ব্যবহারকারী আলাপ:A. K. M. Kamrul Hassan Miah

পাতাটির বিষয়বস্তু অন্যান্য ভাষায় নেই।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে


বারাক ওবামার পররাষ্ট্রনীতি

পররাষ্ট্রনীতি হলো কোন রাষ্ট্রের সেই সব কার্যের ধারা, যা উক্ত রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তার ভৌগলিক সীমারেখার বাইরে অবস্থিত অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য সম্পাদন করে থাকে। মূলত পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে নিহিত থাকে তুলনামূলকভাবে স্থায়ী স্বার্থ, যা কোন রাষ্ট্র সব সময় সংরক্ষণ করতে এবং একই সাথে বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করে। এছাড়াও সাময়িকভাবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে উদ্ভুত কোন ব্যাপারে উক্ত রাষ্ট্রের নীতির বিশেষ ঘোষণা, যা উক্ত রাষ্ট্রের মূল স্বার্থেও সাথে জড়িত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক পরিচালনা করে থাকে। বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্ববৃহৎ অথনৈতিক শক্তি (১৪.৩ ট্রিলিয়ন ডলার) এবং সামরিক শক্তি সম্পন্ন দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের মোট প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক তাদের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে থাকে, যার পরিমাণ ৭১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে- ‘মার্কিন জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুবিধার জন্য একটি অধিকতর নিরাপদ গণতান্ত্রিক এবং সম্ভাবনাময় বিশ্ব সৃষ্টি করাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এছাড়া মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটি পারমানবিক প্রযুক্তি ও পারমানবিক উপকরণের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ, বিদেশী রাষ্ট্র সমূহের সাথে পারস্পরিক বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং মার্কিন বৈদেশিক বাণিজ্যের নিরাপত্তা বিধান, আন্তর্জাতিক পণ্য বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর, আন্তর্জাতিক শিক্ষা এবং প্রবাসী মার্কিন নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করাকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আইনগত লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিগত সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত, সমালোচিত ও প্রসংশিত হয়েছে। বিশেষত ২০০১ সালের ৯/১১ পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ মার্কিন জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় যে নীতিসমূহ গ্রহণ করেন তা সমগ্র বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ২০০১ সালে আফগানিস্তান ও ২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসন এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের ক্ষেত্রে একপাক্ষিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট বুশ কর্তৃক ঘোষিত Pre emptive Attack নীতির ফলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি আগ্রাসী চরিত্র ধারণ করে। সন্ত্রাসবাদ সমস্যা, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সূত্রপাত ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলীয় পদপ্রার্থী নির্বাচনে বারাক হোসেন ওবামা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি ৪৪ তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বারাক ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। মূলত ওবামা প্রশাসন বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া, নতুন কুটনীতি, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানী নিরাপত্তা এবং ইরাক, আফগানিস্তান, ইরান, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ক প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেছে। তাই বলা যায়, বারাক ওবামা তাঁর পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতিতে যেসকল নীতি গ্রহণ করেছেন তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিশ্ব অধিকতর শান্তিময় হয়ে উঠবে, যা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করবে। ওবামার পরিচয়ঃ ১৯৬১ সালের ৪ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে বারাক ওবামা জন্ম গ্রহণ করেন। বারাক ওবামা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্বাট ল’স্কুল থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৯২-২০০৪ সাল পর্যন্ত ওবামা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’স্কুলে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৭ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে ২০০৪ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিনয় রাজ্যের সিনেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি ইলিনয় রাজ্য থেকে প্রথম আফ্রো আমেরিকান হিসেবে সিনেটর নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে রিপাবলিকান দলীয় পদপ্রার্থী জন ম্যাককেইনকে পরাজিত করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

বারাক হোসেন ওবামাঃ ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর ওবামা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়াও ‘আন্তর্জাতিক কুটনীতি এবং বিশ্বের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাকে শক্তিশালী করতে তার অসাধারণ পদক্ষেপের’ জন্য ২০০৯ সালের ৯ অক্টোবর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কংগ্রেসের ক্ষমতাঃ মার্কিন সিনেটের সম্মতিক্রমে প্রেসিডেন্ট বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের সাথে চুক্তি সম্পাদন ও চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আলোচনা করে থাকেন। কিন্তু এ চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মার্কিন সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমতির প্রয়োজন হয়। সামরিক ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে এককভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। তবে কংগ্রেস শুধুমাত্র যুদ্ধ ঘোষণা এবং সামরিক ও বেসামরিক খাতে বাজেট প্রণয়নে ভূমিকা রাখে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মূল কাজ হচ্ছে- অন্য রাষ্ট্রের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনা করা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মার্কিন সিনেটের উপদেশ ও সম্মতিক্রমে নিয়োগ প্রদান করেন। কংগ্রেস বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের সাথে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় পরিচালনা করে থাকেন। তবে এ সংক্রান্ত চুক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে কার্যকর হয়।

বারাক ওবামার পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রশাসনঃ ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি বারাক ওবামা মার্কিন প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিকে বারাক ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি বলা হয়। প্রেসিডেন্ট ওবামার পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টারা হলেন- ১. সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) - হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন, ২. জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা - জেমস্ এল. জোনস্, ৩. জাতিসংঘের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত - সুসান রাইচ।

