বানৌজা সংগ্রাম
ইতিহাস | |
---|---|
![]() | |
নাম: | বানৌজা সংগ্রাম |
নির্মাণাদেশ: | ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ |
নির্মাতা: | উচ্যাং শিপইয়ার্ড |
নির্মাণের সময়: | ৯ অগাস্ট, ২০১৬ |
অভিষেক: | ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ |
অর্জন: | ২৮ মার্চ, ২০১৯ |
কমিশন লাভ: | ১৮ জুন, ২০২০ |
শনাক্তকরণ: | এফ১১৩ |
সাধারণ বৈশিষ্ট্য | |
প্রকার ও শ্রেণী: | টাইপ ০৫৬ কর্ভেট |
ওজন: | ১,৪০০ টন |
দৈর্ঘ্য: | ৯০.২ মিটার (২৯৬ ফুট) |
প্রস্থ: | ১১.১৪ মিটার (৩৬.৫ ফুট) |
ড্রাফট: | ৩.২৬ মিটার (১০.৭ ফুট) |
প্রচালনশক্তি: |
|
গতিবেগ: | ২৫ নট (৪৬ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা; ২৯ মাইল প্রতি ঘণ্টা) |
সীমা: | ৩,৫০০ নটিক্যাল মাইল (৬,৫০০ কিলোমিটার; ৪,০০০ মাইল) |
সহনশীলতা: | ১৫ দিন |
নৌকা ও অবতরণ নৈপুণ্য বহন করে: | ২টি |
সেন্সর এবং কার্যপদ্ধতি: |
|
রণসজ্জা: |
|
বিমান বহন: | ১টি অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড এডব্লিউ১০৯ হেলিকপ্টার |
বিমানচালানর সুবিধাসমূহ: | হেলিকপ্টার ডেক |
বাংলাদেশ নৌবাহিনী জাহাজ (সংক্ষেপেঃ বানৌজা) সংগ্রাম বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি অত্যাধুনিক স্বাধীনতা-শ্রেণীর কর্ভেট। উচ্যাং শিপইয়ার্ডে নির্মিত এই জাহাজটি এই শ্রেণীর প্রথম সংযোজন, যা এটিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক করে তুলেছে।
বানৌজা সংগ্রাম একটি বহুমাত্রিক যুদ্ধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ। এর প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- অবৈধ অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান রোধ: গভীর সমুদ্রে যেকোনো অননুমোদিত প্রবেশ বা চোরাচালান কার্যক্রম প্রতিরোধে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখে।
- জলদস্যুতা দমন: সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং জলদস্যুতা নিয়ন্ত্রণে এটি বিশেষভাবে সক্ষম।
- সমুদ্রে উদ্ধার অভিযান: যেকোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় সমুদ্রে দ্রুত উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় এই জাহাজটি অত্যন্ত কার্যকরী।
- সুনীল অর্থনীতির সুরক্ষা: বাংলাদেশের বিশাল সামুদ্রিক সম্পদ, যেমন মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় এবং সুনীল অর্থনীতির বিভিন্ন কার্যক্রমে এটি সহায়তা করে।
সংক্ষেপে, বানৌজা সংগ্রাম বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং দেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।[১][২][৩][৪][৫][৬][৭][৮][৯][১০][১১][১২]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দূরদর্শী ও দীর্ঘমেয়াদী সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকীকরণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অপারেশনাল সক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনার আওতায় দেশীয় ও বৈদেশিক উৎস থেকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এর ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে একটি অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ বানৌজা সংগ্রাম সফলভাবে কমিশন লাভ করে। এই সংযোজন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শক্তি ও সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। বানৌজা সংগ্রাম জাহাজের সার্বিক ইতিহাস নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
নির্মাণ ও হস্তান্তর:
- নির্মাণাদেশ: ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সালে জাহাজটি নির্মাণের জন্য নির্মাণাদেশ দেওয়া হয়।
- নির্মাণ শুরু: ৯ অগাস্ট, ২০১৬ তারিখে চীনের উচাং শিপইয়ার্ডে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
- অভিষেক: ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখে জাহাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে জলে ভাসানো হয়।
- হস্তান্তর: ২৮ মার্চ, ২০১৯ তারিখে বানৌজা সংগ্রাম বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
