আলাউদ্দিন খিলজি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
সম্পাদনা সারাংশ নেই
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
Pratik89Roy (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
'''আলাউদ্দিন খলজি '''[Alauddin Khalji]:'''- '''নিজ '''পিতৃব্য''' ও '''খলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দিন খলজিকে''' হত্যা করে '''আলাউদ্দিন খলজি''' ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন । তিনি ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ইলবেরি তুর্কি আমলে ভারতে দিল্লি সুলতানির যে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, আলাউদ্দিন খলজির সময় তা পরিপূর্ণ রূপ গ্রহন করেছিল । উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সাম্রাজ্য স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার চালু করে নিজ কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন । এই দিক দিয়ে বিচার করলে তাঁকে সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা যেতে পারে । 
'''আলাউদ্দিন খলজি '''[Alauddin Khalji]:'''- '''নিজ '''পিতৃব্য''' ও '''খলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দিন খলজিকে''' হত্যা করে '''আলাউদ্দিন খলজি''' ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন । তিনি ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ইলবেরি তুর্কি আমলে ভারতে দিল্লি সুলতানির যে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, আলাউদ্দিন খলজির সময় তা পরিপূর্ণ রূপ গ্রহন করেছিল । উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সাম্রাজ্য স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার চালু করে নিজ কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন । এই দিক দিয়ে বিচার করলে তাঁকে সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা যেতে পারে । 
<!--
'''♦আলাউদ্দিন খলজির রাজ্যজয়'''[Expansion of the Delhi Sultanate]:'''-''' আলাউদ্দিন খলজি খুব উচ্চাকাঙক্ষী ছিলেন । গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের মতো তিনিও বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেন । কিন্তু কাজি আলা-উল-মূলকের পরামর্শে তিনি এই অসম্ভব পরিকল্পনা ত্যাগ করে সারা ভারত জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনের নীতি গ্রহন করেছিলেন । বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করলেও তিনি তাঁর মুদ্রায় নিজেকে ‘'''দ্বিতীয় আলেকজান্ডার'''’ হিসাবে উল্লেখ করতেন । ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের পাশাপাশি তিনি উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে মোঙ্গল আক্রমণের হাত থেকেও ভারতকে রক্ষা করেন । প্রথমে তিনি ভারতের গুজরাটের রাজা '''কর্ণদেব''', রণ-থম্ভোরের রাজপুত নেতা '''হামির দেব''' , মেবারের রাজা '''রতন সিং''' ও মালবের অধিপতি '''মহ্লক দেব'''কে পরাজিত করেন । এরপর তিনি '''মালিক কাফুরের''' নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন । কাফুর দেবগিরির রাজা '''রামচন্দ্র''', বরঙ্গলের কাকতীয়রাজ '''প্রতাপ রুদ্র''', দোরসমুদ্রের হোয়্সলরাজ '''তৃতীয় বল্লাল'''কে পরাজিত করবার পর ভাতৃবিরোধের সুযোগ নিয়ে '''পান্ড্য''' রাজ্য অধিকার করেন । এরপর তিনি নাকি রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হন । আলাউদ্দিন খলজি অবশ্য দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি সরাসরি সাম্রাজ্যভুক্ত না করে সেখানকার রাজাদের মৌখিক আনুগত্য ও করদানের প্রতিশ্রুতি নিয়েই '''করদ রাজ্যে''' (কর ডাকে স্বীকৃত) পরিণত করেন । বিজেতা হিসাবে আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন দিল্লির সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । স্যার উলসলে হেগের মতে, তাঁর রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গেই সুলতানি সাম্রাজ্যবাদের সুত্রপাত হয় । তাঁর আমলেই প্রথম দক্ষিণ ভারতে সুলতানি সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে । বিজেতা হিসাবে অনেকে তাঁকে আকবরের সঙ্গে তুলনা করেন । কিন্তু এই তুলনা অনেকাংশে অযৌতিক । আলাউদ্দিন খলজির সাম্রাজ্যবাদ কোনো মহৎ আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না । বাহুবলের প্রাধান্যই ছিল এর একমাত্র ভিত্তি । আকবর সম্পর্কে এই কথা বলা চলে না ।  


