শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Trinanjon (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
Trinanjon (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
১৪ নং লাইন: ১৪ নং লাইন:


গ্রন্থপ্রকাশের প্রায় ১১ বছর পর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় রমেশ বসু সম্ভবত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের নামকরণকেন্দ্রিক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। এরপর বাংলা সাহিত্যের সারস্বত সমাজে এ-নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক উপস্থিত হয়। যাঁরা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণের বিরোধী ছিলেন, তাঁদের যুক্তি ছিল দ্বিমুখী। প্রথমত, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ একটি আদিরসাত্মক অশ্লীল কাব্য – এতে শ্রী বা কীর্তন কোনওটিই উপস্থিত নেই। দ্বিতীয়ত, পুথির সঙ্গে যে চিরকূটটি পাওয়া যায়, তাতে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব’ বলে একটি কথা লিখিত আছে। অনেকে মনে করেন গ্রন্থের মূল নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’। প্রথম যুক্তিটি আধুনিক কাব্যবিচারের দৃষ্টিতে খুবই দুর্বল; কিন্তু আধুনিক গবেষকগণ দ্বিতীয় দাবিটি প্রসঙ্গেও যথেষ্ট সন্দিহান। <ref>''বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত'', প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২২৯</ref> <ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা সম্পাদিত, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (দ্বিতীয় প্রকাশ), প্রবেশক, পৃষ্ঠা ১১</ref> এই কারণে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব করেছেন, {{cquote|যতদিন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যথার্থ নাম আবিষ্কৃত না হচ্ছে ততদিন সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ প্রদত্ত এই নামটিই স্বীকার করতে হবে।<ref>''বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত'', প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২২৯</ref>}}
গ্রন্থপ্রকাশের প্রায় ১১ বছর পর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় রমেশ বসু সম্ভবত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের নামকরণকেন্দ্রিক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। এরপর বাংলা সাহিত্যের সারস্বত সমাজে এ-নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক উপস্থিত হয়। যাঁরা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণের বিরোধী ছিলেন, তাঁদের যুক্তি ছিল দ্বিমুখী। প্রথমত, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ একটি আদিরসাত্মক অশ্লীল কাব্য – এতে শ্রী বা কীর্তন কোনওটিই উপস্থিত নেই। দ্বিতীয়ত, পুথির সঙ্গে যে চিরকূটটি পাওয়া যায়, তাতে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব’ বলে একটি কথা লিখিত আছে। অনেকে মনে করেন গ্রন্থের মূল নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’। প্রথম যুক্তিটি আধুনিক কাব্যবিচারের দৃষ্টিতে খুবই দুর্বল; কিন্তু আধুনিক গবেষকগণ দ্বিতীয় দাবিটি প্রসঙ্গেও যথেষ্ট সন্দিহান। <ref>''বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত'', প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২২৯</ref> <ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা সম্পাদিত, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (দ্বিতীয় প্রকাশ), প্রবেশক, পৃষ্ঠা ১১</ref> এই কারণে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব করেছেন, {{cquote|যতদিন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যথার্থ নাম আবিষ্কৃত না হচ্ছে ততদিন সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ প্রদত্ত এই নামটিই স্বীকার করতে হবে।<ref>''বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত'', প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২২৯</ref>}}

{{উইকিসংকলন|শ্রীকৃষ্ণকীর্তন}}


==কবি==
==কবি==
১৯ নং লাইন: ২১ নং লাইন:


‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস। যদিও তাঁর আত্মপরিচয় বা জীবনকথা জাতীয় কিছু পাওয়া যায় না বলে তাঁর প্রকৃত পরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কাব্যে তাঁর তিনটি ভণিতা পাওয়া যায় – ‘বড়ুচণ্ডীদাস’, ‘চণ্ডীদাস’ ও ‘আনন্ত বড়ুচণ্ডীদাস’। এর মধ্যে ‘বড়ুচণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ২৯৮টি স্থানে ও ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ১০৭ বার।<ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪</ref> ৭টি পদে ব্যবহৃত ‘আনন্ত’ শব্দটি প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে করা হয়। <ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪</ref> ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা মনে করেন, চণ্ডীদাস তাঁর নাম এবং বড়ু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কৌলিক উপাধি বাঁড়ুজ্যে বা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপভ্রংশ। <ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪</ref> কবি চৈতন্যপূর্ববর্তীকালের মানুষ। সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি জীবিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাঁকুড়া ও [[বীরভূম জেলা|বীরভূমের]] মধ্যে যত বিবাদই বিদ্যমান থাকুক না কেন, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার [[বাঁকুড়া সদর মহকুমা|সদর মহকুমাস্থ]] ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। <ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৫</ref> <ref>প্রবন্ধ ''বাঁকুড়ার উপভাষা ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'', ''বাঁকুড়ার উপভাষা'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, হরষিৎ মিশন, কলকাতা, ১৯৭২</ref> বড়ুচণ্ডীদাস বাসলী দেবীর উপাসক ছিলেন। এই বাসলী দেবী প্রকৃতপক্ষে শক্তিদেবী [[মনসা|মনসার]] অপর নাম।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস। যদিও তাঁর আত্মপরিচয় বা জীবনকথা জাতীয় কিছু পাওয়া যায় না বলে তাঁর প্রকৃত পরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কাব্যে তাঁর তিনটি ভণিতা পাওয়া যায় – ‘বড়ুচণ্ডীদাস’, ‘চণ্ডীদাস’ ও ‘আনন্ত বড়ুচণ্ডীদাস’। এর মধ্যে ‘বড়ুচণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ২৯৮টি স্থানে ও ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ১০৭ বার।<ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪</ref> ৭টি পদে ব্যবহৃত ‘আনন্ত’ শব্দটি প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে করা হয়। <ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪</ref> ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা মনে করেন, চণ্ডীদাস তাঁর নাম এবং বড়ু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কৌলিক উপাধি বাঁড়ুজ্যে বা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপভ্রংশ। <ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪</ref> কবি চৈতন্যপূর্ববর্তীকালের মানুষ। সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি জীবিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাঁকুড়া ও [[বীরভূম জেলা|বীরভূমের]] মধ্যে যত বিবাদই বিদ্যমান থাকুক না কেন, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার [[বাঁকুড়া সদর মহকুমা|সদর মহকুমাস্থ]] ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। <ref>''শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৫</ref> <ref>প্রবন্ধ ''বাঁকুড়ার উপভাষা ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'', ''বাঁকুড়ার উপভাষা'', ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, হরষিৎ মিশন, কলকাতা, ১৯৭২</ref> বড়ুচণ্ডীদাস বাসলী দেবীর উপাসক ছিলেন। এই বাসলী দেবী প্রকৃতপক্ষে শক্তিদেবী [[মনসা|মনসার]] অপর নাম।


{{উইকিসংকলন|শ্রীকৃষ্ণকীর্তন}}


==তথ্যসূত্র==
==তথ্যসূত্র==

০৪:৪৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

চিত্র:RadheShyam07.jpg
অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজস্থানী চিত্রকলায় রাধা ও কৃষ্ণ

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস নামক জনৈক মধ্যযুগীয় কবি রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা বিষয়ক একটি আখ্যানকাব্য। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রাম থেকে এই কাব্যের একটি পুথি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ সালে তাঁরই সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে পুথিটি প্রকাশিত হয়। যদিও কারও কারও মতে মূল গ্রন্থটির নাম ছিল ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’।

কৃষ্ণের জন্ম, বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং অন্তে বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় অভিপ্রয়াণ – এই হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের মূল উপজীব্য। আখ্যানভাগ মোট ১৩ খণ্ডে বিভক্ত। পুথিটি খণ্ডিত বলে কাব্যরচনার তারিখ জানা যায় না। তবে কাব্যটি আখ্যানধর্মী ও সংলাপের আকারে রচিত বলে প্রাচীন বাংলা নাটকের একটি আভাস মেলে এই কাব্যে। গ্রন্থটি স্থানে স্থানে আদিরসে জারিত ও গ্রাম্য অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হলেও আখ্যানভাগের বর্ণনানৈপূণ্য ও চরিত্রচিত্রণে মুন্সিয়ানা আধুনিক পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

চর্যাপদের পর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা ভাষার দ্বিতীয় প্রাচীনতম আবিষ্কৃত নিদর্শন। বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। অপরদিকে এটিই প্রথম বাংলায় রচিত কৃষ্ণকথা বিষয়ক কাব্য। মনে করা হয়, এই গ্রন্থের পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলির পথ সুগম হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন,

