বালাকোট যুদ্ধ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Nirbochon (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
WikitanvirBot (আলোচনা | অবদান)
বট বানান ঠিক করছে, কোনো সমস্যায় তানভিরের আলাপ পাতায় বার্তা রাখুন
৩২ নং লাইন: ৩২ নং লাইন:


== বালাকোট যুদ্ধের পটভূমি ==
== বালাকোট যুদ্ধের পটভূমি ==
তৎকালীন পেশোয়ারের সুলতান মুহাম্মাদ খাতেনের ষড়যন্ত্রে ইসলামী হুকুমতের ক্বাযী, তহসিলদারসহ বহু কর্মচারীর গণহত্যার ঘটনায় সাইয়েদ আহমাদ অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং তিনি দ্বিতীয় দফা হিজরত করার মানসে কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। [[সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী|সাইয়েদ আহমাদ শহীদ]] (রহঃ) যে পাঞ্জতার নামক স্থানে অবস্থানরত মুজাহিদ গোত্র ত্যাগ করেন এবং হাযারা জেলার উচ্চভূমির দিকে গমন করেন, তার উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে কেন্দ্র স্থাপন করে উপমহাদেশকে বিধর্মী ও বিদেশীদের জবর দখল হতে মুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি গ্রহণে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল এই বালাকোট, সেকারণ এখানেই সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। অবশ্য প্রথম দিকে প্রধান সামরিক ঘাঁটি রাওয়ালপিণ্ডিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। [[সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী|সাইয়েদ আহমাদ শহীদ]] (রহঃ) তাঁর দীর্ঘ চার বছরের পাঞ্জতার ঘাঁটি ছেড়ে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়টি ছিল ডিসেম্বরের বরফঢাকা শীতকাল। সাইয়্যিদ আহমাদ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে যে এলাকাটি ত্যাগ করেছিলেন শিখরা শীঘ্রই সে এলাকাটি দখল করে তথাকার জনগণের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করল। এ সময় কাশ্মীর গমনের পথে বিভিন্ন এলাকার খান ও সামন্তগণ যেমন- মুজাফ্ফরাবাদের শাসনকর্তা যবরদস্ত খান, খুড়া অঞ্চলের সামন্ত নাজা খান, দেরাবা অঞ্চলের সামন্ত মানসুর খান ও গাঢ়ী অঞ্চলের সামন্ত হাবীবুল¬াহ খান প্রমুখ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সাইয়েদ আহমাদ এই আবেদনে সাড়া দিয়ে যবরদস্ত খানের সাহায্যার্থে মৌলবী খায়রুদ্দীন শেরকুটীর নেতৃত্বে একদল মুহাজিদ মুযাফ্ফরবাদে প্রেরণ করলেন। এদিকে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিংহ-এর পুত্র শেরসিংহ বিরাট বাহিনী নিয়ে নখলী নামক স্থানে পৌঁছে যায়। ফলে সাইয়েদ আহমাদ উক্ত বাহিনী কোন দিকে অগ্রসর হয় তার গতিপথ নির্ণয় করে পরবর্তী করণীয় স্থির করাকে সমীচীন মনে করলেন। এ সময় তিনি মূল গন্তব্য কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নিমিত্তে শের সিং-এর বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে এগিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কারণ হাযারাবেলাতে অবস্থানকারী সাইয়েদ আহমাদ-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পৃক্ত খানদের শিখ সেনারা অত্যাচারের শিকার বানাত। তাই তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত হাযারাতেই থেকে গেলেন। পরে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে, শের সিংহ ভূগাড়মুঙ্গ গিরিপথ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে, তখন তিনি নিজে রাজদারওয়ান নামক স্থান হতে সারচুল নামক স্থানে পৌঁছান এবং শাহ ইসমাঈল শহীদকে বালাকোট পাঠিয়ে দিলেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, শের সিং বালাকোট আক্রমন করতে পারে তখন তিনি ভুগাড়মুঙ্গের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিজেই বালাকোটে চলে গেলেন। আর সেই সময় শের সিং-এর বাহিনী কুনহার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত সোহাল নাজাফ খান গ্রামের সম্মুখে ময়দান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে।