==রাজ্যজয়==
'''আলাউদ্দিন খলজির শাসনব্যবস্থা'''[Administrative Reforms]:-
আলাউদ্দিন খলজি খুব উচ্চাকাঙক্ষী ছিলেন । গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের মতো তিনিও বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেন । কিন্তু কাজি আলা-উল-মূলকের পরামর্শে তিনি এই অসম্ভব পরিকল্পনা ত্যাগ করে সারা ভারত জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনের নীতি গ্রহন করেছিলেন । বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করলেও তিনি তাঁর মুদ্রায় নিজেকে ‘'''দ্বিতীয় আলেকজান্ডার'''’ হিসাবে উল্লেখ করতেন । ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের পাশাপাশি তিনি উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে মোঙ্গল আক্রমণের হাত থেকেও ভারতকে রক্ষা করেন । প্রথমে তিনি ভারতের গুজরাটের রাজা '''কর্ণদেব''', রণ-থম্ভোরের রাজপুত নেতা '''হামির দেব''' , মেবারের রাজা '''রতন সিং''' ও মালবের অধিপতি '''মহ্লক দেব'''কে পরাজিত করেন । এরপর তিনি '''মালিক কাফুরের''' নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন । কাফুর দেবগিরির রাজা '''রামচন্দ্র''', বরঙ্গলের কাকতীয়রাজ '''প্রতাপ রুদ্র''', দোরসমুদ্রের হোয়্সলরাজ '''তৃতীয় বল্লাল'''কে পরাজিত করবার পর ভাতৃবিরোধের সুযোগ নিয়ে '''পান্ড্য''' রাজ্য অধিকার করেন । এরপর তিনি নাকি রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হন । আলাউদ্দিন খলজি অবশ্য দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি সরাসরি সাম্রাজ্যভুক্ত না করে সেখানকার রাজাদের মৌখিক আনুগত্য ও করদানের প্রতিশ্রুতি নিয়েই '''করদ রাজ্যে''' (কর ডাকে স্বীকৃত) পরিণত করেন । বিজেতা হিসাবে আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন দিল্লির সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । স্যার উলসলে হেগের মতে, তাঁর রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গেই সুলতানি সাম্রাজ্যবাদের সুত্রপাত হয় । তাঁর আমলেই প্রথম দক্ষিণ ভারতে সুলতানি সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে । বিজেতা হিসাবে অনেকে তাঁকে আকবরের সঙ্গে তুলনা করেন । কিন্তু এই তুলনা অনেকাংশে অযৌতিক । আলাউদ্দিন খলজির সাম্রাজ্যবাদ কোনো মহৎ আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না । বাহুবলের প্রাধান্যই ছিল এর একমাত্র ভিত্তি । আকবর সম্পর্কে এই কথা বলা চলে না ।  

==শাসনব্যবস্থা==


'''(১) শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন''' : সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিন খলজি প্রশাসনিক সংস্কারের দিকেও মন দেন । তিনি ছিলেন স্বৈরতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক । কেন্দ্রীয় স্বৈরাচারী শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলেন । দিল্লির সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন । নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি উলেমাদেরও অগ্রাহ্য করতেন । কথা প্রসঙ্গে একবার তিনি মুঘুসউদ্দিনকে বলেছিলেন—”আমিই সেই সব নির্দেশ জারি করি, যা রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে এবং জনগণের মঙ্গল সাধন হয় । আমি জানি না কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ । রাষ্ট্রের পক্ষে যা মঙ্গলজনক আমি তাই করি ।” ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মতো তিনিও বলতে পারতেন, “রাষ্ট্র কী ? আমিই রাষ্ট্র ।” কেন্দ্রে নিজ কর্তৃত্বাধীনে একটি কঠোর অথচ সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা জারি করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য । শুধু উলেমাদের নয়, আমির-ওমরাহদেরও তিনি মাথা তুলতে দেন নি এবং তাদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য এবং বিদ্রোহের মূল উৎপাটনের উদ্দেশ্যে তিনি তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট মেলামেশা ও খানাপিনা বন্ধ করে দেন । ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর আক্রমণ করে তিনি সমস্ত রকম ভাতা বন্ধ করে দেন । যে সব জায়গির দেওয়া হয়েছিল. সেগুলি বাজেয়াপ্ত করে সরকারের খাস জমিতে পরিণত করা হয় । এইভাবে অভিজাতদের উপর আক্রমণ করে তিনি বিদ্রোহের মূল উৎপাটন করেন । 
'''(১) শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন''' : সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিন খলজি প্রশাসনিক সংস্কারের দিকেও মন দেন । তিনি ছিলেন স্বৈরতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক । কেন্দ্রীয় স্বৈরাচারী শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলেন । দিল্লির সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন । নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি উলেমাদেরও অগ্রাহ্য করতেন । কথা প্রসঙ্গে একবার তিনি মুঘুসউদ্দিনকে বলেছিলেন—”আমিই সেই সব নির্দেশ জারি করি, যা রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে এবং জনগণের মঙ্গল সাধন হয় । আমি জানি না কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ । রাষ্ট্রের পক্ষে যা মঙ্গলজনক আমি তাই করি ।” ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মতো তিনিও বলতে পারতেন, “রাষ্ট্র কী ? আমিই রাষ্ট্র ।” কেন্দ্রে নিজ কর্তৃত্বাধীনে একটি কঠোর অথচ সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা জারি করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য । শুধু উলেমাদের নয়, আমির-ওমরাহদেরও তিনি মাথা তুলতে দেন নি এবং তাদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য এবং বিদ্রোহের মূল উৎপাটনের উদ্দেশ্যে তিনি তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট মেলামেশা ও খানাপিনা বন্ধ করে দেন । ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর আক্রমণ করে তিনি সমস্ত রকম ভাতা বন্ধ করে দেন । যে সব জায়গির দেওয়া হয়েছিল. সেগুলি বাজেয়াপ্ত করে সরকারের খাস জমিতে পরিণত করা হয় । এইভাবে অভিজাতদের উপর আক্রমণ করে তিনি বিদ্রোহের মূল উৎপাটন করেন । 
২১ নং লাইন: ২২ নং লাইন:
(৪) বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রবর্তন করেছিলেন ।
(৪) বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রবর্তন করেছিলেন ।