- চট্টগ্রাম আগমন: ১২ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে চীনের সাংহাই বন্দর হতে যাত্রা শুরু করে চীনের ইয়ানতিয়ান বন্দর এবং মালয়েশিয়ার কেলাং বন্দর হয়ে প্রায় ৮,০০০ কিলোমিটার সমুদ্র পথ অতিক্রম করে ২৭ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখে এটি বাংলাদেশে পৌঁছায় এবং চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে।
- কমিশনিং: ১৮ জুন, ২০২০ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে বানৌজা সংগ্রাম (পেনান্ট নম্বর: F113) কমিশন লাভ করে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে বানৌজা সংগ্রাম-এর মতো যুদ্ধজাহাজ সংযোজন দেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই সংযোজনের প্রধান উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরূপ:
- যুদ্ধকালীন সক্ষমতা বৃদ্ধি: যুদ্ধকালীন সম্ভাব্য যেকোনো সংঘাতে দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং সফলভাবে নৌ-অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা বানৌজা স্বাধীনতা সংযোজনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এটি নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করবে।
- শান্তিকালীন উপস্থিতি ও কৌশলগত প্রতিরোধ: শান্তিকালীন সময়ে সমুদ্রে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে যেকোনো আগ্রাসী বা অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা এই যুদ্ধজাহাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর মাধ্যমে দেশের সামুদ্রিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে।
- বাণিজ্যিক নৌপথের নিরাপত্তা: আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বাণিজ্যিক জাহাজসমূহের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা এবং সমুদ্রপথে অর্থনীতির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ বজায় রাখা বানৌজা স্বাধীনতা-এর অন্যতম প্রধান কাজ। দেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ সচল রাখতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
- সামুদ্রিক সম্পদ ও পরিবেশ সুরক্ষা: দেশের মৎস্য সম্পদ, খনিজ তেল ও গ্যাসসহ অন্যান্য মূল্যবান সামুদ্রিক সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করা এবং সামুদ্রিক পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা এই যুদ্ধজাহাজের অন্তর্ভুক্ত। এটি সুনীল অর্থনীতি বিকাশে সহায়ক হবে।
- আইনশৃঙ্খলা ও চোরাচালান দমন: সমুদ্রে অবৈধ চোরাচালান, জলদস্যুতা, মানবপাচার এবং অবৈধ অস্ত্র পাচার দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমুদ্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বানৌজা প্রত্যয়-এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
- সমুদ্রে উদ্ধার অভিযান ও মানবিক সহায়তা: সমুদ্রে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় দ্রুত উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে দুর্যোগকালীন সময়ে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা এই যুদ্ধজাহাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও শান্তিরক্ষা মিশন: জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক জোটের সাথে যৌথ মহড়া, প্রশিক্ষণ ও ওয়ারগেম পরিচালনা এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখা এই যুদ্ধজাহাজ সংযোজনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
বানৌজা সংগ্রাম-এর সংযোজন বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী, গতিশীল এবং বহুমুখী সক্ষমতা সম্পন্ন বাহিনীতে রূপান্তরিত করেছে। এটি কেবল দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাই বাড়ায়নি, বরং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশের অঙ্গীকারকেও পুনর্ব্যক্ত করেছে। এই অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজটি বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতি (ব্লু ইকোনমি) সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং দেশের সামুদ্রিক স্বার্থ রক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।
কর্মজীবন