তৎকালীন পেশোয়ারের সুলতান মুহাম্মাদ খাতেনের ষড়যন্ত্রে ইসলামী হুকুমতের ক্বাযী, তহসিলদারসহ বহু কর্মচারীর গণহত্যার ঘটনায় সাইয়েদ আহমাদ অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং তিনি দ্বিতীয় দফা হিজরত করার মানসে কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। [[সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী|সাইয়েদ আহমাদ শহীদ]] (রহঃ) যে পাঞ্জতার নামক স্থানে অবস্থানরত মুজাহিদ গোত্র ত্যাগ করেন এবং হাযারা জেলার উচ্চভূমির দিকে গমন করেন, তার উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে কেন্দ্র স্থাপন করে উপমহাদেশকে বিধর্মী ও বিদেশীদের জবর দখল হতে মুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি গ্রহণে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল এই বালাকোট, সেকারণ এখানেই সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। অবশ্য প্রথম দিকে প্রধান সামরিক ঘাঁটি রাওয়ালপিণ্ডিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। [[সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী|সাইয়েদ আহমাদ শহীদ]] (রহঃ) তাঁর দীর্ঘ চার বছরের পাঞ্জতার ঘাঁটি ছেড়ে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়টি ছিল ডিসেম্বরের বরফঢাকা শীতকাল। সাইয়্যিদ আহমাদ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে যে এলাকাটি ত্যাগ করেছিলেন শিখরা শীঘ্রই সে এলাকাটি দখল করে তথাকার জনগণের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করল। এ সময় কাশ্মীর গমনের পথে বিভিন্ন এলাকার খান ও সামন্তগণ যেমন- মুজাফ্ফরাবাদের শাসনকর্তা যবরদস্ত খান, খুড়া অঞ্চলের সামন্ত নাজা খান, দেরাবা অঞ্চলের সামন্ত মানসুর খান ও গাঢ়ী অঞ্চলের সামন্ত হাবীবুল¬াহ খান প্রমুখ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সাইয়েদ আহমাদ এই আবেদনে সাড়া দিয়ে যবরদস্ত খানের সাহায্যার্থে মৌলবী খায়রুদ্দীন শেরকুটীর নেতৃত্বে একদল মুহাজিদ মুযাফ্ফরবাদে প্রেরণ করলেন। এদিকে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিংহ-এর পুত্র শেরসিংহ বিরাট বাহিনী নিয়ে নখলী নামক স্থানে পৌঁছে যায়। ফলে সাইয়েদ আহমাদ উক্ত বাহিনী কোন দিকে অগ্রসর হয় তার গতিপথ নির্ণয় করে পরবর্তী করণীয় স্থির করাকে সমীচীন মনে করলেন। এ সময় তিনি মূল গন্তব্য কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নিমিত্তে শের সিং-এর বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে এগিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কারণ হাযারাবেলাতে অবস্থানকারী সাইয়েদ আহমাদ-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পৃক্ত খানদের শিখ সেনারা অত্যাচারের শিকার বানাত। তাই তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত হাযারাতেই থেকে গেলেন। পরে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে, শের সিংহ ভূগাড়মুঙ্গ গিরিপথ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে, তখন তিনি নিজে রাজদারওয়ান নামক স্থান হতে সারচুল নামক স্থানে পৌঁছান এবং শাহ ইসমাঈল শহীদকে বালাকোট পাঠিয়ে দিলেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, শের সিং বালাকোট আক্রমণ করতে পারে তখন তিনি ভুগাড়মুঙ্গের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিজেই বালাকোটে চলে গেলেন। আর সেই সময় শের সিং-এর বাহিনী কুনহার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত সোহাল নাজাফ খান গ্রামের সম্মুখে ময়দান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে।