বারাক ওবামার পররাষ্ট্রনীতিঃ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের পর যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন তার কতকগুলো মূলনীতি ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে। নিুে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো- ওবামার পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতিঃ ২০০৭ সালের ২৩ এপ্রিল ‘The Chicago Council on Global Affair’ এ বারাক ওবামা তার নির্বাচনী প্রচারণা সভায় সর্বপ্রথম যে বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত ভাষণ প্রদান করেন, এতে পাঁচটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। মূলত এ পাঁচটি বিষয়- বারাক ওবামার পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি। এগুলো হলো- ১. ইরাক যুদ্ধের দায়িত্বপূর্ণ সমাপ্তি এবং বৃহত্তর অঞ্চলের সংকটপূর্ণ চ্যালেঞ্জসমূহের উপর গুরুত্বারোপ করা। ২. একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী সামরিক বাহিনী হ গঠন এবং সামরিক শক্তি ব্যবহারে প্রজ্ঞা প্রদর্শন। ৩. বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি যেসকল হুমকিসমূহ রয়েছে তা থেকে বিশ্বকে নিরাপদ করতে হুমকিকে প্রতিরোধ করতে এবং গণবিধ্বংসী মরণাস্ত্রের বিস্তার রোধের জন্য বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে সুবিন্যস্ত করা। ৪. অভিন্ন হুমকি প্রতিরোধ এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় অংশীদারিত্ব ও জোট গঠন করা। ৫. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যান্য জাতিসমূহকে সাথে নিয়ে তাদের জন্য একটি অধিকতর নিরাপদ বিশ্ব গঠনে কাজ করা।

ওবামার পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহঃ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে যে সকল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহকে গুরুত্ব প্রদান করেন, তা হলো- ১. বৈশ্বিক জোট সমূহকে পুনবিন্যস্ত ও অধিকতর কার্যকর করা। ২. কোন প্রকার পূর্বশর্ত ব্যতীত যেকোন জাতির সাথে কুটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সম্পর্ক স্থাপন। ৩. পর্যায়ক্রমে ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা। ৪. ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সমস্যার ক্ষেত্রে ‘দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান’ কে অগ্রাধিকার প্রদান করা। ৫. ইসরাইলের প্রতিরক্ষা অধিকারের প্রতি সমর্থন প্রদান এবং ইসরাইলে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে মার্কিন-ইসরাইল অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ককে জোরদার করা। ৬. তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সম্প্রসারণকে নিশ্চিত করতে অধিক সংখ্যক দূতাবাস স্থাপন করা। ৭. এশিয়ান দেশসমূহ বিশেষত জাপান, দক্ষিন-কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে নতুন অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন করা। যার অন্যতম লক্ষ্য হলো- এ অঞ্চলে চীনের আধিপত্যকে প্রতিহত করা। ৮. ন্যাটো’র সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আফগানিস্তানে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য ও বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। ৯. পাকিস্তান বেসামরিক সহযোগিতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে ইসলামাবাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। ১০. বিশ্বব্যাপী পারমানবিক নিরাপত্তা এবং পারমানবিক উপকরণসমূহ অর্জনের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের তৎপরতা প্রতিরোধের জন্য গৃহীত পদক্ষেপের ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করা। ১১. পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT) কে জোরদার করা। বিশেষত ইরান ও উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে NPT চুক্তিকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ১২. জ্বালানী ক্ষেত্রে মার্কিন স্বনির্ভরতা অর্জন। ১৩. রাশিয়ার সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে পারমানবিক অস্ত্রের বিস্তার ও মজুদ হ্রাস করার মধ্য দিয়ে পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গঠনের লক্ষ্য অর্জন করা। ১৪. ইরানকে ভীতি প্রদর্শন ও সুবিধা প্রদান করা। বিশেষত আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এর সদস্য পদ প্রদান, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ব্যবস্থা করা। ইরান যাতে তার পারমানবিক কর্মসূচি ত্যাগ করে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টি ও সন্ত্রাসীদের সাহায্য দান বন্ধ করে। ১৫. ভেনিজুয়েলা ও কিউবার সাথে বিদ্যমান বিরোধ নিরসনের মধ্য দিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা। কিউবার উপর আরোপিত অবরোধ শিথিল করতে আলোচনা শুরু করা।

অন্যান্য লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহঃ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও জাতিসংঘে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সুসান রাইচ কর্তৃক উত্থাপিত কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এগুলো হলো- হিলারি কর্তৃক উত্থাপিত বিষয়সমূহঃ ১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থসমূহ সংরক্ষণে শুধুমাত্র সামরিক শক্তি নয় বরং ‘র্স্মাট পাওয়ার’ (Smart Power) ব্যবহার করা। ২. পারমানবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য চীন ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন। ৩. সিটিবিটি (CTBT) চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্য অর্জন করা। রাশিয়ার সাথে সম্পাদিত START চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে যৌথভাবে কাজ করা। উল্লেখ্য ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ৪. পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাথে এ অঞ্চলের হুমকিসমূহ মোকাবেলায় একত্রে কাজ করা। ৫. উত্তর কোরিয়ার সাথে ছয় জাতি আলোচনা অব্যাহত রাখা। মাদক চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধে মেক্সিকোর সাথে মিত্রতাকে জোরদার করা। ৬. ল্যাতিন আমেরিকার দেশসমূহের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। সুসান রাইচ কর্তৃক উত্থাপিত বিষয়সমূহঃ জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের সময় মার্কিন সিনেটের শুনানিতে সুসান রাইচ নিুোক্ত বিষয়সমূহের কথা উল্লেখ করেন, যা পরবর্তীতে বারাক ওবামা তার পররাষ্ট্রনীতিতে সংযুক্ত করেন। এগুলো হলো- ১. জিম্বাবুয়েতে রবার্ট মুগাবে শাসনের অবসান ঘটানো এবং জিম্বাবুয়ের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন সাধন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা প্রদান করা। ২. জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মার্কিন অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রচারণা, পারমানবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ এবং মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে গৃহীত কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতিসংঘে মার্কিন উপস্থিতিকে উজ্জীবিত করা।

