ব্যবহারকারী:Mehediabedin/খেলাঘর/১

ইতিহাস

২০০৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে ঢাকায় একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা নির্মাণ করার জন্য সুপারিশ করে। একই বছরে মার্কিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লুই বার্জার গ্রুপ ঢাকার জন্য একটি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রস্তুত করে। বিশ্ব ব্যাংক এই খসড়া পরিকল্পনা সাজাতে সাহায্য করলেও প্রথমে কোন দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থার সুপারিশ ছিলনা। নির্মাণ প্রকৌশলী ও জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এই পরিকল্পনা পর্যালোচনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বে পর্যালোচনা দল পরিকল্পনায় দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে। গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার তিন বছর পরে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) মেট্রোরেল প্রকল্পে যোগ দেয়। শহুরে পরিবহন গঠন গবেষণায় জাইকা প্রস্তাবিত রেলপথগুলোর মধ্যে এমআরটি লাইন ৬-কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করেছিলো। ২০১০–২০১১ অর্থবছরে এই লাইন নির্মাণের জন্য একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। ২০১১ সালে লাইন ৬-এর জন্য একটি খসড়া যাত্রাপথের মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়। মানচিত্র অনুযায়ী রেলপথটি উত্তরা থেকে সায়দাবাদ পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিলো। পরবর্তীতে যাত্রাপথ মানচিত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বরে এমআরটি লাইন ৬ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং পরবর্তী বছরে জাইকা নির্মাণ প্রকল্পের জন্য একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করে ও এর পরিচালক সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে প্রকল্প কর্মকর্তাগণ রেলপথের স্টেশনের নকশা প্রস্তুত করে ফেলে। একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার দুই বছর পর এর ধারণাগত নকশা তৈরি করা হয়। ২০১৫ সালে চূড়ান্তকৃত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় সাভার উপজেলা হয়ে বাইপাইলে এমআরটি সম্প্রসারণ প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কিন্তু একই সাথে এমআরটি লাইন ৫-এর নর্দান রুট একই জায়গায় সম্প্রসারিত হওয়ার পরিকল্পনা থাকায় পরের বছর এসটিপি সংশোধন করে এর সম্প্রসারণের শেষ বিন্দু বাইপাইলের বদলে আশুলিয়া করা হয়েছিলো। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এমআরটি লাইন ১-এর যাত্রাপথ গাজীপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু একই পথে ঢাকা বিআরটি নির্মাণাধীন থাকায় তা বাদ দেওয়া হয়েছিলো। এর বিকল্প হিসেবে ডিএমটিসিএল এমআরটি লাইন ৬ উত্তরে গাজীপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা করে। ২০১৬ সালে সংশোধিত এসটিপির চূড়ান্ত সংস্করণে ঢাকায় মোট পাঁচটি দ্রুতগামী গণপরিবহন লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। সেগুলো হলো এমআরটি লাইন ১, এমআরটি লাইন ২, এমআরটি লাইন ৪, এমআরটি লাইন ৫ ও এমআরটি লাইন ৬। লাইনটি নির্মাণের আগে ভৌগলিক সমস্যা ও যাত্রাপথে অসম্মতি পাওয়া যায়। কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টায় সেসব বাধা দূর হয়।

২০১৬ সালের ২৬ জুনে এমআরটি লাইন ৬-এর নির্মাণ প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। রেলপথ নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবানের সময় গুলশান হামলার ঘটনা ঘটার ফলে প্রকল্প স্থিমিত হয়ে যায় আক্রমণের ছয় মাস পরে নির্মাণকাজ আবার শুরু হয়। লাইন ৬-এর পূর্ণাঙ্গ একটি নকশা ২০১৬ সালের আগস্টে প্রস্তুত করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে দিয়াবাড়িতে রেলপথের ডিপোর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে এমআরটি লাইন ২ ও ৪ নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৭ সালের ২ আগস্টে এমআরটি লাইন ৬-এর প্রথম পর্যায়ের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হয়।

২০১৮ সালের ৭ আগস্টে সরকার নর্দার্ন রুট প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করে। ২০১৮ সালের আগস্টে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। এমআরটি লাইন ৬-এর নির্মাণ শেষ করার প্রাথমিক তারিখ নির্ধারণ হয়েছিলো ২০২৪ সাল। কিন্তু শেখ হাসিনা এর প্রথম পর্যায় ২০১৯ ও দ্বিতীয় পর্যায় ২০২০ সালের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে সরকার কর্তৃক মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত এমআরটি লাইন ৬-এর রেলপথ সম্প্রসারণ প্রকল্প পরিকল্পনা করা হয়। একই বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকার এমআরটি লাইন ১ নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। কমলাপুর পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণে এর দৈর্ঘ্য সব মিলিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ২১ কিলোমিটার। সম্প্রসারণের ফলে এমআরটি লাইন ৬-এর নির্মাণ সমাপ্তির তারিখ হয় ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। ১ অক্টোবর ২০১৯ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জকে ঢাকা মেট্রো নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করার জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে একটি লিখিত অনুরোধ জমা দেন। ফলস্বরূপ, ২৪ নভেম্বর ২০১৯ সালে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সভায় এমআরটি লাইন ২-এর যাত্রাপথ সংশোধন করে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার চট্টগ্রাম রোড এলাকা পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সম্পূর্ণ মেট্রো রেলপথ ২০২১ সালে চালু করার পরিকল্পনা করেছিলো। ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাথে সাউদার্ন রুটের প্রাক-নির্মাণ কাজের জন্য একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে নর্দার্ন রুট প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দ্বারা অনুমোদিত হয়।