আবিষ্কার ও প্রকাশনা

১৯০৯ সালে বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামের বাসিন্দা বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ প্রাচীন পুথির অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঐ জেলারই বিষ্ণুপুর শহরের নিকটবর্তী কাকিল্যা গ্রামের জনৈক দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে প্রথম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুথি আবিষ্কার করেন। তাঁর গোয়ালঘরের মাচায় এই পুথিটি তুলে রাখা ছিল। দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বনবিষ্ণুপুরের রাজগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশধর। পুথিটির সঙ্গে প্রাপ্ত চিরকূটটি থেকে জানা যায় যে আড়াই শত বছর আগে বিষ্ণুপুরের ‘গাঁথাঘর’ অর্থাৎ রাজগ্রন্থশালায় এটি রাখা ছিল। [২] আদ্যন্ত খণ্ডিত অবস্থায় প্রাপ্ত এই পুথিটি তুলোট কাগজে লিখিত এবং এতে তিন প্রকার লিপি দেখা যায় – প্রাচীন লিপি, প্রাচীন লিপির হুবহু অনুকরণ লিপি ও পরবর্তীকালের লিপি। পুথির প্রথম দুটি পাতা, মাঝের কয়েকটি ও শেষ পাতাগুলি পাওয়া যায়নি। বর্তমানে ২৪৩/১ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোডস্থ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুথিশালায় এটি রক্ষিত আছে। বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দে) কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ শিরোনামে পুথিটি সম্পাদনা করেন এবং ঐ বছরেই উক্ত প্রতিষ্ঠান সেটি প্রকাশ করেন।

নামকরণ

বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ শিরোনামে গ্রন্থটি সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেও, এই গ্রন্থের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। প্রাচীন পুথিগুলিতে সচরাচর প্রথম বা শেষ পাতায় পুথির নাম লেখা থাকে। কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ পুথির ক্ষেত্রে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি। ফলে পুথির নামও অজানাই থেকে যায়। এমনকি পরবর্তীকালের কোনও পুথিতেও বড়ু চণ্ডীদাস বা তাঁর গ্রন্থের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় তাই নামকরণকালে পুথির কাহিনি বিচার করে লোকঐতিহ্যের অনুসারে এটি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর বক্তব্য ছিল,

গ্রন্থপ্রকাশের প্রায় ১১ বছর পর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় রমেশ বসু সম্ভবত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের নামকরণকেন্দ্রিক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। এরপর বাংলা সাহিত্যের সারস্বত সমাজে এ-নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক উপস্থিত হয়। যাঁরা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণের বিরোধী ছিলেন, তাঁদের যুক্তি ছিল দ্বিমুখী। প্রথমত, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ একটি আদিরসাত্মক অশ্লীল কাব্য – এতে শ্রী বা কীর্তন কোনওটিই উপস্থিত নেই। দ্বিতীয়ত, পুথির সঙ্গে যে চিরকূটটি পাওয়া যায়, তাতে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব’ বলে একটি কথা লিখিত আছে। অনেকে মনে করেন গ্রন্থের মূল নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’। প্রথম যুক্তিটি আধুনিক কাব্যবিচারের দৃষ্টিতে খুবই দুর্বল; কিন্তু আধুনিক গবেষকগণ দ্বিতীয় দাবিটি প্রসঙ্গেও যথেষ্ট সন্দিহান। [৪] [৫] এই কারণে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব করেছেন,

কবি

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস। যদিও তাঁর আত্মপরিচয় বা জীবনকথা জাতীয় কিছু পাওয়া যায় না বলে তাঁর প্রকৃত পরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কাব্যে তাঁর তিনটি ভণিতা পাওয়া যায় – ‘বড়ুচণ্ডীদাস’, ‘চণ্ডীদাস’ ও ‘আনন্ত বড়ুচণ্ডীদাস’। এর মধ্যে ‘বড়ুচণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ২৯৮টি স্থানে ও ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ১০৭ বার।[৭] ৭টি পদে ব্যবহৃত ‘আনন্ত’ শব্দটি প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে করা হয়। [৮] ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা মনে করেন, চণ্ডীদাস তাঁর নাম এবং বড়ু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কৌলিক উপাধি বাঁড়ুজ্যে বা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপভ্রংশ। [৯] কবি চৈতন্যপূর্ববর্তীকালের মানুষ। সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি জীবিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাঁকুড়া ও বীরভূমের মধ্যে যত বিবাদই বিদ্যমান থাকুক না কেন, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। [১০] [১১] বড়ুচণ্ডীদাস বাসলী দেবীর উপাসক ছিলেন। এই বাসলী দেবী প্রকৃতপক্ষে শক্তিদেবী মনসার অপর নাম।

তথ্যসূত্র

পাদটীকা

  1. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২৭৩
  2. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২২৮-২৯
  3. চণ্ডীদাস বিরচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ সম্পাদিত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বঙ্গাব্দ ১৩৮০ (নবম সংস্করণ) দ্রষ্টব্য
  4. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২২৯
  5. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা সম্পাদিত, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (দ্বিতীয় প্রকাশ), প্রবেশক, পৃষ্ঠা ১১
  6. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২২৯
  7. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪
  8. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪
  9. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪
  10. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৫
  11. প্রবন্ধ বাঁকুড়ার উপভাষা ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বাঁকুড়ার উপভাষা, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, হরষিৎ মিশন, কলকাতা, ১৯৭২

বহিঃসংযোগ