বাঙালি রন্ধনশৈলী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(বাংগালি থেকে পুনর্নির্দেশিত)
ঐতিহ্যবাহী বাঙালি রন্ধনশৈলী

বাঙালি রন্ধনশৈলী বা বাঙালি খাবার বলতে বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাদ্যাভ্যাসকে বোঝায়।[১] এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস ও জলবায়ু বাঙালি খাবারের রূপ ও বৈশিষ্ট্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। সরিষার তেলের মোহনীয় স্বাদের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং মিষ্টি ও নানান রকমের পিঠাপুলি তৈরিতে বাঙালিরা বিশেষভাবে পারদর্শী।[২] বাঙালির প্রধান খাদ্য হলো ভাত[৩] এবং আমিষের প্রধান উৎস হিসেবে মাছ সবচেয়ে জনপ্রিয়। সামুদ্রিক মাছের তুলনায় মিঠা পানির মাছের চাহিদাই বেশি, তবে ভেটকি মাছও বাঙালির খাদ্যতালিকায় বেশ পছন্দনীয়।[৪] মাছের পাশাপাশি মুরগি এবং খাসির মাংসও বাঙালিদের কাছে খুবই প্রিয়।[৫] গরুর মাংস মূলত বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ সমাদৃত। সাম্প্রতিক সময়ে, ডালও বাঙালি খাদ্যাভ্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। আড্ডা, ঈদের ভুরিভোজ, ইফতার বা মেজবান, পূজা-পার্বণ কিংবা বিবাহ অনুষ্ঠান – যেকোনো ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান বাঙালিদের অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

ইলিশভাত

রন্ধনশৈলীর প্রভাব[সম্পাদনা]

মুঘল রন্ধনশৈলীর প্রভাব[সম্পাদনা]

গরুর ঝাল ভুনা

মুসলিমরা ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলা জয় করে এবং এর সাথে নিয়ে আসে পারস্যআরবীয় রান্নার রীতি।[৬] বিরিয়ানি, কোরমা এবং ভুনার মতো খাবার একসময় উঁচু সমাজের পছন্দ ছিল, কিন্তু মুঘলদের রাঁধুনিরা তাদের রন্ধনপ্রণালী নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কাছে নিয়ে আসেন।[৭] ব্রিটিশ রাজের শাসনামলে এই প্রভাব আরও গভীর হয়। এসময় কলকাতা অনেক নির্বাসিত নবাবের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়, বিশেষ করে মহীশূরের টিপু সুলতানের পরিবার এবং আওধের বহিষ্কৃত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। নির্বাসিত নবাবদের সাথে শত শত রাঁধুনি ও মশলা বিশেষজ্ঞ আসেন। যখন রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং ধনসম্পদ কমে যায়, তখন তারা স্থানীয় জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েন। এই রাঁধুনিরা বিভিন্ন ধরনের মশলার জ্ঞান নিয়ে এসেছিলেন (বিশেষ করে জাফরান এবং জয়ত্রী), ঘি-এর ব্যাপক ব্যবহার এবং দই ও মরিচ দিয়ে মাংস ম্যারিনেট করার রীতি।[৮]

বাংলাদেশে, এই খাবারগুলো সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিদিনের খাবারে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে, এগুলো পেশাদার রাঁধুনিদের দ্বারাই রান্না করা হয়ে থাকে। এসব রান্নার আরও উদ্ভাবনের মধ্যে রয়েছে চাপ (পাতলা তাওয়ায় ধীরে ধীরে রান্না করা পাঁজর), রেজালা (পাতলা দই এবং এলাচের গ্রেভিতে রান্না করা মাংস) এবং কাঠি রোল (রুটিতে মোড়ানো কাবাব)।[৯]

মুঘলরা মাংসের প্রতি বিশেষ আসক্তি বোধ করত। তাই তারা মূলধারার বাঙালি রান্নায় ভেড়া এবং গরুর মাংস যুক্ত করেন। এছাড়া আগে থেকেই পরিচিত মাংস যেমন মুরগী ও হরিণের মাংসের ব্যবহারও বৃদ্ধি পায়।[১০]

