তৈমুর লং: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
৪১ নং লাইন: ৪১ নং লাইন:


তৈমুর হুসেইনের বোনকে বিয়ে করেন। তারা দুজন মিলে ১৩৬৪ সালে তুঘলক তিমুরের পুত্র আমির খোজাকে পরাজিত করে মধ্য এশিয়ার সিংহাসনে বসেন। তৈমুর এবং হুসেইন যৌথভাবে শাসন করতে থাকেন। কিন্তু তৈমুর সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি হুসেইনকে হটিয়ে দেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এদিকে ১৩৭০ সালে তৈমুরের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু তৈমুরের জন্য শাপে বর হয়ে আসে। এবার আর হুসেইনের সাথে কোনো পারিবারিক বন্ধন থাকলো না। তৈমুর আমির হুসেইনকে হত্যা করে নিজেকে মধ্য এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। শুরু হয় তৈমুর লং এর শাসন।
তৈমুর হুসেইনের বোনকে বিয়ে করেন। তারা দুজন মিলে ১৩৬৪ সালে তুঘলক তিমুরের পুত্র আমির খোজাকে পরাজিত করে মধ্য এশিয়ার সিংহাসনে বসেন। তৈমুর এবং হুসেইন যৌথভাবে শাসন করতে থাকেন। কিন্তু তৈমুর সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি হুসেইনকে হটিয়ে দেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এদিকে ১৩৭০ সালে তৈমুরের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু তৈমুরের জন্য শাপে বর হয়ে আসে। এবার আর হুসেইনের সাথে কোনো পারিবারিক বন্ধন থাকলো না। তৈমুর আমির হুসেইনকে হত্যা করে নিজেকে মধ্য এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। শুরু হয় তৈমুর লং এর শাসন।

==সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ==

তৈমুর মঙ্গোল সাম্রাজ্যের শাসক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চেঙ্গিস খানের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক না থাকায় তিনি মঙ্গোলদের আমির হিসেবে শাসন করেন। তিনি রণকৌশলে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তাই ক্ষমতা লাভের কয়েক বছরের মাথায় অনায়াসেই পুরো মধ্য এশিয়ার অধিপতি হয়ে যান। কিন্তু তৈমুর আরও চান। তিনি চেঙ্গিসের মতো পৃথিবী শাসন করতে চান।

তৈমুর তার সামনে চেঙ্গিস খানের মানচিত্র মেলে ধরেন। পুরো মানচিত্রে একবার চোখ বুলিয়ে নেন তিনি। এতে তার বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে গেলো। রনচক আঁকতে থাকেন তারপর তিনি বিশাল সেনাবহর নিয়ে বিশ্বজয়ে বের হন। তৈমুরের অভিযানের খবর পেয়ে ক্ষমতাচ্যুত মঙ্গোল খান তোকতামিশ তৈমুরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তোকতামিশ খান শত্রুদের হাতে রাশিয়ার মসনদ হারিয়েছিলেন। তৈমুর লং বিশাল সেনাবহর নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং তোকতামিশ খানকে রাশিয়ার হৃত সিংহাসন ফিরিয়ে দেন। এরপরই তৈমুর পারস্যের দিকে রওয়ানা হন। তৈমুরের পারস্য অভিযান শুরু হয় হেরাত নগরী দখলের মাধ্যমে।

প্রথমদিকে কার্তিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী হেরাত তৈমুরের নিকট আত্মসমর্পণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে। তৈমুর যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি হেরাতের দ্বায়িত্বে থাকা সকল কর্মকর্তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার আদেশ দেন। আদেশ পাওয়া মাত্র তৈমুরবাহিনী হেরাতের রাজকর্মকর্তাদের উপর চড়াও হয়ে ওঠে। তৈমুর বাহিনীর আগ্রাসনে মৃত্যু-নগরীতে পরিণত হয় হেরাত। শেষপর্যন্ত ১৩৮৩ সালে হেরাত তৈমুরের পায়ে লুটিয়ে পড়ে পরাজয় স্বীকার করে।