== ঘটনাপ্রবাহ ==
== ঘটনাপ্রবাহ ==

০৫:০২, ২ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

বালাকোট যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: ভারত উপমহাদেশের প্রথম জিহাদ আন্দোলন
চিত্র:Balakot.map.jpg
বালাকোট ম্যাপ
তারিখ৬মে, ১৮৩১ইং
অবস্থান
ফলাফল মুসলিম বাহিনীর মর্মান্তিক বিপর্যয়
অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ
বিবাদমান পক্ষ
শিখ বাহিনী মুসলিম বাহিনী
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
শেরসিংহ(শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিংহ-এর পুত্র) সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী
শাহ ইসমাঈল শহীদ
শক্তি
১০,০০০ শিখ সৈন্য ৭০০ মুজাহিদ
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
৭০০ জন নিহত ৩০০ জন নিহত
সাতবানে ঝর্ণার উপর বালাকোট যুদ্ধের মূল কেন্দ্র।

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজ বণিকরা এ অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃটিশ রাজদণ্ডের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের উপর এক জোরজবরদস্তি মূলক আধিপত্যবাদী শাসন কায়েম করে। একদিকে এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অন্যদিকে স্বয়ং মুসলিম সমাজের ইসলামী জীবনাচরণে দীর্ঘকাল যাবৎ বিপুল অনৈসলামিক আক্বীদা-বিশ্বাসের শক্ত অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলে এক সর্বব্যাপী সংস্কারমূলক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। সেই অনাগত বিপ্লবের হাতছানিই যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে সাইয়েদ আহমাদ শহীদের ‘তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়া’ আন্দোলনের হাত ধরে উপমহাদেশের শিরক-বিদ‘আতী জঞ্জালের অন্ধকার গহ্বরে তাওহীদী নবপ্রভাতের সূচনা ঘটায়। এই আন্দোলনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ঘটে যায় বালাকোট যুদ্ধ । ১৮৩১ সালের ৬ মে সংঘটিত ঐতিহাসিক এই বালাকোট যুদ্ধ একদিকে যেমন ছিল এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের জন্য চরম বিপর্যয়ের, অপরদিকে বিদেশী বেনিয়াদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য উপমহাদেশের বুকে পরিচালিত সর্বপ্রথম সুসংঘবদ্ধ রণডঙ্কা।[১][২]

বালাকোট পরিচিতি

বালাকোট শহর পাকিস্থানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খাইবার-পাখতুনখাওয়ার (সাবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) হাযারা অঞ্চলভুক্ত মানসেহরা জেলা থেকে ৩৮ কি: মি: পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত। চারিদিকে উচ্চ পাহাড়ঘেরা দূর্গম এই ঐতিহাসিক শহরটি আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল হিসাবে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। শহরটি কাগান উপত্যাকার প্রবেশমুখ। লালাসার লেক থেকে উৎসারিত কুনহার নদী এই শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে পাকিস্থান শাসিত কাশ্মীরে ঝিলাম নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। জনৈক বালাপীরের নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় বলে জানা যায়। প্রাচীন বালাকোটে যেখানে ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল পার্শ্ববর্তী মেটিকোট টিলা ও ঝরণা এলাকায়। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ৮ই অক্টোবর এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে শহরটি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে সঊদী আরব, আরব আমিরাত ও পাকিস্তান সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় শহরটি আবার গড়ে তোলা হচ্ছে।f[৩]

সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর পরিচয়

সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) জন্মগ্রহণ করেন ২৯ই নভেম্বর ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দে ভারতের অযোধ্যা যেলায় একটি সুপ্রসিদ্ধ বংশে। তাঁর বংশতালিকা চতুর্থ খলীফা আলী (আঃ)-এর সাথে মিলিত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশদের বিরুদ্ধে পরিচালিত স্বাধীনতা সঙগ্রামের প্রথম সংঘবদ্ধ প্রয়াস ছিল ‘জিহাদ আন্দোলন’। যা সম্ভব হয়েছিল সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভীর মত একজন সিংহকেশর, দৃঢ়চিত্ত বিপ্লবী পুরুষ এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন একদল বিশুদ্ধ আত্মার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে। এজন্য ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর নামটি প্রাতঃস্বরণীয় হয়ে আছে।