তাছাড়া, মিষ্টির ক্ষেত্রে আগে প্রধান উপকরণ ছিল চালের খই এবং গুড়। কিন্তু মুঘলদের প্রভাবে মিষ্টিতে দুধ, ক্রিম এবং চিনির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এছাড়াও এলাচ ও কেশরের মতো ব্যয়বহুল মশলার ব্যবহারও বৃদ্ধি পায়।[১১]

বিধবাদের প্রভাব[সম্পাদনা]

হিন্দু সমাজে, বিধবাদের এমন খাবার খাওয়ার অনুমতি ছিল না যেগুলোকে "তিক্ত" হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায় না। এই বিধিনিষেধ তাদেরকে খাদ্যাভ্যাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং উদ্ভাবনের দিকে পরিচালিত করেছিল।[১২] যদিও অধিকাংশ বাঙালি হিন্দু সমাজ মাছ-মাংস খেত, হিন্দু বিধবাদের জন্য এটি নিষিদ্ধ ছিল। বিধবাদের রান্নায় পিঁয়াজরসুনের মতো "উত্তেজক" খাবার ব্যবহার করা যেত না, তবে আদা ব্যবহারের অনুমতি ছিল। এই রীতি বাঙালি রান্নায় আদার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, নিরামিষ এবং আমিষ উভয় প্রকারের তরকারিতেই।

কাঠবাদাম, শুকনো ফল, দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের (যেমন ক্রিম, ঘি অথবা দই) মতো ব্যয়বহুল মশলা এবং উপাদান, যেমন জাফরান, দারুচিনি বা লবঙ্গ, বিধবাদের রান্নায় খুবই সীমিতভাবে ব্যবহার করা হতো, যদিওবা ব্যবহার হতো।[১৩] এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিধিনিষেধ বাঙালি হিন্দু বিধবাদেরকে সম্পূর্ণভাবে সবজি এবং সাশ্রয়ী মশলা ব্যবহার করে নতুন ধরনের খাবার তৈরি করতে বাধ্য করেছিল।

বঙ্গভঙ্গের প্রভাব[সম্পাদনা]

খেজুরের গুঁড়ের পায়েস

বঙ্গভঙ্গের ফলে যে ব্যাপক ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার স্থানান্তর ঘটেছিল তা খাদ্যাভ্যাসে বদল এনেছিল, যাতে ধর্মীয় বিধিবিধানের প্রতি আনুগত্য বজায় থাকে। বাংলাদেশে (পূর্ববঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তান) মুঘলাই রন্ধনশৈলী বেশ প্রচলিত, যেসব খাবার পশ্চিমবঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম জনপ্রিয়, যেমন গরুর কাবাব। উপরন্তু, জর্দা এবং ফিরনি-পায়েসের মতো মিষ্টিও বহুল প্রচলিত। গ্রামীণ বাংলাদেশে অনেকে শাপলাকে ভেজে, ফুটিয়ে বা কাঁচা খেতে পছন্দ করেন।[১৪][১৫]

Catla kalia
কাতল মাছের কালিয়া

ঔপনিবেশিক আমলে কলকাতায় অনেক পাশ্চাত্য খাবারের দোকান স্থাপিত হয়। ফলস্বরূপ, পাফ পেস্ট্রি, ছানা, চকলেট ও চিপস বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এখানে চপ, গ্রেভি কাটলেট, স্পঞ্জ রসগোল্লা এবং লেডিকেনির মতো খাবারেরও উদ্ভব ঘটে।[১৬] বহু-সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়ের কারণে কলকাতার রান্না একটানা পরিবর্তিত হচ্ছে এবং চীনা ও ইউরোপীয় খাদ্যশৈলী থেকে ব্যাপক প্রভাব গ্রহণ করেছে।[১৭][১৮]

বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

বাংলা রন্ধনপ্রণালীকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়: খাদ্য, ভক্ষ্য বা ভোজ্য (যেমন ভাত, মাছ); চর্ব্য (যেমন ভাত, মাছ); চোষ্য (যেমন আমলকী, টক); লেহ্য (যেমন চাটনি); এবং পেয় (যেমন দুধ)।[১৯]