ওবামার পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ নীতিসমূহঃ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর পররাষ্ট্রনীতির যে সকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষণা করেন তা বাস্তবায়নের জন্য কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মূলত ওবামা প্রশাসন রাষ্ট্রসমূহের ক্ষেত্রে যে সকল নীতি গ্রহণ করে, তা নিুে আলোচনা করা হলো-

ইরাকের প্রতি নীতিঃ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ গণবিধ্বংসী মরণাস্ত্র থাকার অভিযোগে একপাক্ষিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ২০ মার্চ ২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এর পরবর্তীতে ইরাকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ১,২৪,০০০ মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করা হয়। কিন্তু মার্কিন বাহিনী ইরাক ভূ-খণ্ডে ইরাকিদের কঠিন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। গেরিলা আক্রমন, আত্মঘাতী হামলাসহ বিভিন্ন আক্রমনে ২০০৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ইরাকে ৪,২৬০ জন মার্কিন সৈন্য নিহত হয়। ফলে ইরাক যুদ্ধ বিশ্বরাজনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষত ইরাকে মার্কিন সৈন্যের অবস্থান গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সহিংসতা বৃদ্ধিসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং বিশ্ব নিরাপত্তার প্রতি সন্ত্রাসবাদী হুমকিকে বৃদ্ধি করে। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে ইরাক থেকে দখলদার মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে জনমত গড়ে ওঠে। এমনকি ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের বিপর্যকর অবস্থার প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও এ বিষয়ে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ও ইরাক যুদ্ধের দায়িত্বশীল সমাপ্তির ঘোষণা প্রদান করে। ২০০৯ সালের ২৭ ফেব্র“য়ারি প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ-ক্যারোলিনার একটি সামরিক ঘাঁটিতে ইরাক যুদ্ধ সমাপ্তির বিষয়ে তার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন। এতে ওবামা যে বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব প্রদান করেন তা হলো- ১. ৩১ আগস্ট ২০১০ সালে ইরাক যুদ্ধের সমাপ্তি। ২. এ সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা। ৩. ৩১ আগস্ট ২০১০ সালের পরও মার্কিন সেনা ঘাঁটি ও সামরিক সরঞ্জাম সম্পূর্ণ সরিয়ে আনতে এবং ইরাকি সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে সহায়তা প্রদানের জন্য ২০১১ সাল পর্যন্ত ৩৫-৫০ হাজার মার্কিন সৈন্যের ইরাকে অবস্থান। পরবর্তী সময়ে ৪ জুন ২০০৯ সালে ওবামা তাঁর এক ভাষণে ২০০৯ সালের আগস্ট মাস থেকেই ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, যা পর্যায়ক্রমে ২০১২ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

আফগানিস্তানের প্রতি নীতিঃ প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী আফগানিস্তানে আল-কায়দা ও তালেবান দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ওবামা এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট বুশের নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। এজন্য ওবামা তালেবান ও আল-কায়দা দমনে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা সংখ্যা বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। কারণ ওবামা প্রশাসন মনে করে যে, আফগানিস্তানে জোট বাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে আল-কায়দা ও তালেবান জঙ্গিদের ক্রমবর্ধমান হুমকিকে প্রতিরোধ করতে না পারলে অথবা জোট বাহিনীর পরাজয় ঘটলে সন্ত্রাসবাদ শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয় বরং ন্যাটো ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দেবে। এজন্য ওবামা প্রশাসনের বৈদেশিক নীতির বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে- আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা। এক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসন আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে যে সকল নীতি গ্রহণ করে, তা হলো- ১. ২০০৯ সালের মার্চে আফগানিস্তানে ২১ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রেরণের জন্য ওবামার অনুমতি প্রদান। ২. ২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর আরও অতিরিক্ত ১৩ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রেরণের অনুমতি প্রদান। যাদের মধ্যে- প্রকৌশলী, চিকিৎসক, গোয়েন্দা সদস্য ও সামরিক বিশেষজ্ঞ রয়েছে। উল্লেখ্য অক্টোবর ২০০৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মোট মার্কিন সৈন্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৮ হাজার। ৩. আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর প্রধান জেনারেল ম্যাক ক্রিস্টাল আফগানিস্তানে বিজয় নিশ্চিত করতে ২০১০ সালের মধ্যে আরও ৪০-৪৫ হাজার সৈনা পাঠানোর অনুরোধ করেন। ওবামা প্রশাসন সৈন্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিষয়টি পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলে। উল্লেখ্য জেনারেল ম্যাক ক্রিস্টাল’এর নেতৃত্বে বর্তমানে আফগানিস্তানে ন্যাটো জোটের ১ লক্ষ্য সৈন্য রয়েছে। ৪. ২২ জানুয়ারি ২০০৯ সালে ওবামা রিচার্ড হলব্র“ককে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সমস্যার সমাধানের জন্য বিশেষ দূত নিযুক্ত করেন। হলব্র“ক আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে আফগান সমস্যা সমাধানে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ৫. ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সমস্যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে উত্থাপন করে। বারাক ওবামা তার পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তানকে গুরুত্ব প্রদান করে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য মার্কিন সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও তালেবান ও আল-কায়দার ক্রমাগত হামলায় ওবামা প্রশাসনের সময়ই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানে নিহত হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রতি নীতিঃ আফগানিস্তানে ক্রমবর্ধমান তালেবান ও আল-কায়দা হুমকির সাথে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ওয়াজিরিস্তানে তালেবান আধিপত্য, ইন্দো-মার্কিন বিশেষ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করেছে। পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি এবং পাক-আফগান সীমান্তে তালেবানদের অবাধ বিচরণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এমতাবস্থায় ওবামা প্রশাসন বিগত সময়ে পাকিস্তান নীতি পর্যালোচনা করে নিুোক্ত নীতিসমূহ গ্রহণ করে- ১. পাকিস্তানে গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসনকে সুসংহত করতে সমর্থন প্রদান। ২. পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সাহায্য প্রদান। ৩. পাকিস্তানের সাথে একটি টেকসই, দীর্ঘ মেয়াদী এবং বহুমুখী সম্পর্ক স্থাপন। ৪. পাকিস্তানের সাথে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তিসমূহ সম্প্রসারণ। ৫. পাকিস্তান ও তার সীমান্তবর্তী দেশসমূহের শান্তি রক্ষায় যৌথভাবে কাজ করা। ৬. শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধির মাধ্যমে পাক-মার্কিন জনগণের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করা। ৭. পাকিস্তান সরকারের সাথে নিুোক্ত ক্ষেত্রসমূহে একত্রে কাজ করা, এ ক্ষেত্রসমূহ হলো-  পাকিস্তানি ভূ-খণ্ড থেকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত এবং পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে রোধ করা।  সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে সামরিক, আধা-সামরিক ও আইন শৃংখলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধনে সহায়তা প্রদান।  অভ্যন্তরীণভাবে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন বজায় রাখতে সহায়তা করা।

