বলরাম বসু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বলরাম বসু
জন্ম(১৮৪২-১২-০০) ডিসেম্বর ১৮৪২
বাগবাজার উত্তর কলকাতা , ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)[১]
মৃত্যু১৩ এপ্রিল ১৮৯০(1890-04-13) (বয়স ৪৭)
কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ)
পেশাশ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান গৃহীভক্ত
ভাষাবাংলা
সময়কালঊনিশ শতক
সাহিত্য আন্দোলনবাংলার নবজাগরণ, রামকৃষ্ণ পরমহংস
দাম্পত্যসঙ্গীকৃষ্ণভামিনী দেবী
সন্তানরামকৃষ্ণ বসু (পুত্র)
আত্মীয়স্বামী প্রেমানন্দ (বাবুরাম মহারাজ)

বলরাম বসু (ডিসেম্বর ১৮৪২ - ১৩ এপ্রিল ১৮৯০) ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান গৃহীভক্তদের মধ্যে অন্যতম। মহান জনহিতৈষী হিসাবে পরিচিতি ছিল তার। সরকারী ও বেসামরিক সংস্থায় নিয়মিত দান করতেন । তিনি রামকৃষ্ণের রসদদারদের একজন ছিলেন। [২]

জন্ম ও প্রারম্ভিক[সম্পাদনা]

বলরাম বসুর জন্ম ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ ভারতের উত্তর কলকাতার বাগবাজারের এক বিশিষ্ট বৈষ্ণব পরিবারে। পিতা রাধামোহন বসু। তার পৈতৃক নিবাস ছিল হুগলি জেলার আঁটপুর-তড়া গ্রামে । [৩] তাঁর পিতামহ গুরুপ্রসাদ বসুর বাড়িতে একটি রাধাশ্যাম মন্দির স্থাপন করেছিলেন এবং সেই কারণে তাদের উত্তর কলকাতায় বসবাসের অঞ্চলটি পরে 'শ্যাম বাজার' নামে পরিচিতি পায়। [৪]নিকটবর্তী কৃষ্ণরাম বসু স্ট্রীট আজও বলরামের প্রপিতামহের গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করে। তাদের বাসভবনে স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১ মে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে এটি বলরাম মন্দির নামে পরিচিত। রামকৃষ্ণদেবর পূতাস্থি এখানেই, রক্ষিত ছিল। এখান থেকেই পরে বেলুড়ে রাখা হয়। [৫] বলরাম তার মাতাপিতার তিন সন্তানের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়। বৈষ্ণব পরিবারের সকলেই ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হওয়ার করেন শৈশব হতেই বলরাম ছিলেন ধর্মভাবাপন্ন। আধ্যাত্মিক জীবন যাপনে যথেষ্ট সময় কাটাতেন পুরীতে। প্রসঙ্গত, বসু পরিবারের ভারতের বিভিন্ন অংশে সম্পত্তি ছিল, বিশেষকরে ওড়িশার বালাসোরে। বলরামের খুড়তুতো ভাই নিমাইচরণ এবং হরিবল্লভ বসু পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন। তারা বলরামকে ভাতা প্রদান করতেন। [৬] বলরামের আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করে তাদের আশঙ্কা হয়েছিল বলরাম হয়তো একদিন তপস্বী হয়ে যাবেন। তাই তারা বলরামকে কলকাতায় ফিরিয়ে এনে বাগবাজারে এক বাড়িতে রাখেন এবং তাদের আঁটপুর গ্রামের তারাপ্রসন্ন ঘোষ ও মাতঙ্গিনী দেবীর কন্যা কৃষ্ণভাবিনীর সঙ্গে বিবাহ দেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে, কৃষ্ণভাবিনীর অগ্রজ ছিলেন বাবুরাম মহারাজ তথা স্বামী প্রেমানন্দ। সেকারণে কৃষ্ণভাবিনীও স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন আধ্যাত্মিক মননশীল। তাদের দুই কন্যা ও এক পুত্র ছিল। বলরাম তার পুত্রের নাম রেখেছিলেন রামকৃষ্ণ।

