বাংলা ভাষা আন্দোলন: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
[অপরীক্ষিত সংশোধন][অপরীক্ষিত সংশোধন]
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Aliftahzibul (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
Aliftahzibul (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
৪ নং লাইন: ৪ নং লাইন:
'''বাংলা ভাষা আন্দোলন''' ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন [[পূর্ব বাংলা]]য় (বর্তমান [[বাংলাদেশ|বাংলাদেশে]]) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে [[বাংলা ভাষা|বাংলা ভাষাকে]] ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন [[পাকিস্তান অধিরাজ্য|পাকিস্তান অধিরাজ্যের]] অন্যতম [[রাষ্ট্রভাষা]] হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
'''বাংলা ভাষা আন্দোলন''' ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন [[পূর্ব বাংলা]]য় (বর্তমান [[বাংলাদেশ|বাংলাদেশে]]) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে [[বাংলা ভাষা|বাংলা ভাষাকে]] ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন [[পাকিস্তান অধিরাজ্য|পাকিস্তান অধিরাজ্যের]] অন্যতম [[রাষ্ট্রভাষা]] হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।


১৯৪৭ সালে [[দ্বিজাতি তত্ত্ব|দ্বিজাতি তত্ত্বের]] ভিত্তিতে [[ব্রিটিশ ভারত]] [[ভারত বিভাজন|ভাগ]] হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও [[ভারত অধিরাজ্য]] নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দু’টি অংশ: [[পূর্ব বাংলা]] (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত [[পূর্ব পাকিস্তান]]) ও [[পশ্চিম পাকিস্তান]]। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে [[পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল|পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার]] ঘোষণা করে যে, [[উর্দু ভাষা|উর্দুই]] হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।[[পূর্ব বাংলার]] মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানুষের মুখের ভাষা ছিল পাঞ্জাবি৷ পাকিস্তানে পাঁচটি প্রদেশের মানুষের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা ছিল। পাঞ্জাবের মানুষের মাতৃভাষা ছিল পাঞ্জাবী, সিন্ধু প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা ছিল সিন্ধি, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা ছিল পশতু, বেলুচিস্তানের মানুষের মানুষের মাতৃভাষা ছিল বেলুচি, পূর্ব বাংলার মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। উর্দু পাকিস্তানের পাঁচ প্রদেশের কোন প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা ছিল না৷ এমন কি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর মাতৃভাষাও ছিল গুজরাটি, উর্দু নয়। উর্দু মূলত দিল্লীর কাছাকাছি এলাকায় মুঘল আমলে গড়ে উঠা আরবী ফার্সি তুর্কীর মিশ্রনে গড়ে উঠা একটা জগাখিচুড়ি ভাষা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২% উর্দুতে কথা বলত৷ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী চারটি প্রদেশের লোকেরা এই অন্যায় মেনে নিলেও পূর্ব বাংলার মানুষেরা প্রতিবাদ করে উঠে৷ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার সিধান্ত নিয়ে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার প্রতি অন্যায় নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী চারটি টি প্রদেশের প্রতিও অন্যায় করা হয়৷ কারন পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী চারটি টি প্রদেশের মাতৃভাষাও উর্দু ছিল না৷ সেই সময়ে উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যাবহৃত হত আর এই কারনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে মুসলমানদের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা করে এবং এই অজুহাতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর উপুর চাপিয়ে দেয়।
১৯৪৭ সালে [[দ্বিজাতি তত্ত্ব|দ্বিজাতি তত্ত্বের]] ভিত্তিতে [[ব্রিটিশ ভারত]] [[ভারত বিভাজন|ভাগ]] হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও [[ভারত অধিরাজ্য]] নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দু’টি অংশ: [[পূর্ব বাংলা]] (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত [[পূর্ব পাকিস্তান]]) ও [[পশ্চিম পাকিস্তান]]। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে [[পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল|পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার]] ঘোষণা করে যে, [[উর্দু ভাষা|উর্দুই]] হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।[[পূর্ব বাংলার]] মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানুষের মুখের ভাষা ছিল পাঞ্জাবি৷ পাকিস্তানে পাঁচটি প্রদেশের মানুষের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা ছিল। পাঞ্জাবের মানুষের মাতৃভাষা ছিল পাঞ্জাবী, সিন্ধু প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা ছিল সিন্ধি, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা ছিল পশতু, বেলুচিস্তানের মানুষের মানুষের মাতৃভাষা ছিল বেলুচি, পূর্ব বাংলার মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। উর্দু পাকিস্তানের পাঁচ প্রদেশের কোন প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা ছিল না৷ এমন কি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর মাতৃভাষাও ছিল গুজরাটি, উর্দু নয়। উর্দু মূলত দিল্লীর কাছাকাছি এলাকায় মুঘল আমলে গড়ে উঠা আরবী, ফার্সি, তুর্কীর মিশ্রনে গড়ে উঠা একটা জগাখিচুড়ি ভাষা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২% উর্দুতে কথা বলত৷ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী চারটি প্রদেশের লোকেরা এই অন্যায় মেনে নিলেও পূর্ব বাংলার মানুষেরা প্রতিবাদ করে উঠে৷ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার সিধান্ত নিয়ে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার প্রতি অন্যায় নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী চারটি টি প্রদেশের প্রতিও অন্যায় করা হয়৷ কারন পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী চারটি টি প্রদেশের মাতৃভাষাও উর্দু ছিল না৷ সেই সময়ে উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে উর্দু শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যাবহৃত হত আর এই কারনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে মুসলমানদের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা করে এবং এই অজুহাতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর উপুর চাপিয়ে দেয়।


এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ [[১৪৪ ধারা]] জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ [[১৪৪ ধারা]] জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

২২:৪৪, ২৩ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার আদায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আয়োজিত মিছিল

বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দু’টি অংশ: পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।পূর্ব বাংলার মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানুষের মুখের ভাষা ছিল পাঞ্জাবি৷ পাকিস্তানে পাঁচটি প্রদেশের মানুষের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা ছিল। পাঞ্জাবের মানুষের মাতৃভাষা ছিল পাঞ্জাবী, সিন্ধু প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা ছিল সিন্ধি, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা ছিল পশতু, বেলুচিস্তানের মানুষের মানুষের মাতৃভাষা ছিল বেলুচি, পূর্ব বাংলার মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। উর্দু পাকিস্তানের পাঁচ প্রদেশের কোন প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা ছিল না৷ এমন কি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর মাতৃভাষাও ছিল গুজরাটি, উর্দু নয়। উর্দু মূলত দিল্লীর কাছাকাছি এলাকায় মুঘল আমলে গড়ে উঠা আরবী, ফার্সি, তুর্কীর মিশ্রনে গড়ে উঠা একটা জগাখিচুড়ি ভাষা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২% উর্দুতে কথা বলত৷ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী চারটি প্রদেশের লোকেরা এই অন্যায় মেনে নিলেও পূর্ব বাংলার মানুষেরা প্রতিবাদ করে উঠে৷ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার সিধান্ত নিয়ে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার প্রতি অন্যায় নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী চারটি টি প্রদেশের প্রতিও অন্যায় করা হয়৷ কারন পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী চারটি টি প্রদেশের মাতৃভাষাও উর্দু ছিল না৷ সেই সময়ে উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে উর্দু শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যাবহৃত হত আর এই কারনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে মুসলমানদের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা করে এবং এই অজুহাতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর উপুর চাপিয়ে দেয়।

এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক[১], সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকতআব্দুল জব্বারসহ[২][৩] আরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক , পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন।

ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে।[৪] ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়।[৫]

উদযাপন

ভাষা শহীদদের স্মরণে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে স্থাপিত মোদের গরব ভাস্কর্য

১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সারাদিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে। এছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তর্পণ করা হয় এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিনটি কখনো জাতীয় শোক দিবস, কখনোবা জাতীয় শহীদ দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। বাংলাদেশে এদিনে সরকারি ছুটি। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দিবসের তাৎপর্য্য তুলে ধরা হয়। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করে।[২]

পটভূমি

বর্তমানের পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুটি পূর্বে ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দু ভাষাটি কিছু সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতা স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব ওয়াকার-উল-মুলক মৌলভী‎‎ এবং মৌলভী আবদুল হক প্রমুখদের চেষ্টায় ভারতীয় মুসলমানদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় উন্নীত হয়।[৬][৭] উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। এ ভাষাটি আবার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উর্দু ভাষাটি অপভ্রংশের (মধ্যযুগের ইন্দো-আর্য ভাষা পালি-প্রাকৃতের সর্বশেষ ভাষাতাত্ত্বিক অবস্থা) ওপর ফার্সি, আরবি এবং তুর্কির ঘনিষ্ঠ প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে[৮] দিল্লি সুলতানাতমুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত হয়।[৯] এর পারসিক-আরবি লিপির কারণে উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হত; যেখানে হিন্দি এবং দেবনাগরী লিপিকে হিন্দুধর্মের উপাদান বিবেচনা করা হত।[৬]

উর্দুর ব্যবহার ক্রমেই উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে, কিন্তু বাংলার (ব্রিটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি প্রদেশ) মুসলমানেরা বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিল। বাংলা পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য ইন্দো ভাষাসমূহ থেকে উদ্ভূত একটি পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্য ভাষা,[১০] যা বাংলার নবজাগরণের সময়ে বিপুল বিকাশ লাভ করে। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার বিস্তার তখন থেকেই বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের পূর্বেই উর্দুর বিরোধিতা শুরু করেন, যখন ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। মুসলিম লীগ ছিল ব্রিটিশ ভারতের একটি রাজনৈতিক দল, যা ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। [১১]

আন্দোলনের সূচনা

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশশাসিত অঞ্চলগুলো ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে চারটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়: ভারত, বার্মা (বর্তমান মায়ানমার), সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) এবং পাকিস্তান (যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা অধুনা বাংলাদেশ নামে পরিচিত)।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলা হিসেবেও পরিচিত) বাংলাভাষী ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ৬ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যাবিশিষ্ট নবগঠিত পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়।[২] কিন্তু পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।[১২] ১৯৪৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়।[১৩][১৪] তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ওই সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি উত্থাপন করা হয়।[১৫] কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয়তালিকা থেকে বাদ দেয় ও সাথে সাথে মুদ্রা এবং ডাকটিকেট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান মালিক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।[১৬] পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল এবং সমাবেশের আয়োজন করে।[২]

নেতৃস্থানীয় বাঙালি পণ্ডিতগণ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে মত দেন। পাকিস্তানের কোনো অংশেই উর্দু স্থানীয় ভাষা ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেন যে, “আমাদের যদি একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়, তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি।” [১৭] সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ বলেছেন যে, উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ ‘নিরক্ষর’ এবং সকল সরকারি পদের ক্ষেত্রেই ‘অনুপযুক্ত’ হয়ে পড়বে।[১৮] ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।[২][১৯] পরবর্তীতে সংসদ সদস্য সামসুল হক আহ্বায়ক হয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কার্যক্রম আরও জোরদার করেন।

গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষার দাবি

১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজী ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত[২] ইংরেজীতে প্রদত্ব বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলেন। এছাড়াও সরকারি কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান তিনি।

সংসদ সদস্য প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার এ প্রস্তাবকে স্বাগতঃ জানান। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন এবং তাদের এ সমর্থনের মাধ্যমে মূলত পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক মতামতই প্রতিফলিত হয়েছিল। তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে পরিষদের সকল মুসলমান সদস্য (সবাই মুসলিম লীগের) একযোগে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন যে, “পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক” ।[২০][২১] পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এ প্রস্তাবটিকে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। উর্দুকে লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে” । অনেক বিতর্কের পর সংশোধনীটি ভোটে বাতিল হয়ে যায়।[২][২২][২৩] সংসদীয় দলের আপত্তির কারণে অনেক বাঙালি মুসলমান সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত সংশোধনীটিকে সমর্থন করতে পারেননি।[২৪]

