ফানা (সুফিবাদ)
সুফিবাদ এবং তরিকা |
---|
![]() |
![]() ![]() |
সুফিবাদে ফানা শব্দটির অর্থ হল 'অন্তর্ধান' বা 'নিঃশেষ হয়ে যাওয়া'[১]। অন্য কথায়, 'ফানা' হল একজন মানুষের মৃত্যুর আগেই তার অহংকারের মৃত্যু বরণ করা। এই ধারণাটি পারস্যের আধ্যাত্মিক কবি ও সুফি ব্যক্তিত্ব রুমি সহ অনেক বিশিষ্ট সুফিদের দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।[২][৩] 'ফানা' কী? এই প্রশ্নটি নিয়ে সুফিদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। কিছু সুফির মতে, ফানা হল মানুষের অহংকারের সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং আল্লাহর ইচ্ছার একটি মাধ্যম হিসেবে নিজেকে পরিণত করা। এই অবস্থাকে বাকা বলা হয়।[৪]
অন্যদিকে, অনেক সুফি মনে করেন যে, ফানা হল ব্যক্তিগত অহংকারের পতন এবং আল্লাহ, সৃষ্টি এবং ব্যক্তিগত সত্তার মৌলিক একতার স্বীকৃতি। তবে, এই অবস্থায় প্রবেশকারী ব্যক্তিরা আল্লাহ এবং সকল সৃষ্টির মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত একতা (তাওহীদ) সম্পর্কে পরম সচেতনতা অর্জন করে। এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাকে অনেক রক্ষণশীল মুসলমানরা কুফরি বলে গণ্য করে।[১][৪][৫]
ধারণা
[সম্পাদনা]অন্যান্য সুফি মতবাদের মতো ফানা-ও ইসলামের মৌলিক শিক্ষার ভিত্তিতে গঠিত। বিশেষত, কোরআন-এ বলা হয়েছে:
"যা কিছুই ভূপৃষ্ঠে রয়েছে সবই নশ্বর। অবিনশ্বর কেবল আপনার প্রতিপালকের সত্তাই, যিনি অধিকারী সম্মান ও মর্যাদার এবং অনুগ্রহ ও দয়ার।"
দর্শন হিসেবে ফানা
[সম্পাদনা]আল-জুনায়েদ আল-বাগদাদী, আল-গাজ্জালী এবং আল-সাররাজের মতো আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বরা মনে করতেন যে সুফিবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ঐশ্বরিক দর্শন (মুশাহাদাহ)।[৪][৭]
আবু নসর আস-সাররাজ ফানাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন:
নিজস্ব সত্তার (নফস) গুণাবলী থেকে মুক্ত হওয়া এবং যে কোনো বিষয়ে নির্ভরতা ও বিদ্বেষ দূর করা।[৭]
— আল-সাররাজ, কিতাব আল-লুমা ফি আল-তাসাউউফ
আল-হুজভিরি এই বিষয়ে বলেন:
আপনি যদি বলেন যে 'নিঃশেষ হওয়া' একটি নিঃশেষ হওয়ার স্বতন্ত্র অবস্থা, তাহলে এই ক্ষেত্রে 'নিঃশেষ হওয়া' (ফানা) মানে হল 'অন্য সবকিছুর স্মৃতির নিঃশেষ হয়ে যাওয়া' এবং 'অস্তিত্ব' (বাকা) মানে হল 'আল্লাহর স্মৃতির অস্তিত্ব' (বাকা আল-ধিকর আল-হাক্ক)।[৭]
— আল-হুজভিরি, কাশফ আল-মাহজুব
প্রাচীন সুফিদের মতে, 'ফানা' হল আল্লাহর ইচ্ছার স্বীকৃতি দেওয়া বা নিজের সচেতনতা ত্যাগ করে কেবল আল্লাহর চিন্তায় নিমগ্ন হওয়া। অর্থাৎ, তারা 'ফানাকে' নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছায় সমর্পণ করার একটি প্রক্রিয়া হিসাবে দেখত। এই অবস্থায়, ব্যক্তি তার নিজস্ব ইচ্ছা, অভিলাষ এবং পরিচয়কে পরিত্যাগ করে আল্লাহর ইচ্ছাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।
আল-হুজ্জুিরি মতে, আধ্যাত্মিক সন্ধানী যদি নিরন্তর চেষ্টা না করে তাহলে সে ঐশ্বরিক দর্শন লাভ করতে পারবে না। এই ধরনের দর্শনকে 'ইলম আল-ইয়াকিন' বা নিশ্চয়তার জ্ঞানের সাথে যুক্ত করা হয়। এই অবস্থা থেকে 'আইন আল-ইয়াকিন' (নিশ্চয়তার দর্শন) এবং তারপর 'মারিফাত' (জ্ঞান) এর অবস্থায় পৌঁছে শেষ পর্যন্ত 'হাক্ক আল-ইয়াকিন' (নিশ্চয়তার বাস্তবতা) অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধুদের (ওয়ালি আল্লাহ) অবস্থায় পৌঁছায়। এই হাক্ক আল-ইয়াকিন অবস্থাকেই আল-গাজ্জালি ফানা কুল্লি এবং ফানা ফি আত-তৌহীদ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আল-গাজ্জালি এবং তার আগে আল-জুনাইদ উভয়ের কাছে এর অর্থ ছিল মহাবিশ্বের একমাত্র কর্তা হিসাবে আল্লাহকে স্বীকৃতি দেওয়া। তবে ফানা ফি আত-তৌহীদের অর্থ 'মিশ্রণ', 'অভিন্নতা', 'অবতার' ইত্যাদি নয়। বরং আল-গাজ্জালির মতে, দার্শনিকদের মতো অনুমানের মাধ্যমে বা আল-বিস্তামি এবং আল-হল্লাজের মতো একাত্মতার দাবির মাধ্যমে আল্লাহকে জানা যায় না, বরং ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ (মুশাহাদা) এর মাধ্যমে আল্লাহর স্ব-প্রকাশ (খাসফ) এর মাধ্যমেই তাকে জানা যায়।
আল-সাররাজ অবতারবাদ এবং সংমিশ্রণের ধারণাকে (নিচে উল্লেখিত ঐক্যবাদী ব্যাখ্যা) কঠোরভাবে নিন্দা করেছেন:
কিছু বাগদাদি সুফি এই ভুল ধারণা পোষণ করেছেন যে, যখন তারা তাদের নিজস্ব গুণাবলী থেকে মুক্ত হন, তখন তারা আল্লাহর গুণাবলীতে প্রবেশ করেন। এটি অবতারবাদের ধারণা সৃষ্টি করে অথবা খ্রিস্টধর্মের যিশু সম্পর্কিত বিশ্বাসের দিকে নিয়ে যায়। এই মতবাদ কিছু প্রাচীন সুফিদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হলো—যখন একজন ব্যক্তি নিজের গুণাবলী থেকে বেরিয়ে আসে এবং আল্লাহর গুণাবলীতে প্রবেশ করে, তখন সে নিজের ইচ্ছা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় প্রবেশ করে। সে বুঝতে পারে যে তার ইচ্ছা আল্লাহর দান এবং এই দানের ফলে সে নিজেকে ভুলে যায় এবং সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর প্রতি নিবেদিত হয়। এটি ঐক্যবাদীদের (তাওহিদবাদীদের) একটি ধাপ। যারা এই মতবাদে ভুল করেছেন, তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে আল্লাহর গুণাবলী আল্লাহ নিজে নন। গুণাবলীর সঙ্গে আল্লাহকে অভিন্ন করা অবিশ্বাসের (কুফর) শামিল, কারণ আল্লাহ আত্মায় অবতীর্ণ হন না। বরং আত্মায় যা প্রবেশ করে, তা হলো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাঁর ঐক্যের প্রতি বিশ্বাস (তাওহিদ) এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।[৭]
— আল-সাররাজ, কিতাব আল-লুমা ফি আল-তাসাউউফ
এই দৃষ্টিভঙ্গি কিছু চিন্তাবিদের দ্বারা "মধ্যপন্থী ইসলামী সুফিবাদ" হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে পরবর্তী ব্যাখ্যাটি "অসাধারণ সুফিবাদ" বলে বিবেচিত হয়েছে।[৪]
একতা হিসেবে ফানা
[সম্পাদনা]ফানার আরেকটি ব্যাখ্যা হলো একত্ব বা সত্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐক্য (ইত্তিহাদ) প্রতিষ্ঠা।[৪] এই ধারণার দুই বিখ্যাত প্রচারক হলেন বায়েজিদ বোস্তামি এবং মানসুর আল–হাল্লাজ, যারা ফানাকে সম্পূর্ণ ঐক্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন।[৪]
ফানার বিষয়ে জালালুদ্দিন রুমি-র ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
"যখন শেখ (হাল্লাজ) বললেন, 'আমি আল্লাহ' এবং তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করলেন, তিনি সকল অন্ধ (সন্দেহবাদী) ব্যক্তিকে পরাজিত করলেন। যখন একজন মানুষের 'আমি' অস্তিত্ব থেকে বিলীন হয়ে যায়, তখন কী থাকে? চিন্তা করো, হে অবিশ্বাসী।"[৮]
সুলতান বাহু তাঁর "আইন-উল-ফকর" গ্রন্থে ফানাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:
"শুরুতে আমি ছিলাম চার, পরে তিন হলাম, তারপর দুই। এবং যখন আমি 'দুই' থেকে মুক্তি পেলাম, তখন আমি আল্লাহর সঙ্গে এক হয়ে গেলাম।"
সৈয়দ হোসেইন নাসর এই ব্যাখ্যাকে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক সত্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।[৪]
প্রাচ্য ধর্মগুলোর সাথে মিল
[সম্পাদনা]সুফিবাদের ফানার ধারণার তুলনা হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সমাধি ধারণার সঙ্গে করা হয়েছে।
কেউ কেউ ফানার সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের শূন্যতার (Śūnyatā) ধারণার তুলনা করেছেন, যা সমস্ত কিছুর "শূন্যতা" এবং বাস্তবতার ঊর্ধ্বে অবস্থিত। তবে সুফিবাদের দৃষ্টিতে, জগতের পিছনের বাস্তবতা শূন্যতা নয়, বরং আল্লাহ।[৯]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Harmless, William. Mystics. New York: Oxford University Press, 2008
- ↑ Rumi, Raza (২০০৮-০৯-১৭)। "Fana: When the ego gets annihilated"। Raza Rumi (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-২৯।
- ↑ Mystics, William Harmless. Oxford University Press, USA, 2008. Page 187
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ Yaran, Cafer. Muslim religious experiences. Alister Hardy Religious Experience Research Centre, 2004.
- ↑ "Fana in Sufism"। Britannica।
- ↑ 7 Renowned Translations, Arabic to English Translation। "Surah Ar-Rahman (55), 165"।
- ↑ ক খ গ ঘ Mat, Ismail. "[en] The Concept of Fana'in Sufism." Islāmiyyāt 2 (1978).
- ↑ Reza Aslan: Kein Gott außer Gott: Der Glaube der Muslime bis zur Gegenwart. Verlag C.H. Beck, 2006, ISBN 3-406-54487-8, p. 235 (German)