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব[সম্পাদনা]

১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে বলরাম বসুর সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। দৃশ্যত বলরাম তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ঈশ্বর আছেন কিনা। রামকৃষ্ণ বলেন নিশ্চয়ই আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে প্রথম সাক্ষাতে বলরাম আজীবন তার ভক্ত হয়ে ওঠেন, যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামকে চিনতে দেরি করেন নি। একমাত্র বলরামের বাড়িতেই শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বাধিকবার আগমন ঘটেছিল। ঠাকুরের মুখে শোনা যেত - বলরামের অন্ন, শুদ্ধ অন্ন। শ্রীরামকৃষ্ণের রসদদারদের মধ্যে বলরাম ছিলেন অন্যতম। বলরাম ভক্তদের এবং ভগবানের সেবা করার জন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্য, পোশাক এবং অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীগৌরাঙ্গ বা শ্রীচৈতন্যের অনুসারীদের বিশাল শোভাযাত্রায় বলরামকে কীর্তনদলে গান ও নৃত্যে দর্শন করেন। [৭] বলরামের পুরো পরিবার ছিল আধ্যাত্মিক মননশীল। তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণভাবিনীকে শ্রী রামকৃষ্ণ শ্রীমতীর (রাধারানীর) অষ্ট সখীর প্রধানা হিসাবে উল্লেখ করেন। কৃষ্ণভাবিনীর অগ্রজ বাবুরাম মহারাজ তথা স্বামী প্রেমানন্দ রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন। একবার কৃষ্ণভাবিনী অসুস্থ হলে তাকে দেখবার জন্য তিনি শ্রীমা সারদা দেবীকে দক্ষিণেশ্বর থেকে বলরাম বসুর বাড়িতে পাঠান। বলরামও প্রতিবৎসর রথের সময় ঠাকুরকে তার বাসভবনে নিয়ে আসতেন। ঠাকুরও এখানে রথের সম্মুখে নৃত্যসহ কীর্তন করতেন ও রথ টানতেন। ঠাকুর বলতেন, বলরামের পরিবারের সবাই এক সুরে বাঁধা। বলরাম নিজে নন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব যাতে ঠাকুরের কৃপালাভে ধন্য হতে পারে, সেজন্য তাদেরকেও ঠাকুরের কাছে উপস্থিত করাতেন।

শ্রী রামকৃষ্ণ প্রায়ই পবিত্র অনুষ্ঠানে বলরামের বাড়িতে যেতেন। তিনি আধ্যাত্মিক আনন্দে থাকতেন সেখানে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের অসুস্থতার সময়ও তিনি বেশ কিছু দিন তাঁর বাড়িতে অতিবাহিত করেন যতদিন না ভক্তরা তার ভালো চিকিৎসার জন্য কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন।

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের বলরাম ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন এবং ১৩ এপ্রিল মাত্র ৪৭ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন।

বলরাম তাঁর একমাত্র পুত্রের নামও রাখেন রামকৃষ্ণের নামে। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর, বলরাম বরানগর মঠে তার সন্ন্যাসী ভাই শিষ্যদের জন্য অল্প সহায়তা প্রদান করেন। কারণ, তিনি নিজে অসুস্থ ছিলেন এবং পারিবারিক সম্পত্তি হতে প্রাপ্ত ভরণপোষণের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড়া তার নিজের নিয়মিত কোন আয় ছিল না তবুও তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ এবং তাঁর ভক্ত ও অনুগামীদের সেবা করতে কখনও পিছপা হননি।

রামকৃষ্ণ আদেশের শ্রীমা, শ্রী সারদা দেবীও কলকাতায় থাকার সময় বলরাম বসুর বাড়িতে কিছুকাল অবস্থান করেন।