বালাকোট যুদ্ধের পটভূমি

তৎকালীন পেশোয়ারের সুলতান মুহাম্মাদ খাতেনের ষড়যন্ত্রে ইসলামী হুকুমতের ক্বাযী, তহসিলদারসহ বহু কর্মচারীর গণহত্যার ঘটনায় সাইয়েদ আহমাদ অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং তিনি দ্বিতীয় দফা হিজরত করার মানসে কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) যে পাঞ্জতার নামক স্থানে অবস্থানরত মুজাহিদ গোত্র ত্যাগ করেন এবং হাযারা জেলার উচ্চভূমির দিকে গমন করেন, তার উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে কেন্দ্র স্থাপন করে উপমহাদেশকে বিধর্মী ও বিদেশীদের জবর দখল হতে মুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি গ্রহণে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল এই বালাকোট, সেকারণ এখানেই সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। অবশ্য প্রথম দিকে প্রধান সামরিক ঘাঁটি রাওয়ালপিণ্ডিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) তাঁর দীর্ঘ চার বছরের পাঞ্জতার ঘাঁটি ছেড়ে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়টি ছিল ডিসেম্বরের বরফঢাকা শীতকাল। সাইয়্যিদ আহমাদ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে যে এলাকাটি ত্যাগ করেছিলেন শিখরা শীঘ্রই সে এলাকাটি দখল করে তথাকার জনগণের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করল। এ সময় কাশ্মীর গমনের পথে বিভিন্ন এলাকার খান ও সামন্তগণ যেমন- মুজাফ্ফরাবাদের শাসনকর্তা যবরদস্ত খান, খুড়া অঞ্চলের সামন্ত নাজা খান, দেরাবা অঞ্চলের সামন্ত মানসুর খান ও গাঢ়ী অঞ্চলের সামন্ত হাবীবুল¬াহ খান প্রমুখ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সাইয়েদ আহমাদ এই আবেদনে সাড়া দিয়ে যবরদস্ত খানের সাহায্যার্থে মৌলবী খায়রুদ্দীন শেরকুটীর নেতৃত্বে একদল মুহাজিদ মুযাফ্ফরবাদে প্রেরণ করলেন। এদিকে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিংহ-এর পুত্র শেরসিংহ বিরাট বাহিনী নিয়ে নখলী নামক স্থানে পৌঁছে যায়। ফলে সাইয়েদ আহমাদ উক্ত বাহিনী কোন দিকে অগ্রসর হয় তার গতিপথ নির্ণয় করে পরবর্তী করণীয় স্থির করাকে সমীচীন মনে করলেন। এ সময় তিনি মূল গন্তব্য কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নিমিত্তে শের সিং-এর বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে এগিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কারণ হাযারাবেলাতে অবস্থানকারী সাইয়েদ আহমাদ-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পৃক্ত খানদের শিখ সেনারা অত্যাচারের শিকার বানাত। তাই তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত হাযারাতেই থেকে গেলেন। পরে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে, শের সিংহ ভূগাড়মুঙ্গ গিরিপথ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে, তখন তিনি নিজে রাজদারওয়ান নামক স্থান হতে সারচুল নামক স্থানে পৌঁছান এবং শাহ ইসমাঈল শহীদকে বালাকোট পাঠিয়ে দিলেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, শের সিং বালাকোট আক্রমণ করতে পারে তখন তিনি ভুগাড়মুঙ্গের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিজেই বালাকোটে চলে গেলেন। আর সেই সময় শের সিং-এর বাহিনী কুনহার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত সোহাল নাজাফ খান গ্রামের সম্মুখে ময়দান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে।