[সম্পাদনা]গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কর্ভেট বানৌজা সংগ্রাম (পেন্যান্ট নম্বর: এফ ১১৩) এর এযাবৎকালের সম্পূর্ণ কর্মজীবন এতদ্বারা নিম্নোক্তভাবে উপস্থাপিত হলো:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর স্বাধীনতা-শ্রেণীর কর্ভেট 'বানৌজা সংগ্রাম' দেশের সমুদ্রসীমা সুরক্ষা, অবৈধ অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান রোধ, জলদস্যুতা দমন, সমুদ্রে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, সুনীল অর্থনীতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা এবং মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। একইসাথে, এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে বিভিন্ন বিদেশ সফর, সামরিক মহড়া এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করছে। বানৌজা সংগ্রাম আধুনিক বিশ্বে ব্যবহৃত সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ একটি যুদ্ধজাহাজ, যা বহুমাত্রিক যুদ্ধ ক্ষমতা সম্পন্ন।
শুভেচ্ছা সফর:
বানৌজা সংগ্রাম জাহাজটি তার কর্মজীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফর সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে যাত্রা (২০২০): ২০২০ সালের ৯ আগস্ট, বানৌজা সংগ্রাম লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন (ইউনিফিল)-এ যোগদানের জন্য চট্টগ্রামের নেভাল জেটি ত্যাগ করে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে এটি ভারতের মর্মুগাও বন্দরে (মর্মুগাও পোর্ট, গোআ) ১৭ আগস্ট, ২০২০ তারিখে একটি শুভেচ্ছা সফর করে।
- তুরস্ক সফর (২০২১): ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর, বানৌজা সংগ্রাম তুরস্কের মার্সিন বন্দরে শুভেচ্ছা সফর করে। এই সফর দুই দেশের নৌবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে সহায়ক হয়।
এই সফরগুলো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা প্রদর্শনে, বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্র নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সামরিক মহড়া:
বানৌজা সংগ্রাম বিভিন্ন সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে তার যুদ্ধ সক্ষমতা এবং অভিযানিক প্রস্তুতি বৃদ্ধি করেছে। যদিও বানৌজা সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট সকল মহড়ার বিস্তারিত তথ্য সবসময় সরকারিভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় না, তবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী নিয়মিতভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে থাকে। বানৌজা সংগ্রাম-এর মতো আধুনিক যুদ্ধজাহাজগুলো সাধারণত নিম্নলিখিত ধরনের মহড়ায় অংশ নেয়:
- 'সমুদ্র ঘূর্ণি' এর মতো নৌ মহড়া: এই ধরনের মহড়া দেশের সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, নৌযুদ্ধ পরিস্থিতি অনুকরণ করতে এবং দেশের সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধের অনুশীলন করতে পরিচালিত হয়।
- বহুজাতিক সামরিক মহড়া: আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বানৌজা সংগ্রাম অন্যান্য দেশের নৌবাহিনীর সাথে যৌথভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করে, যা আন্তঃকার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন হুমকি মোকাবেলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা জোরদার করে।
বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন: জাহাজটি তার নিজস্ব ক্রুদের অস্ত্রশস্ত্র পরিচালনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, এবং উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনে অংশ নেয়।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন:
বানৌজা সংগ্রাম জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে, বিশেষ করে জাতিসংঘ অন্তর্বর্তীকালীন বাহিনী লেবানন (ইউনিফিল)-এর মেরিটাইম টাস্ক ফোর্সের (এমটিএফ) অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
- ইউনিফিল মিশনে অংশগ্রহণ: ২০২০ সালের ৯ আগস্ট, বানৌজা সংগ্রাম লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে (ইউনিফিল) অংশগ্রহণের জন্য যাত্রা করে। এটি পূর্বে মোতায়েনকৃত বানৌজা বিজয়-এর স্থলাভিষিক্ত হয়, যা বৈরুত বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
- শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা: লেবাননের জলসীমায় অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ, সন্দেহজনক জাহাজ ও বিমানের ওপর নজরদারি, সমুদ্রে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা এবং লেবানিজ নৌবাহিনীর সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানে বানৌজা সংগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
- মানবিক সহায়তা: বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের পর, লেবাননে মোতায়েনকৃত বানৌজা সংগ্রাম ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা এবং ত্রাণ প্রদানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মানবিক অঙ্গীকারকে তুলে ধরে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী ২০১০ সাল থেকে ইউনিফিল-এর মেরিটাইম টাস্ক ফোর্সে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে আসছে। বানৌজা সংগ্রাম এই মিশনের অংশ হিসেবে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিকে সুদৃঢ় করেছে।
বানৌজা সংগ্রাম, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ হিসেবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর সফল বিদেশ সফর, সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অবদান বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা, পেশাদারিত্ব এবং মানবিক অঙ্গীকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই জাহাজটি "সবার উপরে দেশ, সবার উপরে নৌবাহিনী" এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে বাংলাদেশের গর্ব ও সম্মানের প্রতীক হিসেবে কাজ করে চলেছে।
বৈশিষ্ট্য ও যান্ত্রিক কাঠামো
[সম্পাদনা]বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিক কর্ভেট বানৌজা সংগ্রাম একটি অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ, যা দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নিম্নে জাহাজটির প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং যান্ত্রিক কাঠামো সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য প্রদান করা হলো:
যান্ত্রিক কাঠামো ও কার্যক্ষমতা:
- দৈর্ঘ্য: ৯০ মিটার (৩০০ ফুট)
- প্রস্থ: ১১.১৪ মিটার (৩৬.৫ ফুট)
- ওজন: ১,৪০০ টন
- ইঞ্জিন: জাহাজটিতে জার্মানির তৈরি ২টি এসইএমটি পিয়েলসটিক ১২পিএ৬ ডিজেল ইঞ্জিন রয়েছে।
- সর্বোচ্চ গতি: এই ইঞ্জিনের সাহায্যে জাহাজটি ২৫ নট (৪৬ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা; ২৯ মাইল প্রতি ঘণ্টা) গতিতে চলতে সক্ষম।
- শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র: জাহাজটিতে সামনে ও পিছনে দুটি আলাদা শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। এর ফলে, একটি কেন্দ্র অকার্যকর হয়ে পড়লেও অন্যটির সাহায্যে জাহাজটি নির্বিঘ্নে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে, যা এর কার্যক্ষমতার নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি করে।
- নকশা: চিরাচরিত গোলাকার সম্মুখভাগের পরিবর্তে জাহাজটিকে ভি-আকৃতিতে তৈরি করা হয়েছে, যা এটিকে উত্তাল সমুদ্রেও দ্রুতগতিতে চলতে সক্ষম করে তোলে। এই বিশেষ নকশা প্রতিকূল আবহাওয়ায় জাহাজটির স্থিতিশীলতা এবং গতিশীলতা নিশ্চিত করে।
- ডুবোজাহাজ-বিধ্বংসী কার্যক্রম: জাহাজটিতে কোনো সোনার না থাকায় এটি খুব সীমিত মাত্রায় ডুবোজাহাজ-বিধ্বংসী কার্যক্রম চালাতে সক্ষম।
- হেলিকপ্টার ডেক: বানৌজা স্বাধীনতাতে একটি হেলিকপ্টার ডেক রয়েছে যেখানে একটি মধ্যম আকৃতির হেলিকপ্টার ওঠানামা করতে পারে। তবে, এতে কোনো হ্যাঙ্গার নেই।
ইলেক্ট্রনিক্স ও র্যাডার ব্যবস্থা:
- সার্ফেস সার্চ র্যাডার: জাহাজটি সমুদ্রপৃষ্ঠ ও আকাশে অনুসন্ধানের জন্য চীনের তৈরি এসআর২৪১০সি এস-ব্যান্ড ৩ডি এইএসএ র্যাডার ব্যবহার করে। এই র্যাডারটি ২৫০ কিলোমিটার (১৬০ মাইল) দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করে এবং একসঙ্গে ১৫০টি লক্ষ্যবস্তুকে অনুসরণ করতে পারে।
- ফায়ার কন্ট্রোল র্যাডার: প্রধান গানের জন্য ১টি টাইপ ৩৪৮ ফায়ার কন্ট্রোল র্যাডার রয়েছে।
- নেভিগেশন র্যাডার: এছাড়াও, কেলভিন হিউজেস এর তৈরি শার্পআই আই-ব্যান্ড (এক্স-ব্যান্ড) এবং শার্পআই ই/এফ-ব্যান্ড (এস-ব্যান্ড) র্যাডার এবং মাল্টি-ডিজিটাল কৌশলগত প্রদর্শন সফটওয়্যার ব্যবহার করে। এই র্যাডারগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠে অনুসন্ধান এবং নৌচালনার কাজে ব্যবহৃত হয়।