প্রথম প্রতিক্রিয়া

গণপরিষদের ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ঢাকায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ছাত্রদের উদ্যোগে শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে। ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখেও ধর্মঘট ঘোষিত হয় এবং ঐদিন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালন করা হয়। সরকারের প্ররোচনায় পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে এবং অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে।[২০] তমদ্দুন মজলিস ঐসময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবিদের এক সমাবেশ ঘটে।[২১] ঐ সভায় দ্বিতীয়বারের মত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং শামসুল আলম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এ পরিষদে অন্যান্য সংগঠনের দুই জন করে প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হয়।[২০] সেখান থেকে ছাত্ররা ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তার সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানায়।

১১ মার্চের কর্মসূচী নির্ধারণের জন্য ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ ভোরে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে ছাত্রদের একটি দল রমনা ডাকঘরে গেলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রদের আরও একটি দল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সচিবালয়ের সামনে নবাব আবদুল গণি রোডে পিকেটিংয়ে অংশ নেয়। তারা গণপরিষদ ভবন (ভেঙ্গে পড়া জগন্নাথ হলের মিলনায়তন), প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস (বর্তমান বাংলা একাডেমী), হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অফিস বর্জনের জন্যে সবাইকে চাপ দিতে থাকে, ফলে বিভিন্ন স্থানে তাদেরকে পুলিশের লাঠিচার্জের সম্মুখীন হতে হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। এ বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। পূর্ব পাকিস্তানের জেনারের অফিসার কম্যান্ডিং ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি) মেজর পীরজাদার অধীনে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়োগ করেন এবং স্বয়ং গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে বের করে আনেন।[২৫] বিকেলে এর প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হলে পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন নঈমুদ্দিন আহমদ।[২১]

খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে চুক্তি

১১ তারিখের এ ঘটনার পর ১২ থেকে ১৫ মার্চ ধর্মঘট পালন করা হয়। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমূখ অংশগ্রহণ করেছিলেন। আলোচনাসাপেক্ষে দুই পক্ষের মধ্যে ৮টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকারের এ নমনীয় আচরণের প্রধান কারণ ছিল ১৯ মার্চ জিন্নাহ্‌'র ঢাকা আগমন। তার আসার পূর্বে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্ত করার জন্য নাজিমুদ্দিন চুক্তিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিটি তখন পর্যন্ত মেনে নেয়া হয়নি। চুক্তিতে আন্দোলনের সময় গ্রেফতারকৃত বন্দিদের মুক্তি, পুলিশের অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল।[২০]

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌র ঢাকা সফর

১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় এক ভাষণে ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”

১৯ মার্চ ১৯৪৮-এ ঢাকায় এসে পৌঁছান পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ও সেখানে তিনি ভাষণ দেন। তার ভাষণে তিনি ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন।[২৬][২৭][২৮][২৯][৩০] যদিও তিনি বলেন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী; কিন্তু দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন - “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়” ।[২][২৮][৩১][৩২] তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না” । জিন্নাহ্‌'র এ বিরূপ মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্র-জনতার একাংশ। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা - এ ধরনের একপেশে উক্তিতে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।[২৭] ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই ধরনের বক্তব্য রাখেন।[১২] তিনি উল্লেখ করেন এ আন্দোলন সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ এবং অভিযোগ করেন কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছে। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তার অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন, উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে চিৎকার করে ওঠে।

একই দিনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ্‌'র সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম।[২] কিন্তু জিন্নাহ্ খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত বলে প্রত্যাখান করেন।[৩৩] অনেক তর্ক-বিতর্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জিন্নাহ্'র নিকট স্মারকলিপি পেশ করে।[২৪] ২৮ মার্চ জিন্নাহ্ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে দেয়া ভাষণে তার পূর্বেকার অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন।[৩৪] জিন্নাহ্'র ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রলীগ এবং তমুদ্দন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তমুদ্দন মজলিসের আহ্বায়ক শামসুল আলম তার দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহা'র কাছে হস্তান্তর করেন।[২৭] পরবর্তীতে তমুদ্দন মজলিস আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে একটি বিবৃতি প্রদান করে এবং পরে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে।

লিয়াকত আলি খানের ঢাকা সফর

১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়, কিন্তু তিনি কোনোরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নভেম্বর তারিখে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন এবং সেটি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোনো সাড়া দেননি।[২০][৩৫]

ভাষা সমস্যার প্রস্তাবিত সমাধান

এর কিছুদিন পরই, পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠনকরা হয়, এবং এই বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়।[৩৬] ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে; তবে এটি ১৯৫৮ সালের আগে প্রকাশ করা হয়নি। এখানে ভাষা সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কার্যকর ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়, যেখানে তারা বাংলাকে আরবি অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করেছিলেন।[৩৭]

১৯৫২: ভাষা আন্দোলনের পুনর্জাগরণ

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নওয়াবপুর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রদের মিছিল।

ভাষা আন্দোলনের মতো আবেগিক বিষয়ের পুনরায় জোরালো হবার পেছনে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।[২৪] তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহ্'র কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।[৩৩] রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে কোনো জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি।[৩৩] নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।[২০] পরে তারা তাদের মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমী) দিকে অগ্রসর হয়।[১৯] পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়।[২][৩৮] সভায় আরবি লিপিতে বাংলা লেখার সরকারি প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়া হয়। পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।[৩৩]

পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে সমবেত হয়। সমাবেশ থেকে আরবি লিপিতে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ছাত্ররা তাদের সমাবেশ শেষে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে।[৩৯]

২০ ফেব্রুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪ নবাবপুর রোডস্থ আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ১১-৩ ভোটে[৪০] ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।[২০] ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একই বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত সভায় নেতৃত্ব দেন আবদুল মোমিন। শাহাবুদ্দিন আহমদের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে এই সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেন আবদুল মোমিন এবং শামসুল আলম।[৪১]

২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে আমতলায় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা।

পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী এ দিন সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঐসময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়।[২] কিছু ছাত্র ঐসময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌঁড়ে চলে গেলেও বাদ-বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পুনরায় তাদের বিক্ষোভ শুরু করে।

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণ, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রাক্কালে।

বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাঁধা দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইনসভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবে। ছাত্ররা ঐ উদ্দেশ্যে আইনসভার দিকে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ দৌঁড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে।[২৪] পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন।[১] এছাড়া আব্দুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরও অনেকে সেসময় নিহত হন।[২][৩] ঐদিন অহিউল্লাহ নামের একজন ৮/৯ বছরেরে কিশোরও নিহত হয়।[২]

ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে জনগণ ঘটনাস্থলে আসার উদ্যোগ নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত অফিস, দোকানপাট ও পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন সাথে সাথে জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়।[৩১] রেডিও শিল্পীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহ্বান করে এবং রেডিও স্টেশন পূর্বে ধারণকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে থাকে।[৪২]

ঐসময় গণপরিষদে অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে মাওলানা তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ান।[২] গণপরিষদে মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-সহ ছোট ছয়জন সদস্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্যে অনুরোধ করেন এবং শোক প্রদর্শনের লক্ষ্যে অধিবেশন স্থগিত করার কথা বলেন।[২৪] কোষাগার বিভাগের মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, শরফুদ্দিন আহমেদ, সামশুদ্দিন আহমেদ খন্দকার এবং মসলেউদ্দিন আহমেদ এই কার্যক্রমে সমর্থন দিয়েছিলেন। যদিও নুরুল আমিন অন্যান্য নেতাদের অনুরোধ রাখেননি এবং অধিবেশনে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন।[২][২৪]

২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা

২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে বিশাল মিছিল বের হয়।

সেদিন আইন পরিষদে বিরোধী দলের সদস্যরা বিষয়টি উত্থাপন করেন। তারা প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে এবং অধিবেশন মুলতবি করার ঘোষণা দিতে আহ্বান জানান। ক্ষমতাসীন দলের কিছু সদস্যও এই আহ্বানে সমর্থন জানান। কিন্তু নুরুল আমিন তাদের আহ্বানের সাড়া না দিয়ে অধিবেশন অব্যাহত রাখেন এবং হাসপাতালে যেতে অস্বীকৃতি জানান।

ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে সারা দেশ হয়ে উঠে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল। জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি শোক পালন করতে থাকে।[২৪] বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শহরের নাগরিক সমাজ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। পরে তাদের অংশগ্রহণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণ করে। বেলা ১১টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং একপর্যায়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। ঐ ঘটনায় সরকারি হিসেবে ৪ জনের মৃত্যু হয়।

শহরের বিভিন্ন অংশে একইভাবে জানাজা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন কলেজ, ব্যাংক-সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজন এই মিছিলে অংশ নিতে আসে।[৩১] বিকেলে আরেকটি বিশাল মিছিল পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিক্ষুদ্ধ জনতা সরকার পক্ষের প্রথম সারির দুটি সংবাদপত্র জুবিলী প্রেস এবং মর্নিং নিউজ অফিসে অগ্নিসংযোগ করে।[৪৩][৪৪] উল্লেখ্য, জুবিলী প্রেস থেকে সকালের পত্রিকা বের হয়েছিল।

একই দিনে পুলিশ দ্বারা আক্রমণ ও হত্যার বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। নবাবপুর রোডের বিশাল জানাজার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিবর্ষণে শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, ওয়াহিদুল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল।[২০] একই রাস্তায় অহিউল্লাহ নামে নয় বছরের এক বালকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।[২][৪৫] জনশ্রুতি আছে, পুলিশ কিছু লাশ কৌশলে সরিয়ে ফেলে।

পরবর্তী ঘটনা (১৯৫২)

২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সরকার আন্দোলনের বিপক্ষে জোরালো অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে যে, কমিউনিস্ট ও পাকিস্তানবিরোধীদের প্ররোচনায় ছাত্ররা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। তারা বিভিন্নভাবে তাদের এই প্রচার অব্যাহত রাখে। তারা সারাদেশে প্রচারণাপত্র বিলি করে। সংবাদপত্রগুলোকে তাদের ইচ্ছানুসারে সংবাদ পরিবেশনে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।[৪৬] পাশাপাশি ব্যাপক হারে সাধারণ জনগণ ও ছাত্র গ্রেফতার অব্যাহত রাখে। ২৫ ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের ভাই একটি হত্যা মামলা দায়ের করার চেষ্টা করলে, উপযুক্ত কাগজের অভাব দেখিয়ে সরকার মামলাটি গ্রহণ করেনি।[৪৭] রফিকউদ্দিন আহমদের পরিবার একই ধরনের একটি প্রচেষ্টা নিলে, ঐ একই কারণে তাও বাতিল হয়। ৮ এপ্রিল সরকার তদন্ত শুরু করে। কিন্তু এর প্রতিবেদনে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদের উপর গুলি করার কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ দেখাতে পারেনি।[৪৮] সরকারের প্রতিশ্রুত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ প্রত্যাখান করে। ১৪ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন সামনে চলে আসে।[৪৯] এ সমস্যা নিরসনের পক্ষে অনেক সদস্য মত প্রকাশ করলেও মুসলিম লীগের সদস্যরা এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ের বিপক্ষে তারা ভোট দিলে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে তারা ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর গণপরিষদে বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন।[৫০] ২৭ এপ্রিল বার সেমিনার হলে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ একটি সেমিনার আহ্বান করে এবং সরকারের কাছে ২১-দফা দাবি উত্থাপন করে। ১৬ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সেদিন ছাত্ররা সমাবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয় লীগ কমিটির প্রধান নেতা আব্দুল মতিন গ্রেফতার হলে কমিটি আবার পুণর্গঠিত হয়।

শহীদ মিনার

আবুল বরকতের পরিবার শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে। কাজ শেষ হয় ২৪ তারিখ ভোরে। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ গেঁথে দেয়া হয়, যাতে লেখা ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ[৫১] শহীদ মিনার নির্মাণের খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে পাঠানো হয় ঐ দিনই। শহীদ বীরের স্মৃতিতে - এই শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয় শহীদ মিনারের খবর।[২১]