উপরোক্ত হুমকিসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের নীতি গ্রহণ করে। এগুলো হলো- ১. সোয়াত ও ওয়াজিরিস্তানে তালেবান বিরোধী অভিযানের সময় মানবিক সংকট মোকাবেলায় জরুরী ত্রাণ হিসেবে যথাক্রমে ১১ কোটি মার্কিন ডলার ও ৫০ লক্ষ মার্কিন ডলার সহায়তা প্রদান। ২. ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও জঙ্গীবাদ দমনের জন্য আগামী পাঁচ বছরের জন্য ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের প্যাকেজ ঘোষণা। ৩. ২০০৯ সালের ২৩ অক্টোবর মার্কিন সিনেট শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে সামরিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য ‘ডিফেন্স অথরাইজেশন’ বিলের আওতায় ২০১০ সালে পাকিস্তানের জন্য ৬৮ হাজার মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা বরাদ্দ করে। পাকিস্তান সমস্যার সমাধানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রিচার্ড হলব্র“ককে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করেন। হলব্র“ক পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান প্রতিরোধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। পাকিস্তানের প্রতি বিশেষ দৃষ্টির অংশ হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ২৮ অক্টোবর ২০০৯ সালে তিন দিনের সফরে ইসলামাবাদ আসেন। এ সময় হিলারি ক্লিনটন পাকিস্তানকে পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আহবান জানান। এ সফরকালে দু-দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি বেসামরিক বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। হিলারি পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ববর্তী সরকারের অনুসৃত নীতিকে অপ্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করেন এবং পাকিস্তানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে দু-দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে মাইল ফলক হিসেবে অভিহিত করেন।

ইরানের প্রতি নীতিঃ ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীতে আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাককে সামরিক সহায়তা প্রদান দু-দেশের সম্পর্কে আরও অবনতি ঘটায়। ২০০৫ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ পুনরায় ইরানের পারমানবিক কর্মসূচি শুরু করলে ইরান-মার্কিন দ্বন্দ্ব মারাত্মক আকার ধারণ করে। এ সময় প্রেসিডেন্ট বুশ ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন। বারাক ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পর পূর্ববর্তী মার্কিন নীতি থেকে বেরিয়ে এসে ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ইরানও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে এবং বারাক ওবামা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর দীর্ঘদিনের নিয়ম ভেঙ্গে আহমাদিনেজাদ প্রথম ইরানি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁকে অভিনন্দন বার্তা পাঠান। যাতে তিনি বলেন- “ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের বন্ধু হতে পারে।” এ অবস্থায় ওবামা প্রশাসন ইরানের জন্য নিুোক্ত নীতি গ্রহণ করে- ১. ২০০৯ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মিউনিখ সম্মেলনে কোন পূর্ব শর্ত ছাড়াই ইরানের সাথে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দেন। ২. ২০০৯ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি প্রেসিডেন্ট ওবামা ইরানের প্রতি মার্কিন নীতিকে পর্যালোচনা করার এবং সরাসরি বৈঠকের কথা বলেন। এ প্রেক্ষিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ বলেন- “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্মানজনক পরিবেশে ইরান দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত।” ২০০৯ সালের ১৯ মার্চ ইরানের নওরোজ উৎসব উপলক্ষ্যে ইরানি জনগণের উদ্দেশ্যে সরাসরি এক ভিডিও বক্তব্যে ওবামা পুনরায় ইরানের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেন। ৩. ৪ জুন ২০০৯ সালে কায়রোতে মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদানকালে বারাক ওবামা ইরান- মার্কিন দ্বন্দ্বকে স্বীকার করে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে কোন পূর্বশর্ত ছাড়াই উভয় দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। এ ভাষণে ওবামা ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমানবিক শক্তির অধিকারকে স্বীকার করলেও পারমানবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। ৪. ২০০৯ সালের ১২ জুন আহমাদিনেজাদ পুনরায় ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এসময় ইরান কোম্ শহরে ইরানের দ্বিতীয় পারমানবিক স্থাপনার কথা প্রকাশ করে। ফলে বারাক ওবামা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ এবং পারমানবিক সংকট নিরসনে ‘দ্রুত গঠনমূলক’ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানান। ৫. কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে পারমানবিক সংকট নিরসনে ১ অক্টোবর ২০০৯ সালে জেনেভায় ছয় বিশ্ব শক্তির সাথে ইরানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসময় ইরানের প্রতিনিধি সাইদ জলিলি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি উইলিয়াম বার্নস দ্বিপাক্ষিকভাবে বৈঠক করেন। বিগত ৩০ বছরের মধ্যে এটিই ছিল- দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের প্রথম বৈঠক। ৬. ১৯ অক্টোবর ২০০৯ সালে অষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইরানের প্রতিনিধিবৃন্দ পুনরায় আলোচনায় বসেন। এ আলোচনায় International Atomic Energy Agency (IAEA)পারমানবিক সংকট নিরসনে তৃতীয় কোন দেশে ইরানের মজুদকৃত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য প্রেরণের প্রস্তাব দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে এ প্রস্তাব মেনে নিতে বলে, অন্যথায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকি প্রদান করে।

