বিষয়বস্তুতে চলুন

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন[] এই আইনটি ১৯২৯ সালের আইনকে[note ১] রহিত করে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে প্রণীত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা, যা বিশেষ করে নারীদের শারীরিক, মানসিক, এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা। এই আইনটি বাল্যবিবাহ রোধ করতে কঠোর শাস্তির বিধান করে, যা সমাজে সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

আইনটির প্রধান লক্ষ্য হলো ১৮ বছরের কম বয়সী নারী এবং ২১ বছরের কম বয়সী পুরুষের বিয়ে নিষিদ্ধ করা। এর মধ্যে কমিটি গঠন, সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা প্রদান, এবং আদালতের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিধান রয়েছে। পাশাপাশি, বাল্যবিবাহের সাথে জড়িত পিতা-মাতা, অভিভাবক, এবং বিবাহ সম্পাদনকারীকে শাস্তি প্রদানের বিধান রয়েছে। বাল্যবিবাহ নারী শিক্ষার অন্তরায় এবং মাতৃমৃত্যু হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সমাজের উন্নয়নের জন্য নারীদের সমান অধিকার এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এই আইনটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হলে, বাল্যবিবাহের হার কমানো সম্ভব হবে, যা নারীর ক্ষমতায়ন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি বড় ধাপ।[]

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি

[সম্পাদনা]

সরকার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন স্তরে কমিটি গঠন করবে। এই কমিটি গঠন করার উদ্দেশ্য হলো, স্থানীয় পর্যায়ে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সচেতনতা সৃষ্টি করা।[]

কমিটি গঠনের স্তরসমূহ
[সম্পাদনা]

জাতীয় পর্যায়ে: কেন্দ্রীয়ভাবে একটি কমিটি গঠন করা হবে, যার মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত হবেন। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে: স্থানীয় স্তরে সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা, এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে।[]

কমিটির দায়িত্ব
[সম্পাদনা]

বাল্যবিবাহের খবর পাওয়ার সাথে সাথে তা প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া, স্থানীয়ভাবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সাথে সমন্বয় করে কাজ করা।[]

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ

[সম্পাদনা]

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ক্ষমতা বলতে বোঝানো হয়েছে, কিছু নির্দিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রতিনিধি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। তাঁরা হলেন:

  • উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও),
  • নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট,
  • উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা,
  • উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা,
  • প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা,
  • থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং
  • স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি।[]

তাঁদের কর্তব্য ও ক্ষমতা:

  • কোনো ব্যক্তি লিখিত বা মৌখিকভাবে বাল্যবিবাহের খবর দিলে অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে এই ধরনের তথ্য পাওয়া গেলে, এই কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে বিবাহ বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে পারবেন।[]
  • তাঁরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবেন, যেমন বিবাহ বন্ধ করা, আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা, এবং আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা করা।[]

বাল্যবিবাহ করানোর শাস্তি

[সম্পাদনা]

যদি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি (পুরুষ বা নারী) বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করেন, তা একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এর জন্য তাকে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় শাস্তিই হতে পারে। এই শাস্তির মাধ্যমে সরকার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, যাতে প্রাপ্তবয়স্করা আইন ভেঙে অপ্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে বিবাহ না করেন। যদি কোনো পিতা-মাতা বা অভিভাবক তাদের অধীনে থাকা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করতে কোনোভাবে যুক্ত থাকেন বা তা অনুমতি দেন, তবে সেটিও একটি অপরাধ। এ ক্ষেত্রে তাদের ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এর মাধ্যমে বাল্যবিবাহে পিতা-মাতার ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। যদি কোনো বিবাহ নিবন্ধক বাল্যবিবাহের নিবন্ধন করেন, তবে তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং তাকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়া হবে। পাশাপাশি, তার লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এর উদ্দেশ্য হলো বাল্যবিবাহ নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বিবাহ নিবন্ধকদের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা।[]

বয়স প্রমাণের দলিল/ডক্যুমেন্ট

[সম্পাদনা]

বয়স প্রমাণের দলিল বলতে বোঝানো হয়েছে যে, বিবাহের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা ব্যক্তির বয়স প্রমাণের জন্য কিছু নির্দিষ্ট নথি ব্যবহার করা যাবে। এই দলিলগুলো আইনগতভাবে বৈধ হিসেবে গণ্য হবে এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সহায়ক হবে।[]

