একাত্তরের যীশু

একাত্তরের যীশুঃ Jesus '71
চিত্র:Jesus '71.jpg ভিসিডি কভার
পরিচালক	নাসির উদ্দিন ইউসুফ
প্রযোজক	অনুপম চিত্রয়ন ট্রাষ্ট
রচয়িতা	শাহরিয়ার কবির (উপন্যাস)
শ্রেষ্ঠাংশে	পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় হুমায়ুন ফরীদি জহির উদ্দিন পিয়াল আবুল খায়ের আনওয়ার ফারুক কামাল বায়েজীদ ইব্রাহিম বিদ্যৎ শতদল বড়ুয়া বিলু সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল ফারুক আহমেদ শহীদুজ্জামান সেলিম ইউসুফ খসরু দেলোয়ার হোসেন
সুরকার	শিমুল ইউসুফ
চিত্রগ্রাহক	বেবী ইসলাম
সম্পাদক	নজরুল ইসলাম
পরিবেশক	অনুপম চিত্রয়ন ট্রাষ্ট
মুক্তি	১৯৯৩
স্থিতিকাল	১০০ মিনিট
দেশ	বাংলাদেশ
ভাষা	বাংলা

একাত্তরের যীশু ১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ভিত্তিক একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র । লেখক শাহরিয়ার কবির এর লেখা একাত্তরের যীশু (উপন্যাস) অবলম্বনে ছবিটি পরিচালনা করেছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। ছবির প্রধান প্রধান চরিত্র গুলোতে অভিনয় করেছেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন ফরীদি, জহির উদ্দিন পিয়াল, আবুল খায়ের, আনওয়ার ফারুক, কামাল বায়েজীদ ও শহীদুজ্জামান সেলিম। এছাড়াও বিভিন্ন চরিত্র অভিনয় করেছেন ইব্রাহিম বিদ্যৎ, শতদল বড়ুয়া বিলু, সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল, ফারুক আহমেদ, ইউসুফ খসরু, দেলোয়ার হোসেনসহ আরও অনেকে।

কাহিনী সংক্ষেপ

১৯৭১ সালের কথা তো তোমরা জানোই। সে বছর পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের এক ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিলো। দীর্ঘ ৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল সেই যুদ্ধ। আর সেই মুক্তিযুদ্ধে কিন্তু জয় হয়েছিলো আমাদেরই। সেই যুদ্ধেরই একটি কাহিনী নিয়ে এই ছবিটি বানানো হয়েছে। গল্পটি এক জেলেপাড়া নিয়ে। তখনো যুদ্ধ গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েনি। জেলেপাড়ার জেলেরা মাছ ধরে, তারপর হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। সে গ্রামে একটা চার্চও ছিলো। গ্রামের বেশিরভাগ জেলেই ছিলো খ্রিস্টান। প্রতি রবিবার চার্চের কেয়ারটেকার ডেসমন্ড সকালে গির্জার ঘণ্টা বাজাতেন। আর তারপর গ্রামের সব মানুষ আসতেন সেই গির্জায়। ফাদার তাদেরকে বাইবেল থেকে যীশুর গল্প শোনাতেন। সবকিছুই চলছিলো ঠিকঠাক। কিন্তু একদিন ওদের গ্রামেও যুদ্ধ এসে পড়লো। সেদিন জেলেরা হাটে গিয়ে বসে বসে মাছি মারছিলো; কেউই আর মাছ কিনতে আসে না। হঠাৎ ওরা শোনে কারা যেনো ‘জয় বাংলা’ বলে শ্লোগান দিচ্ছে। আর তারপরই গুলির শব্দ। পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে। জেলেরা যে যেদিকে পারলো পালাতে লাগলো। কিন্তু সবাই পালাতে পারলো না। ওদেরই একজন, হরিপদ পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে মারা গেলো।

