বনু মুসা
বনু মুসা | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | ৯ম শতাব্দী |
একাডেমিক কর্ম | |
যুগ | ইসলামি স্বর্ণযুগ |
প্রধান আগ্রহ | জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতি |
উল্লেখযোগ্য কাজ | কিতাব আল-হিয়্যাল, কিতাব মারিফা'ত মাসাহাত আল-আশকাল আল-বাসিতা ওয়া'ল-কুরিয়্যা |
উল্লেখযোগ্য ধারণা | জ্যামিতিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রয়োগ[১] |
বনু মুসা (আরবি: بنُو مُوسیٰ, বাংলা: মুসার পুত্রগণ) ভ্রাতৃবৃন্দ ছিলেন নবম শতাব্দীর তিনজন ফারসি পণ্ডিত যাঁরা বাগদাদে থাকতেন এবং কাজ করতেন। জ্যেষ্ঠতার ক্রমে তাঁদের নাম হচ্ছে আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবন মুসা ইবন শাকির, আবুল কাশিম আহমাদ ইবন মুসা ইবন শাকির এবং আল-হাসান ইবন মুসা ইবন শাকির। তাঁরা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের উপর তাঁদের বই কিতাব আল-হিয়্যাল (আরবি: كتاب الحيل আক্ষরিক অর্থে: "কৌশলের বই") এবং তাঁদের যান্ত্রিক আবিষ্কারগুলোর জন্যে পরিচিত। তাঁদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে কিতাব মারিফা'ত মাসাহাত আল-আশকাল আল-বাসিতা ওয়া'ল-কুরিয়্যা (আরবি: كتاب معرفة مساحة الاشكال البسيطة و الكورية অনুবাদ: "সমতল ও গোলাকার আকৃতিসমূহের পরিমাপ সম্পর্কে জানার বই") বইটি। এটি জ্যামিতির উপর একটি কর্ম যা প্রায়শই ইসলামি ও ইউরোপীয় গণিতবিদরা উদ্ধৃত করতেন।
বনু মুসা ভ্রাতৃবৃন্দ বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণাগারে কাজ করতেন। পাশাপাশি, তাঁরা বাইতুল হিকমাহতে গবেষণা করতেন। তাঁরা নবম শতাব্দীতে ডিগ্রীর একক দৈর্ঘ্য নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে জিওডেসিক পরিমাপের একটি অভিযানেও অংশগ্রহণ করেন।
জীবন[সম্পাদনা]
বনু মুসা ছিলেন মুসা ইবন শাকিরের তিনজন পুত্র। তাঁদের বাবা মুসা ইবন শাকির খলিফা হারুনুর রশিদের পুত্র খলিফা আল-মা'মুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তার মৃত্যুর পর, আল-মা'মুনের দরবার তার অল্প বয়ষ্ক পুত্রদের দেখাশুনা করেন।[২] আল-মা'মুন তিন ভাইয়ের দক্ষতা চিনতে পারেন এবং তাদেরকে বাগদাদের বিখ্যাত পাঠাগার ও অনুবাদ কেন্দ্র বাইতুল হিকমাহতে ভর্তি করিয়ে দেন।[৩]
ইয়াহিয়া ইবন আবি মানসুরের অধীনে পড়ালেখা করে[৪] তারা প্রাচীন গ্রিক রচনাবলি আরবিতে অনুবাদের প্রয়াসে অংশ নেন। এই কাজটি করার জন্যে তারা বাইজেন্টাইনদের থেকে গ্রিক পাঠ্য সংগ্রহ করতে দূত পাঠান, অনুবাদের জন্যে বিশাল অর্থ ব্যয় করেন এবং নিজেরা গ্রিক ভাষা শিখেন।[২] এই ভ্রমণগুলোতে মুহাম্মাদ বিখ্যাত গণিতবিদ ও অনুবাদক সাবিত ইবন ক্বুররাহর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁকে নিয়োগ দেন। কোন এক পর্যায়ে হুনাইন ইবন ইসহাকও তাদের দলের অংশ ছিলেন।[৫] এই ভাইয়েরা অনেক বিজ্ঞানী ও অনুবাদককে তহবিল সরবরাহ করেছিলেন। তাঁদেরকে মাসে প্রায় ৫০০ দিনার দেওয়া হত। ভ্রাতৃবৃন্দ চেষ্টা না করলে তাদের অনূদিত অনেক গ্রিক পাঠ্য হারিয়ে যেত এবং ভুলে যাওয়া হত।[৬]
আল-মা'মুনের মৃত্যুর পর, বনু মুসা খলিফা আল-মু'তাসিম, আল-ওয়াসিক ও আল-মুতাওয়াক্কিলের অধীনে কাজ করতে থাকেন। আল-মুতাওয়াক্কিল পরবর্তীতে আল-জাফরিয়্যা শহরে একটি খাল নির্মাণে তাদেরকে নিযুক্ত করেন।[১]
গণিত ও বলবিদ্যা[সম্পাদনা]