কিন্তু প্রজাপালন এবং জনকল্যাণ যদি কোনো রাষ্ট্রনায়কের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাটি হয়, তাহলে আলাউদ্দিন খলজিকে সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা যায় না ।-->
কিন্তু প্রজাপালন এবং জনকল্যাণ যদি কোনো রাষ্ট্রনায়কের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাটি হয়, তাহলে আলাউদ্দিন খলজিকে সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা যায় না ।

০৮:৫৯, ২০ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

আলাউদ্দিন খলজি [Alauddin Khalji]:নিজ পিতৃব্য ও খলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দিন খলজিকে হত্যা করে আলাউদ্দিন খলজি ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন । তিনি ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ইলবেরি তুর্কি আমলে ভারতে দিল্লি সুলতানির যে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, আলাউদ্দিন খলজির সময় তা পরিপূর্ণ রূপ গ্রহন করেছিল । উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সাম্রাজ্য স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার চালু করে নিজ কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন । এই দিক দিয়ে বিচার করলে তাঁকে সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা যেতে পারে । 

রাজ্যজয়

আলাউদ্দিন খলজি খুব উচ্চাকাঙক্ষী ছিলেন । গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের মতো তিনিও বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেন । কিন্তু কাজি আলা-উল-মূলকের পরামর্শে তিনি এই অসম্ভব পরিকল্পনা ত্যাগ করে সারা ভারত জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনের নীতি গ্রহন করেছিলেন । বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করলেও তিনি তাঁর মুদ্রায় নিজেকে ‘দ্বিতীয় আলেকজান্ডার’ হিসাবে উল্লেখ করতেন । ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের পাশাপাশি তিনি উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে মোঙ্গল আক্রমণের হাত থেকেও ভারতকে রক্ষা করেন । প্রথমে তিনি ভারতের গুজরাটের রাজা কর্ণদেব, রণ-থম্ভোরের রাজপুত নেতা হামির দেব , মেবারের রাজা রতন সিং ও মালবের অধিপতি মহ্লক দেবকে পরাজিত করেন । এরপর তিনি মালিক কাফুরের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন । কাফুর দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র, বরঙ্গলের কাকতীয়রাজ প্রতাপ রুদ্র, দোরসমুদ্রের হোয়্সলরাজ তৃতীয় বল্লালকে পরাজিত করবার পর ভাতৃবিরোধের সুযোগ নিয়ে পান্ড্য রাজ্য অধিকার করেন । এরপর তিনি নাকি রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হন । আলাউদ্দিন খলজি অবশ্য দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি সরাসরি সাম্রাজ্যভুক্ত না করে সেখানকার রাজাদের মৌখিক আনুগত্য ও করদানের প্রতিশ্রুতি নিয়েই করদ রাজ্যে (কর ডাকে স্বীকৃত) পরিণত করেন । বিজেতা হিসাবে আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন দিল্লির সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । স্যার উলসলে হেগের মতে, তাঁর রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গেই সুলতানি সাম্রাজ্যবাদের সুত্রপাত হয় । তাঁর আমলেই প্রথম দক্ষিণ ভারতে সুলতানি সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে । বিজেতা হিসাবে অনেকে তাঁকে আকবরের সঙ্গে তুলনা করেন । কিন্তু এই তুলনা অনেকাংশে অযৌতিক । আলাউদ্দিন খলজির সাম্রাজ্যবাদ কোনো মহৎ আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না । বাহুবলের প্রাধান্যই ছিল এর একমাত্র ভিত্তি । আকবর সম্পর্কে এই কথা বলা চলে না ।  

