বিষুবীয় গিনির ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

নিরক্ষীয় গিনির ইতিহাস হলো মূলত ব্রিটিশ, স্পেনীয় পর্তুগিজ ও স্থানীয় গোত্রপ্রধানদের শাসনের ইতিবৃত্ত।

প্রাক-ঔপনিবেশিক ইতিহাস[সম্পাদনা]

ধারণা করা হয়, পিগমিরা নিরক্ষীয় গিনির আদি বাসিন্দা ছিল। তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ এখনো রিও মুনি এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছে। সপ্তদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে চলা বান্টু অভিবাসনের ফলে অনেক উপকূলনিবাসী জাতিসত্তা এখানে আগমন করে। পরবর্তীতে ফ্যাং জাতির মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করে। ক্যামেরুন থেকে নিরক্ষীয় গিনির বাকুয়াগান অঞ্চলে অভিবাসী বুবি জাতি হতে ফ্যাংদের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। পরবর্তীতে নাইজেরিয়ার ইগবো জাতিসত্তার মানুষ এখানে আগমন করে। অ্যাঙ্গোলা হতে পর্তুগিজরা এখানে অ্যানোবন জাতির মানুষদের নিয়ে আসে।

উপনিবেশিক যুগ[সম্পাদনা]

১৪৭২ সালে প্রথম ইউরোপীয় অভিযাত্রী হিসেবে ফার্নান্দো দো পো ভারতের অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিয়োকো দ্বীপে এসে পৌঁছান। তিনি একে ফরমোজা, বা সুন্দর নামকরণ করেন। কিন্তু দ্বীপটির নাম দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে আবিষ্কারকের নামে "ফার্নান্দো পো" হয়। ১৪৭৪ সালে পর্তুগিজরা বিয়োকো ও আনোবন দ্বীপ স্বীয় উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত করে।

১৭৭৮ সালে পর্তুগিজ রানি প্রথম মারিয়া ও স্পেনীয় রাজা তৃতীয় চার্লস এল পার্দো চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং পর্তুগাল চুক্তি অনুযায়ী স্পেনের নিকট বিয়োকো ও এর সংলগ্ন দ্বীপগুলো হস্তান্তর করে। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত দাসব্যবস্থার উপর কর্তৃত্ব সৃষ্টিতে স্পেনীয়রা উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ১৭৭৮ থেকে ১৮১০ পর্যন্ত বুয়েনেস এইরেসে অবস্থিত রিও ডি লা প্লাটার ভাইসরয়ের কার্যালয় হতে নিরক্ষীয় গিনির যাবতীয় কার্যাবলি পরিচালিত হয়।

১৮২৭ থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত দাসব্যবসা মোকাবিলার লক্ষ্যে বিয়োকো দ্বীপে একটি সামরিক ঘাঁটি ছিল, যা ব্রিটেন স্পেনের সাথে চুক্তি করে সিয়েরা লিওনে স্থানান্তর করে। ১৮৪৪ সালে স্পেনীয় সার্বভৌমত্ব পুনঃসংরক্ষিত হবার পর এটির নামকরণ হয়, "তেরিতোরিয়স এসপানোলেস দেল গলফো দি গিনি"। স্পেনীয়রা বায়াফ্রায় বিশাল ভূমি অধিগ্রহণের সুযোগ থাকলেও তারা এ বিষয়ে বেশি গা করেনি। যার ফলে ফ্রেঞ্চরা এর সুযোগ নিতে শুরু করে। ১৯০০ সালের প্যারিস চুক্তির ফলে উবাঙ্গী নদীর পূর্বদিকের ৩,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে স্পেনীয়দের ২৬,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রিও মুনি অঞ্চল নিয়েই তাদের তুষ্ট থাকতে হয়। [১]

স্পেনীয় ঔপনিবেশিক ভূখণ্ড[সম্পাদনা]

বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কালো ক্রিওল অভিজাতদের হাতে ফার্নান্দো পোর কৃষিকাজের নিয়ন্ত্রণ ছিল। এদের ফার্নান্দিনহো বলা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ব্রিটিশরা ২,০০০ সিয়েরা লিওনীয় ও মুক্ত দাসদের এখানে বসতি স্থাপনে সাহায্য করেছিল। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরেও পশ্চিম আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে প্রচুর মানুষ এখানে অভিবাসী হয়। রাজনৈতিক সহ বিভিন্ন অপরাধে দণ্ডিত ফিলিপিনো, কিউবান ও স্পেনীয়দের এখানে নির্বাসন দেওয়া হয়। আবার, পর্তুগিজ উপনিবেশ থেকেও এখানে প্রচুর মানুষ এসে বসতি স্থাপন করে। কোনো কোনো ফার্নান্দিনহো স্পেনীয়-ভাষী ও ক্যাথলিক হলেও তাদের অধিকাংশ ছিল প্রটেস্টান্ট ও ইংরেজিভাষী।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে স্পেনের নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে জার্মান ক্যামেরুন পলায়নকারী অনেক সৈন্য এখানে আশ্রয় নেয়। ক্যামেরুনীয়রা রিও মুনি ও জার্মানরা ফার্নান্দো পো দ্বীপে অবস্থান করে।

ফার্নান্দিনহোদের প্রভাব ক্রমশ খর্ব হতে শুরু করে। ১৯০৪-০৫ সালে প্রবর্তিত নতুন ভূমি সংস্কারের ফলে স্পেনীয় অভিবাসীরা অধিক প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ১৯১৪ সালের লাইবেরীয় শ্রম চুক্তির ফলে স্পেনীয়রা রিও মুনি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে শ্রমশক্তি ব্যবহারে সক্ষম হয়।১৯৪০ সালের দিকে হিসাব করে দেখা যায়, দ্বীপটির কোকো উৎপাদনের মাত্র ২০ শতাংশ আফ্রিকানদের হাতে ছিল।

শ্রমশক্তির অভাব সবসময়ই দ্বীপটির একটি বিরাট সমস্যা ছিল। বিয়োকো দ্বীপের আদি বাসিন্দা বুবি উপজাতির মানুষ মদ্যপান, গুটিবসন্ত সহ নানা রকম সমস্যায় আক্রান্ত ছিল। তারা কিছুটা স্বনির্ভর হওয়ায় স্পেনীয় ভূমিতে তারা কাজ করতে চাইত না। স্পেনীয় যাজকরাও নিশ্চিত করেছিলেন, যাতে তাদের কোনো কাজে জোর না করা হয়। কিন্তু ১৮৯৮ থেকে ১৯১০ এর মধ্যে তাদের জোর করে কাজে লাগানো হতে থাকে। বুবিরা এর প্রতিবাদ করলে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হয়।


অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে পর্তুগিজ, স্পেনীয় ও ব্রিটিশরা কাকাও বা কোকোয়া চাষের হার বাড়িয়ে দেয়। বুবি জনগোষ্ঠী নানা কারণে ক্ষীয়মাণ হতে থাকায় বিদেশ থেকে এখানে শ্রমিক আমদানি করা হয়। ১৯১৪ সালের লাইবেরীয় চুক্তির মাধ্যমে এখানে ৫,০০০ শ্রমিক আনা হয়। ১৯৩০ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-র উদ্যোগের ফলে লাইবেরীয় শ্রম আমদানি ও তাদের নিষ্পেষণ বন্ধ হয়ে যায়। [২]

১৯২৬ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রিও মুনি ও বিয়োকো একত্রে "স্প্যানিশ গিনি"নামে পরিচিত ছিল। লাইবেরিয়া, ক্যামেরুন ও নাইজেরিয়া থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকদের কাকাও এবং কফি চাষে নিয়োজন করা হত। [৩]ফ্যাং জনগোষ্ঠীকে দমন করার জন্য বিশের দশকে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হয়, যা ১৯২৯ সালের মধ্যেই সমাপ্ত হয়ে যায়।

স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ[সম্পাদনা]

১৯৩৬-১৯৩৯ সালব্যাপী সংঘটিত স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের সময় উপনিবেশটি প্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ১৯৩৬ সালের ২৪শে জুলাই প্রজাতন্ত্রী সরকারের জাহাজ "মেন্দেজ নুনেস" দ্বীপে এসে পৌঁছায়। কিছুদিন পর এটি আবার স্পেনে প্রত্যাবর্তনের সময় প্রজাতন্ত্রী সরকার তাদের মাঝপথে নিরক্ষীয় গিনিতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়, কারণ সরকার জানতে পারে জাহাজের কর্মকর্তারা সরকারবিরোধী বিদ্রোহে অংশ নেবার পরিকল্পনা করছিলেন। দ্বীপে পৌঁছা মাত্রই নাবিকরা ফার্নান্দো পোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বাকি অংশের অধিবাসীরা প্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখে।

