বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪নং সেক্টর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪নং সেক্টর হলো উত্তরে সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা থেকে দক্ষিণে কানাইঘাট থানা পর্যন্ত ১০০ মাইল বিস্তৃত সীমান্ত এলাকা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অন্যতম সেক্টর।[১][২] সিলেটের ইপিআর বাহিনীর সৈন্যদের সঙ্গে ছাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে এ সেক্টর গঠিত হয়েছিলো। সেক্টরটি ছোট ছোট ছয়টি সাবসেক্টরে ভাগ করা হয়েছিলো। সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর সি. আর. দত্ত।[৩] সেক্টরটিতে ৯৭৫ জন নিয়মিত সৈন্য এবং ৯০০০ জন সাধারণ গণবাহিনীর যোদ্ধা ছিলেন। সেক্টরটিতে অনেক পাহাড়ি অঞ্চল ও দুর্গম অঞ্চল থাকায়, এটি গেরিলা যুদ্ধের জন্য বেশ উপযোগী স্থান ছিলো। সেক্টরের রাজনৈতিক সংযুক্তিতে ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী এবং প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন আজিজুর রহমান।[৪]
বিস্তৃত অঞ্চল
[সম্পাদনা]৪ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার করিমগঞ্জে এবং পরে আসামের মাসিমপুরে স্থানান্তরিত হয়।[৫] সেক্টরটির এলাকা ছিল প্রধানত সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা থেকে দক্ষিণে কানাইঘাট থানা পর্যন্ত ১০০ মাইল বিস্তৃত এলাকা। তবে এটাকে বিস্তৃতভাবে ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার খােয়াই পর্যন্ত প্রায় ৩৪০ মাইল পর্যন্তও বলা যায়। অর্থাৎ সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল খােয়াই-শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন ছাড়া পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এবং হবিগঞ্জ জেলা থেকে দক্ষিণে কানাইঘাট পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত এই সেক্টরের বিসতৃতি ছিল।[৪]
অঞ্চলের প্রকৃতি
[সম্পাদনা]এই সেক্টরটি পাথরিয়া পাহাড়, সাতগাঁও পাহাড় ইত্যাদি পাহাড়সহ পাহাড়ি অঞ্চলে সমৃদ্ধ ছিলো। এছাড়াও এই অঞ্চলে প্রায় একশােটি চা-বাগান ছিলো। এইজন্য সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেক্টরটি গেরিলাযুদ্ধের উপযুক্ত ছিল, সাথে সাথে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যের জন্য অনুপযোগী দুর্গম পথ ছিলো। ফলে এই অঞ্চলে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা হালকা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অনায়সে চলাচল করতে পারতো। এই সেক্টরের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেখভাল করতেন আজিজুর রহমান ও ডক্টর হাসান দুই প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
সাব-সেক্টরসমূহ
[সম্পাদনা]সেক্টর কমান্ডার চিত্ত রঞ্জন দত্ত তার ৪ নং সেক্টরকে ৬টি সাবসেক্টরে ভাগ করে ৬ জন সাহসী মুক্তিযােদ্ধাকে পরিচালনার দায়িত্ব দেন। প্রতিটি সাবসেক্টরে একজন সাবসেক্টর কমান্ডার এবং একাধিক সহ-সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলো। ৬র্টি সাবসেক্টর হলো যথা:-
- জালালপুর সাবসেক্টর: গণবাহিনীর সদস্য মাহবুবুর রব সাদী এই সাবসেক্টরের কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, ১৯৭১ সালে তার বয়স মাত্র ২৬ বছর ছিলো। তার নেতৃত্বে এই সাব সেক্টর থেকে আটগ্রাম, জাকীগঞ্জ, লুবাছড়া ও কানাইঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে তিনি হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ এলাকায় প্রায় ৫০ জন গণবাহিনীর সদস্য নিয়ে নবীগঞ্জ এলাকা মুক্ত করার জন্য অভিযান পরিচালনা করেন।[৪]
- বারাপুঞ্জী সাবসেক্টর: এই সাবসেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রব। তিনি মূলত ছিলেন একজন সাপ্লাই কোরের অফিসার, তবে এখানে তিনি পদাতিক সেনা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তিনি এই সাবসেক্টরের অধীনে বিয়ানীবাজার, শারােপার, বরােগ্রাম, জাকীগঞ্জ, আটগ্রাম, কানাইঘাট, চিকমাগুল, এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তার সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফট্যানেন্ট নিরঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন।