ঘটনাপ্রবাহ

চিত্র:DSC02456.JPG
মেটিকোট পাহাড়ের পাদদেশে শিখ বাহিনীর অবস্থানস্থল।

একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া আবশ্যক যে, শিখ বাহিনীর অবস্থান থেকে বালাকোটে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করার দু’টি পথ ছিল। প্রথমত : কুনহার নদীর পূর্ব তীর বরাবর উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ার পর নদী পার হয়ে বালাকোটে পৌঁছনো। দ্বিতীয়ত : ভুগাড়মুঙ্গের গিরিপথের মধ্য দিয়ে বালাকোটে পৌঁছনো। মূলত বালাকোটে পৌঁছনোর জন্য তাদের সোজা কোন পথ ছিল না। কেননা বালাকোটের পূর্ব দিকে কালুখানের উচ্চচূড়া পশ্চিম দিকে মেটিকোট পর্বত শিখর ও উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত কুনহার নদী। বালাকোট মূলত দক্ষিণমুখী একটি উপত্যকার নাম। কুনহার নদীর উৎসমুখ ছাড়া এখানে প্রবেশের কোন পথ নেই। সঙ্গত কারণেই অনেক কষ্টে মুজাহিদ বাহিনীসহ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী ১৮৩১ সালে ১৭ এপ্রিল বালাকোটে প্রবেশ করেন। উপমহাদেশের জিহাদ আন্দোলনের পথিকৃৎ, সমরকুশলী, আল্লাহ্র পথের নিবেদিতপ্রাণ বীর সিপাহসালার সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী তাঁর সূক্ষ্ম পরিকল্পনা মাফিক বালাকোটে প্রবেশ করা যায় এমন ধরনের কয়েকটি স্থানে প্রতিরক্ষামূলক সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিলেন। বলা যায়, রাসূল (ছাঃ) উহুদ যুদ্ধের সময় গিরিপথ বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে স্বশস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করেন সে পদ্ধতিকেই তিনি অনুসরণ করেছিলেন। কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ায় পর শিখ শিবিরে অগ্রযাত্রার লক্ষণ আঁচ করা গেল। শিখ সৈন্যরা পারাপারের সুবিধার জন্য আগেই নদীর উপর একটি কাঠের সাঁকো নির্মাণ করে রেখেছিল। সেই সাঁকোর উপর দিয়ে নদী পার হয়ে শিখ সৈন্যরা সোহাল নাজাফ খান গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে এবং সোহাল গ্রামের পার্বত্যাঞ্চলের পাদদেশে দিয়ে সাইয়েদ আহমাদের মুজাহিদ বাহিনী ঢাকা গ্রামের পশ্চাতে পৌঁছান। আর সেই দিকেই বালাকোটের দক্ষিণাংশে খাড়েয়্যানের কাছে এবং পূর্ব দিকে সাঁকোর কাছে তিনি সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিলেন। এইভাবে মেটিকোটে ও উহার পাহাড়ী রাস্তায় একেকটি করে সামরিক চৌঁকি বসিয়ে রেখেছিলেন। আর সর্বাগ্রের চৌঁকির নেতা ছিলেন মীর্যা আহমাদ বেগ খান। অকস্মাৎ তার চৌঁকির দিক হতে গুলির শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই জানা গেল যে, শিখ সৈন্যগণ এদিক দিয়েই বালাকোটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মীর্যা আহমাদ বেগ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মুজাহিদ বাহিনী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শিখ বাহিনীকে প্রতিরোধ ও গতিরোধ করার চেষ্টা চালালে তাদের একাংশ শাহাদত বরণ করেন এবং বাকী অংশ পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হন। তারপর মেটিকোটে স্থাপিত চৌকিরত মুজাহিদদেরকে তাদের পথ দিয়ে শিখ বাহিনীর প্রবেশ করার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হল। এমনকি বালাকোটেও পৌঁছিয়ে দেওয়া হল। তবে শিখ সেনাদের গতিরোধ করা কোনমতেই সম্ভব হল না। বিপুল সংখ্যক সৈন্য মেটিকোটে পৌঁছে গেল। আর মেটিকোট মূলত একটি পাহাড়, যার পাদদেশের সমতল ভূমিই হচ্ছে বালাকোট। বালাকোট অঞ্চলের একটি প্রবাদ আছে যে, মেটিকোট যার অধিকারে আসবে, বালাকোট তাহারই অধিকার আসিবে’। সুতরাং যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের বিষয়টি আগেই নির্ধারণ হয়ে গেল। ফলে মুজাহিদদের সংখ্যাল্পতা ও রসদ-সমরাস্ত্রে অপ্রতুলতা সত্ত্বেও সাইয়েদ আহমাদের জন্য বালাকোটের পশ্চিমাংশের অবস্থিত প্রান্তরে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর রইল না। এখানে একটি কথা বলে নেওয়া ভাল যে, এমত পরিস্থিতিতে যদি সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী আপাতত যুদ্ধ এড়াবার জন্য পিছন দিকে চলে যেতেন তাহলে শিখ সৈন্যগণ তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করতে পারত না। অথবা তিনি নদী পার হয়ে পূর্ব তীরে পৌঁছেও আক্রমণ করতে পারতেন। আর এ ব্যাপারে যেসব মুসলিম গ্রামবাসী অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাপে পড়ে শিখদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন তারাও গোপনে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ইতিহাস যে সাক্ষ্যটি এ যাবৎ বহন করে চলছে তা যে আরশে আযীমের অধিপতির পক্ষ হতে বহুকাল পূর্বেই নির্ণিত হয়ে রয়েছে। সুতরাং সর্বদিক ভেবে তিনি শিখদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কোনরূপ রণকৌশল নয়; বরং বীরত্ব, সাহসিকতা ও ঈমানী শক্তির যে মূল্যবান সম্পদ মুজাহিদগণের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, তাকে সম্বল করেই শিখদের বিপুল সমরশক্তির মুকাবিলা করে যাওয়াকে এবং তার পরিণতিকে আল্ল¬াহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়াকেই স্বীয় কর্তব্য বলে গ্রহণ করলেন।