উত্তর কোরিয়ার প্রতি নীতিঃ ওবামা প্রশাসন উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক অস্ত্রের বিষয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে। মার্কিন প্রশাসন আশংকা প্রকাশ করে যে, উত্তর কোরিয়া অর্থনৈতিক কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিকট গোপনে পারমানবিক অস্ত্র বিক্রি করতে পারে, যা মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠীসমূহের পারমানবিক অস্ত্র প্রাপ্তির আশংকাকে বৃদ্ধি করবে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে উত্তর কোরিয়ার প্রতি চাপ সৃষ্টির উপর গুরুত্বারোপ করে। ২০০৯ সালের ২৫ মে উত্তর কোরিয়া পুনরায় পারমানবিক কর্মসূচি শুরু করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর তীব্র সমালোচনা করে। উত্তর কোরিয়া বিষয়ে ওবামা প্রশাসন কঠোর অবস্থান গ্রহণ করলেও সংকট সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার উপর গুরুত্বারোপ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে উল্লেখযোগ্য দিক পরিলক্ষিত হয়, তা হলো- ১. উত্তর কোরিয়ায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে দন্ডিত দু’জন মার্কিন সাংবাদিককে মুক্ত করতে ৪ আগস্ট ২০০৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন উত্তর কোরিয়া সফর করেন। হোয়াইট হাউস এ পদক্ষেপকে সরকার প্রেরিত কোন মিশন হিসেবে অস্বীকার করলেও বিগত এক দশকের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের কোন মার্কিন নাগরিকের এটিই ছিল- প্রথম উত্তর কোরিয়া সফর। উত্তর কোরিয়া এ দু’জন সাংবাদিককে মুক্তি প্রদান করে, যুক্তরাষ্ট্র এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানায়। ২. ওবামা প্রশাসন উত্তর কোরিয়া সংকট সমাধানে চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ককে ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এজন্য ২০০৯ সালের অক্টোবরে চীনের প্রধানমন্ত্রী উত্তর কোরিয়া সফর করেন। ফলে ৬ অক্টোবর ২০০৯ সালে উত্তর কোরিয়া পুনরায় ছয় জাতি আলোচনায় ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। ৩. ছয় জাতি আলোচনায় অংশ গ্রহণের পূর্বে পিয়ং ইয়ং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে আগ্রহ প্রকাশ করে। এর প্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়া ২০০৯ সালের ২৩ অক্টোবর জ্যেষ্ঠ কুটনৈতিক রি গান’কে যুক্তরাষ্ট্র সফরে প্রেরণ করে। এ সফরে দু-দেশের মধ্যে শীর্ষ কূটনৈতিক পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

চীনের প্রতি নীতিঃ বিগত ৮ বছরে চীনের প্রতি যে মার্কিন নীতি পরিলক্ষিত হয় ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতিতে তার একটি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এ প্রসঙ্গে বলেন- “এ শতাব্দীতে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হবে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।” ওবামা প্রশাসন চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে নিুোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে- ১. ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল লন্ডনে জি-২০ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও চীনের প্রেসিডেন্ট হো জিন তাও - এর মধ্যে প্রথম দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে উভয় দেশ ÔUS-China Strategic & Economic Dialogue’ এর ঘোষণা প্রদান করেন। ২. ২৭-২৮ জুলাই ২০০৯ সালে ওয়াশিংটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রথম ডায়লগ অনুষ্ঠিত হয়। এতে চীনের পক্ষে Dai Bingguo I Wang Qishan এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে হিলারী ক্লিনটন ও Timothy Geithner অংশগ্রহণ করেন। এতে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সকল ক্ষেত্রে যৌথভাবে কাজ করার কথা ঘোষনা করে, তা হলো-  দ্বিপাক্ষিক বিষয় (জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় অব্যাহত রাখা),  আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার সংক্রান্ত ইস্যুসমূহ (পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কার্যক্রমে পারস্পরিক সহযোগিতা),  বৈশ্বিক ইস্যু (স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, জ্বালানী এবং বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানসমূহ),  আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্থিতিশীলতা (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান ও উত্তর কোরিয়া),  পরিবেশগত বিষয় ও জলবায়ু পরিবর্তন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের বৃহৎ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার। তাই ওবামা প্রশাসন চীনের সাথে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করে। প্রেসিডেন্ট ওবামা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলসহ ২০০৯ সালের ১৫-১৮ নভেম্বর চীন সফর করবেন। মায়ানমারের প্রতি নীতিঃ মায়ানমারে দীর্ঘ দিনের সামরিক শাসনের কারণে মায়ানমার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোন কুটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক জান্তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওবামা প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর মায়ানমার সম্পর্কে মার্কিন নীতিকে পর্যালোচনা করে, নতুন ধরনের নীতি গ্রহণ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেন- “যুক্তরাষ্ট্র মায়ানমারের উপর অবরোধ আরোপও নয় এবং তাদের সাথে সম্পর্কও নয়- এ ধরনের একটি নতুন কৌশল অনুসরণ করবে, যা মায়ানমারের জান্তা শাসনকে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।” এজন্য যুক্তরাষ্ট্র মায়ানমারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মায়ানমারের নেতৃত্ব এ বিষয়টিকে স্বাগত জানায় এবং সর্বশেষ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মায়ানমারের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল থিন সেইন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়ান উইন যোগদান করেন। বিগত ১৪ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত মায়ানমার সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্তাব্যক্তিরা এ ধরনের অধিবেশনে যোগদান করলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র মায়ানমারের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় দুইটি শর্ত আরোপ করে, তা হলো- ১. মায়ানমারকে NPT চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হবে এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে কোন প্রকার অস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করা যাবে না, ২. জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৮৮৪ ও ১৭১৮ নং প্রস্তাবের সাথে একাত্মতা পোষণ করতে হবে।