বনু মুসার ক্ষেত্রফল ও পরিধি সম্পর্কে গ্রিকদের তুলনায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাদের অনূদিত গবেষণায় গ্রিকরা আয়তন ও ক্ষেত্রফলকে একটি প্রকৃত সংখ্যাসূচক মান দেওয়ার পরিবর্তে সেগুলোকে অনুপাতের দিক দিয়ে বেশি দেখতেন। তাদের অধিকাংশই এমন পরিমাপগুলো অন্য বস্তুর আকারের উপর ভিত্তি করে তুলনামূলকভাবে করতেন। তাদের টিকে থাকা প্রকাশনাগুলোর মধ্যে একটি, কিতাব মারিফা'ত মাসাহাত আল-আশকাল আল-বাসিতা ওয়া'ল-কুরিয়্যাতে (সমতল ও গোলাকার আকৃতিসমূহের পরিমাপ সম্পর্কিত বই) বনু মুসা আয়তন ও ক্ষেত্রফলকে সংখ্যাসূচক মান দেন। এটাই প্রমাণ যে তাঁরা গ্রিক উৎসগুলোকে শুধুমাত্র অনুবাদ ও নকল করছিলেন না। তারা আসলে ধারণা তৈরি করছিলেন এবং নিজেদের কিছু আসল কাজ নিয়ে হাজির হচ্ছিলেন।[১]
তাদের প্রকাশনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল কিতাব আল-হিয়্যাল (কৌশলাদির পুস্তক)। এই বইটির বেশিরভাগই ছিল মেঝো ভাই আহমাদের কাজ। বইটি একশটি যান্ত্রিক আবিষ্কার দিয়ে পূর্ণ ছিল। বইটিতে একটি বাতি যা যান্ত্রিকভাবে অনুজ্জ্বল হয়, পর্যাবৃত্ত ঝর্ণা ও একটি ক্ল্যামশেল গ্র্যাবসহ কিছু বাস্তব ব্যবহারিক আবিষ্কার ছিল।
জ্যোতির্বিজ্ঞান[সম্পাদনা]
তারা অনেক পর্যবেক্ষণ করেন ও তাদের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা সম্পর্কে প্রায় এক ডজন প্রকাশনা লেখার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখেন। তারা সূর্য ও চাঁদের উপর অনেক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আল-মা'মুন তাদেরকে ডিগ্রির একক দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে মেসোপোটেমিয়ার একটি মরুভূমিতে পাঠান। তারা এক বছরের দৈর্ঘ্যও পরিমাপ করেন[উল্লেখ করুন] এবং ৩৬৫ দিন, ৬ ঘণ্টা নির্ণয় করেন।[১]
রচনাবলি[সম্পাদনা]
বনু মুসা প্রায় ২০টি বই রচনা করেন যার অধিকাংশই এখন হারিয়ে গেছে।[৫]
স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র[সম্পাদনা]
তাদের অর্জনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়তার ক্ষেত্রে তাদের কাজ যা তারা খেলনা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক সৃষ্টিতে ব্যবহার করেন। তারা তাদের গ্রীক পূর্বসূরীদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখিয়েছেন।[৫]
- কিতাব আল-হিয়্যাল ১০০টি আবিষ্কার বর্ণনা করে; যেগুলো নকশা অনুসারে পুনর্নির্মিত হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে বিনোদনের উদ্দেশ্যে নকশা করার সাথে সাথে, সেগুলোতে উদ্ভাবনী প্রকৌশল প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে যেমন নিজে নিজেই খুলতে ও বন্ধ হতে সক্ষম একমুখী ও দ্বিমুখী কপাটিকা, যান্ত্রিক স্মৃতিধারক, প্রতিক্রিয়া ও বিলম্বের প্রতি সাড়াদানকারী যন্ত্র। এই যন্ত্রগুলোর অধিকাংশই পানির চাপ দ্বারা ক্রিয়াশীল হত।[২]
- কারাস্তুন, ওজন ভারসাম্যের উপর লিখিত একটি গবেষণামূলক আলোচনা-গ্রন্থ।[৩]
- যন্ত্রচালিত সরঞ্জাম সম্পর্কে, আহমাদ কর্তৃক রচিত বায়ুচালিত যন্ত্রাদির উপর একটি কর্ম।[৩]
জ্যোতির্বিজ্ঞান[সম্পাদনা]
- জ্যোতিষ্কমণ্ডলের প্রথম গতি সম্পর্কিত বই (কিতাব হারাকাত আল-ফালাক আল-উলা), যাতে রয়েছে টলেমীয় সিস্টেমের একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। এই বইতে মুহাম্মাদ টলেমীয় ৯ম মণ্ডলের অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করেন, টলেমি যেটিকে গতিটির জন্যে দায়ী মনে করেছিল।[৫]