৫ই মে শিখ সৈন্যগণ মেটিকোট পাহাড়ের শিখরে আরোহন করতে সক্ষম হয়েছিল। বিধায় ৬ই মে ১৮৩১ মোতাবেক ২৪ যুলকা’দা ১২৪৬ হিঃ সনে পবিত্র জুম‘আর দিনে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর মুজাহিদ বাহিনী চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন। উল্লে¬খ্য যে, মুজাহিদ বাহিনীতে সর্বমোট যোদ্ধা ছিল ৭০০ জন এবং শিখ সৈন্যদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। শিখ সৈন্যগণ মেটিকোট টিলা হতে বালাকোট ময়দানে অবতরণ করতে আরম্ভ করল। আর সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী এবং অধিকাংশ মুজাহিদ মসজিদে-ই বালা ও তার আশপাশে অবস্থান করছিলেন। উল্লেখ্য যে, ৭০০ জনের মুজাহিদ বাহিনীকে সাতবানে ঝরনা বরাবর বহুদুর পর্যন্ত শিবির স্থাপন করানো হয়েছিল। সায়্যিদ আহমদ ব্রেলভী হঠাৎ শিখদের আক্রমণ করার জন্য মসজিদ-ই বালা হতে বের হয়ে মসজিদে যেরিনে পৌঁছলেন। অতঃপর তিনি মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে মেটিকোটের পাদদেশের দিকে অগ্রসর হলেন। মেটিকোটের পাদদেশে অবতরণরত শিখসেনাদের অধিকাংশ নিহত হল। কিন্তু ইতিমধ্যে মেটিকোটে টিলার প্রতিটি ইঞ্চি পর্যন্ত সৈন্য দ্বারা পূর্ণ হয়েছিল। তারা প্রত্যেক স্থান দিয়ে নেমে এসে মুজাহিদদের উপর প্রচণ্ড হামলা শুরু করে। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী মুজাহিদ বাহিনীর অগ্রভাগে ছিলেন। তার সাথে ছিলেন একান্ত সহযোগী শাহ ইসমাঈল। হঠাৎ করে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী মেটিকোটের ঝরনার মধ্যে শাহাদত বরণ করেন এবং শাহ ইসমাঈলও শাহাদত বরণ করলেন। মুজাহিদগণের একটি বড় দল সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর শাহাদত বরণের বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারায় তাঁর সন্ধানে ঘুরে ঘুরে শাহাদত বরণ করলেন। এছাড়া মুজাহিদদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করেন। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। অতঃপর গোজার গোষ্ঠির লোকজন বিভিন্ন দলে উচ্চৈঃস্বরে প্রচার করতে থাকল যে, সাইয়েদ আহমাদকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা সকলে পাহাড়ের উপরের দিকে আস। ফলে মুজাহিদগণ উত্তর দিকে অবস্থিত পাহাড়ের দিকে গমন করেন। আর এইভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। গোজার গোষ্ঠির লোকদের এরূপ করার কারণ হিসেবে উল্লে¬খ করা যেতে পারে যে, হয় তারা শিখদের প্ররোচনায় তা করেছিল। কেননা মুজাহিদগণ মেটিকোটে যুদ্ধরত থাকলে আরও বহু শিখ যোদ্ধার প্রাণনাশ হত। অথবা অবশিষ্ট মুজাহিদগণকে হিজরতের উদ্দেশ্যে উক্ত কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। মুজাহিদ বাহিনীর আমীর ও প্রধান সেনাপতি সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর শহীদ হওয়া সম্পর্কে অন্য একটি কথা ছড়িয়ে আছে তা হল তিনি মুজাহিদগণের অগ্রভাগে ছিলেন এবং শিখদের একদল সৈন্যের মধ্যে ঢুকে পড়েন। শিখরা তাঁকে ঘেরাও করে ফেলে যা তাঁর অনুসারীরা লক্ষ্য করেননি। এভাবে তিনি শহীদ হন এবং তাঁর লাশও মুজাহিদগণ শনাক্ত করতে পারেননি। এ কারণে অনেককাল পরেও অবশিষ্ট মুজাহিদগণ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর শাহাদতের বিষয়টি সত্য বলে বিশ্বাস করতে পারেননি।

সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর কবর
চিত্র:DSC02333.JPG
শাহ ইসমাঈল শহীদের কবর

