বাংলার প্ৰাচীন জনপদসমূহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
যে ধারাবাহিকের অংশ সেটি হল
Atisha.jpg
প্রাচীন বাংলা
ধ্রুপদী বাংলা
মধ্যযুগীয় বাংলা
আধুনিক বাংলা
এছাড়াও দেখুন


প্ৰাচীনযুগে বাংলা নামে কোনো অখণ্ড রাষ্ট্ৰ ছিল না। বাংলার বিভিন্ন অংশ তখন পুণ্ড্ৰ, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, হরিকেল, বরেন্দ্ৰ এরকম প্ৰায় ১৬টি জনপদে বিভক্ত ছিল।বাংলার বিভিন্ন অংশে অবস্থিত প্ৰাচীন জনপদগুলোর সীমা ও বিস্তৃতি সঠিকভাবে নির্ণয় করা অসম্ভব। কেননা বিভিন্ন সময়ে এসব জনপদের সীমানা হ্ৰাস অথবা বৃদ্ধি পেয়েছে।বাংলার জনপদগুলোর মধ্যে প্ৰাচীনতম হলো পুণ্ড্ৰ[১]

বাংলা প্ৰাচীন জনপদসমূহের তালিকা[সম্পাদনা]

  প্রাচীন জনপদের নাম বর্তমান অবস্থান
পুণ্ড্র

বৃহত্তর বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশ বিশেষ

বরেন্দ্ৰ বগুড়ার পশ্চিমাংশ,পাবনা, রাজশাহী বিভাগের উত্তর পশ্চিমাংশ, রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অংশ
বঙ্গ বৃহত্তর ঢাকা,ময়মনসিংহ,ফরিদপুর, বিক্রমপুর,বাকলা (বরিশাল) ও পটুয়াখালি অঞ্চল[২]
গৌড় মালদহ,মুর্শিদাবাদ,বীরভূম,বর্ধমান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ
সমতট বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল
রাঢ় পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চল বর্ধমান জেলা (রাঢ়ের আরেক নাম ছিল সুক্ষ্ম)
হরকূল বা হরিকেল চট্টগ্ৰাম, পার্বত্য চট্ৰগ্ৰাম, ত্ৰিপুরা, সিলেট
চন্দ্ৰদ্বীপ বরিশাল, বিক্ৰমপু্‌র, মুন্সীগঞ্জ জেলা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল
সপ্তগাঁও খুলনা এবং সমুদ্ৰ তীরবর্তী অঞ্চল
১০ তাম্ৰলিপ্ত মেদিনীপুর জেলা
১১ রূহ্ম (আরাকান) কক্সবাজার, মায়ানমারের কিছু অংশ, কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণা অঞ্চল
১২ সূহ্ম গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের দক্ষিণ ভূভাগ,আধুনিক মতে বর্ধমানের দক্ষিণাংশে, হুগলির বৃহদাংশ, হাওড়া এবং বীরভূম জেলা নিয়ে সূহ্ম দেশের অবস্থান ছিল
১৩ বিক্রমপুর মুন্সীগঞ্জ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল
১৪ বাকেরগঞ্জ বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট

প্রাচীনকালে বাংলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলগুলাের নাম দেয়া হয়েছিল জনপদ। চতুর্থ শতক হতে গুপ্ত যুগ, গুপ্ত পরবর্তী যুগ, পাল, সেন প্রভৃতি আমলের উল্কীর্ণ শিলালিপি ও সাহিত্য গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার ১৬ টি জনপদগুলাের নাম পাওয়া যায় (বাংলায় ছিল ১০টি)। বঙ্গ, গৌড়, সমতট, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, রাঢ়, পুণ্ড ও বারিন্দ্রী প্রভৃতি নামে জনপদ ছিল।

পুণ্ড্র[সম্পাদনা]

‘পৌণ্ড্রিক শব্দ থেকে 'পুণ্ড্র' নামের উৎপত্তি। এর অর্থ- আখ বা চিনি। বাংলার সর্বপ্রাচীন জনপদ হলাে পুণ্ড্র। বগুড়া, রাজশাহী, রংপুরদিনাজপুর জেলার অবস্থানভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে পুণ্ড্র জনপদ। প্রাচীন পুণ্ড রাজ্যের রাজধানী ছিল পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর। সম্রাট অশােকের রাজত্বকালে প্রাচীন পুণ্ডু রাজ্যের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। বর্তমান অবস্থান বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়। বৈদিক সাহিত্য ও মহাভারতে এ জাতির উল্লেখ আছে। পাল রাজারা উত্তরবঙ্গকে তাদের পিতৃভূমি মনে করত। সেজন্য এর নামকরণ করেছিল বারিন্দ্রী। এই বারিন্দ্রী থেকে বরেন্দ্র শব্দের উৎপত্তি। বর্তমান করতােয়া নদীর পশ্চিম তীরের লালমাটি সমৃদ্ধ অঞ্চলই বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত। গঙ্গা ও করতােয়া নদীর পশ্চিমাংশের মধ্যবর্তী অংশকে রামায়ণে বারিন্দ্রীমণ্ডল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