- স্থির তারাসমূহের মণ্ডলের বাইরে কোন নবম মণ্ডলের অস্তিত্ব নেই, তার জ্যামিতি দ্বারা গাণিতিক প্রমাণ সংবলিত বই, আহমাদ কর্তৃক রচিত।
- অ্যাস্ট্রোল্যাবের গঠন সম্পর্কিত বই, আল-বিরুনি কর্তৃক উদ্ধৃত।[৫]
- সৌর বছর সম্পর্কিত বই, সাবিত ইবন কুররাকে এর লেখক মনে করা হত, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা প্রমাণ করেছে এটি বনু মুসা কর্তৃক রচিত।[৫]
- অর্ধচন্দ্রের দৃশ্যমানতা প্রসঙ্গে, মুহাম্মাদ কর্তৃক।
- বিশ্বের সূচনা সম্পর্কিত বই, মুহাম্মাদ কর্তৃক।
- জ্যোতিষ্কমণ্ডলের গতি সম্পর্কিত বই (কিতাব হারাকাত আল-আফলাক), মুহাম্মাদ কর্তৃক।
- জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই (কিতাব আল-হায়া), মুহাম্মাদ কর্তৃক।
- যিজের একটি বই, আহমাদ কর্তৃক।
- যিজের আরেকটি বই, বনু মুসার অধীনে তালিকাভুক্ত, ইবন ইউনুস কর্তৃক উল্লিখিত।[৫]
গণিত[সম্পাদনা]
- সমতল ও গোলকীয় আকৃতিসমূহের পরিমাপ সংক্রান্ত বই, পরবর্তীতে নাসির আল-দীন আল-তুসি কর্তৃক ১৩শ শতকে সম্পাদিত। Liber trium fratrum de geometria ও Verba filiorum Moysi filii shekir শিরোনামে ১২শ শতকে ক্রেমোনার জেরার্ড কর্তৃক একটি লাতিন অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। জ্যামিতির উপর এই গবেষণামূলক গ্রন্থটি মধ্যযুগে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত। সাবিত ইবন কুররাহ, ইবন আল-হাইসাম, লিওনার্দো ফিবোনাক্কি (তার Practica geometriae-তে) জর্ডানাস ডি নেমোরে এবং রজার বেকনের মত লেখক এই গ্রন্থকে উদ্ধৃত করেছিলেন।[৫] এই বইয়ের কিছু উপপাদ্য গ্রিক গণিতবিদদের কোন কর্মেই পাওয়া যায় না।[৩]
- পার্গার অ্যাপোলোনিয়াসের মোচাকৃতির ছেদসমূহ, গ্রিক কর্মের একটি পুনরাবৃত্তি, যা প্রথম আরবিতে অনুবাদ করেন হিলাল আল-হিমসি ও সাবিত ইবন কুররাহ।[৩]
- আয়ত বৃত্তাকার চিত্রের উপর একটি বই, যাতে রয়েছে তার ব্যবহার করে উপবৃত্ত অঙ্কনের পদ্ধতিটির একটি বর্ণনা।[৫]
- গ্যালেন কর্তৃক প্রমাণিত একটি জ্যামিতিক প্রস্তাব সংক্রান্ত বই।
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- ↑ ক খ গ ঘ ও'কনর, জন জে.; রবার্টসন, এডমুন্ড এফ., "Banu Musa brothers", ম্যাকটিউটর গণিতের ইতিহাস আর্কাইভ, সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয় ।
- ↑ ক খ গ Masood, Ehsad (২০০৯)। Science and Islam A History
। Icon Books Ltd। পৃষ্ঠা 161–163।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Al-Darrbagh 1970।
- ↑ Pingree 1988।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ Casulleras 2007।
- ↑ Gutas, Dimitri (১৯৯৮-০৭-২৩)। Greek Thought, Arabic Culture: The Graeco-Arabic Translation Movement in Baghdad and Early 'Abbasaid Society
। Routledge। পৃষ্ঠা 133। আইএসবিএন 0415061334।
- Pages using infobox academic with unknown parameters
- Articles needing more detailed references
- ৮৭৩-এ মৃত্যু
- মধ্যযুগীয় ইসলামের গণিতবিদ
- ৯ম শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী
- বাগদাদের ব্যক্তি
- মধ্যযুগীয় ইসলামের জ্যোতির্বিজ্ঞানী
- ইরানি বিজ্ঞানী
- ৯ম শতাব্দীর ইরানি ব্যক্তিত্ব
- মধ্যযুগীয় ফার্সি জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ
- মধ্যযুগীয় পদার্থবিদ