- হেলিকপ্টার নিয়ন্ত্রণ: পাশাপাশি, হেলিকপ্টার উড্ডয়ন ও অবতরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যও এই র্যাডার ব্যবহার করা যায়।
রণসজ্জা
[সম্পাদনা]বানৌজা সংগ্রাম বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, যা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত। শত্রু জাহাজ মোকাবেলা, চোরাচালান প্রতিরোধ এবং জলদস্যুতা দমনে এই জাহাজটি নিম্নলিখিত মারণাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে সজ্জিত:
- ১টি এইচ/পিজে-২৬ ৭৬ মিমি কামান: এটি জাহাজের প্রধান কামান, যা বিভিন্ন ধরনের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
- ২টি এইচ/পিজে-১৭ ৩০ মিমি কামান: ছোট লক্ষ্যবস্তু এবং দ্রুতগতির আক্রমণের জন্য এই কামানগুলো কার্যকর।
- ৪টি সি-৮০২এ জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র: এটি শত্রু জাহাজ ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত একটি শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা।
- ১টি ৮ সেল বিশিষ্ট এফএল-৩০০০এন আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র: এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি আকাশপথে যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম।
- ১টি ৬-টিউব টাইপ ৮৭ ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী রকেট লঞ্চার: এটি ডুবোজাহাজ সনাক্তকরণ ও ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ৪টি এসটিকে-৫০এমজি ১২.৭ মিমি বিমান-বিধ্বংসী মেশিনগান: স্বল্পপাল্লার বিমান এবং ড্রোন মোকাবেলায় এই মেশিনগানগুলো কার্যকর।
- ৬টি কিউডব্লিউ-২ বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র: এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আকাশপথে হুমকি মোকাবেলায় অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা প্রদান করে।
এই রণসজ্জা বানৌজা সংগ্রামকে একটি সুসজ্জিত এবং সক্ষম যুদ্ধজাহাজে পরিণত করেছে, যা বাংলাদেশের জলসীমা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "China's CSSC launches C-13B corvette for Bangladesh"। Quwa। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
- ↑ "গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ০৭ (সাত) বছরের অগ্রগতির তথ্য প্রচারের ব্যবস্থাকরণ সম্পর্কিত" (পিডিএফ)। ২০১৬-০৪-০৭।
- ↑ "গণচীন হতে দেশে পৌঁছেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নতুন দুটি যুদ্ধজাহাজ 'সংগ্রাম' ও 'প্রত্যাশা'"। আইএসপিআর। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-২৪।
- ↑ আইএসপিআর (২০২০-০৬-১৮)। "নৌবাহিনীর আধুনিক যুদ্ধজাহাজ 'সংগ্রাম' এর কমিশনিং করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নিযুক্ত হবে বিশ¡ শান্তিরক্ষায় -"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৫।
- ↑ Jamuna TV (২০২০-০৬-১৭)। "বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হলো যুদ্ধজাহাজ সংগ্রাম | BNS Sangram"।
- ↑ আইএসপিআর (২০২০-০৮-০৯)। "জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিতে লেবাননে যাচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ সংগ্রাম -"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৫।
- ↑ "Mahbubur Rahman, Deputy Contingent Commander & Executive Officer of the BNS Sangram, a #maritime taskforce unit ship working under UNIFIL-PIO, calls for... | By United Nations Information Centre Beirut | Facebook"।
- ↑ "A Day to Remember"।
- ↑ "BNS F113 Sangram - Postbeutelmanöver UNIFIL | FusselFred 🐇😄 [iPhone | Cinematic]"।
- ↑ "BNS F113 Sangram - Neue Korvette aus Bangladesch | FusselFred 🐇😄 [iPhone|Cinematic] #PrayForBeirut"।
- ↑ "United Nations Interim Force In Lebanon (UNIFIL) | Armed Forces Division(AFD)"। afd.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৬-১৫।
- ↑ "Bangladesh Increase of Transit Time For Ships Rotation In UNIFIL, MTF" (পিডিএফ)। operationalsupport.un.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-২৮।