  • খাদ্য, ভক্ষ্য, বা ভোজ্য: এগুলো হলো মূলত খাবার যা আমরা খাই। এর মধ্যে ভাত, মাছ, মাংস, শাকসবজি, ডাল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
  • চর্ব্য: এগুলো হলো এমন খাবার যা চিবিয়ে খেতে হয়। এর মধ্যে ভাত, মাছ, মাংস, শাকসবজি, ডাল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
  • চোষ্য: এগুলো হলো এমন খাবার যা চুষে খাওয়া হয়। এর মধ্যে আমলকী, টক, রস ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
  • লেহ্য: এগুলো হলো এমন খাবার যা জিহ্বা দিয়ে লেহে খাওয়া হয়। এর মধ্যে চাটনি, মিষ্টি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
  • পেয়: এগুলো হলো এমন খাবার যা পান করা হয়। এর মধ্যে দুধ, পানি, রস ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।

বাঙালি খাবার তার বৈচিত্র্য এবং স্বাদের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত। বাঙালি খাবারে মসলার ব্যবহার অনেক বেশি, যা একে অনন্য স্বাদ প্রদান করে। বাঙালি খাবারে মাছ, মাংস, সবজি, ডাল এবং দুগ্ধজাত খাবারের ব্যবহার প্রচুর। বাঙালি খাবারে মিষ্টির একটি বিশেষ স্থান রয়েছে।

আঞ্চলিক বিশেষত্ব[সম্পাদনা]

গরুর চুইঝাল
বাংলাদেশী বিরিয়ানি

বাংলার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য এর খাবারের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব কিছু বিশেষ খাবার, উপকরণ ও রন্ধনপ্রণালী রয়েছে। যেমন, সুন্দরবন লাগোয়া দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে পাওয়া যায় ঝালের তীব্রতায় অতুলনীয় চুঁই ঝাল, যা খুব সরু করে কেটে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গ বাংলার নানাবিধ মিষ্টির আঁতুরঘর - বগুড়ার মিষ্টি দই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা কিংবা পোড়াবাড়ির চমচমের সুনাম দেশজুড়ে। এছাড়াও আরও অনেক অঞ্চলেরই বিখ্যাত মিষ্টি রয়েছে। নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি, মুক্তাগাছার মোণ্ডা, নবদ্বীপের লাল দই অথবা কুমিল্লার রসমালাই এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

চট্টগ্রাম[সম্পাদনা]

ঐতিহ্যবাহী চাটগাঁইয়া বাঙালি রন্ধনশৈলী (মেজবানগরুর কালাভুনা)

চট্টগ্রামের খাদ্য সংস্কৃতি মেজবান এবং কালা ভুনার মতো মিশ্র ভাতের খাবারের পদের জন্য বিখ্যাত। কালা ভুনায় গরুর কাঁধের মাংস এবং ঐতিহ্যবাহী মশলা ব্যবহার করা হয়। শুটকি (শুকনো মাছ) চট্টগ্রাম অঞ্চলে অন্যান্য বাংলা অঞ্চলের তুলনায় বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়।[২০]

মেজবান[সম্পাদনা]

মেজবান ভিডিওগ্রাফি

মেজবান (স্থানীয়ভাবে মেজ্জান নামে পরিচিত) হলো বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়োজিত ভোজের বাংলা শব্দ।[২১] ঐতিহ্যগতভাবে মেজবান একটি প্রচলিত আঞ্চলিক ভোজ যেখানে আতপ চালের ভাত, গরুর মাংস এবং প্রাণিজ চর্বি ও দুগ্ধজাত অন্যান্য খাবারের আয়োজন জানানো হয়।[২২] মৃত্যুবার্ষিকী, জন্মবার্ষিকী, সাফল্য উদযাপন, নতুন ব্যবসার সূচনা, নতুন বাড়িতে প্রবেশ, সন্তান জন্ম, বিয়ে, আকিকা এবং সুন্নতে খৎনা, মেয়েদের কান ছিদ্র এবং নবজাতকের নামকরণের মতো অনুষ্ঠানে মেজবান আয়োজন করা হয়।[২৩][২৪] সাধারণত, মেজবান অনুষ্ঠানের দাওয়াত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং আশেপাশের বিভিন্ন মানুষ এই ভোজের আমন্ত্রণ জানাতে এগিয়ে আসেন। তবে, শহুরে এলাকায় মেজবানে যোগদান দাওয়াতের মাধ্যমেই হয়। সাধারণত মেজবানে খাওয়া-দাওয়া সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে।[২৫]

বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে গরুর মাংসের তৈরি খাবার বেশি পছন্দনীয় এবং মেজবানে এটি সামাজিক মর্যাদারও প্রতীক।[২৬] ধনী এবং গরিব উভয়ই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেজবান আয়োজন করে থাকেন। মেজবান রান্নার আছে নিজস্ব ধাঁচ এবং মেজবানের জন্য গরুর মাংস তৈরিতে দক্ষতা প্রয়োজন।[২৭] যেমন: এই ভোজে পরিবেশিত অনন্য গরুর মাংসের ঝোলটি মেজবানি গোশত নামে পরিচিত, যার রন্ধনপ্রণালীর জ্ঞান মূলত চট্টগ্রামের রাঁধুনিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।[২৮]

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান রান্না।

হিন্দু ঐতিহ্যে মেজবান রান্নায় গরুর মাংসের পরিবর্তে মাছ ব্যবহার করা হয়। চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় 'চট্টগ্রাম পরিষদ' -এর ব্যানারে প্রতিবছর মেজবান আয়োজন করে থাকে, যেখানে মাছ, শাকসবজি এবং শুটকি মাছের তরকারি পরিবেশন করা হয়।[২৯]

ঢাকা[সম্পাদনা]

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার

ঢাকার খাবার বা ঢাকাইয়া খাবার বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত আঞ্চলিক খাবার। এই সমৃদ্ধ রন্ধনশৈলী মুঘল, মধ্য এশীয়, আর্মেনীয়, ভারতীয় এবং স্থানীয় বাঙালি খাবারের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। তবে এর পাশাপাশি ঢাকার নিজস্ব কিছু অনন্য খাবারও রয়েছে। ঢাকার নবাবরা বাংলায় মুঘল খাবারের সূচনা করেছিলেন, যেগুলো সম্পূর্ণরূপে ঢাকার রন্ধন সম্প্রদায় এখনও ধরে রেখেছে। মুঘল খাবার তৈরির উচ্চ খরচের কারণে তৎকালীন ভারতে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেই এর প্রচলন সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে এর প্রসারও ঘটতে থাকে। এই খাবারের মূল বৈশিষ্ট্য হলো ভেড়া, খাসি, গরুর মাংস, দই এবং হালকা মশলার ব্যবহার। কাবাব, বিভিন্ন ধরনের ভর্তা-পরাটা, কাচ্চি বিরিয়ানি, রোস্ট করা হাঁস-মুরগি-ভেড়া, পাটিসাপটা, কাশ্মীরি চা এবং কোর্মা জাতীয় খাবার এখনও ঈদ বা বিয়ে-শাদির মতো বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। এইসব বিশেষ খাবার প্রস্তুতে প্রচুর পরিমাণে ঘি-এর মতো ব্যয়বহুল উপাদান ব্যবহার করা হয় এবং খাবারগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন মুখেই গলে যায়।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গরুর নিহারী

