বলির পাঁঠায়ন

বলির পাঁঠায়ন (ইংরেজি: Scapegoating), যা দোষ চাপানোর খেলা (playing the blame game) নামেও পরিচিত, হল কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অযৌক্তিকভাবে দোষারোপ করা এবং এর ফলে নেতিবাচক আচরণের শিকার করা। বলির পাঁঠা বানানোর প্রক্রিয়া ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির বিরুদ্ধে (যেমন: “ও করেছে, আমি না!”), ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে (যেমন: “সব লম্বা মানুষের কারণে আমি কিছুই দেখতে পাইনি”), গোষ্ঠী থেকে ব্যক্তির বিরুদ্ধে (যেমন: “ওর কারণেই আমাদের দল জিততে পারেনি”), কিংবা গোষ্ঠী থেকে গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চালানো হতে পারে।
বলির পাঁঠা হতে পারে একজন প্রাপ্তবয়স্ক, শিশু, ভাইবোন, কর্মচারী বা সহপাঠী; আবার এটি হতে পারে একটি জাতিগত, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠী, এমনকি একটি দেশও। চাপকানো ছেলে (whipping boy), চিহ্নিত রোগী (identified patient) বা পতিত লোক (fall guy) হল বলির পাঁঠার বিভিন্ন রূপ।
বলির পাঁঠায়ন এবং বাক পাসিং ভিন্ন বিষয়। যেখানে বলির পাঁঠায়ন মূলত দোষারোপকে ঘিরে আবর্তিত হয়, সেখানে বাক পাসিং এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে দায়িত্ব সরিয়ে দেওয়া নিয়ে কাজ করে। বলির পাঁঠায়নে যেখানে নেতিবাচকভাবে কোণঠাসা করা হয়, সেখানে বাক পাসিঙে জড়িত ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব সরিয়ে দেওয়ার কাজে অংশ নেয় এবং অনেক সময় দোষ এড়াতে সক্ষম হয়।
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]বলির পাঁঠায়ন শব্দটির উৎস বাইবেলের লেবীয় পুস্তকের (অধ্যায় ১৬) প্রায়শ্চিত্তদিনে পাঁঠাবলির আচারানুষ্ঠানের মধ্যে পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, একটি ছাগল বা গাধাকে মরুভূমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়, যার মাথায় একজন পুরোহিত সকল পাপ আরোপ করে দেন—এভাবেই তা পুরো সম্প্রদায়ের পাপ বহন করে নিয়ে যায়[১]
ব্যক্তিপর্যায়ে
[সম্পাদনা]আন্তঃগোষ্ঠীয় সংঘর্ষে বলির পাঁঠা তত্ত্ব
[সম্পাদনা]আন্তঃগোষ্ঠীয় সংঘর্ষের বলির পাঁঠা তত্ত্ব অর্থনৈতিক দুরবস্থার সময় এবং বহিরাগত গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাত ও সহিংসতার বৃদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে।[২] ১৮৮২ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে সহিংসতার (বর্ণবাদী সহিংসতা) গবেষণায় দেখা যায়, অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির সাথে সাথে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে সহিংসতা (যেমন: গণপিটুনি) বেড়ে যেত। তুলো (তৎকালীন প্রধান উৎপাদিত পণ্য) এর দামের সাথে শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের গণপিটুনির সংখ্যা −০.৬৩ থেকে −০.৭২-এর মধ্যে সম্পর্কযুক্ত পাওয়া যায়, যা প্রস্তাব করে যে দুর্বল অর্থনীতি শ্বেতাঙ্গদের হতাশা বহিরাগত গোষ্ঠীর উপর হামলার মাধ্যমে প্রকাশ করাত।[৩]
গোষ্ঠী হিসেবে বলির পাঁঠা বানাতে হলে অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীর সদস্যদের নিজেদের সমস্যার জন্য একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে দোষ চাপানোতে সম্মত হতে হয়।[৪]
ব্যবস্থাপনায় বলির পাঁঠা বানানো একটি পরিচিত প্রক্রিয়া, যেখানে সিনিয়র কর্মকর্তাদের ভুলের জন্য নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের দোষারোপ করা হয়। এটি প্রায়ই উচ্চপদস্থ ব্যবস্থাপনার জবাবদিহির অভাবের কারণে ঘটে।[৫]