মিনারটি তৈরি হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) বার নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে। কোণাকুণিভাবে হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তার গা-ঘেষে। উদ্দেশ্য ছিল যাতে বাইরের রাস্তা থেকে সহজেই দেখা যায় এবং যেকোনো ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে ভেতরের লম্বা টানা রাস্তাতে দাঁড়ালেই যেন চোখে পড়ে। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচু আর ৬ ফুট চওড়া। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত), নকশা অঙ্কন করেছিলেন বদিউল আলম। তাদের সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। শহীদ মিনার নির্মাণে সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রী। মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালু এবং পুরনো ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট আনা হয়। ভোর হবার পর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় মিনারটি।[২১] ঐ দিনই অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে, ২২ ফেব্রুয়ারির শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।[৩৫] ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন[২১] উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী মেডিক্যালের ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে।[২১][৫২] এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়,[৩৫] এটিও একসময় সরকারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়।

অবশেষে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার পরে ১৯৫৭ সালে সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে ১৯৬৩ সালে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।[৩৫] এবং ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের মা উক্ত মিনারটি উদ্বোধন করেন।[৫৩]

ফেব্রুয়ারি ২৫ তারিখে, কল-কারখানার শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জ শহরে ধর্মঘটের ডাক দেয়।[৫১] ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে প্রতিবাদে অংশগ্রহকারীরা ব্যাপক পুলিশী হামলার শিকার হন।[৫৪]

একুশের গান

২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ‘একুশ’ নিয়ে প্রথম গান আবদুল গাফফার চৌধুরী;- গানটি হল - আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। এ গানটিতে প্রথমে সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। পরে করাচী থেকে ঢাকা ফিরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন করে সুরারোপ করেন।[৫৫] সেই থেকে ওটা হয়ে গেল একুশের প্রভাতফেরীর গান। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুর করা গানটিই গাওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। জহির রায়হান তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে এ গানটি ব্যবহার করার পর এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকতা লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই গানটির সুনাম আরো বাড়তে শুরু করে। ইতোমধ্যে গানটি সুইডিশ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।[৫৬] বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩–৫৬)

১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি: প্রথম শহীদ দিবস সকালে ছাত্র-জনতার শোক শোভাযাত্রা মেডিক্যাল হোস্টেল মোড়ে (যেখান থেকে গুলি চলেছিল) শহীদানের আত্মার মাগফেরাত কামনায় মোনাজাত করছে।
১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরিতে ফ্যাস্টুন হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা।

কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি স্মরণে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মজিবুর রহমানও দিবসটি পালনে সম্মত হন।[৫৭] ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের উদ্দেশ্যে প্রশাসনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভাষা আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে সারা দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ দিবস পালিত হয়। অধিকাংশ অফিস, ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষ প্রভাতফেরীতে যোগ দেন। হাজার হাজার মানুষ শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আসে এবং মিছিল করে প্রাঙ্গন ত্যাগ করে। সহিংসতা রোধের জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। প্রায় লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে আরমানিটোলায় বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে এক-দফা দাবি জানানো হয়, ভাষার দাবির পাশাপাশি মাওলানা ভাসানীসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি উত্থাপন করা হয়।[২] রেলওয়ের কর্মচারীরা ছাত্রদের দাবির সাথে একমত হয়ে ধর্মঘট পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ছাত্ররা শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে।[৫৮] অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন যে, বাংলাকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চায় তারা দেশদ্রোহী। তার এ বক্তব্যে জনগণ হতাশ হয়ে তাকে কালো ব্যাজ দেখায়। সাধারণ মানুষের মাঝে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই লেখা সম্বলিত স্মারক ব্যাজ বিলি করা হয়। ভাষা সংগ্রাম কমিটি দিবসটি পালন উপলক্ষে সমাবেশ আহ্বান করে। আন্দোলনকে আরো বেগবান করার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণাদায়ী অমর সঙ্গীত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো... ঐ বছর কবিতা আকারে লিফলেটে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনের সময় পুলিশ কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে।[৫৯]

যুক্তফ্রন্ট গঠন

১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি

১৯৫৪ সালকে পূর্ব বঙ্গের রাজনৈতিক ও ভাষা আন্দোলনের ব্যাপক পট পরিবর্তনের বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগ বৃহত্তর প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নিন্দা জানায়। নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট যেন আন্দোলনের আর কোনো সুযোগ না পায় সেজন্য মুসলিম লীগ তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখে।[৬০] সেজন্য তারা ভাষা আন্দোলন দিবসের আগে যুক্তফ্রন্টের একাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে।[৬১] অন্যদিকে ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ের অচলাবস্থা নিরসনের উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগের সংসদীয় কমিটির একটি সভা করাচীতে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া এবং সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমমর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা করে হবে।[৬২] এ সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ছয়টি ভাষাকে একই মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলে সেখানকার প্রতিনিধিত্বকারীরা।[৬৩] আবদুল হক (“বাবা উর্দু” নামে পরিচিত) এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান এবং তার এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অনড় থাকেন। তার নেতৃত্বে ২২ এপ্রিল করাচীতে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়। প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মিছিলে অংশ নেয় ও মুসলিম লীগের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়।[৬৪][৬৫] সেখানে সহিংস ঘটনায় সিন্ধি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক আল ওয়াহিদ পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়।[৬৬] অন্যদিকে ২৭ এপ্রিল বাংলা ও অন্যান্য ভাষাকে সমমর্যাদা দেয়ার দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তারা সংখ্যালঘু উর্দুভাষী যারা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছিল তাদের মানসিকতার তীব্র সমালোচনা করেন। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। গণপরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট এবার অধিকাংশ আসনে জয়লাভ করে; যেখানে মুসলিম লীগের আসনসংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম।[৩১][৬৫]

যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমী গঠন করে। এ প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, গবেষণা এবং মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে বলে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়।[৬৭] যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মাহমুদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে তারিখে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকার বাতিল ঘোষণা করে।[৬১] ১৯৫৫ সালের ৬ জুন তারিখে যুক্তফ্রন্ট পুণর্গঠন করা হয়; যদিও আওয়ামী লীগ মন্ত্রীপরিষদে যোগ দেয়নি।[৬০]

১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। শহীদ মিনার নতুনভাবে তৈরি করার লক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে পাকিস্তানের গণপরিষদে কার্যক্রম পাঁচ মিনিট বন্ধ রাখা হয়। সারাদেশব্যাপী পালিত হয় শহীদ দিবস এবং বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ।[৬০][৬৮] আরমানীটোলায় এক বিশাল সমাবেশের নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী।[৬০][৬৯][৭০]