এরপর তৈমুর তার বাহিনী নিয়ে আরো পশ্চিমে অগ্রসর হতে থাকেন। ততদিনে তৈমুরের নৃশংসতার খবর পারস্যের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তৈমুর তেহরানের মাটিতে পা দিলেন। তেহরান নির্দ্বিধায় তৈমুরের নিকট আত্মসমর্পণ করে। ধীরে ধীরে এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং ইরাকের কিছু অংশ তৈমুরের দখলে চলে আসে। তৈমুর যখন দেশ দখলে ব্যস্ত, তখন তার কানে খবর পৌঁছে, বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারা তৈমুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। ক্রুদ্ধ তৈমুর অভিযান ক্ষান্ত দিয়ে কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেন। আফগানিস্তানে বিদ্রোহীদের হত্যা করার পর তিনি একটি মিনার নির্মাণ করেন। মিনার নির্মাণের সরঞ্জাম ছিল বিদ্রোহীদের মস্তক। ইস্পাহান শহরের ৭০ হাজার বিদ্রোহীর মাথার খুলি একটি অপরটির উপর জুড়ে দিয়ে মিনার তৈরি করা হয়। এভাবে ১৩৮৫ সালে পুরো পারস্য তৈমুরের দখলে চলে আসে।

১৩৮৭ সালে তৈমুরের মিত্র তোকতামিশ মধ্য এশিয়া আক্রমণ করে বসেন। নিজের ঘর বাঁচাতে তৈমুর নিজ অঞ্চলে ফিরে আসেন। তৈমুরের বিশাল বাহিনীর হাতে পরাজয় ঘটে তোকতামিশ খানের। তোকতামিশ খান রাশিয়ায় ফেরত যান। তৈমুর ১৩৯২ সালে পুনরায় পশ্চিমে অভিযান চালান এবং ইরাক দখল করে নেন। মঙ্গোল খানদের গৌরব ‘গোল্ডেন হোর্ড’ বা ‘ইলখানাত‘ তৈমুরের নিকট অসহায় পরাজয় বরণ করে। তৈমুরের পূর্বে কেউ ইলখানাত ধ্বংস করতে পারেনি। এবার তিনি রাশিয়ার দিকে অগ্রসর হন। তেরেক নদীর তীরে তোকতামিশ খান এবং তৈমুর ফের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এবারও তৈমুরের কাছে পরাজিত হন তিনি। তৈমুর ১৩৯৫ সালে মস্কো দখল করেন।

অগ্নিস্নাত মস্কোর সামনে দাঁড়িয়ে তৈমুর তৃপ্তির হাসি দেন। তবে তার ক্ষুধা তখনও মিটেনি। সেদিনই মনে মনে ছক কষতে থাকেন তৈমুর। এবার ভারতবর্ষ জয়ের পালা।

==ভারতবর্ষে তৈমুর==

ভারতবর্ষ আজীবন তৈমুরকে মনে রাখবে তার নৃশংসতার জন্য। ভারতবর্ষের অধিপতি ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভিন্ন নেতারা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। চতুর তৈমুর এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। ১৩৯৮ সালের শেষের দিকে প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিন্ধু নদের পাড়ে হাজির হন তৈমুর লং। দূর থেকে দেখে ভয় পেয়ে যায় ভারতবাসী। যেন তৈমুর নয়, সাক্ষাত যমদূত তার বাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছেন।

সিন্ধু নদ পাড়ি দিয়েই তৈমুর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠেন। নির্বিচারে হত্যা করতে থাকেন সৈন্যদের দিল্লীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন তৈমুর। প্রায় ২০ হাজার সৈন্য হত্যার পরে তিনি দিল্লী গিয়ে পৌঁছান। দিল্লীর সুলতান [[নাসিরুদ্দিন শাহ তুঘলক]] হস্তিবাহিনী নিয়ে তৈমুরকে আক্রমণ করে বসেন। বুদ্ধিমান তৈমুর এবার নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন। হাজার হাজার উটের পিঠ খড়ের গাদা দিয়ে বোঝাই করলেন। এরপর খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে উটগুলোকে হস্তিবাহিনীর দিকে হটিয়ে দেন। সুলতানের হস্তিবাহিনী জ্বলন্ত উটের আগ্রাসনে ভয় পেয়ে যায়। অবস্থা হিতে বিপরীত হয়ে যায়। হাতিগুলো উল্টো ঘুরে সুলতানকেই আক্রমণ করে বসে।