বলির পাঁঠায়ন প্রক্রিয়া
[সম্পাদনা]সাহিত্য সমালোচক ও দার্শনিক কেনেথ বার্ক প্রথম “বলির পাঁঠায়ন প্রক্রিয়া” (scapegoat mechanism) পরিভাষাটি প্রবর্তন ও বর্ণনা করেন তাঁর পার্মানেন্স অ্যান্ড চেঞ্জ (১৯৩৫)[৬] এবং অ্যা গ্রামার অব মোটিভস (১৯৪৫)[৭] গ্রন্থে। তাঁর এই কাজ দার্শনিক নৃবিজ্ঞানী আর্নেস্ট বেকার ও র্যনে জিরারসহ অনেককে প্রভাবিত করে।
জিরার এই ধারণাটিকে মানব সংস্কৃতির ব্যাখ্যা হিসেবে আরও ব্যাপকভাবে উন্নত করেন। তাঁর মতে, ঈশ্বর নয়, বরং মানুষই বিভিন্ন রকমের প্রায়শ্চিত্তমূলক সহিংসতার প্রয়োজন অনুভব করে। মানুষ এমন জিনিসের জন্য আকাঙ্ক্ষা করে যা অন্য কারও আছে বা অন্যেরা চায় (অনুকরণমূলক আকাঙ্ক্ষা)। এর ফলে আকাঙ্ক্ষার ত্রিভুজায়ন ঘটে এবং আকাঙ্ক্ষাকারী পক্ষগুলো মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। এই অনুকরণজনিত সংক্রমণ এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যেখানে সমাজ বিপদের মুখে পড়ে; তখনই বলির পাঁঠায়ন প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়।[৮] এ পর্যায়ে এক ব্যক্তিকে সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে দল তাকে বহিষ্কার বা হত্যা করে। সেই ব্যক্তিই হয়ে ওঠে বলির পাঁঠা। তাকে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হয়, কারণ মানুষ মনে করে তারা সমস্যার মূল কারণ মিটিয়ে ফেলেছে—এবং এই চক্র আবার নতুন করে শুরু হয়।
বলির পাঁঠায়ন কোনো গোষ্ঠীর জন্য মানসিক স্বস্তি হিসেবে কাজ করে। জিরারের মতে, খ্রীষ্টধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব নাসরতীয় যীশুর ঘটনায়ও এটাই ঘটেছিল। পার্থক্য হল—যীশুর পুনরুত্থানে দেখা যায় যে তিনি নির্দোষ শিকার ছিলেন; ফলে মানবজাতি তার সহিংস প্রবণতার ব্যাপারে সচেতন হয় এবং চক্রটি ভেঙে যায়। এ কারণে জিরারের কাজ খ্রিস্তুস ভিক্তর প্রায়শ্চিত্ত তত্ত্বের এক পুনর্গঠন হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]পাদটীকা
- ↑ Wyatt-Brown, Bertram (2007) (1982) Southern Honor: Ethics and Behavior in the Old South. New York: Oxford University Press. আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৫৩২৫১৭-১. p.441
- ↑ Poppe, Edwin (২০০১)। "Effects of changes in GNP and perceived group characteristics on national and ethnic stereotypes in central and eastern Europe."। Journal of Applied Social Psychology। ৩১ (8): ১৬৮৯–১৭০৮। ডিওআই:10.1111/j.1559-1816.2001.tb02746.x।
- ↑ Hovland, C. I.; Sears, R. R. (১৯৪০)। "Minor studies of aggression: VI. Correlation of lynchings with economic indices"। Journal of Psychology: Interdisciplinary and Applied। ৯ (2): ৩০১–৩১০। ডিওআই:10.1080/00223980.1940.9917696।
- ↑ Glick, Peter (২০০৫)। "Choice of Scapegoats"। Dovidio, John F.; Glick, Peter; Rudman, Laurie (সম্পাদকগণ)। On the Nature of Prejudice: Fifty Years after Allport। Blackwell Publishing। পৃ. ২৪৪–২৬১। ডিওআই:10.1002/9780470773963.ch15। আইএসবিএন ৯৭৮-০৪৭০৭৭৩৯৬৩।
- ↑ The Art of Scapegoating in IT Projects PM Hut, 15 October 2009
- ↑ "Permanence and Change: An Anatomy of Purpose – 1935 by Kenneth Burke. 99056219"। ৩০ মে ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত।
- ↑ "A Grammar of Motives – 1945, Page iii by Kenneth Burke."। ১৫ আগস্ট ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত।
- ↑ Mimesis – The Scapegoat Model, Jean-Baptiste Dumont