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি

১৯৫৪ সালের ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়।[৬৫] ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়।[৬০] সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়:

214.(1) The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali.
[২১৪. (১) উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।]

যদিও আইয়ুব খানের প্রতিষ্ঠিত সামরিক সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল; ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি সামরিক শাসকগোষ্ঠী এক সরকারি বিবৃতি জারি করে এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উল্লেখিত দুই রাষ্ট্র ভাষার উপর সরকারি অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে।[৭১]

বাঙালি সংস্কৃতিতে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার; ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে নির্মিত

বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে বাংলা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান। বাঙালির মধ্যে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপলক্ষ উদযাপন ও ভাষার উন্নয়নের কাজ করার মানসিকতা তৈরিতে এ আন্দোলনের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘মাতৃভাষা দিবস’ বা ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে, এবং একই সাথে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসটি আরো নানাভাবে উদযাপিত হয় যার মধ্যে আছে, মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদযাপন, যা একুশে বইমেলা নামে সমধিক পরিচিত। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগকারীদের ত্যাগের সম্মানে এ মাসেই ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’।[৭২] মানুষের ভেতর একুশের আবেগ পৌঁছে দিতে একুশের ঘটনা ও চেতনা নিয়ে রচিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকার দেশাত্মবোধক গান, নাটক, কবিতা ও চলচ্চিত্র। তন্মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি।[৭৩] ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব সূচিত হয়ে আসছে। রচনাগুলোর মধ্যে আছে - শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী রচিত নাটক কবর; কবি শামসুর রাহমান রচিত কবিতা বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯; জহির রায়হান রচিত উপন্যাস একুশে ফেব্রুয়ারি; বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান রচিত আর্তনাদ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া[৩৫]

প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলার ২বছর পর ১৯৫৪ সালে নিহতদের স্মরণে নতুন একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সহযোগিতায় বড় পরিসরে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করা হয়। নতুন শহীদ মিনারের স্থপতি ছিলেন হামিদুর রহমান এবং নভেরা আহমেদ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল চত্বরে বড় আকারের এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। মূল বেদির উপর অর্ধ-বৃত্তাকারে সাজানো ৫টি স্তম্ভের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, মা তার শহীদ সন্তানদের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের কারণে স্থাপনাটির নির্মাণ কাজের অগ্রগতি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের মা হাসনা বেগম শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী এটি ভেঙ্গে দেয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার এটি পুণরায় নির্মাণ করে।[৭৪]

পূর্ব পাকিস্তান ছাড়াও ভারতের আসম রাজ্যে বাংলা ভাষাকে সমমর্যাদা দেয়ার লক্ষ্যে আন্দোলন হয়েছিল। ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর রেলস্টেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য দাবি জানালে পুলিশের গুলিতে ১১ বাঙালি শহীদ হন। পরবর্তীতে আসামের বাংলাভাষী লোকসংখ্যা বেশি রয়েছে এমন ৩টি জেলাতে বাংলাকে আধা-সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে।[৭৫]

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইউনেস্কোর কাছে লিখিতভাবে প্রস্তাব করে, যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সংস্থার ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে পাশ হয়।[৭৬]

বাংলাদেশের স্বাধীনতা

যদিও ১৯৫৬ সালের পর সরকারি ভাষার বিতর্ক সম্পন্ন হয়, কিন্তু আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ও পশতুনদের দেনাগুলো বাঙালিদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়। জনসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সামরিক এবং বেসামরিক চাকুরীর ক্ষেত্রে বাঙালিদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব এবং সরকারি সাহায্যের দিক থেকেও বাঙালিদের প্রাপ্ত অংশ ছিল খুবই কম। জাতিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাঙালিদের এ বৈষম্যের ফলে চাপা ক্ষোভের জন্ম নিতে থাকে। এরই প্রভাব হিসেবে আঞ্চলিক স্বার্থসংরক্ষণকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থন নিরঙ্কুশভাবে বাড়তে থাকে।[২৮] এর ফলেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আরো বড় অধিকার আদায় ও গণতন্ত্রের দাবিতে ছয় দফা আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনই পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আকার ধারণ করে।[৭][১২]

পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া

ভাষা শহীদদের স্মরণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত অমর একুশে (ভাস্কর্য)।

যদিও পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বাঙালি মনে করেন যে, বাংলা ভাষা আন্দোলন জাতিগত জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়েছিল; কিন্তু এ আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের সংস্কৃতির পার্থক্যগুলো সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে।[৭][২৮][৭৭] পশ্চিম পাকিস্তানে এ আন্দোলনটি পাকিস্তানি জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বিভাগীয় উত্থান বলে মনে করা হয়।[৭৮] দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে “একমাত্র উর্দু” নীতি প্রত্যাখ্যান করাকে মুসলমানদের পারসিক-আরবি সংস্কৃতি এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার মূল মতাদর্শের গুরুতর লঙ্ঘন হিসাবে দেখা হয়।[৭] পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন শক্তিশালী রাজনীতিবিদ মনে করেন যে, “উর্দু” হল ভারতীয় ইসলামী সংস্কৃতির অংশ, আর বাংলাকে তারা হিন্দু সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তৈরি বাংলা সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচনা করতেন।[১২] অধিকাংশই যারা “একমাত্র উর্দু” নীতির পক্ষে ছিলেন, তারা মনে করতেন যে, উর্দু কেবলমাত্র পাকিস্তান দেশের ভাষা হিসেবেই নয়, বরং সমগ্র জাতির ভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এধরনের চিন্তা-ভাবনাও উর্দু নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল; কেননা, পাকিস্তানে তখন আরও বেশ কিছু ভাষাগত পার্থক্যের সম্প্রদায় ছিল।[১২] ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে আইয়ুব খান বলেন যে, “পূর্ব পাকিস্তান... এখনো হিন্দু সংস্কৃতি এবং প্রভাবের অধীনে রয়েছে।” [১২]