রাশিয়ার প্রতি নীতিঃ মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০০৯ সালের ৭ ফেব্র“য়ারি রাশিয়ার সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। অন্যদিকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেমস্ এল জোনস্ বলেন- “যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতি তার গুরুত্বপূর্ণ নীতিসমূহকে পর্যালোচনা করতে যাচ্ছে।” ওবামা রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা এবং বৈশ্বিক ইস্যুসমুহে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। ওবামা প্রশাসন রুশ-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে সকল নীতি অনুসরণ করে, তা হলো- ১. ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল লন্ডনে জি-২০ এর সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদ একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। এ বিবৃতিতে যে সকল বিষয়ের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয় তা হলো-  দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন,  ইরানকে তার পারমানবিক কর্মসূচি ত্যাগ এবং ইরানের পারমানবিক স্থাপনায় বিদেশী পর্যবেক্ষকদের প্রবেশের অনুমতি প্রদানের জন্য আহ্বান। ২. ৬ জুন ২০০৯ সালে ওবামা মস্কো সফরকালে উভয় দেশ বিভিন্ন ইস্যুতে এক যোগে কাজ করতে সম্মত হয়। এগুলো হলো-  ইউরোপে ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের পরিকল্পনা পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ।  ইরান, উত্তর কোরিয়া পারমানবিক সংকট নিয়ে আলোচনা এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে একযোগে কাজ করা।  ন্যাটো বাহিনীকে আফগানিস্তানে যুদ্ধ সরঞ্জাম পরিবহনে ভূ-খণ্ড ব্যবহারে রাশিয়ার অনুমতি প্রদান।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তাদের পারমানবিক অস্ত্র মজুদ আগামাী সাত বছরের মধ্যে ১,৭০০ এর নিচে নামিয়ে আনতে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ৩. ২০০৯ সালে ১৩ অক্টোবর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন রাশিয়া সফর করেন। এ সময় উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুতে আলোচনা করেন।

কিউবার প্রতি নীতিঃ ১৯৬৩ সালে কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত থাকলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পর দু-দেশের মধ্যকার উত্তেজনা কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। ওবামা প্রশাসন কিউবা মার্কিন স¤পর্কের ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে,তা হলো-  কিউবাতে ভ্রমণ এবং অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিলের পদক্ষেপ গ্রহণ।  সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালের শুরুর দিকে পশ্চিম গোলার্ধ বিষয়ক মার্কিন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিসা উইলিয়াম হাভানা সফর কালে কিউবার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন। এ বৈঠকে দু-দেশের মধ্যে সরাসরি ডাক সেবা চালুর বিষয়ে আলোচনা হয়। পাঁচ দিনের এ সফরকালে বিসা কিউবার কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তার সাথে দু-দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কয়েক দফা আলোচনা করেন। গত কয়েক দশকের মধ্যে এটিই ছিল- দু-দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রথম বৈঠক।

ভেনিজুয়েলার প্রতি নীতিঃ বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী থাকা অবস্থায় ভেনিজুয়েলার সাথে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ও ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের সাথে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর বারাক ওবামা এপ্রিল ২০০৯ সালে মধ্য ও ল্যাতিন আমেরিকা সফরে যান। এ সময় ১৭ এপ্রিল ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে অনুষ্ঠিত আমেরিকান শীর্ষ সম্মেলনে ওবামা অংশ গ্রহণ করেন। এ সম্মলনে ওবামা হুগোশ্যাভেজের সাথে করমর্দন করেন এবং পূর্ণ রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে ভেনিজুয়েলার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

ইসরাইলের প্রতি নীতিঃ ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পর ইসরাইলের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হলো- ১. পশ্চিমতীরে ইরসাইলের বসতি স্থাপন বৃদ্ধি বন্ধের জন্য ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু’র উপর চাপ প্রয়োগ। ২. ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট নিরসনে ‘দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান’ মেনে নিতে ইসরাইলের উপর চাপ প্রয়োগ। ৩. এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্য ইসরাইলকে চাপ প্রয়োগ।

ফিলিস্তিনের প্রতি নীতিঃ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান ও মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার জন্য অভিজ্ঞ কুটনৈতিক জর্জ মিশেলকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করেন। ওবামা ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানে আস্থা প্রকাশ করেন এবং এ দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানকে ইসরাইল যাতে স্বীকৃতি প্রদান করে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ব্যক্ত করেন। এ লক্ষ্যে ওবামা ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু’র সাথে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন।