অধিকতর পাঠ
- বই
- Colman, A.D. Up from Scapegoating: Awakening Consciousness in Groups (1995)
- Douglas, Tom Scapegoats: Transferring Blame (1995)
- Dyckman, JM & Cutler JA Scapegoats at Work: Taking the Bull's-Eye Off Your Back (2003)
- Girard, René: Violence and the Sacred (1972)
- Girard, René: The Scapegoat (1986)
- Jasinski, James: "Sourcebook on Rhetoric" (2001)
- Perera, Sylvia Brinton, The Scapegoat Complex: Toward a Mythology of Shadow and Guilt (Toronto: Inner City 1986), Studies in Jungian Psychology By Jungian Analysts
- Pillari V Scapegoating in Families: Intergenerational Patterns of Physical and Emotional Abuse (1991)
- Quarmby K Scapegoat: Why We Are Failing Disabled People (2011)
- Wilcox C.W. Scapegoat: Targeted for Blame (2009)
- Zemel, Joel: Scapegoat, the extraordinary legal proceedings following the 1917 Halifax Explosion (2012)
- আকাদেমীয় নিবন্ধ
- Binstock, R. H. (১৯৮৩)। "The Aged as Scapegoat"। The Gerontologist। ২৩ (2): ১৩৬–১৪৩। ডিওআই:10.1093/geront/23.2.136। পিএমআইডি 6862222।
- Boeker, Warren (১৯৯২)। "Power and Managerial Dismissal: Scapegoating at the Top"। Administrative Science Quarterly। ৩৭ (3): ৪০০–৪২১। ডিওআই:10.2307/2393450। জেস্টোর 2393450।
- Gemmill, G. (১৯৮৯)। "The Dynamics of Scapegoating in Small Groups"। Small Group Research। ২০ (4): ৪০৬–৪১৮। ডিওআই:10.1177/104649648902000402। এস২সিআইডি 145569193।
- Katz, Irwin; Class, David C.; Cohen, Sheldon (১৯৭৩)। "Ambivalence, guilt, and the scapegoating of minority group victims"। Journal of Experimental Social Psychology। ৯ (5): ৪২৩–৪৩৬। ডিওআই:10.1016/S0022-1031(73)80006-X।
- Khanna, Naveen; Poulsen, Annette B. (১৯৯৫)। "Managers of Financially Distressed Firms: Villains or Scapegoats?"। The Journal of Finance। ৫০ (3): ৯১৯–৯৪০। ডিওআই:10.1111/j.1540-6261.1995.tb04042.x।
- Maybee, Janet (২০১০)। "The Persecution of Pilot Mackey" (পিডিএফ)। The Northern Mariner। XX (2): ১৪৯–১৭৩। ডিওআই:10.25071/2561-5467.317। আইএসএসএন 1183-112X। এস২সিআইডি 247265901।
- Schopler, Eric (১৯৭১)। "Parents of psychotic children as scapegoats"। Journal of Contemporary Psychotherapy। ৪ (1): ১৭–২২। ডিওআই:10.1007/BF02110269। এস২সিআইডি 44010269।
- Vogel, E. F.; Bell, N. W. (১৯৬০)। "The emotionally disturbed child as the family scapegoat"। Psychoanalysis and the Psychoanalytic Review। ৪৭ (2): ২১–৪২। আইএসএসএন 0885-7830।
- উদ্ধৃত বই
- Glick, Peter (২০১০)। "Scapegoating"। Weiner, Irving B.; Craighead, W. Edward (সম্পাদকগণ)। The Corsini Encyclopedia of Psychology (4th সংস্করণ)। John Wiley & Sons। পৃ. ১৪৯৮–১৪৯৯। ডিওআই:10.1002/9780470479216.corpsy0817। আইএসবিএন ৯৭৮-০৪৭০৪৭৯২১৬।
- Hammer, Elliott D. (২০০৭)। "Scapegoat Theory"। Baumeister, Roy; Vohs, Kathleen (সম্পাদকগণ)। Encyclopedia of Social Psychology। Sage Publications। ডিওআই:10.4135/9781412956253.n465। আইএসবিএন ৯৭৮-১৪১২৯১৬৭০৭।
- Miller, Norman; Pollock, Vicki (২০০৭)। "Displaced Aggression"। Baumeister, Roy; Vohs, Kathleen (সম্পাদকগণ)। Encyclopedia of Social Psychology। Sage Publications। ডিওআই:10.4135/9781412956253.n155। আইএসবিএন ৯৭৮-১৪১২৯১৬৭০৭।