শহরে তো যুদ্ধ তখন চলছেই। দলে দলে লোক শহর ছেড়ে পালিয়ে আসতে শুরু করেছে। ওরা সবাই যাচ্ছে ভারতে, যেখানে পাকবাহিনী নেই। ওদের হাতে মরার ভয় নেই। কেউ যাচ্ছে শুধুই আশ্রয়ের জন্য, আর কেউ ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে শত্রুকে ঘায়েল করবে- এজন্য। জেলেপাড়ার লোকগুলো দেখলো, দলে দলে মানুষ, কেবল হাঁটছে আর হাঁটছেই। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই। রাতে শোওয়ার জায়গা নেই। অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেই। লোকগুলো কেবলই হাঁটছে। কেউ মরে গেলে রাস্তার পাশে পড়ে থাকছে। যারা অসুস্থ তারাও হাঁটছে। জেলেপাড়ার মাস্টার সেখানকার সব লোককে জড়ো করলো। আর তারপর শুরু করলো এই শহর ছেড়ে আসা মানুষগুলোর সেবা। রাতারাতি তাদের জন্য তৈরি করলো কতোগুলো তাঁবু। গ্রামের সবার কাছ থেকে চাদর আর মাদুর নিয়ে সেখানে রাতে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। বাড়ি বাড়ি থেকে চাল-ডাল নিয়ে সবার জন্য খিচুড়ি রান্না করা হলো। কিন্তু চিকিৎসার কি করা যাবে? জেলেপাড়ার লোকদের কাছে তো আর কোনো ওষুধ নাই। ওরা তো কোনো চিকিৎসা জানে না। গ্রামের স্কুলের মাস্টার গির্জার ফাদারকে বললেন, গির্জায় রাখা ওষুধ দিতে। আরো বললেন, সিস্টাররা যেনো অসুস্থ মানুষগুলোর চিকিৎসার ভার নেয়। এতে আবার ফাদার পড়লেন আরেক চিন্তায়। গির্জাকে তিনি এই যুদ্ধের মধ্যে জড়াবেন? কিন্তু এতো মানুষের কষ্ট কী আর চোখে দেখে সহ্য করা যায়? ফাদার সিস্টারদের অনুমতি দিলেন সবার চিকিৎসার ভার নেওয়ার জন্য। রাতভর মাস্টার, তার ছাত্ররা, বুড়ো ডেসমন্ড আর সিস্টাররা মিলে শহর ছেড়ে পালিয়ে আসা লোকদের সেবা করলো, খাওয়ালো, চিকিৎসা করলো।

পরদিন সকালে সব লোক আবার ভারতের পথে যাত্রা শুরু করলো। তাঁবুগুলো আবার ফাঁকা হয়ে গেলো। কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে বুড়ো ডেসমন্ড দেখে কি, ওমা! একটা ফুটফুটে মেয়ে যে রয়ে গেছে! একটা গাছের গোড়ায় বসে ডাগর দুটো চোখ তুলে ভীরু চোখে চেয়ে আছে ডেসমন্ডের দিকে। ডেসমন্ড ওর কাছে নাম জানতে চাইলো, গ্রামের নাম জানতে চাইলো। মেয়েটা কিন্তু কিছুই বলে না। পরে ডেসমন্ড বুঝতে পারলো, মেয়েটা বলবে কি করে, ও তো বোবা! ডেসমন্ড এবার মেয়েটার পিছনে সময় দিতে লাগলো। ওকে গল্প শোনায়- যীশুর গল্প। পাতার বাঁশি বানিয়ে দেয়, বাজিয়ে শোনায়। মেয়েটা কিন্তু একসময় সেই বাঁশি বাজানোও শিখে ফেললো!

আরেকদিন গ্রামে খবর এলো, হাটে পাকবাহিনী এসেছে। তারা হাট জ্বালিয়ে দিয়েছে। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে। আরেক গ্রামের গির্জার ফাদারকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। শিশু-বৃদ্ধ, জোয়ান-বুড়ো, ফাদার-জেলে, কাউকে ওরা ছাড়ছে না, সবাইকে মারছে। গ্রামের সব লোক ভয়ে পালাতে লাগলো। গির্জা ছেড়ে পালিয়ে গেলেন স্বয়ং ফাদারও। কেবল থেকে গেলেন বুড়ো ডেসমন্ড আর ঐ ফুটফুটে মেয়েটা। ওদিকে এই জেলেপাড়াতেও পাকবাহিনী এসে পড়লো। ডেসমন্ড মেয়েটাকে বললেন ঘর থেকে না বের হতে। আর নিজে দেখতে গেলেন বাইরের অবস্থা। ওদিকে পাকবাহিনী এসে তো সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে করে মারতে লাগলো। ডেসমন্ড গ্রামে ফিরে দেখেন, পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে আর কিছু বাদ রাখেনি পাক হায়েনারা। যতো বাড়ি ছিলো, সব জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। যতো মানুষ ছিলো সবাইকে মেরে রেখে গেছে। কেউ বেঁচে নেই। মেয়েদেরও ওরা মেরে ফেলেছে। আর সে সব লাশেরই মাঝে পড়ে রয়েছে সেই ফুটফুটে বোবা মেয়েটার লাশ। ডেসমন্ড মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ওকে কবর দিয়ে ছোট্ট ক্রুশ পুঁতে দিলেন ওর মাথার কাছে। এবার পৃথিবীতে একেবারেই একা হয়ে গেলেন ডেসমন্ড।