উপনিবেশবাদের অবসান[সম্পাদনা]

তিন ধাপে নিরক্ষীয় গিনিতে উপনিবেশবাদের অবসান ঘটে:

  1. ১৯৫৯ সালে প্রদেশের স্বীকৃতি প্রদান
  2. ১৯৬০ থেকে ১৯৬৮ সালব্যাপী চলা "আংশিক অনুপবেশায়ন"(ঔপনিবেশিক শাসনের আংশিক শিথিলকরণ)
  3. ১৯৬৮ সালে স্বাধীনতা অর্জন

১৯৫৯ সালে প্রথম স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নিরক্ষীয় গিনি স্পেনীয় আইনসভায় (কর্তেস জেনারেলেস) প্রতিনিধি প্রেরণ করে। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে প্রণীত মৌলিক আইন প্রদেশটিকে আংশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। ১৯৬৫ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে আইনটি অনুমোদন পায়। স্বাধীনতাবাদী আবেগ ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে; জাতিসংঘ-ও স্পেনকে উপনিবেশবাদী কর্তৃত্ব পরিত্যাগের জন্য চাপ দেয়। অবশেষে স্পেন নতি স্বীকার করে এবং ১৯৬৮ সালের ১২ই অক্টোবর দেশটি স্বাধীন হয়। ফ্রান্সিয়াস ওবিয়াং এনগুয়েমা এমবাসোগো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

স্বাধীন নিরক্ষীয় গিনি[সম্পাদনা]

স্বাধীনতার পরে নিরক্ষীয় গিনির মাথাপিছু আয় আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ ছিল। কিন্তু অধিকাংশ অর্থই গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে পুঞ্জীভূত হয়।স্পেনীয় ঔপনিবেশিক সরকার এখানে একটি উন্নত স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার সময় এখানে হাতেগোনা আফ্রিকান আইনজীবী ও চিকিৎসক ছিলেন।

১৯৭০ সালে মাসিয়াস একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। ১৯৭১ সালে সংবিধানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ ছাঁটাই করা হয়। ১৯৭২ সালে মাসিয়াস নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। তাঁর শাসনামল স্বৈরাচার, সর্বাত্মকবাদ ও কর্তৃত্বপরায়ণতার জন্য কুখ্যাত ছিল। নিরক্ষীয় গিনির এক-তৃতীয়াংশ মানুষ তাঁর শাসনামলে হয় মারা গিয়েছিল, অথবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। অর্থনীতি ও প্রশাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় ও দক্ষ কর্মীরা নিরক্ষীয় গিনি ছেড়ে চলে যায়।

১৯৭৫ সালে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ১৯৭৮ সালে সব চার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৯৭৯ এর আগস্টে ফ্রান্সিয়াস এর ভাইপো তিওডোরো ওবিয়াং এনগুয়েমা এমবাসোগো তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ১৯৭৯ এর অক্টোবরে ওবিয়াং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ফ্রান্সিয়াস স্বৈরতন্ত্রের পতনের সময় রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্যের কোঠায় পৌঁছে; দেশের জনসংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়।

১৯৯০-২০০০[সম্পাদনা]

রাষ্ট্রপতি তিওডোরো ২০০৬ সালে নির্যাতনবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর করেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালহিউম্যান রাইটস ওয়াচ মন্তব্য করে, ফ্রান্সিয়াস আমলের স্বৈরশাসন হতে উত্তরণে সরকারকে আরো সচেষ্ট হতে হবে।

১৯৯৭ সালে তেল উৎপাদন শুরুর পর নিরক্ষীয় গিনি অধিকতর সমৃদ্ধি লাভ করে। তিওডোরোর ছেলে তিওডোরিন এবং এমবাসোগো পরিবারের অন্যান্য সদস্য রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন।

২০০৪ সালে ওবিয়াংকে প্রতিস্থাপিত করে একজন পুতুল শাসককে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে "ওয়োঙ্গা" অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। কিন্তু শীঘ্রই এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

২০১১ সালে সরকার ওয়ালা শহরে রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করে।[৪]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]