএন 978-1595583420 
  28. Marie Christine Duggan (2013). "Taking Back Globalization: A China-United States Counterfactual Using Keynes' 1941 International Clearing Union" in Review of Radical Political Economy
  29. Donald Moggeridge (ed.), The Collected Writings of John Maynard Keynes (London: Cambridge University Press, 1980), vol. 26, p. 101
  30. Conway, Ed (২০১৪), The Summit: The Biggest Battle of the Second World War - fought behind closed doors, London: Little, Brown Book Group, পৃষ্ঠা 123, আইএসবিএন 978-1408704929, ১০ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ 
  31. Steil, Benn (৮ এপ্রিল ২০১২)। "Banker, Tailor, Soldier, Spy"The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ 
  32. Helleiner, Eric. States and the Reemergence of Global Finance: From Bretton Woods to the 1990s. Ithaca: Cornell University Press, 1994.
  33. Mason, Edward S.; Asher, Robert E. (১৯৭৩)। The World Bank Since Bretton Woods। Washington, D.C.: The Brookings Institution। পৃষ্ঠা 105–07, 124–35। 
  34. "Poland: Carnations". Time (9 February 1948).
  35. [১]
  36. "Money Matters, an IMF Exhibit – The Importance of Global Cooperation, System in Crisis (1959–1971), Part 4 of 7"Imf.org। ৫ সেপ্টেম্বর ২০০১। সংগ্রহের তারিখ ২৫ মার্চ ২০১৭ 
  37. "Wilson defends 'pound in your pocket'"BBC News। ১৯ নভেম্বর ১৯৬৭। 
  38. Francis J. Gavin, Gold, Dollars, and Power – The Politics of International Monetary Relations, 1958–1971, The University of North Carolina Press (2003)
  39. "Memorandum of discussion, Federal Open Market Committee" (পিডিএফ)। Federal Reserve। ১৪ মার্চ ১৯৬৮। 
  40. United States Congress, Public Law 90-269, 18 March 1968
  41. Speech by Darryl R. Francis, President Federal Reserve Bank of St. Louis (১২ জুলাই ১৯৬৮)। "The Balance of Payments, The Dollar, and Gold"। Statements and Speeches of Darryl R. Francis। পৃষ্ঠা 7। 
  42. Larry Elliott, Dan Atkinson (২০০৮)। The Gods That Failed: How Blind Faith in Markets Has Cost Us Our Future। The Bodley Head Ltd। পৃষ্ঠা 6–15, 72–81আইএসবিএন 978-1-84792-030-0 
  43. Laurence Copeland (২০০৫)। Exchange Rates and International Finance (4th সংস্করণ)। Prentice Hall। পৃষ্ঠা 10–35। আইএসবিএন 0-273-68306-3 
  44. Best, Jacqueline (২০০৭)। The Limits of Transparency: Ambiguity and the History of International Finance (ইংরেজি ভাষায়)। Cornell University Press। আইএসবিএন 978-0-8014-7377-7 
  45. Gray, William Glenn (২০০৭), "Floating the System: Germany, the United States, and the Breakdown of Bretton Woods, 1969–1973", Diplomatic History, 31 (2): 295–323, ডিওআই:10.1111/j.1467-7709.2007.00603.x 
  46. Blanchard (2000), op. cit., Ch. 9, pp. 172–73, and Ch. 23, pp. 447–50.
  47. Mastanduno, M. (২০০৮)। "System Maker and Privilege Taker"। World Politics61: 121। এসটুসিআইডি 154088693ডিওআই:10.1017/S0043887109000057 
  48. Eichengreen, Barry (২০১১)। Exorbitant Privilege: The Rise and Fall of the Dollar and the Future of the International Monetary System। Oxford: Oxford University Press। পৃষ্ঠা 61আইএসবিএন 9780199753789