শ্রীম রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত হতে রামকৃষ্ণের প্রতি বলরামের এক পরম নম্রতা এবং সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের চিত্র লক্ষ্য করা যায়। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট যেদিন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ বাদুড়বাগানে বিদ্যাসাগরের বাসায় সাক্ষাতে যান,বলরাম সেখানে পরে পৌঁছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঠাকুরের জন্য কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করেন। কথাবার্তা শেষে ফেরার পথে রাস্তায় দেখা হয় ঠাকুরের। রামকৃষ্ণ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-'ভিতরে কেন যাও নাই'। তিনি স্মিতহাস্যে উত্তর দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি মাঝপথে বিরক্ত করতে চান নি। ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করেছিলেন। সেই মুহূর্তের জ্যোতিপূর্ণ স্নিগ্ধোজ্জ্বল মুখ রামকৃষ্ণের আকৃষ্ট করে। [৮]

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের বলরাম ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন এবং ১৩ এপ্রিল মাত্র ৪৭ বৎসর বয়সে রামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তানদের উপস্থিতিতে পরলোক গমন করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তার স্ত্রী কৃষ্ণভাবিনী দেবী প্রয়াত হন।

উত্তরাধিকার[সম্পাদনা]

উত্তর কলকাতার তার পৈতৃক বাড়ি বলরাম মন্দির নামে নামাঙ্কিত হয়। এই বাড়িতেই ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ১মে স্বামী বিবেকানন্দ এক ঐতিহাসিক সভায় রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। [৯]এই বাড়িতেই রামকৃষ্ণ সারদা দেবী সহ স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী তুরিয়ানন্দ, স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী অখণ্ডানন্দ এবং স্বামী অদ্ভূতানন্দ সহ শ্রীরামকৃষ্ণের অনেক সাক্ষাৎ শিষ্য বাস করেছেন। এটি বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশনের মালিকানাধীন। রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশনের জন্ম এই বাড়িতেই। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে একটি রাস্তা 'বলরাম বসু ঘাট রোড' নামে নামাঙ্কিত হয়।

মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রভু জগন্নাথদেবকে উৎসর্গ করে একটি ছোট মন্দির এবং তার রথও রয়েছে, যে রথযাত্রায় শ্রী রামকৃষ্ণ অংশ নিতেন।[১০] এছাড়াও কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে হরিশ চ্যাটার্জি স্টিটে বলরাম বসুর আত্মীয় যোগেশ চন্দ্র ঘোষের একমাত্র পুত্র গদাধরের অকাল মৃত্যুর স্মৃতিতে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর শ্রীশ্রী সারদাদেবীর ইচ্ছায় এক আশ্রমের সূচনা করেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহ সংঘাধ্যক্ষ শিবানন্দজী মহারাজ। গদাধরের নামে এই গদাধর আশ্রম বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশনের অধীনে পরিচালিত হয়।[১১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Balaram Basu-Lay Disciple of Sri Ramakrishna" 
  2. "শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে উল্লিখিত ব্যক্তিদের পরিচয়"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৯-২৪ 
  3. "পরমহংসের পদধূলিতে ধন্য বাগবাজারের 'বলরাম বসু' বাটীর রথযাত্রা" 
  4. "Lay disciples of Sri Ramakrishna"। ২০১১-০৭-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-০৪-১১ 
  5. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪৫৪, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  6. স্বামী গম্ভীরানন্দ রচিত 'শ্রীরামকৃষ্ণ- ভক্তমালিকা' অখণ্ড সংস্করণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা
  7. Gospels of Sri Ramakrishna, by Mahendra Nath Gupta (M), translated by Swami Nikhilananda
  8. "কলকাতার কড়চা: ভক্তপ্রবর বলরাম বসু"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৯-২৭ 
  9. Lay Disciples of Sri Ramakrishna on Belur Math website
  10. Car Festival at Balaram's House, The Gospel of Sri Ramakrishna
  11. "শতবর্ষে রামকৃষ্ণ মঠ গদাধর আশ্রম"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৯-২৭