নিজেদের বাহিনীর হাতেই পরাজিত হন সুলতান। দিল্লী দখলের আনন্দে তৈমুর বাহিনী দিল্লী জুড়ে বিরোধী সৈন্যের রক্তের বন্যা বসিয়ে দেয়। তৈমুর ভারতবর্ষ শাসন করেননি। অভিযানরত অবস্থায় তৈমুর বাগদাদের দখল হারানোর দুঃসংবাদ লাভ করেন। ১৩৯৯ সালে তৈমুর পুনরায় বাগদাদ আক্রমণ করেন। বরাবরের মতোই তিনি অনায়াসে বাগদাদ দখল করে নেন। এবার তৈমুরের নিষ্ঠুরতা যেন আরো বেড়ে গেলো। তার আদেশে বাগদাদের ২০ হাজার বিদ্রোহীর শিরশ্ছেদ করা হয়।


== তথ্যসূত্র ==
== তথ্যসূত্র ==

১৬:০৩, ৯ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

তৈমুর বেগ
Amir of the Timurid Empire
রাজত্ব1370-1405
রাজ্যাভিষেক1370, Balkh
উত্তরসূরিKhalil Sultan mirza shahruk mirza
সমাধি
প্রাসাদসেলযুক রাজবংশ
পিতাMuhammad Taraghay Begh
মাতাTekina Mohbegim

তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস (চাগাতাই ভাষায়: تیمور - তেমোর্‌, "লোহা") (১৩৩৬ - ফেব্রুয়ারি, ১৪০৫) ১৪শ শতকের একজন তুর্কী-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ[১][২][৩][৪] তিনি পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজ দখলে এনে তৈমুরীয় সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৩৭০ থেকে ১৪০৫ সাল পর্যন্ত নেতৃত্বে আসীন ছিল। এছাড়াও তাঁর কারণেই তৈমুরীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই বংশ কোন না কোনভাবে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে নেতৃত্বে আসীন ছিল। তিনি তিমুরে ল্যাংগ্‌ (ফার্সি ভাষায়: تیمور لنگ‎ ​) নামেও পরিচিত যার অর্থ খোঁড়া তৈমুর। তার আসল নাম তৈমুর বেগ। যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি আহত হন যার ফলে তাঁর একটি পা অকেজো হয়ে যায় এবং তিনি খোঁড়া বা ল্যাংড়া হয়ে যান। তিনি উনার পূর্বপুরুষ মহান সেলযুক সাম্রাজ্যের শাসক সুলতান তুগরিল বেগ কে অনুপ্রেরণা হিসেবে অনুসরণ করতেন। এবং তিনিও আলেকজান্ডার ও চেঙ্গিস খানের মতো বিশ্বজয়ে উনার সৈন্যবাহিনী নিয়ে বের হয়েছিলেন। এ নিয়ে বিশ্ব বিজেতা তৈমুর লং নামের একটি বইও রচিত হয়েছে। তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ যার মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত।

তিনি উনার একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করিয়ে যান যার নাম তুজুক ই তৈমুরী

কেশ শহরের দূরন্ত শিশু

১৩৩৬ সালের কথা। গভীর রাত। উজবেকিস্তানের প্রতিটি ঘরের বাতি নিভে গেছে। গভীর ঘুমে বিভোর উজবেকবাসী। কিন্তু ঘুম নেই শুধু একটি ঘরে। সমরকন্দ থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে অবস্থিত কেশ নগরীর স্কারদু শহরের সবচেয়ে বড় বাড়িতে এখনও নিভু নিভু অবস্থায় প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের বাইরে উঠানে অস্থির পায়চারি করছেন বাড়ির মালিক তারাগাই বেগ। তিনি এই অঞ্চলের ভূস্বামী। হঠাৎ তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা ওঠায় তিনি চিন্তিত। শহরে লোক পাঠানো হয়েছে ধাত্রীর খোঁজে, কিন্তু তারা এখনও ফিরে আসেনি। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করছেন তিনি। শেষপর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিলেন সৃষ্টিকর্তা। ভোরের প্রথম আলোর সাথে ভূমিষ্ঠ হলো এক পুত্রসন্তান। পুত্রের নাম রাখা হলো তৈমুর বেগ ‘তৈমুর’, যার অর্থ ‘লৌহ’,‘বেগ’ অর্থ ‘শাসক’। ইউরোপে তিনি ‘তিমুর’ (Timur) বা ‘তিমুরলেন’ (Timurlane) নামে পরিচিত।