একটি বর্ণনা মতে, একজন বন্দী প্রত্যক্ষ করেন যে, তাঁর খণ্ডিত দেহ পাওয়া গিয়েছিল এবং এক নদীর ধারে তাকে কবরস্থ করা হয়েছিল। অনেকেই সেটাকে তাঁর কবর বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু অপর একটি বর্ণনা মতে, তাঁর মস্তক নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল এবং তা কয়েক মাইল ভাটিতে পাওয়া গিয়েছিল। অতঃপর সেটি সেখানে কবরস্থ করা হয়। ওদিকে মুজাহিদগণের মধ্য থেকে প্রায় ৩০০ জন শাহাদাত বরণ করেন। আর ৭০০ জন শিখ সৈন্য নিহত হয়। ১০০০ জন শিখ সেনা নিহত হবার কথাও কোন কোন জায়গায় উল্লে¬খ করা হয়েছে। আর অন্য বর্ণনা মতে, ৬০০ মুজাহিদ শহীদ হন। তবে নির্ভরযোগ্য তথ্য হল, সেখানে ৩০০ মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন আর শিখ সৈন্য নিহত হয় ৭০০ জন। এরপর শিখদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বালাকোটের ঘর-বাড়ীতে আগুন দিয়ে তাদের নিহত সৈন্যদের লাশ তার মধ্যে নিক্ষেপ পূর্বক পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়। শিখদের উক্ত আগুন লাগানোর ফলে মুসলমানদের অপরিমেয় ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। ভস্মীভূত সম্পদের মধ্য হতে উল্লে¬খযোগ্য যা ছিল তা হল সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী ও শাহ ইসমাইল শহীদের অনেক রচনা, পত্রাবলীর পাণ্ডুলিপি, পুস্তিকা ও বক্তৃতাবলীর অনুলিপি। সমসাময়িক যুগের অনেক আলিম, সুলতান ও বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তির পত্রাবলীও সেখানে ছিল। এছাড়া সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর সম্পূর্ণ দফতরই বালাকোটে অবস্থিত ছিল। যেখানে রোজনামচাসহ তাঁর জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনায় রচিত ‘নূর-ই আহমদী’ গ্রন্থটিও সংরক্ষিত ছিল। ঘটনা প্রবাহের শেষ লগ্নে অবশিষ্ট মুজাহিদগণ পালিয়ে উপত্যকার বিপরীতে রাত্রি যাপন করেন। ধীরে ধীরে তারা সেখানে একত্রিত হন এবং আংগ্রাইতে রাত্রিযাপন করেন। দু’জন গুপ্তচর এসে জানালেন যে, সাইয়েদ জীবিত এবং নিরাপদে আছেন। কিছু দূরে তিনি আছেন। মুজাহিদরা পরবর্তী প্রভাত পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করলেন। সূর্যদয়ের পর যখন তাঁরা গোজারদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছলেন তখন সাইয়েদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। মুজাহিদরা যখন তাঁদের নেতাকে নিজেদের মধ্যে অবর্তমান দেখলেন তখন তারা শোকাহত হলেও ভেঙ্গে পড়লেন না। আন্দোলনের লক্ষ্য পরিত্যাগের ধারণা তাঁরা তাদের হৃদয়ে স্থান দেননি। এজন্যে তারা সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত অথবা তারা মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চয়তা লাভ না করা পর্যন্ত দায়িত্বভার আরোপের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন নেতা হিসাবে কুলাতের শাইখ ওয়াদী মুহাম্মাদকে নেতা নির্বাচিত করলেন। এভাবে আন্দোলন অব্যাহত থাকলেও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনটি অচিরেই স্তিমিত হয়ে পড়ে।

পরাজয়ের কারণ

মুজাহিদদের সংখ্যাস্বল্পতা ও রসদপত্রের অপ্রতুলতা যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করলেও পরাজয়ের মুল কারণ ছিল মুসলিম নামধারী মুনাফিকদের বিশ্বাসঘাতকতা। তা ছিল- প্রথমত: যেসব সামন্ত ও খানরা শিখবাহিনীর হাত থেকে তাদেরকে রক্ষার জন্য সাইয়েদ আহমাদকে আহ্বান করেছিল তারা পরবর্তীতে মুসলমানদের সাহায্য না করে গোপনে শিখদের সাথে হাত মিলায়। দ্বিতীয়ত: শিখবাহিনী যখন মেটিকোটে আরোহনের চেষ্টা করছিল তখন সেখানে পাহারায় থাকা মুজাহিদ বাহিনীতে অনুপ্রবেশকারী কিছু মুনাফিক তাদেরকে গোপন পথ বাতলে দেয়। এই চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা না করলে শিখবাহিনী মেটিকোটে প্রবেশ করতে পারত না। তৃতীয়ত: সাইয়েদ আহমাদের সাথে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে হাযারার এক উপজাতীয় প্রধান শিখদেরকে বালাকোটের সাথে সংযুক্ত পাহাড়ের উপরিভাগে উঠার গোপন পথের সন্ধান দেয়। [২] আর পরোক্ষ আরো কিছু কারণ ছিল যেমন :