আন্দোলনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করে এবং দলের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দিয়ে দেয়।[৭৯] ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত জাতীয়তাবাদীভিত্তিক দলগুলোর কার্যক্রমে গতির সঞ্চার করে।[৭] পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কেন্দ্রীয় সরকার এবং যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে প্রদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খানের সামরিক অভ্যূত্থানের অন্যতম প্রধান কারণ।[৩১]

গণমাধ্যমে বাংলা ভাষা আন্দোলন

ঢাকায় ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। তবে সেখানে বলা হয়, “ঢাকায় ভাষার জন্য শিক্ষার্থীদের উপর পাকিস্তানি পুলিশের গুলি বর্ষণ।”

চিত্রশালা

আরো দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. ইতিহাস, কবির উদ্দিন আহমেদ. পৃ-২২৫-২৬
  2. "ভাষা আন্দোলন"বাংলাপিডিয়া - বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ। এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০২-১০ 
  3. "Dhaka Medical College Hostel Prangone Chatro Shomabesher Upor Policer Guliborshon. Bishwabidyalayer Tinjon Chatroshoho Char Bekti Nihoto O Shotero Bekti Ahoto"। দৈনিক আজাদ (Bengali ভাষায়)। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। 
  4. "বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭"আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৪-২২ 
  5. Glassie, Henry and Mahmud, Feroz.2008.Living Traditions. Cultural Survey of Bangladesh Series-II. এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ. Dhaka. p.578
  6. Upadhyay, R (২০০৩-০৫-০১)। "Urdu Controversy - is dividing the nation further"Papers। South Asia Analysis Group। ২০০৮-০৪-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০২-২০ 
  7. Rahman, Tariq (১৯৯৭)। "The Medium of Instruction Controversy in Pakistan" (PDF)Journal of Multilingual and Multicultural Development18 (2): 145–154। আইএসএসএন 0143-4632ডিওআই:10.1080/01434639708666310। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-২১ 
  8. Halder, Shashwati। "অপভ্রংশ"বাংলাপিডিয়া। এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৭-০৮ 
  9. "A Historical Perspective of Urdu"। National Council for Promotion of Urdu language। ২০০৭-০৬-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-১৫ 
  10. Bhattacharya, T (২০০১)। "Bangla" (পিডিএফ)। Gary, J. and Rubino, C. (Eds)। Encyclopedia of World's Languages: Past and Present (Facts About the World's Languages) (PDF)। New York: HW Wilson। আইএসবিএন 0824209702। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-২০ 
  11. রহমান, তারেক (ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭)। "The Urdu-English Controversy in Pakistan"। Modern Asian Studies৩১ (1): ১৭৭–২০৭। ডিওআই:10.1017/S0026749X00016978পিএমআইডি 312861  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  12. Oldenburg, Philip (August, 1985)। ""A Place Insufficiently Imagined": Language, Belief, and the Pakistan Crisis of 1971"। The Journal of Asian Studies। The Journal of Asian Studies, Vol. 44, No. 4। 44 (4): 711–733। আইএসএসএন 0021-9118জেস্টোর 2056443ডিওআই:10.2307/2056443  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  13. Morning News। ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৭।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  14. দৈনিক আজাদ (a daily newspaper) (Bengali ভাষায়)। Abul Kalam Shamsuddin, Dhaka। ১১ ডিসেম্বর ১৯৪৮।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  15. Umar 1979, পৃ. 35
  16. Al Helal 2003, পৃ. 227–28
  17. দৈনিক আজাদ। ২৯ জুলাই ১৯৪৭।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  18. Umar 1979, পৃ. 30–32
  19. Ekusher Shongkolon '80 (Bengali ভাষায়)। Dhaka: Bangla Academy। ১৯৮০। পৃষ্ঠা 102–103। 
  20. মালেক, আবদুল (২০০০)। হোসেন, আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার, সম্পাদক। ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস। ঢাকা: সেলিনা হোসেন, পরিচালক, গবেষণা সংকলন ফোকলোর বিভাগ, বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা ৫–২৭। আইএসবিএন 984-07-4045-8 
  21. একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস - আহমদ রফিক পৃষ্ঠা: ৫৬,১৪২, ৫৯
  22. Rahman, Hasan Hafizur (১৯৮২)। Bangladesher Swadhinotajuddher Dolilpotro। Ministry of Information, People's Republic of Bangladesh। 
  23. "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র. পৃ-৫৪-৬৫
  24. Al Helal 2003, পৃ. 377–393
  25. আইয়ুব খান ‘প্রভু নয় বন্ধু’; পৃষ্ঠা: ৩৮
  26. Choudhury, G. W. (April, 1972)। "Bangladesh: Why It Happened"। International Affairs। Royal Institute of International Affairs। 48 (2): 242–249। আইএসএসএন 0020-5850জেস্টোর 2613440ডিওআই:10.2307/2613440  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  27. Umar 1979, পৃ. 279
  28. Uddin 2006, পৃ. 3–16, 120–124
  29. দৈনিক আজাদ। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  30. R. Upadhyay (২০০৭-০৪-০৭)। "De-Pakistanisation of Bangladesh"। Bangladesh Monitor, South Asia Analysis Group। ২০০৭-০৬-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-১৬ 
  31. James Heitzman and Robert Worden (eds), সম্পাদক (১৯৮৯)। "Pakistan Period (1947–71)"Bangladesh: A Country Study। Government Printing Office, Country Studies US। আইএসবিএন 0-16-017720-0। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-১৬ 
  32. Sayeed, Khalid Bin (September, 1954)। "Federalism and Pakistan"। Far Eastern Survey23 (9): 139–143। আইএসএসএন 0362-8949জেস্টোর 3023818ডিওআই:10.1525/as.1954.23.9.01p0920l  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  33. Al Helal 2003, পৃ. 263–265
  34. Umar 1979, পৃ. 290
  35. Islam, Rafiqul (২০০০)। Amar Ekushey O Shaheed Minar (Bengali ভাষায়)। Dhaka: Poroma। পৃষ্ঠা 62–85। আইএসবিএন 984-8245-39-1 
  36. Mandal, Ranita (২০০২-০৬-২৪)। "Chapter 4 : Other Activities"Muhammad Shahidullah & His Contribution To Bengali Linguistics। Central Institute of Indian Languages, Mysore, India। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-২৩ 
  37. দৈনিক আজাদ। ২৪ মে ১৯৫০।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  38. দৈনিক আজাদ। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  39. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৫২
  40. পরিষদের সভায় মোট ১৫জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু মোহাম্মদ তোয়াহা ভোট দানে বিরত ছিলেন।
  41. গাজীউল হক, একুশের সংকলন, প্রকশিত: ১৯৮০, পৃষ্ঠা: ১৩৮
  42. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ২২, ১৯৫২
  43. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ১৯৫২
  44. "বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের শুপারিশ। শুক্রবার শহরের অবস্থার আরো অবনতি: সরকার কর্তৃক সামরিক বাহিনী তলব। পুলিশ ও সেনাদের গুলিতে চারজন নিহত ও শতাধিক আহত: সাত ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি। শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শতস্ফূর্ত হরতাল পালন"। দৈনিক আজাদ। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। 
  45. Al Helal 2003, পৃ. 483
  46. Al Helal 2003, পৃ. 515-523
  47. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৫২
  48. Al Helal 2003, পৃ. 546–552
  49. দৈনিক আজাদ, মার্চ ২০, ১৯৫২
  50. দৈনিক আজাদ, এপ্রিল ১১, ১৯৫২
  51. দৈনিক আজাদ,February 25, 1952
  52. The Daily Star,February 27, 1952
  53. "জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫"- ওলি আহাদ পৃ-১৫৩
  54. Umar 1979, পৃ. 417–418
  55. "বাংলাপিডিয়া নিবন্ধ"। ২৩ মে ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৩ 
  56. বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এমএ/এমআই/১৮১১ ঘ.
  57. সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারি ৮, ১৯৫৩
  58. সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ১৯৫৩
  59. Al Helal 2003, পৃ. 604–609
  60. আলহেলাল ২০০৩, পৃ. ৬০৮–৬১৩
  61. Al Helal 2003, পৃ. 600–603
  62. সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ২১, ১৯৫৩
  63. দৈনিক আজাদ, এপ্রিল ২১, ১৯৫৪
  64. দৈনিক আজাদ। ২২ এপ্রিল ১৯৫৪।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  65. "UF elections victory"Chronicles of Pakistan। ২০১২-০১-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-১২-১১ 
  66. দৈনিক আজাদ, এপ্রিল ২২, ১৯৫৪
  67. "বাংলা একাডেমী"বাংলাপিডিয়া - বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ। এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০২-২৮ 
  68. "Gambhirjopurno Poribeshay Shaheed Dibosh Utjapon"। Weekly Notun Khobor (Bengali ভাষায়)। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬। 
  69. "Gambhirjopurno Poribeshay Shaheed Dibosh Utjapon"। Weekly Notun Khobor (Bengali ভাষায়)। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬। 
  70. সাপ্তাহিক নতুন খবর, ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৫৬
  71. Lambert, Richard D. (April, 1959)। "Factors in Bengali Regionalism in Pakistan"। Far Eastern Survey28 (4): 49–58। আইএসএসএন 0362-8949ডিওআই:10.1525/as.1959.28.4.01p1259x  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  72. Khan, Sanjida। "জাতীয় পুরস্কার"বাংলাপিডিয়া। এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-২৩ 
  73. Aminzade, Ronald; Douglas McAdam; Charles Tilly (১৭ সেপ্টেম্বর ২০০১)। "Emotions and Contentious Politics"। Silence and Voice in the Study of Contentious Politics। Cambridge: Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 42। আইএসবিএন 0521001552। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-২৪ 
  74. Imam, Jahanara (১৯৮৬)। Ekattorer Dingulee (Bengali ভাষায়)। Dhaka: Shondhani Prokashani। পৃষ্ঠা 44। আইএসবিএন 984-480-000-5 
  75. Court route for language status , The Telegraph, May 20, 2008.
  76. "International Mother Language Day - Background and Adoption of the Resolution"বাংলাদেশ সরকার (ইংরেজি ভাষায়)। ২০০৭-০৫-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-২১ 
  77. "বাংলাদেশের ইতিহাস" (ইংরেজি ভাষায়)। ডিসকভার বাংলাদেশ। ৯ জুন ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১-০৬-২০০৭  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  78. Rahman, Tariq (September, 1997)। "Language and Ethnicity in Pakistan"। Asian Survey37 (9): 833–839। আইএসএসএন 0004-4687জেস্টোর 2645700ডিওআই:10.1525/as.1997.37.9.01p02786  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  79. Lintner, Bertil (January, 2004)। "Chapter 17: Religious Extremism and Nationalism in Bangladesh" (পিডিএফ)। eds Satu Limaye, Robert Wirsing, Mohan Malik। Religious Radicalism and Security in South Asia (PDF)। Honolulu, Hawaii: Asia-Pacific Center for Security Studies। পৃষ্ঠা 413। আইএসবিএন 0-9719416-6-1। সংগ্রহের তারিখ 2007-06-28  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)