হয়তো তার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণের জন্যই তৈমুর বেশ দুরন্ত এবং সাহসী কিশোর হিসেবে বেড়ে ওঠেন। এমনকি ছোটখাট সৈন্য বাহিনীও গড়ে তুলেন তিনি। এলাকা ঘুরে ঘুরে ছোটখাটো হানা দিতো তারা। দেখতে দেখতে তৈমুর যৌবনে পদার্পণ করেন। বয়সের সাথে সাথে তার শক্তি এবং সাহস, দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার সত্যিকারের সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে থাকেন তিনি। তৈমুরের দাপটে এলাকার ভূস্বামীরা আতংকিত হয়ে থাকতো। যুবক তৈমুরের ডান পা এক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যায়। কিন্তু ঠিক কীভাবে তিনি খোঁড়া হয়েছিলেন, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। একদল ইতিহাসবিদের মতে, একদল লুটতরাজদের তাড়া করতে গিয়ে নিজ সৈন্যদলের তীরের আঘাত লাগে। এরপর থেকে তিনি ‘খোঁড়া তৈমুর’ বা ‘তৈমুর-ই-লং’ নামে পরিচিত হন।

তৈমুর লং এর উত্থান

এক পা খোঁড়া হয়ে গেলেও তৈমুর দমে যাননি। আহত বাঘের মতো আরও হিংস্র হয়ে ওঠেন তিনি। তৈমুরের সময়ের প্রায় একশত বছর পূর্বে চেঙ্গিস খান পুরো পৃথিবীর শাসন করেছিলেন। তৈমুর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, তিনিও চেঙ্গিসের মতো পৃথিবী শাসন করবেন। তাই খোঁড়া পা নিয়ে সমরবিদ্যার প্রশিক্ষণ নেন তিনি। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি অস্ত্র চালনায় বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

তৈমুর যখন টগবগে যুবক, তখন সমগ্র মধ্য এশিয়া (আমু দরিয়া এবং সির দরিয়া নদীবিধৌত অঞ্চল) জুড়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। বিভিন্ন যাযাবর দল এবং স্থানীয় নেতাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকতো। অপরদিকে স্থানীয় নেতারা অনেকটা পশ্চিমা মতাদর্শে শাসন করতেন। তারা চেঙ্গিস খান, কুবলাই খানের শাসনব্যবস্থা পরিত্যাগ করেছিলেন। এই কারণে স্থানীয় জনগণ তাদের উপর অসন্তুষ্ট ছিল। ১৩৪৭ সালে আমির কাজগান স্থানীয় নেতা চাগতাই খানাতের সর্দার বরলদেকে হটিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু ১৩৫৮ সালে তিনি ঘাতকের হাতে নিহত হন।

এবার ক্ষমতায় আসেন তুঘলক তিমুর। তিনি বারলাস অঞ্চলের শাসক হিসেবে তৈমুর লংকে নিযুক্ত করেন। তৈমুর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তুঘলককে অপসারণ করার নীলনকশা তৈরি করতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি ধরা পড়ে যান। তুঘলক তিমুর তৈমুরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এবার তৈমুর লং স্বয়ং আমির কাজগানের নাতি আমির হুসেইনের সাথে হাত মেলান।

তৈমুর হুসেইনের বোনকে বিয়ে করেন। তারা দুজন মিলে ১৩৬৪ সালে তুঘলক তিমুরের পুত্র আমির খোজাকে পরাজিত করে মধ্য এশিয়ার সিংহাসনে বসেন। তৈমুর এবং হুসেইন যৌথভাবে শাসন করতে থাকেন। কিন্তু তৈমুর সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি হুসেইনকে হটিয়ে দেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এদিকে ১৩৭০ সালে তৈমুরের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু তৈমুরের জন্য শাপে বর হয়ে আসে। এবার আর হুসেইনের সাথে কোনো পারিবারিক বন্ধন থাকলো না। তৈমুর আমির হুসেইনকে হত্যা করে নিজেকে মধ্য এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। শুরু হয় তৈমুর লং এর শাসন।

সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ

তৈমুর মঙ্গোল সাম্রাজ্যের শাসক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চেঙ্গিস খানের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক না থাকায় তিনি মঙ্গোলদের আমির হিসেবে শাসন করেন। তিনি রণকৌশলে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তাই ক্ষমতা লাভের কয়েক বছরের মাথায় অনায়াসেই পুরো মধ্য এশিয়ার অধিপতি হয়ে যান। কিন্তু তৈমুর আরও চান। তিনি চেঙ্গিসের মতো পৃথিবী শাসন করতে চান।

তৈমুর তার সামনে চেঙ্গিস খানের মানচিত্র মেলে ধরেন। পুরো মানচিত্রে একবার চোখ বুলিয়ে নেন তিনি। এতে তার বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে গেলো। রনচক আঁকতে থাকেন তারপর তিনি বিশাল সেনাবহর নিয়ে বিশ্বজয়ে বের হন। তৈমুরের অভিযানের খবর পেয়ে ক্ষমতাচ্যুত মঙ্গোল খান তোকতামিশ তৈমুরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তোকতামিশ খান শত্রুদের হাতে রাশিয়ার মসনদ হারিয়েছিলেন। তৈমুর লং বিশাল সেনাবহর নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং তোকতামিশ খানকে রাশিয়ার হৃত সিংহাসন ফিরিয়ে দেন। এরপরই তৈমুর পারস্যের দিকে রওয়ানা হন। তৈমুরের পারস্য অভিযান শুরু হয় হেরাত নগরী দখলের মাধ্যমে।

প্রথমদিকে কার্তিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী হেরাত তৈমুরের নিকট আত্মসমর্পণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে। তৈমুর যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি হেরাতের দ্বায়িত্বে থাকা সকল কর্মকর্তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার আদেশ দেন। আদেশ পাওয়া মাত্র তৈমুরবাহিনী হেরাতের রাজকর্মকর্তাদের উপর চড়াও হয়ে ওঠে। তৈমুর বাহিনীর আগ্রাসনে মৃত্যু-নগরীতে পরিণত হয় হেরাত। শেষপর্যন্ত ১৩৮৩ সালে হেরাত তৈমুরের পায়ে লুটিয়ে পড়ে পরাজয় স্বীকার করে।

এরপর তৈমুর তার বাহিনী নিয়ে আরো পশ্চিমে অগ্রসর হতে থাকেন। ততদিনে তৈমুরের নৃশংসতার খবর পারস্যের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তৈমুর তেহরানের মাটিতে পা দিলেন। তেহরান নির্দ্বিধায় তৈমুরের নিকট আত্মসমর্পণ করে। ধীরে ধীরে এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং ইরাকের কিছু অংশ তৈমুরের দখলে চলে আসে। তৈমুর যখন দেশ দখলে ব্যস্ত, তখন তার কানে খবর পৌঁছে, বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারা তৈমুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। ক্রুদ্ধ তৈমুর অভিযান ক্ষান্ত দিয়ে কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেন। আফগানিস্তানে বিদ্রোহীদের হত্যা করার পর তিনি একটি মিনার নির্মাণ করেন। মিনার নির্মাণের সরঞ্জাম ছিল বিদ্রোহীদের মস্তক। ইস্পাহান শহরের ৭০ হাজার বিদ্রোহীর মাথার খুলি একটি অপরটির উপর জুড়ে দিয়ে মিনার তৈরি করা হয়। এভাবে ১৩৮৫ সালে পুরো পারস্য তৈমুরের দখলে চলে আসে।