পুরান ঢাকা বিখ্যাত পোলাওয়ের একটি বৈচিত্র্যের জন্য সুপরিচিত - মোরগ পোলাও - যেখানে চাল রান্নার পরে মুরগির টুকরো দেওয়া হয়। অন্যান্য পোলাওয়ের মধ্যে রয়েছে ইলিশ পোলাও এবং রুই পোলাও। ঢাকাইয়ারা খিচুড়িতে পনির এবং সেদ্ধ ডিম যোগ করার জন্যও বিখ্যাত। ঢাকাই বাকরখানি হলো ঘন, বিস্কুটের মতো চ্যাপ্টা রুটি যা একটি ঐতিহ্যবাহী স্ট্রিট-ফুড। এর স্বাদ ও গুণমানের জন্য এটি বিখ্যাত এবং প্রধানত চায়ের সাথে পরিবেশন করা হয়। ঢাকার মানুষরা বিভিন্ন ভেষজ ও মশলা ব্যবহার করে সেরা খিলি পান তৈরির ঐতিহ্য গর্বের সাথে ধারণ করে আসছে। এমনকি তারা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষ "পান আফসানা" নামে খিলি পানও পরিবেশন করে। ১৯৩৯ সালে একজন রেস্তোরাঁ মালিক হাজী বিরিয়ানি নামে একটি বিশেষ খাবার আবিষ্কার করেন। এই বিরিয়ানি অত্যন্ত মশলাযুক্ত চাল, খাসির মাংস এবং আরও নানা ধরনের মশলা ও বাদাম দিয়ে তৈরি করা হয়। বর্তমানে এই রেস্তোরাঁটি ঢাকাইয়া সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।

কলকাতা[সম্পাদনা]

কলকাতার রসগোল্লা
বাচ্চাদের প্রথম ভাত খাওয়ানোর অনুষ্ঠান বা মুখে ভাত বা অন্নপ্রাশন একটি ঐতিহ্যবাহী বাঙালি ঐতিহ্য।

কলকাতার রাস্তার হকারদের অনেকেই তাদের তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে ছোট ছোট দোকান চালান। পনিরের মতো জিনিসগুলো সরাসরি খাওয়া যেতে পারে অথবা সেগুলো দিয়ে মিষ্টি সন্দেশ, রসগোল্লা বা ছানার পায়েস তৈরি করা যেতে পারে। দুধ বিশেষভাবে কলকাতার বিভিন্ন ধরনের পায়েসে ব্যবহার করা হয়, যেখানে আলাদা আলাদা শস্য এবং খেজুর, ডুমুর ও বিভিন্ন বেরির মতো উপকরণ মেশানো হয়। চকোলেটের মতো ইউরোপীয় খাবার ছাড়াও, কলকাতা তার চীনা বংশোদ্ভুত জনগোষ্ঠীর থেকে রান্নার অনুপ্রেরণা নেয়। ফুচকা, যা ভারতের অন্যান্য অংশে পানিপুরি নামে পরিচিত, হলো এক ধরনের জনপ্রিয় বাঙালি স্ট্রিট ফুড যা ভাজা ময়দার তৈরি খোল এবং আলু ও ছোলার পুর দিয়ে তৈরি হয়। ফুচকাকে সাধারণত ছোট স্টলে ভেলপুরি, মশলা চা, ঘুগনি এবং চাটের সাথে পাওয়া যায়।

প্রভাবসমূহ[সম্পাদনা]

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার বিত্তবান পরিবারগুলোর বাড়িতে রাঁধুনি হিসেবে কাজ করার জন্য অনেক ওড়িয়া রাঁধুনি কলকাতায় চলে আসেন। বিবাহ ও অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানে রান্নার জন্যও তাদের ডাকা হতো। কলকাতার রন্ধনশৈলীতে ওড়িয়া রাঁধুনিদের আগমন সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। কলকাতার অনেক বিখ্যাত খাবার আসলে উৎপত্তিগতভাবে ওড়িশার ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ওড়িয়া রাঁধুনিদের হাতে সেগুলো কলকাতার রান্নাঘরে আরও পরিমার্জিত হয়। আসলে কিছু গবেষকের মতে, কণিকা (বাঙালি মিষ্টি পোলাও)-এর মতো খাবার প্রথমে ওড়িয়া রাঁধুনিরাই কলকাতার রান্নাঘরে নিয়ে এসেছিলেন, যদিও অন্যান্য গবেষকরা এটা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। এমনকি আজও কলকাতার রান্নাঘর ও হোটেলের বেশিরভাগ রাঁধুনিই ওড়িয়া বংশোদ্ভূত।

