বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(বাস্ত্তসঙ্কটাপন্ন এলাকা থেকে পুনর্নির্দেশিত)
বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে পরিবেশগতভাবে সংকটজনক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে

বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা বল‌তে মানুষের কর্মকাণ্ড দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুতন্ত্র এলাকা‌কে বোঝানো হয়। এগু‌লি হ‌ল বাংলা‌দেশের প‌রি‌বেশ-সংরক্ষিত অঞ্চল। ১৯৯৫ সা‌লে প্রণীত বাংলা‌দেশ প‌রি‌বেশ সংরক্ষণ আইনের অ‌ধীনে বাংলা‌দে‌শের নি‌র্দিষ্ট কিছু অঞ্চলকে "বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা" হি‌সেবে অ‌ভিহিত করা যায়।[১]

বাংলা‌দে‌শে এক‌টি খুবই বৈ‌চিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র আ‌ছে, যার ম‌ধ্যে রয়ে‌ছে ৩০০টিরও বে‌শি নদী, যেগুলি সামুদ্রিক এবং বিশুদ্ধ পানীয় প‌রি‌বেশ সৃ‌ষ্টি ক‌রে। বাংলা‌দে‌শে অ‌নেক অঞ্চল‌কে "বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা" হি‌সে‌বে বি‌বেচনা করা হয়।

‌বিবরণ[সম্পাদনা]

১৯৯৫ সা‌লের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, যেসব এলাকার বাস্তুতন্ত্র চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় চ‌লে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সেসব অঞ্চল‌কে বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন। পরিবেশের অবনতির কারণে কোন এলাকার বাস্তুতন্ত্র সঙ্কটাপন্ন হয়ে গে‌লে অথবা সংকটাপন্ন হওয়ার সম্মুখীন হলে সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সেই অঞ্চল‌কে বাস্তুতন্ত্র সঙ্কটাপন্ন এলাকা ব‌লে ঘোষণা করতে পারে। উল্লিখিত আইনের উপধারা অথবা অন্য ঘোষণার মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্র সঙ্কটাপন্ন এলাকায় কী কী কাজ প‌রিচালনা করা যা‌বে, তা নির্ধা‌রিত ক‌রে দে‌বে। ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে প্রায় ৪০,০০০ হেক্টর অঞ্চল বি‌শিষ্ট সাতটি ভিন্ন জলাভূমিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেন। এগুলি হল: হাকালুকি হাওর, সোনাদিয়া দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন দ্বীপটেকনাফ উপদ্বীপ (কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত)। য‌দিও এসব অঞ্চল সংলগ্ন পরিবেষ্টনকারী (বাফার) অঞ্চল উক্ত ঘোষণার আওতার ব‌র্হিভূত।

বাস্তুতন্ত্রের নিখুঁত বিবেচনায় বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের অবস্থা আশঙ্কাজনক হলেও সরকারের পক্ষে এতগু‌লি অঞ্চল বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা হি‌সে‌বে ঘোষণা করা এবং সেগুলির ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব না। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এলাকা শনাক্তকরণের ক্ষে‌ত্রে পূর্বোক্ত "জরুরি নিরিখ" এবং জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ শর্তাবলী বিবেচিত হয়। বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকাগুলিতে সরকারি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমির মিশ্রণ রয়েছে। উভয়ের ক্ষে‌ত্রে একই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য রয়েছে।

বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকাসমূহ[সম্পাদনা]

বাংলাদেশে[সম্পাদনা]