২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মহামারী চলাকালে সরকার কর্তৃক আরোপিত লকডাউন কয়েক মাসের জন্য নির্মাণকাজ থামিয়ে দেয়। তবে সংক্রমণ ঠেকাতে কিছু নিয়ম জারি করা সাপেক্ষে সরকার নির্মাণকাজ চালানোর অনুমতি দিলে কাজ আবার শুরু করা হয়।

নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় চালু করার তারিখ পরের বছরের ১৬ই ডিসেম্বরে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে রেলপথের প্রথম পর্যায়ের সব স্প্যান বসানো সম্পূর্ণ হয়। ২০২১ সালের ২৯ আগস্টে নির্মাণাধীন রেলপথের উপর পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। যাত্রাপথের সবগুলো ভায়াডাক্ট ২৭ জানুয়ারি ২০২২ সালে সম্পন্ন হয়। সাউদার্ন রুটের যাত্রাপথে গণভবনের নিকটস্থ কলেজ গেট ও আসাদ গেটে দুটি স্টেশনের অবস্থান নির্ধারণ করার ফলে সৃষ্ট জটিলতা সমাধানের জন্য একটি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমএএন সিদ্দিকী রেলপথটি টঙ্গী পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার আগ্রহ দেখান। বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীসেবা বাড়ানোর জন্য চলমান ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প ও ঢাকা–যশোর রেলপথ নির্মাণের কারণে নির্ধারিত পথে এমআরটি লাইন ৪ নির্মিত হলে মেট্রো সেবা লাভজনক করার মতো সেখানে যাত্রী পাওয়া যাবেনা আশঙ্কা করে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) যাত্রাপথ সংশোধন করে নারায়ণগঞ্জ থেকে মদনপুরে এর গন্তব্য পরিবর্তন করে। ডিপোর নির্মাণকাজ ২০২২ সালের জুনে সম্পন্ন হয়। ২০২২ সালের ১৫ জুন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক এমআরটি লাইন ১-এর লাইসেন্স ডিএমটিসিএলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ সাল থেকে কর্তৃপক্ষ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সমন্বিত পরীক্ষামূলক চলাচল পরিচালনা শুরু করে। উত্তরা–আগারগাঁও অংশে মোট ৪টি পরীক্ষামূলক ট্রেন পরিবহন পরিচালনা করা হয়। সমীক্ষা অনুযায়ী যদি পিপিপিতে নির্মাণ করা হয় তাহলে সরকারকে বাজেটের ৮৫% বহন করতে বলে সরকার লাইন ২-কে পিপিপি থেকে বাদ দেয় ও নির্মাণের জন্য দাতা সংস্থার সন্ধান করতে থাকে। অন্যদিকে৷ এর প্রস্তাবিত যাত্রাপথে আরেকটি রেলওয়ে প্রকল্প চলমান থাকায় ডিএমটিসিএল অক্টোবরে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নারায়ণগঞ্জকে মেট্রো নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করার জন্য যাত্রাপথ পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করে। নর্দার্ন রুটের প্রস্তাবিত যাত্রাপথটি ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের উপর দিয়ে যাবে বলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (আরএইচডি) ও মেট্রো কর্তৃপক্ষের মধ্যে ২০২২ সালের আগস্টে বিবাদের সৃষ্টি হয়। ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ সালে বাংলাদেশের এই প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত অংশটি শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। ডিএমটিসিএল দুটি পর্যায় ২০২৩ সালের মধ্যে চালু করার কথা ভাবে। এরপরের দিন জনসাধারণের জন্য প্রথম পর্যায়ের প্রথম ও শেষ স্টেশনের মধ্যে বিরতিহীনভাবে মেট্রো সেবা চালু হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে স্টেশন প্লাজার পশ্চিমে সম্প্রসারণ কাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমআরটি লাইন ১-এর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে আরো কিছু স্টেশন খুলে দেওয়া হয়। ৩১ মার্চ ২০২৩ সাল থেকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের নয়টি স্টেশনই ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে উচ্চ ব্যয়ের কারণে সরকার এমআরটি লাইন ৪ নির্মাণের উদ্দেশ্যে করা জাপানের সাথে চুক্তি থেকে সরে আসে। সরকার এমআরটি লাইন ২ ৪-এর তহবিলের দাতা খুঁজে বের করার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী নিশ্চিত করেন যে মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের সম্প্রসারণের কাজ শেষ হওয়ার পরে উত্তরা উত্তর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ কাজ শুরু হবে। ইআরডি বিশ্বব্যাংক, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে সম্ভাব্য দাতা হিসেবে খুঁজে পায়। ২০২৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিকী লাইন ৬-এর উত্তর-পশ্চিমে আশুলিয়া ও বাইপাইল হয়ে নবীনগর পর্যন্ত এর আরেকটি অংশ নির্মাণ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ২৩ মে ২০২৩ সালে দুই পক্ষের বৈঠকের পর নর্দার্ন রুটের সমস্যা দূর হয়। ৭ জুলাই ২০২৩ সালে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে প্রথম পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী ৯ আগস্ট ২০২৩ সালে জানান যে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ হবে।