কলকাতার চীনা বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী আঠারো শতকের শেষ দিকে প্রথমে কলকাতার দক্ষিণে আচিপুর নামক একটি গ্রামে বসতি করে, পরে শহরের মধ্যে এবং অবশেষে কলকাতার পূর্ব প্রান্তে ট্যাংরায় বসবাস শুরু করে। কলকাতার চীনা বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীরা একটি উল্লেখযোগ্য ও সফল সম্প্রদায় গড়ে তোলে এবং তাদের একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি রয়েছে। এই পরিচয়ের সাথে চীনা খাবারও এসেছে। কলকাতার বর্তমানে প্রায় প্রতিটি রাস্তার মোড়েই এই খাবার পাওয়া যায়। মূল চীনা রেসিপির সাথে সয়াসসের ব্যবহার ছাড়া খুব একটা মিল নেই, কিন্তু স্বাদের জন্য, দ্রুত রান্নার পদ্ধতির জন্য এই খাবারগুলো বেশ জনপ্রিয়। এই চীনা বংশোদ্ভূত মানুষেরা মূলত ক্যান্টনিজ ব্যবসায়ী এবং নাবিক যারা প্রথম এখানে বসতি স্থাপন করেছিল এবং হাতের কাছে যা উপকরণ পেত তাই দিয়ে রান্না করা শুরু করেছিল।

ভারতীয় চীনা খাবার ১৯৫০-এর দশকে জনপ্রিয়তার দ্বিতীয় ঢেউ পায় যখন চতুর্দশ দালাই লামা-র অনুসরণে বহু তিব্বতি ভারতীয় ভূখণ্ডে আসেন। তিব্বতিরা তাদের নিজস্ব স্বাদ ও পছন্দ এখানকার রান্নায় যোগ করে, যেমন জনপ্রিয় মোমো (এক ধরনের ডাম্পলিং) বা থুকপা (একটি হৃদয়গ্রাহী নুডল স্যুপ)। তিব্বতি এবং নেপালি অভিবাসীরা কলকাতার প্রায় প্রতিটি রাস্তায় অবস্থিত অগণিত রান্নাঘরে সহজেই কাজ পেয়ে যায়।

সিলেট[সম্পাদনা]

ঐতিহ্যবাহী সিলেটী বাঙালি খাবার (সাত রঙের চা, আখনী পোলাও ও চিকেন টিক্কা মসলা)

সিলেটে বিখ্যাত পোলাওয়ের একটি বৈচিত্র্য রয়েছে যাকে আখনী পোলাও বলে। এই খাবারে ভাতটি পরে রান্না করা হয় এবং মুরগির টুকরো আলাদাভাবে তৈরি করা হয়। গরুর মাংস, মুরগি, খাসি এবং হাঁস বা রাজহাঁসের মাংস খাওয়া হয়, যা হাঁস ও বাস্‌ বা হাশের কারির মতো জনপ্রিয় খাবারে ব্যবহার করা হয়। সিলেট একটি অসাধারণ খাবারের অধিকারী, যাকে বলা হয় বিফ হাটকোরা। এটি চাল দিয়ে তৈরি এবং এর মূল উপাদান একটি বুনো লেবুজাতীয় ফল যা বাংলার অন্য অঞ্চলে পাওয়া যায় না।

ব্রিটিশ শাসনামলে বিস্কুট এবং রুটি সিলেটে চালু হয়েছিল এবং এই খাবারগুলো সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অন্যদিকে, কাছাড় ও সিলেটের মধ্যবিত্ত হিন্দুরা বিস্কুট এবং রুটি সম্পর্কে খুবই সন্দিহান ছিল কারণ তারা বিশ্বাস করত যে এগুলো মুসলমানরা তৈরি করে। একবার, কাছাড়ের কয়েকজন হিন্দু কয়েকজন ইংরেজকে চায়ের সাথে বিস্কুট খেতে দেখে যার ফলে একটি হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। এই তথ্যটি সিলেটের হিন্দুদের কাছে পৌঁছালে সেখানেও একটু বিদ্রোহ ঘটে। তখন কোম্পানিগুলো তাদের রুটির বিজ্ঞাপন "মেশিনে তৈরি" এবং "(মুসলিম) হাত দ্বারা অস্পৃষ্ট" হিসাবে দিতে শুরু করে যাতে হিন্দুদের বোঝানো যায় যে রুটিগুলো "খাওয়ার জন্য নিরাপদ"। বিপিনচন্দ্র পাল তার আত্মজীবনীতে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন কিভাবে হিন্দুদের খাদ্যাভ্যাস ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছিল।