মুসলিম বিশ্বের প্রতি নীতিঃ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পররাষ্ট্রনীতির একটি বিরাট পরিবর্তন হলো- মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন। বুশের সময় সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ, ইরাক-আফগান আগ্রাসন এবং তথাকথিত ক্রুসেড ঘোষণার ফলে মুসলিম বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। বারাক হোসেন ওবামা মুসলিম বিশ্বের সাথে দ্বন্দ্ব, সন্দেহ ও অবিশ্বাস দুর করে নতুন ধরনের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ প্রকাশ করেন। ৪ জুন ২০০৯ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশ্যে প্রদানকৃত ভাষণে ওবামা কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেন। এগুলো হলো-  বিশ্ব সভ্যতা ও যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নে মুসলমানদের অবদানের প্রশংসা।  ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের অঙ্গীকার।  ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ।  মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা।  ৯/১১ পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক আচরণকে স্বীকার করা। এছাড়াও ওবামা এপ্রিল ২০০৯ সালে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে তুরস্ক ও সৌদি আরব সফর করেন।

ভারতের প্রতি নীতিঃ ১৯৯৭ সালে ভারতে পারমানবিক বিষ্ফোরণের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ২০০১ সালে বুশ প্রশাসন ভারতের প্রতি ইতিবাচক নীতি গ্রহণ করতে শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে অক্টোবর মাসে ইন্দো-মার্কিন বেসামরিক পারমানবিক সহযোগিতা চুক্তিসহ বেশ কিছু বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৯ সালে ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতের প্রতি বুশের নীতিকে অনুসরণ করে দ-ুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন। ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ভারত সফর করেন। এ সফরকালে দ-ুদেশের নেতৃবৃন্দ উভয় দেশের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করা এবং বৈশ্বিক ইস্যুসমূহে অভিন্নভাবে কাজ করার কথা বলেন।

অন্যান্য ইস্যু ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রসমূহের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। নিুে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-  জলবায়ু পরিবর্তনঃ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়টিকে তার পররাষ্ট্রনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছেন। ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন Todd Stern কে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। Todd Stern বলেন- “২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে একটি নতুন চুক্তি সম্পাদনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোর প্রচেষ্টা চালাবে।”  পারমানবিক অস্ত্র মুক্ত বিশ্ব গঠনঃ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গঠনকে তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এতে ওবামা রাশিয়ার সাথে চুক্তির মাধ্যমে পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ হ্রাস করা, সিটিবিটি ও এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে নতুন পারমানবিক প্রযুক্তির উৎপাদন বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিশ্বে পারমানবিক অস্ত্রের বিস্তারকে প্রতিরোধের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের মাধমে একটি পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত ভবিষ্যৎ বিশ্ব গঠনের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনাঃ ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পর তার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা প্রদান করেন এবং বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা উল্লেখসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। যার ফলশ্র“তিতে ৯ অক্টোবর ২০০৯ সালে ওবামাকে তার পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে উৎসাহিত করার জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তথাপি ওবামা প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত পররাষ্ট্রনীতির কতকগুলো নেতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হয়। এগুলো হলো-  প্রেসিডেন্ট বুশের সময় আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী পাকিস্তান সীমান্তে জঙ্গি দমনের জন্য বিমান হামলা পরিচালনা করলে পাকিস্তান সরকার এ হামলাকে অবৈধ ও স্বাধীন দেশের প্রতি হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করে। কিন্তু ওবামা প্রশাসন বুশের আগ্রাসী নীতিকে অনুসরণ করে এ হামলা অব্যাহত রেখেছে। যা ওবামার বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।  আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট ওবামা নতুনভাবে সৈন্য প্রেরণের অনুমতি প্রদান করেন এবং আফগান যুদ্ধে জয়লাভের জন্য সকল ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত রয়েছে বলে ঘোষণা প্রদান করেন। আফগানিস্তানে ক্ষেত্রে ওবামার এ ধরনের নীতি এ অঞ্চলে পুনরায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের শান্তি ও নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।  আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বৈধ সরকার কাঠামো স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়াও আফগানিস্তানে বিদেশী সৈন্যদের সাথে সাধারণ জনগণের পারস্পরিক আস্থা সম্পন্ন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এমতাবস্থায় অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আফগান রনাঙ্গনে ওবামা অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ করলে মার্কিন সেনাদের মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক মন্দার এ সংকটপূর্ণ সময়ে অতিরিক্ত সামরিক ব্যয়ের কারণে মার্কিন অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।  পাকিস্তানে জঙ্গি দমনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করছে এর সমালোচনা করে নিউজার্সির সিনেটর রবার্ট মানানডেজ বলেন- “যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাপক আর্থিক ও সামরিক সাহায্য গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকার জঙ্গি দমনে ব্যবহার না করে ভারত সীমান্তে সৈন্য ও অস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি করবে যা পাক-ভারত সীমান্তে উত্তেজনাসহ দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বৃদ্ধি করবে।”  মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানে জর্জ মিশেলকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করার মাধ্যমে ওবামা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় মার্কিন দৃষ্টিপাতকে বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরতে চাইলেও তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হননি। কারণ ওবামার নিকট ইরাক আফগানিস্তান ও ইরানের অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে।  ইউরোপীয় ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে ওবামা পশ্চিম ইউরোপের নিরাপত্তাকে দুর্বল করেছেন।  ইরানের প্রতি ওবামার নীতি মূলত ইরানি রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থাকে আরও রক্ষণশীল করবে এবং যা ইরানের পারমানবিক অস্ত্র অর্জনে সহায়ক হবে।  পশ্চিমতীর থেকে বসতি প্রত্যাহারে ইসরাইলকে চাপ প্রয়োগের ফলে মধ্য প্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া বিঘিœত হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।  কিউবা ও ভেনিজুয়েলার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন মধ্য ও ল্যাতিন আমেরিকায় মার্কিন স্বার্থকে বিঘিœত করার পাশাপাশি এ অঞ্চলে সমাজ তন্ত্র প্রসারে সহায়তা করবে। যা ওবামার বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রসারের নীতিকে বাঁধাগ্রস্ত করবে।  ২৮ জুন ২০০৯ সালে মধ্য আমেরিকা হন্ডরাসে সেনা অভ্যুত্থানে সিআইএ সহায়তা প্রদান করে। যা ওবামার পরিবর্তনশীল পররাষ্ট্রনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ওবামা আন্তর্জাতিক শান্তি নিরাপত্তা ও মানবাধিকারসহ আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য গুয়ানতানামা বে কারাগার বন্ধ করে দিলেও বন্দীদের উপর বর্বর নির্যাতনের জন্য দায়ি সিআইএ এজেন্টদের বিচার ও শাস্তি থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন।  যুক্তরাষ্ট্র মায়ানমারের সামরিক জান্তার সাতে কুটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের জন্য অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধ তুলে নেয়ার কথা বলে। যা গণতন্ত্রের ধারক মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্রের নীতি প্রশ্নবিদ্ধ করে।  বারাক ওবামা তার পররাষ্ট্রনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিয়োটো প্রটোকলের স্বাক্ষরের বিষয়ে কোন ইঙ্গিত প্রদান করেননি।  ওবামা পারমানবিক অস্ত্র মুক্ত বিশ্ব গঠনের কথা বললেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সিটিবিটি ও এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর সংক্রান্ত বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেননি।