তথ্যসূত্র

  • আল হেলাল, বশীর (২০০৩), ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, আইএসবিএন 984-401-523-5  (বাংলা)
  • Uddin, Sufia M. (২০০৬), Constructing Bangladesh: Religion, Ethnicity, and Language in an Islamic Nation, Chapel Hill: The University of North Carolina Press, আইএসবিএন 0807830216 
  • ওমর (১৯৭৯), পূর্ব বাংলা ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা 

আরো পড়ুন

  • আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫।
  • আবদুল হক, ভাষা-আন্দোলনের আদি পর্ব, ঢাকা, ১৯৭৬।
  • বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, ঢাকা, ১৯৭৯।
  • Badruddin Umar (২০০৪)। The Emergence of Bangladesh: Class Struggles in East Pakistan (1947-1958)। Oxford University Press, USA। আইএসবিএন 978-0195795714 
  • Anwar S. Dil (২০০০)। Bengali language movement to Bangladesh। Ferozsons। আইএসবিএন 978-9690015778 
  • Robert S. Stern (২০০০)। Democracy and Dictatorship in South Asia: Dominant Classes and Political Outcomes in India, Pakistan, and Bangladesh। Praeger Publishers। আইএসবিএন 978-0275970413 
  • Syed Manzoorul Islam (১৯৯৪)। Essays on Ekushey: The Language Movement 1952। Bangla Academy। আইএসবিএন 984-07-2968-3 

বহিঃসংযোগ