শাসনব্যবস্থা

(১) শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন : সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিন খলজি প্রশাসনিক সংস্কারের দিকেও মন দেন । তিনি ছিলেন স্বৈরতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক । কেন্দ্রীয় স্বৈরাচারী শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলেন । দিল্লির সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন । নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি উলেমাদেরও অগ্রাহ্য করতেন । কথা প্রসঙ্গে একবার তিনি মুঘুসউদ্দিনকে বলেছিলেন—”আমিই সেই সব নির্দেশ জারি করি, যা রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে এবং জনগণের মঙ্গল সাধন হয় । আমি জানি না কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ । রাষ্ট্রের পক্ষে যা মঙ্গলজনক আমি তাই করি ।” ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মতো তিনিও বলতে পারতেন, “রাষ্ট্র কী ? আমিই রাষ্ট্র ।” কেন্দ্রে নিজ কর্তৃত্বাধীনে একটি কঠোর অথচ সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা জারি করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য । শুধু উলেমাদের নয়, আমির-ওমরাহদেরও তিনি মাথা তুলতে দেন নি এবং তাদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য এবং বিদ্রোহের মূল উৎপাটনের উদ্দেশ্যে তিনি তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট মেলামেশা ও খানাপিনা বন্ধ করে দেন । ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর আক্রমণ করে তিনি সমস্ত রকম ভাতা বন্ধ করে দেন । যে সব জায়গির দেওয়া হয়েছিল. সেগুলি বাজেয়াপ্ত করে সরকারের খাস জমিতে পরিণত করা হয় । এইভাবে অভিজাতদের উপর আক্রমণ করে তিনি বিদ্রোহের মূল উৎপাটন করেন । 

(২) বাজারদর নিয়ন্ত্রণ [Market Regulation]:  তিনি সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করেন এবং সৈনিকরা যাতে অল্প দামে জিনিস পত্র কিনতে পারেন তার জন্য বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করেন এবং রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, কারণ তিনি সৈনিকদের বেশি বেতন দিতেন না । ব্যবসায়ীরা যাতে মূল্যের বেশি টাকা দাবি না করে, তার জন্য তিনি কঠোর প্রসাশনিক ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলেন । বিষয়টির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলে ‘শাহানা-ই-মান্ডি’ ও ‘দেওয়ান-ই-রিসালাত’ -এর উপর ।  আলাউদ্দিন খলজির লক্ষ্য ছিল সম্ভবত মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা ও ব্যবসায়ীরা যাতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে না পারে, তার দিকে লক্ষ রাখা ; কিন্তু তাই বলে ব্যবসায়ীরা একবারে বিনা লাভে বিক্রি করতো এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই । আলাউদ্দিন খলজির দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সফল হয়েছিল এবং এর দ্বারা সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষও কিছুটা উপকৃত হয়েছিল । অবশ্য ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে না পারায় মনঃক্ষুন্ন এবং অসন্তুষ্ট হয়েছিল । কিন্তু তাদের কিছু করার ছিল না । যতদিন আলাউদ্দিন খলজি জীবিত ছিলেন, ততদিন এইসব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কঠোর ভাবে মানা হয় । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর এই ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে । 

(৩) রাজস্ব ও অন্যান্য সংস্কার [Land Revenue and other Reforms]:  অন্যদিকে দিল্লী সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম জমি জরিপ করে রাজস্বব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন । দেশে যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে সেদিকেও তিনি নজর দেন । অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বিধান দেওয়া হত । গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি দেশের সমস্ত খবরাখবর রাখতেন । জনগণের সক্রিয় সমর্থন, শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা তিনি হয়তো পান নি; কিন্তু এক সুদৃঢ় ও কঠোর শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে দিল্লি সুলতানিকে এক শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন । 

মূল্যায়ন [Evaluation]: যুদ্ধ বিজেতা এবং প্রসাশক হিসাবে আলাউদ্দিন খলজি সুলতানি আমলে অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দেন । অর্থনৈতিক সংস্কারের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে আলাউদ্দিন ছিলেন মধ্যযুগের ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক, যিনি

(১) জমি জরিপ করিয়েছিলেন ,

(২) জায়গির দান বা ভূমিদান প্রথার অবলুপ্তি ঘটিয়েছিলেন ।

(৩) উচ্চ হারে রাজস্ব ও কর ধার্য করেছিলেন

(৪) বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রবর্তন করেছিলেন ।

কিন্তু প্রজাপালন এবং জনকল্যাণ যদি কোনো রাষ্ট্রনায়কের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাটি হয়, তাহলে আলাউদ্দিন খলজিকে সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা যায় না ।