ঐতিহ্যবাহী খাবারের চিত্রশৈলী[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Jane Hinchey (২০১৯)। Bangladesh। Redback Publishing। পৃষ্ঠা 9। আইএসবিএন 9781925630831 
  2. Joe Bindloss (২০২২)। Lonely Planet India। Lonely Planet। পৃষ্ঠা 802। আইএসবিএন 9781837580330 
  3. Utsa Ray (২০১৫)। Culinary Culture in Colonial India। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 151। আইএসবিএন 9781107042810 
  4. Colleen Taylor Sen (২০০৪)। Food Culture in India। Greenwood Publishing Group। পৃষ্ঠা 117। আইএসবিএন 9780313324871 
  5. Ghulam Murshid (২০১৮)। Bengali Culture Over a Thousand Years। Niyogi Books। পৃষ্ঠা 428। 
  6. Pearce, Melissa (১০ জুলাই ২০১৩)। "Defining Bengali Cuisine: The Culinary Differences of West Bengal and Bangladesh"Culture Trip। সংগ্রহের তারিখ ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  7. "Mughalnama: changing the contours of Mughlai cuisine in India"ANI। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মে ২০২২ 
  8. "All That You Ever Wanted To Know About Mughlai Cuisine!"culturalindia.net (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ 
  9. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; :52 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  10. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; :42 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  11. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; :43 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  12. Nair, Rukmini। "Are we what we eat?"। সংগ্রহের তারিখ ২৮ নভেম্বর ২০১১ 
  13. Banerji, Chitrita (Winter ১৯৯৫)। "What Bengali Widows Cannot Eat"Granta (52)। ২০ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ নভেম্বর ২০১১ 
  14. "Food Habits"Banglapedia। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৯ 
  15. "Historical Sketch | Bengal Cuisine"bengalcuisine.in। ৮ মার্চ ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৯ 
  16. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; :22 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  17. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; :32 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  18. Pearce, Melissa (১০ জুলাই ২০১৩)। "Defining Bengali Cuisine: The Culinary Differences of the Bengal Region"Culture Trip। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৯ 
  19. "Our Food Their Food: A Historical Overview of the Bengali Platter | Sahapedia"sahapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৯ 
  20. "Coastal cuisines of Bangladesh"Dhaka Tribune। ২৪ মার্চ ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৮ এপ্রিল ২০১৯ 
  21. ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর, সম্পাদকগণ (২০১২)। "বাংলাদেশ"বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  22. Fayeka Zabeen Siddiqua (১০ অক্টোবর ২০১৩)। "Majestic Mezban"The Daily Star। ৪ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুলাই ২০১৯ 
  23. ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর, সম্পাদকগণ (২০১২)। "বাংলাদেশ"বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  24. Fayeka Zabeen Siddiqua (১০ অক্টোবর ২০১৩)। "Majestic Mezban"The Daily Star। ৪ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুলাই ২০১৯ 
  25. ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর, সম্পাদকগণ (২০১২)। "বাংলাদেশ"বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  26. Fayeka Zabeen Siddiqua (১০ অক্টোবর ২০১৩)। "Majestic Mezban"The Daily Star। ৪ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুলাই ২০১৯ 
  27. Fayeka Zabeen Siddiqua (১০ অক্টোবর ২০১৩)। "Majestic Mezban"The Daily Star। ৪ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুলাই ২০১৯ 
  28. "Palate from the port" (ইংরেজি ভাষায়)। The Daily Star। ৫ জানুয়ারি ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুলাই ২০২০ 
  29. ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর, সম্পাদকগণ (২০১২)। "বাংলাদেশ"বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743