ওদিকে মাস্টার তো অনেক আগেই যুদ্ধে চলে গেছেন। তাঁর বাহিনীর কয়েকটা ছোটো দলের থাকার জায়গা দরকার। মাস্টার ওদের একটা দলকে পাঠিয়ে দিলেন ডেসমন্ড কাকার কাছে। আর ডেসমন্ড কাকাও অনেক আগেই বুঝে গেছেন, এ যুদ্ধ আমাদের সবারই যুদ্ধ। এ যুদ্ধ কোনো রাজনৈতিক যুদ্ধ নয়, এ যুদ্ধ আমাদের জীবনের যুদ্ধ। আমাদের সবাইকেই এখন কিছু না কিছু করতে হবে। ডেসমন্ড কাকাও ওদেরকে আশ্রয় দিলেন। ডেসমন্ড কাকা তখনো সেই গির্জার পাশে তার ছোট্ট ঘরে থাকেন। সেখানে ওদেরকেও থাকতে দিলেন। ওদের খাওয়ালেন, ওদের যত্ন নিলেন। আর ওরা এখান থেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগলো।

কিছুদিন পরে একটা ছোটোখাটো অপারেশনে বের হলো ওরা। একটা পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করতে হবে। খুব একটা বড়ো নয় ক্যাম্পটা। ওদের দলটাই যথেষ্ট অপারেশনটা করতে। ডেসমন্ড কাকার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে ওরা বের হয়ে গেলো। আর তারপর খুব যুদ্ধ করে হারিয়ে দিলো ক্যাম্পে থাকা পাক আর্মিদের। ওদের সবাইকেই যুদ্ধে মেরে ফেললো ওরা। কিন্তু ওদের যুদ্ধ তো শুরু হলো মাত্র।

এবার করা হবে একটা বড়ো অপারেশন। আশেপাশে পাকিস্তানিদের সবচেয়ে বড়ো ক্যাম্প কমলগঞ্জে। ওরা এই ক্যাম্পটাই আক্রমণ করবে। পিছন দিক আর একপাশ থেকে আক্রমণ করবে দুইটা-দুইটা চারটা দল। আরেকপাশে থাকবে ওদের দলসহ তিনটা দল। আর সামনে থেকে আক্রমণে নেতৃত্ব দেবে মাস্টারের দলসহ তিনটা দল। মোট ১০টা দল মিলে সাঁড়াশি আক্রমণ করে ওরা দখল করে নেবে কমলগঞ্জের পাকিস্তানি ক্যাম্প। সব প্রস্তুতি নিয়ে ডেসমন্ড কাকার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো। কমলগঞ্জ ক্যাম্পে শুরু হলো যুদ্ধ। সে এক ভীষণ যুদ্ধ! ওখানে পাকিস্তানি বাহিনীর ডেরাও ভীষণ মজবুত, কোনোভাবেই দখল করা যাচ্ছে না।

---কি মনে হয়, পারবে না আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা? আমাদের একাত্তরের যীশুরা? আগেই যেনো ভেবে বসো না, আমরা জিতে গেছি। আমাদের স্বাধীনতা কিন্তু এমনি এমনি আসেনি, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। তাই আগেই ওরা জিতে গেছে না ভেবে শীগগির শীগগির দেখে নাও এই ছবিটা। আর তোমরা তো একাত্তরের যুদ্ধ দেখোনি। তাই সুযোগ পেলেই বেশি বেশি করে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ছবি দেখবে আর বই পড়বে। তবেই বুঝবে, আমাদের স্বাধীনতা কতো দামি, কতো গর্বের!

শ্রেষ্ঠাংশে

• পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় -
• হুমায়ুন ফরীদি -
• জহির উদ্দিন পিয়াল -
• আবুল খায়ের -
• আনওয়ার ফারুক
• কামাল বায়েজীদ -
• ইব্রাহিম বিদ্যৎ -
• শতদল বড়ুয়া বিলু -
• সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল -
• ফারুক আহমেদ -
• শহীদুজ্জামান সেলিম -
• ইউসুফ খসরু -
• দেলোয়ার হোসেন -
• পলাশ -
• লিটন -
• সাজ্জাদ -
• পাবেল -
• সোয়েব -
• বাদল -
• ফ্লোরেন্স শর্মিলী গোমেজ -

সম্মাননা

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

• শ্রেষ্ঠ সংলাপঃ সেলিম আল দীন ১৯৯৩

আর্ন্তজাতিক সম্মননা

• মনোনয়নঃ লন্ডন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৯৪
• মনোনয়নঃ এডিনবার্গ (স্কটল্যান্ড) আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৯৩
• মনোনয়নঃ ব্রিসবেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৯৪

সংগীত

একাত্তরের যীশু ছবির সঙ্গীত পরিচালনা গীত রচনা করেছেন শিমুল ইউসুফ।

বহিঃসংযোগ

• ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে একাত্তরের যীশু (ইংরেজি) - এ
• একাত্তরের যীশু - রোটন টমেটোস