- আমলসিদ সাবসেক্টর: এই সাবসেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন লেফট্যানেন্ট জহির। তিনি কানাইঘাট অভিযানে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে সাবসেক্টরটি জেড ফোর্সের প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছলো।
- কুকিল সাবসেক্টর: এই সাবসেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট কাদের। তিনি মূলত বিমানবাহিনীর অফিসার ছিলেন, তবে এখানে তিনি পদাতিক সৈন্য হিসাবে কাজ করেছিলেন। এই সাবসেক্টরটি দিলখুশ, কুলাউড়া, বিয়ানীবাজার, জুরী প্রভৃতি এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলো। |মেজর শরিফুল হক ডালিম পরে এই সাবসেক্টরে যােগ দিয়েছিলেন। ডালিম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য করার জন্য পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।
- কৈলাসহর সাবসেক্টর: এই সাবসেক্টরের কমান্ডার হিলেন লেফট্যানেন্ট ওয়াকিজ্জামান। ভারতের কৈলাশশহর এলাকার নয়টি গ্রাম দখল করে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলো এই সাবসেক্টরটি।[৪] কৈলাসহরে অভিযানের পরে ফেঞ্চুগঞ্জের দিকে এগিয়েছিলো এই উপদলটি। ডিসেম্বর মাসে যখন ভারত থেকে সাহায্য আসে, তখন ৫৯ ব্রিগেডের সাথে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করে।
- কমলপুর সাবসেক্টর: এই সাবসেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ছিলেন মেজর এনাম। তিনিও পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তার দল নিয়ে রাজাঘাট, ধলাইসহ বিভিন্ন স্থানের চা বাগান নষ্ট করে, যাতে পাক হানাদাররা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পরে। ডিসেম্বরে ভারতের সাহায্য আসার পরে এরাও ভারতের ৮১ পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করে।
সামরিক অভিযান
[সম্পাদনা]৪ নং সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধাদের লােহারবন্দ নামক স্থানে প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে। এছাড়াও স্থানটি রিলিফ ক্যাম্প, শরনার্থী শিবির, আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এই ক্যাম্পে ছাত্র-যুবক সংগ্রহ করা ও তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থায় সাহায্য করেছিলেন স্থানীয় নেতা-দেওয়ান ফরিদ গাজী,ডাঃ মৃগেন কুমার দাস চৌধুরী, নুরুল ইসলাম আজিজ, তােয়াবুর রহিম, ডঃ আলি, হাবিবুর রহমান, ডঃ মালেক, আব্দুল লতিফ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
এই সেক্টরের কাজ ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ছোট-খাটো ঘাটি ধ্বংস করা, অ্যামবুশ করা, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত করা, মাইন পেতে রাখা প্রভৃতি। আর গণবাহিনীর কাজ ছিলো পুল ও সাঁকো ধ্বংস করা। মুক্তিবাহিনীর উচ্চ মহলের নির্দেশনায় থেকে সি. আর. দত্ত ৪ নং সেক্টরের এলাকার সকল চা-বাগান নষ্ট করে দেয়, যাতে করে পাকসেনারা চা-বাগান থেকে কোন অর্থ সরবরাহ না করতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫ নং সেক্টরের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং বিধু দাশগুপ্তকে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাতে ৪ নং সেক্টরকে জন্য সাহায্য করেছিলো। তারা দিরাই অভিযান, মখালকান্দি অভিযান এবং আজমিরিগঞ্জ অভিযানে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলো।[৪]
সেক্টরটি মে মাস থেকে নিজ নিজ এলাকার পাকিস্তান সেনাদের উপর আক্রমণ করতে শুরু করে, এবং জুন মাসে আক্রমণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। জুন-জুলাই মাসে সেক্টরটির আক্রমণের ধরন ছিলো গেরিলা কায়দা, তারা আক্রমণ করে পিছিয়ে আসতো। মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিলো পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষতি সাধন করা। এই দুই মাসে ঘাটি লাটু, বড়লেখা, ছোটলেখা, কুলতলা, আটগ্রাম প্রভৃতি গ্রামের উপর আঘাত হানে সেক্টরটির মুক্তিবাহিনী। পাশাপাশি রাজকি, ফুলতলা, শাওকি, পৃথিমপাশা, সমনভাগ, সোনা-রুপা, হাসনাবাদ, চূড়ামণি, গাহেরা, সাগরলাল প্রভৃতি চা-বাগান ধ্বংস করে দেয়।[৬]
আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে উচ্চ মহলের নির্দেশে আক্রমণের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এরফলে পাকবাহিনী আরো কোণঠাসা হয়ে পরে, তাদের মধ্যে কিছুটা হতাশা চলে আসে। পাকবাহিনী শুরুতে হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালালেও অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সকল বাঙালিদের উপর অত্যাচার শুরু করে দেয়। এই সুযোগে মুক্তিবাহিনীও সুযোগ বুঝে বাংলাদেশের রাজাকারদের বিচার শুরু করে দেয়।[৭]
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি ও শেষ সপ্তাহ ধরে সেক্টরটির সৈন্যরা পুরোদমে পাকিস্তানি বাহিনীদের উপর আক্রমণ চালায়, এবার উদ্দেশ্য তাদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত করা। জালালপুর সাবসেক্টরের কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদী লুবাছড়া চা-বাগান থেকে আক্রমণ শুরু করে।[৪]
ক্ষয়-ক্ষতি
[সম্পাদনা]নয় স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভিন্ন খন্ড যুদ্ধে এই সেক্টরে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়েছেন। আরো কয়েকশাে মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছেন।[৪]
সংগৃহীত শহীদদের তালিকা:
- রফিকউদ্দিন
- খাজা নিজামউদ্দিন বীর উত্তম
- বশির আহমদ
- মােঃ ফয়জুল ইসলাম
- রফিকুল ইসলাম
- মােঃ মইজুল ইসলাম
- শাহাবউদ্দিন
- মােঃ হােসেন
- আতিকুল ইসলাম
- নায়েক আলী আকবর
- আশরাফুল হক
- মাহমুদুর রব
সংগৃহীত উল্লেখযোগ্য আহতদের তালিকা:
- মোঃ সাহাব উদ্দিন
- জালালউদ্দিন আখঞ্জী
- আব্দুল মালেক
- আব্দুর রহিম
- বাবুল
- জ্ঞানেন্দ্র চক্রবর্তী
- দুলাল মিয়া
- মানিকুর রহমান
- আব্দুল বারী
- মােঃ নামর হােসেন
- আব্দুস সহিদ
- আজগর
- মােঃ ফয়েজ মিয়া
- আব্দুল গফুর
- আবুল হােসেন
- ইসহাক মিয়া
- মানিক আলী
- মােঃআব্দুর রহমান
- আফাজউদ্দিন
- আকরাম আলী
- আকবর আলী
- রফিক মিয়া সহরউল্লা
- অনিল কুমার তালুকদার
- সুরুজ মিয়া
- আলী আকবর
- কাজী মাতুমিয়া
- মােঃ ফরিদ আলী
- মােঃ মন্তাজ আলী
- মােঃ সিরাজ মিয়া
- যতীন্দ্র চন্দ্র
- মােঃ ফজর আলী
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- প্রথম আলোয় সেক্টর ৪ ট্যাগের পোস্ট
- সংগ্রামের নোটবুকে ৪ নং সেক্টর
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ডেস্ক, প্রথম আলো। "সেক্টর ৪"। চিরন্তন ১৯৭১ | প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-১৭।
- ↑ "মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টর"। banglanews24.com। ২০১৬-০৩-০৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-১৭।
- ↑ "মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-১৭।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ "মুক্তিযুদ্ধে ৪নং সেক্টর কমান্ডার ও মেজর জেনারেল অব সি আর দত্ত বীর উত্তম | তপন কুমার দে"। সংগ্রামের নোটবুক। ২০২১-০৪-২০। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-১৭।
- ↑ হ্, আ হ মে দ উ ল্লা। "সেক্টর কমান্ডারদের মুক্তিযুদ্ধ"। DailyInqilabOnline। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-১৭।
- ↑ ডেস্ক, প্রথম আলো। "বহু প্রতীক্ষিত সেক্টর কমান্ডারদের সভা"। Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-১৭।
- ↑ শামসুল কবির, ড. (জানুয়ারি ২০১৮)। "ফেনী জেলার উল্লেখযোগ্য সম্মুখযুদ্ধ ও গনহত্যা (১৯৭১): একটি পর্যালোচনা" (পিডিএফ)। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এটা একটি থিসিস পেপার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পেপারটি তৈরি করেছেন। জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি জার্নাল অব আর্টস।