  • কক্সবাজার বাংলা‌দেশের দ‌ক্ষিণ-পূর্ব কো‌ণের বাংলা‌দেশ-মিয়ানমা‌রের সীমানায় অব‌স্থিত টেকনাফ হ‌চ্ছে ৮০ কি‌লোা‌মিটার বালুময় সমুদ্র সৈকত এবং এ‌টি সব‌চেয়ে বড় সমুদ্র সৈকতগু‌লির এক‌টি। এ‌টি ১০,৪৬৫ হেক্টর দীর্ঘ সরু বনাচ্ছাদিত উপদ্বীপ এবং এটি বঙ্গোপসাগরকে নাফ নদীর মোহনা ও প্রতিবেশী মায়ানমার থেকে আলাদা কর‌ছে। এটি হচ্ছে ইন্দো-হিমালয়ান এবং ইন্দো-মালয়ী বাস্তুসংস্থানিক উপঅঞ্চলের প্রাণি‌দে‌র মিশ্রণ‌কেন্দ্র। এ‌টি আন্তর্জাতিকভাবে বিপন্ন চার প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজননক্ষেত্র। পরিযায়ী পাখিদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণপথের অন্তর্গত হওয়ায় এটি একটি পাখিবহুল এলাকা। এখানে প্রায় ৮১ প্রজাতির পাখি শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও এই উপদ্বীপের উপকূলীয় জলাঞ্চলে আন্তর্জাতিকভাবে বিপন্ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রা‌ণি‌দের বাস।
  • সোনা‌দিয়া দ্বীপপুঞ্জে পৃ‌থিবীর শেষ ম্যান‌গ্রোভ বনগু‌লির এক‌টি অব‌স্থিত এবং সেই অঞ্চ‌লের উচ্চ লবণাক্ততা সহনশীল প্রা‌ণী এই ব‌নে বসবাস ক‌রে।[২] এই ম্যানগ্রোভ বন একসময় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবনের সোনাদিয়ার ম্যানগ্রোভ বনের পার্থক‌্য র‌য়ে‌ছে। কারণ, বদ্বীপের বদলে এখানকার বন উপকূলীয় উপহ্রদে (lagoon) বেড়ে উঠেছে। এই ম্যানগ্রোভ ব‌নের প্রা‌ণীগু‌লি অ‌ধিক লবণাক্ততা সহিষ্ণু, তাই সুন্দরবনের চে‌য়ে এখানে ভিন্ন ধরনের ম্যানগ্রোভ ব‌নের প্রা‌ণীর আধিক্য র‌য়ে‌ছে। এছাড়া এই দ্বীপে রয়েছে বিপুল সংখ্যক জলজ পাখি, ঝিনুক, সামুদ্রিক কচ্ছপ ও কণ্টকত্বকীদের (echinoderms) বসবাস করার অনুকূল পরিবেশ।
  • সুন্দরব‌নেও ম্যান‌গ্রোভ বন আ‌ছে কিন্তু অ‌তি‌রিক্ত শোষণ এবং নগরায়‌নের ফ‌লে সেই অঞ্চল‌টিও এক‌টি বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘো‌ষিত।[৩] সবু‌জে ভরা এই বন‌টি প্রকৃ‌তি‌প্রেমী মানুষদের চিরকাল মুগ্ধ এবং আকৃষ্ট করে। এছাড়া অ‌নেক বিলুপ্তপ্রায় প্রা‌ণী এ ব‌নে বাস ক‌রে। এছাড়া এই ব‌নে অ‌নেক বি‌চিত্র উ‌দ্ভিদ এবং পাখিও র‌য়ে‌ছে। অর্থনৈ‌তিক দিক থেকে কাঠ এবং মধুসহ অ‌নেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ও সরঞ্জা‌মের উৎস এই বন। বাংলা‌দে‌শের মানু‌ষের কা‌ছে এই বন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়ের কারণে সুন্দরবনের চারপাশের প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা হি‌সে‌বে বি‌বেচিত।[৪]
  • সেন্ট মার্টিন দ্বীপের শিলাপ্রাচীরটি সামুদ্রিক প্রবালনির্ভর শেওলার প্রাচুর্যের কারণে পৃথিবীর অন্যতম বিরল শিলাপ্রাচীর হিসে‌বে বি‌বেচিত। এটি প্রবা‌লের নিম্নমুখী প্রবা‌হের জন্য প‌রি‌চিত, যা শিলাপ্রচীর‌কে ভা‌সি‌য়ে দেয়। এই দ্বীপ‌টি বিশ্বব্যাপী হুমকির সম্মুখীন সামু‌দ্রিক প্রা‌ণীদের জন্য এক‌টি আশ্রয়স্থল। এ‌টি আন্তর্জাতিকভাবে বিপন্ন সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন ক্ষেত্র। এছাড়াও এ‌টি বিপন্ন পরিযায়ী জলচর পাখিদের যাত্রাবিরতি স্থান।
  • মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত হাকালুকি হাওর বর্তমা‌নে এক‌টি বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা হি‌সে‌বে বি‌বেচিত। কারণ, সেখা‌নে এক‌টি জলাভূ‌মি বাস্তুতন্ত্র র‌য়ে‌ছে, যা বি‌ভিন্ন ধরনের প্রা‌ণির বেঁচে থাকার উপ‌যোগী।[৫] উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাংলাদেশের হাওর অববাহিকা পলিসমৃদ্ধ। ফ‌লে, সেখানে নানা ধরনের জলাভূমি রয়েছে। এ অঞ্চলে প্রায় ৪৭টি প্রধান হাওর এবং ছয়‌ হাজারের বেশি বিল বা পরিষ্কার পানির হ্রদ আ‌ছে। এগুলির প্রায় অর্ধেক মৌসুমি ধরনের। হাকালুকি হাওর ৮০টিরও বেশি পরস্পরযুক্ত বিলের সমন্ব‌য়ে এবং শুকনো মৌসুমে এসব বিল প্রায় ৪,৪০০ হেক্টর এলাকা জু‌ড়ে ছড়ানো থাকে। কিন্তু বর্ষার মৌসুমে পুরো এলাকা ডুবে যায় ব‌লে বিলগুলি একটি অভিন্ন হ্রদে বা হাওরে রূপান্তরিত হয়। প্রায় ১৮,০০০ হেক্টর জায়গা জু‌ড়ে থাকা হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সব‌চে‌য়ে বৃহৎ হাওর। ১ লাখ ৯০ হাজান মানুষ এই এলাকায় বসবাস ক‌রে। এটি নানা ধরনের জলচর পাখি এবং শীতের সম‌য়ে অতিথি পাখিদের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি রামসার স্থান, কারণ এটি জলাভূমির একটি উত্তম প্রতিনিধিত্বমূলক উদাহরণ, যা কোনও প্রধান নদীর অববাহিকার প্রাকৃতিক কর্মক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য জলতাত্ত্বিক, জীবতাত্ত্বিক অথবা বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করে (রামসার স্থান মাপকাঠি 1c); উল্লেখযোগ্য সংখ্যার বিরল, নাজুক ও বিপন্ন প্রাণী এবং উদ্ভিদের অথবা উল্লিখিত এক বা একাধিক প্রজাতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য বাস ক‌রে (মাপকাঠি 2a); এটি প্রায় দুই জলজ পাখি এখা‌নে বসবাস ক‌রে। (মাপকাঠি 3a); জলাভূমির জন্য মূল্যমান, উৎপাদনশীলতা এবং বৈচিত্র্যের সূচক হিসে‌বে একটি নির্দিষ্ট দলের যথেষ্ট সংখ্যক জলচর পাখির নির্ভরযোগ্য আবাস এই হাওর (মাপকাঠি 3b)।
  • গুলশান-বা‌রিধারা লেক ২০০১ সা‌লে বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা হি‌সে‌বে ঘো‌ষিত হয়।[৬]
  • ২০০৯ সা‌লে বাংলাদে‌শের রাজধানী ঢাকার চার পা‌শে ব‌য়ে যাওয়া নদীগুলি: বুড়িগঙ্গা নদী, শীতলক্ষ্যা নদী, তুরাগ নদী এবং বালু নদী প‌রি‌বেশ বিভাগ কর্তৃক বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা হি‌সে‌বে ঘো‌ষিত হয়।[৭]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Raising Awareness of the Sundarban Ecologically Critical Area, Bangladesh
  2. "Community based adaptation in the ecologically critical areas of Cox's Bazar – Teknaf Peninsula and Sonadia Island – through biodiversity conservation and social protection." IUCN. N.p., n.d. Web. 21 May 2013. <http://www.iucn.org/about/union/secretariat/offices/asia/asia_news/?uNewsID=7886>.
  3. "Raising Awareness of the Sundarban Ecologically Critical Area, Bangladesh." WFN. N.p., n.d. Web. 21 May 2013. <http://whitleyaward.org/winners/sundarban-ecologically-critical-area-bangladesh/>.
  4. বহুমা‌ত্রিক
  5. "Community based adaptation in the ecologically critical areas of Cox's Bazar – Teknaf Peninsula and Sonadia Island – through biodiversity conservation and social protection." IUCN. N.p., n.d. Web. 21 May 2013.
  6. Md. Sohrab Ali (২০০৭-১০-১৯)। "Gulshan Lake: An ecologically critical area"The Daily Star 
  7. "4 rivers around city declared ecologically critical area"The Daily Star। BSS। ২০০৯-১২-২৫। 

ব‌হিঃসং‌যোগ[সম্পাদনা]

বাংলা‌পি‌ডিয়া[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]