মূল্যায়নঃ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা, সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠন গুলোর তৎপরতা, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক কর্মসূচী প্রভৃতি সমস্যা অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতা গ্রহণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় একক পরাশক্তি সম্পন্ন রাষ্ট্র হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব তাৎপর্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অত্যধিক। বিশেষত বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর তার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের যে ঘোষণা দেন, তা আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মূলত ওবামার পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গঠন, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক সংকট মোকাবেলায় আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ, ইরাক যুদ্ধের দায়িত্বশীল সমাপ্তির ঘোষণা, আফগানিস্তানে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে মূলোৎপাটন মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন নীতি, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান, কিউবা ও ভেনিজুয়েলার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও স্বাভাবিকীকরণ প্রভৃতি পদক্ষেপ শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে নিশ্চিত করবে না বরং ৯/১১ পরবর্তী সময়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ কর্তৃক গৃহীত নীতির কারণে সমগ্র বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি যে নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়, তা প্রশমিত করতে সক্ষম হবে। তবে ওবামার পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে ওবামা সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের নীতিকে অনেক ক্ষেত্রে অনুসরণ করছেন। ওবামা প্রেসিডেন্ট বুশের নীতিকে অনুসরণ করে আফগানিস্তানে নিযুক্ত ন্যাটো বাহিনীতে মার্কিন সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যদিও আফগানিস্তানে ক্রমাগতভাবে মার্কিন সেনাদের মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধিসহ এ অঞ্চলের সন্ত্রাসী তৎপরতা পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওবামা এ সকল সমস্যা সমাধানে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি। ওবামা প্রশাসন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রপথিকের ভূমিকা পালনের ঘোষণা দিলেও মায়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও স্বাভাবিকরণ গণতন্ত্র প্রসারের নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ ও পারমানবিক অস্ত্র মুক্ত বিশ্ব গঠনের ঘোষণা প্রদান করলেও ওবামা এ ব্যাপারে তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ ওবামা প্রশাসন পরিবেশ সংক্রান্ত কিয়াটো প্রটোকল ও পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত সিটিবিটি ও এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তার পররাষ্ট্রনীতিতে যে পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেছেন তা সত্যি প্রশংসার দাবিদার। আর ওবামার এ পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতিতে বাস্তবায়নে উৎসাহিত করার জন্য ৯ অক্টোবর ২০০৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। যদি বারাক ওবামা সকল ধরনের আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক চাপ ও বিরোধীতার শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে তাঁর পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহকে সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন, তাহলে তা নিঃসন্দেহে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের সাথে মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্রের সুদৃঢ় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়। পরিশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বিশ্বের একক পরাশক্তি সম্পন্ন রাষ্ট্র। বর্তমান একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় একক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ২০০১-০৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বুশের শাসনামলে ৯/১১ হামলা, ইরাক-আফগান যুদ্ধ, Pre emptive Attack নীতি, জঙ্গীবাদের উত্থান এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দা প্রভৃতি কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র বিশ্বে যে সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, এমন অবস্থায় ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের অঙ্গীকার ব্যক্তসহ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে সকল ধরনের সংকট মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন। ওবামা প্রশাসন পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ওবামা প্রশসান আন্তর্জাতিক সংকটসমূহ মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত তেমন কোন সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও অদূর ভবিষ্যতে গৃহীত নীতিসমূহকে সঠিকভাবে প্রয়োগ ও কার্যকর করার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থসহ আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। কারণ ওবামা প্রশাসনের ক্ষমতা গ্রহণের মেয়াদ মাত্র ৯ মাস হলেও এ অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ বিশেষত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নকারী রাষ্ট্রসমূহও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং এ লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একযোগে কাজ করতে একমত পোষণ করেছে। তাই বলা যায় যে, ওবামা প্রশাসনের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসকল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে যদি তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, তাহলে তা অবশ্যই একটি শান্তিময় ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ বিশ্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।

এ, কে, এম কামরুল হাসান মিয়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়