  • জন্ম নিবন্ধন সনদ: এটি ব্যক্তির জন্ম তারিখের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং সরকার কর্তৃক স্বীকৃত।
  • জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি): বাংলাদেশে সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদান করা হয়, যা বয়সসহ নাগরিকত্বের প্রমাণ দেয়।
  • মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি): মাধ্যমিক পরীক্ষার সার্টিফিকেট, যা সাধারণত শিক্ষাজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি এবং ব্যক্তির বয়সও উল্লেখিত থাকে।
  • পাসপোর্ট: একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নথি যা বয়স এবং পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[]

বিশেষ বিধান

[সম্পাদনা]

বিশেষ বিধান বলতে বোঝানো হয়েছে যে, কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আইনটি ব্যতিক্রম করার সুযোগ দেয়, তবে এর জন্য কঠোর শর্ত মানতে হবে। এই বিধানটি অপ্রাপ্তবয়স্কদের সর্বোত্তম স্বার্থে প্রযোজ্য, যেখানে আদালত এবং পিতা-মাতা বা অভিভাবকের সম্মতি নেওয়া আবশ্যক। তবে শর্ত থাকে:

  • অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থ: যদি কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালত মনে করে যে, অপ্রাপ্তবয়স্কের সুরক্ষা এবং মঙ্গলের জন্য বিবাহ প্রয়োজন, তখন এটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
  • আদালতের অনুমোদন: আদালতকে অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে, এই বিবাহটি অপ্রাপ্তবয়স্কের স্বার্থের অনুকূলে। আদালতের নির্দেশ ছাড়া এই ধরনের বিবাহ বৈধ হবে না।
  • অভিভাবক বা পিতা-মাতার সম্মতি: পিতা-মাতা বা অভিভাবকের স্পষ্ট সম্মতি থাকতে হবে যে, এই বিবাহ তাদের সন্তান বা অধীনস্থের জন্য সর্বোত্তম বলে তারা মনে করছেন।[]

বিশেষ বিধানের সমালোচনা

[সম্পাদনা]

জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই বিশেষ বিধান অপসরণের জন্য সরকারের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই বিধানের ফলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের বা কিশোরী/বালিকাদের বাল্যবিবাহ জনিত সমস্যাগুলো সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।[][]

  1. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ (১৯২৯ সালের XIX নং আইন): আইনটি ব্রিটিশ ভারতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য প্রথম প্রণীত আইন। এই আইনের মূল লক্ষ্য ছিল নির্দিষ্ট বয়সের নিচে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে রোধ করা। আইনটি পুরুষদের জন্য ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ বছর এবং নারীদের জন্য ১৪ বছর নির্ধারণ করে, যা পরবর্তীতে সংশোধিত হয়ে পুরুষদের জন্য ২১ বছর এবং নারীদের জন্য ১৮ বছর করা হয়। এই আইন অনুযায়ী, বাল্যবিবাহ সংঘটিত বা এতে সহায়তা করলে অভিভাবক, বিবাহ পরিচালনাকারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতো, যার মধ্যে অর্থদণ্ড এবং কারাদণ্ড অন্তর্ভুক্ত ছিল। আইনটি ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে ব্রিটিশ ভারতের সব নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য ছিল।[] আইনটি প্রণয়নের প্রধান প্রয়োজন ছিল বাল্যবিবাহের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করা, বিশেষত কন্যাশিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতির জন্য। যদিও আইনটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল, এর বাস্তবায়ন তেমন সফল হয়নি। তবে এটি পরবর্তীতে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।


তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]

[[বিষয়শ্রেণী:বাংলাদেশ]

  1. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ (২০১৭ সনের ৬ নং আইন) ১১ মার্চ, ২০১৭, লিঙ্ক: http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-1207.html
  2. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন (২০১৭).
  3. বাল্যবিবাহের বিশেষ বিধানের সমালোচনা ইইউ পার্লামেন্টে, https://www.dhakatimes24.com/2017/04/06/27460/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B7-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%87%E0%A6%87%E0%A6%89-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%87
  4. বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের দুর্বল দিকগুলো নিয়ে সমালোচনা, https://www.voabangla.com/a/3611628.html