১৩৮৭ সালে তৈমুরের মিত্র তোকতামিশ মধ্য এশিয়া আক্রমণ করে বসেন। নিজের ঘর বাঁচাতে তৈমুর নিজ অঞ্চলে ফিরে আসেন। তৈমুরের বিশাল বাহিনীর হাতে পরাজয় ঘটে তোকতামিশ খানের। তোকতামিশ খান রাশিয়ায় ফেরত যান। তৈমুর ১৩৯২ সালে পুনরায় পশ্চিমে অভিযান চালান এবং ইরাক দখল করে নেন। মঙ্গোল খানদের গৌরব ‘গোল্ডেন হোর্ড’ বা ‘ইলখানাত‘ তৈমুরের নিকট অসহায় পরাজয় বরণ করে। তৈমুরের পূর্বে কেউ ইলখানাত ধ্বংস করতে পারেনি। এবার তিনি রাশিয়ার দিকে অগ্রসর হন। তেরেক নদীর তীরে তোকতামিশ খান এবং তৈমুর ফের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এবারও তৈমুরের কাছে পরাজিত হন তিনি। তৈমুর ১৩৯৫ সালে মস্কো দখল করেন।

অগ্নিস্নাত মস্কোর সামনে দাঁড়িয়ে তৈমুর তৃপ্তির হাসি দেন। তবে তার ক্ষুধা তখনও মিটেনি। সেদিনই মনে মনে ছক কষতে থাকেন তৈমুর। এবার ভারতবর্ষ জয়ের পালা।

ভারতবর্ষে তৈমুর

ভারতবর্ষ আজীবন তৈমুরকে মনে রাখবে তার নৃশংসতার জন্য। ভারতবর্ষের অধিপতি ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভিন্ন নেতারা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। চতুর তৈমুর এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। ১৩৯৮ সালের শেষের দিকে প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিন্ধু নদের পাড়ে হাজির হন তৈমুর লং। দূর থেকে দেখে ভয় পেয়ে যায় ভারতবাসী। যেন তৈমুর নয়, সাক্ষাত যমদূত তার বাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছেন।

সিন্ধু নদ পাড়ি দিয়েই তৈমুর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠেন। নির্বিচারে হত্যা করতে থাকেন সৈন্যদের দিল্লীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন তৈমুর। প্রায় ২০ হাজার সৈন্য হত্যার পরে তিনি দিল্লী গিয়ে পৌঁছান। দিল্লীর সুলতান নাসিরুদ্দিন শাহ তুঘলক হস্তিবাহিনী নিয়ে তৈমুরকে আক্রমণ করে বসেন। বুদ্ধিমান তৈমুর এবার নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন। হাজার হাজার উটের পিঠ খড়ের গাদা দিয়ে বোঝাই করলেন। এরপর খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে উটগুলোকে হস্তিবাহিনীর দিকে হটিয়ে দেন। সুলতানের হস্তিবাহিনী জ্বলন্ত উটের আগ্রাসনে ভয় পেয়ে যায়। অবস্থা হিতে বিপরীত হয়ে যায়। হাতিগুলো উল্টো ঘুরে সুলতানকেই আক্রমণ করে বসে।

নিজেদের বাহিনীর হাতেই পরাজিত হন সুলতান। দিল্লী দখলের আনন্দে তৈমুর বাহিনী দিল্লী জুড়ে বিরোধী সৈন্যের রক্তের বন্যা বসিয়ে দেয়। তৈমুর ভারতবর্ষ শাসন করেননি। অভিযানরত অবস্থায় তৈমুর বাগদাদের দখল হারানোর দুঃসংবাদ লাভ করেন। ১৩৯৯ সালে তৈমুর পুনরায় বাগদাদ আক্রমণ করেন। বরাবরের মতোই তিনি অনায়াসে বাগদাদ দখল করে নেন। এবার তৈমুরের নিষ্ঠুরতা যেন আরো বেড়ে গেলো। তার আদেশে বাগদাদের ২০ হাজার বিদ্রোহীর শিরশ্ছেদ করা হয়।

তথ্যসূত্র

  1. বি.এফ. মান্‌জ, "Tīmūr Lang", in এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম, Online Edition, 2006
  2. The Columbia Electronic Encyclopedia, "Timur", 6th ed., Columbia University Press: "... Timur (timoor') or Tamerlane (tăm'urlān), c.1336–1405, মোঙ্গল বিজেতা, b. কেশ, সমরখন্দের নিকটে. ...", (LINK)
  3. "Timur", in ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ: "... [Timur] was a member of the Turkic Barlas clan of Mongols..."
  4. "Baber", in ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ: "... Baber first tried to recover Samarkand, the former capital of the empire founded by his Mongol ancestor Timur Lenk ..."

বহিঃসংযোগ