গৌড়[সম্পাদনা]

প্রাচীন বাংলার জনপদ গুলােকে শশাঙ্ক গৌড় নামে একত্রিত করেন। পাণিনির গ্রন্থে সর্বপ্রথম গৌড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে এ জনপদের শিল্প ও কৃষিজাত দ্রব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের শিলালিপি হতে প্রমাণিত হয় যে, সমুদ্র উপকূল হতে গৌড় দেশ খুব বেশি দূরে ছিল না। সাত শতকে গৌড়রাজ শশাঙ্কের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও এর সন্নিকটের এলাকা গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আধুনিক এ মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও পশ্চিম বর্ধমানের কিছু অংশ গৌড়ের সীমানা মনে করা হয়।

বঙ্গ[সম্পাদনা]

বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বরিশাল, পাবনা, ফরিদপুর নােয়াখালী, বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীর নিম্ন জলাভূমি এবং পশ্চিমের উচ্চভূমি যশাের, কুষ্টিয়া, নদীয়া, শান্তিপুর ও ঢাকার বিক্রমপুর সংলগ্ন অঞ্চল ছিল বঙ্গ জনপদের অন্তর্গত। পাঠান আমলে সমগ্র বাংলা বঙ্গ নামে ঐক্যবদ্ধ হয়। পুরানাে শিলালিপিতে ‘বিক্রমপুর’ ও ‘নাব্য' নামে দুটি অংশের উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন বঙ্গ ছিল একটি শক্তিশালী রাজ্য। ঐতরেয় আরণ্যক' গ্রন্থে বঙ্গ নামে উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া রামায়ণ, মহাভারতে এবং কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ গ্রন্থে ‘বঙ্গ’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

সমতট[সম্পাদনা]

চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণ অনুযায়ী সমতট ছিল বঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ পূর্বাংশের একটি নতুন রাজ্য। মেঘনা নদীর মােহনাসহ বর্তমান কুমিল্লা ও নােয়াখালী অঞ্চল সমতটের অন্তর্ভুক্ত। কুমিল্লা জেলার বড় কামতা সমতট রাজ্যের রাজধানী ছিল বলে জানা যায়। কুমিল্লা ময়নামতিতে পাওয়া প্রাচীন নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম ‘শালবন বিহার।

রাঢ়[সম্পাদনা]

রাঢ় বাংলার একটি প্রাচীন জনপদ। ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীর হতে গঙ্গা নদীর দক্ষিণাঞ্চল রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত। অজয় নদী রাঢ় অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। উত্তর রাঢ় বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমাংশ সমগ্র বীরভূম জেলা এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা দক্ষিণ রাঢ় বর্ধমানে দক্ষিণাংশ হুগলি বহুলাংশ এবং হাওড়া জেলা। উওর রাঢ় অঞ্চল ছিল বজ্রভূমি ও দক্ষিণ রাঢ় ছিল সুহ্মভূমি এলাকা।

হরিকেল[সম্পাদনা]

সপ্তম শতকের লেখকেরা হরিকেল নামে একটি জনপদের বর্ণনা করেছেন। চীনা ভ্রমণকারী ইৎ সিং বলেছেন, হরিকেল ছিল পূর্ব ভারতের শেষ সীমায়। ত্রিপুরার শৈলশ্রেণির সমান্তরাল অঞ্চল সিলেট হতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হরিকেল বিস্তৃত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত দুইটি শিলালিপিতে হরিকেল সিলেটের সঙ্গে সমর্থক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাম্রলিপ্ত[সম্পাদনা]

তাম্রলিপ্ত নামক জনপদ হরিকেল ও রাঢ়ের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। তাম্রলিপ্ত প্রাচীন বাংলার একটি বিখ্যাত বন্দর ছিল। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুকই এলাকাই ছিল তাম্রলিপ্ত জনপদের কেন্দ্রস্থল। পেরিপ্লাস’ নামক গ্রন্থে এবং টলেমি, ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাং ও ইৎ সিংয়ের বিবরণে এই তাম্রলিপ্ত জনপদের নাম বন্দর হিসেবে উল্লেখ আছে। সপ্তম শতক হতে এটা দণ্ডভুক্তি নামে পরিচিত হতে থাকে। আট শতকের পর হতেই তাম্রলিপ্ত বন্দরের সমৃদ্ধি নষ্ট হয়ে।

চন্দ্রদ্বীপ/বাকলা[সম্পাদনা]

আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থে উল্লেখিত বাকলা পরগণা বর্তমান বরিশাল জেলার অন্তর্গত। মধ্যযুগে বর্তমানে বরিশাল জেলাই ছিল চন্দ্রদ্বীপের মূল ভূখণ্ড ও প্রাণকেন্দ্র। এ প্রাচীন জনপদটি বালেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। পাল যুগে এটি ত্রৈলােক্যচন্দ্রের শাসনাধীন ভূখণ্ডরূপে শাসিত হতাে।

আর্যপূর্ব যুগে বাংলা।

বঙ্গদেশে জনবসতির প্রাথমিক তথ্য পাওয়া না গেলেও প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ এবং তাম্র যুগের কিছু অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান মেলে এখানে। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এখানে এক সুসভ্য জাতির বাস ছিল বলে পণ্ডিতরা অনুমান করেন। এরা চাষাবাদ, পশু শিকার ও পশুপালন করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। এরা পাথর ও তামা ব্যবহার করত এবং ইট পাথরের ভিটার উপর প্রশস্ত ঘর তৈরি করত। প্রাচীন পুণ্ডু ও বঙ্গজাতি আর্যপূর্ব যুগের মানুষ ছিল বলে ধারণা করা হয়। আর্যপূর্ব যুগে বাংলার অধিবাসীরা সভ্যতার দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত ছিল। কৃষিকাজ, নৌকা নির্মাণ, বয়ণশিল্প, ধাতুশিল্প প্রভৃতি আর্যপূর্ব যুগের লােকেরাই বাংলায় প্রথম প্রচলন করেন। কুমার, কামার, সূত্রধর, তাম্রকার স্বর্ণকার, মণিকার, বাসারী, শাখারী ইত্যাদি পেশাদারদের কারিগরি কাজে এরা সুদক্ষ ছিল।।

আর্য জাতি[সম্পাদনা]

যারা ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষা গােষ্ঠীর ইন্দো-ইরানীয় আর্যভাষা তথা ল্যাটিন, গ্রিক, জার্মান, ফরাসি ভাষায় কথা বলতাে তারা আর্য জাতি[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এদের বসবাস ছিল ইউরাল পর্বতের দক্ষিণের তৃণভূমি অঞ্চলে তথা ককেশাস অঞ্চল। এরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিল এবং এদের ধর্মগ্রন্থের নাম ‘ঋগ্বেদ'। আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আর্যগণ ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। ভারতবর্ষে প্রবেশের চৌদ্দশত বছর পর খ্রিষ্টপূর্ব ১০০ অব্দে আর্যগণ বাংলায় প্রবেশ করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এসময় বঙ্গদেশ অস্ট্রিক জাতির প্রভাবাধীন ছিল। প্রায় আটশত বছর তথা মৌর্য ও গুপ্ত শাসনামল পর্যন্ত বঙ্গদেশে আর্যীকরণ ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

Meyers Konversationslexikon ( Leipzig, 1885-1890 ) এর চতুর্থ সংস্করণে আর্য, সেমাইটস এবং হ্যামাইটদের সমন্বয়ে ককেশীয় জাতি (ধূসর নীল-সবুজ ছায়ায়) দেখানো হয়েছে। আর্যরা ইউরোপীয় আর্য এবং ইন্দো-আর্য (যাদের এখন ইন্দো-ইরানীয় বলা হয়) এই দুই ভাগে বিভক্ত।

আর্য জাতি হল একটি অপ্রচলিত ঐতিহাসিক জাতি ধারণা যা ১৯শতকের শেষের দিকে ইন্দো-ইউরোপীয় ঐতিহ্যের লোকদেরকে জাতিগত গোষ্ঠী হিসাবে বর্ণনা করার জন্য উদ্ভূত হয়েছিল।[৩][৪] নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এই ধারণার বৈধতা সমর্থন করে না।[৫] [৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (History of the Emergence of Independent Bangladesh)। এপ্রিল, ২০১৪। পৃষ্ঠা ৪।  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  2. চক্রবর্তী, উৎপল (১৯৯০)। বিলুপ্ত রাজধানী। কলকাতা: অমর ভারতী। পৃষ্ঠা ১৯৮। 
  3. "The Great Aryan Myth," Knight Dunlap, The Scientific Monthly Vol. 59, No. 4 (Oct. 1944), pp. 296-300
  4. Arvidsson 2006:298 Arvidsson, Stefan (2006), Aryan Idols: Indo-European Mythology as Ideology and Science, translated by Sonia Wichmann, Chicago and London: The University of Chicago Press.
  5. Arvidsson 2006:298 Arvidsson, Stefan (2006), Aryan Idols: Indo-European Mythology as Ideology and Science, translated by Sonia Wichmann, Chicago and London: The University of Chicago Press.
  6. Ramaswamy, Sumathi (জুন ২০০১)। "Remains of the race: Archaeology, nationalism, and the yearning for civilisation in the Indus valley": 105–145। আইএসএসএন 0019-4646ডিওআই:10.1177/001946460103800201