  1. উপমহাদেশের মূল ভূখণ্ড বাংলা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এক থেকে দুই হাজার অনুসারী সৈয়দ সাহেবের সাথে পশ্চিম সীমান্তে যায়। তারা ইসলামি চেতনাসম্পন্ন ছিল। স্থানীয় পাঠানরা তিন লাখ লোক দিয়ে সহায়তা করলেও এরা সরদার বা গোত্রীয় শাসকের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এই সরদার ও শাসকদের অনেককেই শিখ ও ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ‘কিনে ফেলে’। ফলে দরিদ্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাঠান সিপাহিরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে শত্রুর মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে।
  2. আধুনিক রণকৌশলের প্রশিক্ষণ তেমন ছিল না মুজাহিদ বাহিনীর।
  3. সৈয়দ সাহেব পাঠান নেতা সুলতান মুহাম্মদ খাঁ ও তার ভাইদের বিশ্বাস করে সুলতানকে পেশোয়ারের প্রশাসক বানান। সে বিশ্বাসঘাতকতা করে কয়েক শ’ উঁচুস্তরের মুজাহিদকে এক রাতে শহীদ করেছিল। ফলে পেশোয়ার হাতছাড়া হয়ে যায় সৈয়দ সাহেবের।
  4. কিছু পাঠান জিহাদ করার চেয়ে লুটপাটে বেশি আগ্রহী ছিল।
  5. পাঠানেরা অনেক ক্ষেত্রে শরিয়তি আইনের চেয়ে স্থানীয় কবিলার প্রচলিত আইন পালন করত বেশি। যেমনÑ গরিব পাঠানেরা মেয়েকে বিয়ে দিত যা অনেকটা মেয়ে বেচার মতো, বলপূর্বক বিয়েও সেখানে ছিল, কেউ কেউ চারের অধিক বিবি রাখত, মৃতের ওয়ারিশানের মধ্যে বিধবাদের বাটোয়ারা করত ইত্যাদি।সৈয়দ আহমদ এগুলো সম্পর্কে শরিয়তের আলোকে ফয়সালা দিলেন, যা পাঠানদের মনঃপূত হলো না। এ দিকে ওশর (ফসলের দশমাংশ) ও জাকাত (শতকরা আড়াই ভাগ) বায়তুলমালে দিতে বলা হলে পাঠানেরা রাজি হলো না। পাঠানেরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কমই মানত। সৈয়দ আহমদ সংস্কারমূলক আইনগুলো একসাথে সব বাস্তবায়ন না করে ধীরে ধীরে করলে হয়তো প্রতিক্রিয়া এত উগ্র হতো না।
  6. সৈয়দ সাহেবকে আসলেই মোকাবেলা করতে হয়েছে (যদিও পরোক্ষভাবে) ইউরোপীয়দের, যাদের সূর্য সেই সময় মধ্যগগনে। প্রায় সমগ্র বিশ্বকে তারা কবজা করে ফেলেছিল। সেখানে ছিল স্বার্থপর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিশ্বাসঘাতক সরদার ও তাদের অনুসারীরা।
  7. ফলে এভাবেই ক্ষুদ্র অথচ পর্বতসম ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান মুজাহিদ বাহিনীর চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে।[২]

প্রামাণ্য গ্রন্থপঞ্জী

  • আবুল হাসান নাদভী, সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ।
  • ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পিএইচ.ডি. থিথিস)।
  • ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ।
  • আই, এইচ কুরেশী, উপমহাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ; (ঢাকা, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ : ২০০৫)।
  • মুহাম্মাদ মিঞা, ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী।
  • ড. মুহিব্বুল্ল্যাহ সিদ্দীকী, প্রবন্ধ : বালাকোটের মর্মান্তিক শিক্ষা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন পত্রিকা, এপ্রিল-জুন ২০০৭, পৃ: ৩৩।
  • চেতনার বালাকোট - শেখ জেবুল আমীন দুলাল

তথ্যসূত্র

  1. শেখ জেবুল আমীন দুলাল। চেতনার বালাকোট। ঢাকা। 
  2. ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক (২০১৪)। "বালাকোটের বিপর্যয় ও কারণ"দৈনিক নয়া দিগন্ত 
  3. ঐতিহাসিক বালাকোটের যুদ্ধ : ঘটনাপ্রবাহ, শিহাবুদ্দীন আহমাদ https://ia701200.us.archive.org/21/items/tawheederdak_307/tawheeder_dak_January-february2011.pdf

বহিঃসংযোগ