প্রাণীদের মধ্যে ধর্মীয় আচরণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

প্রাণীদের বিশ্বাস (Animal faith) হচ্ছে প্রাণীদের আচরণ নিয়ে একটি পাঠ যা আদি-ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে প্রস্তাব দেয়। এরকম কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যে কোন অ-মানব প্রাণী ঈশ্বর বা দেবতায় বিশ্বাস করে, পূজা বা প্রার্থনা করে, অধিবিদ্যা সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা আছে, ধর্মীয় আচারগত গুরুত্ব আছে এমন কোন মূর্তি তৈরি করে, বা মানুষের ধর্মীয় আচরণের মত অন্য কোন আচরণ করে। প্রাণীর কোন রকম ধর্মীয় বিশ্বাস আছে কিনা তা ধর্মের পর্যাপ্ত পরিমাণে উদার সংজ্ঞা এর উপরে নির্ভর করে। তাই যদি ধর্ম বলতে, "অ-মানবকেন্দ্রিক, অ-নরত্বারোপনমূলক, নিরীশ্বরবাদী ও অ-ধীকেন্দ্রিক আন্ত-প্রজাতীয় ধর্ম বোঝানো হয়,[১][২] তাহলে শিম্পাঞ্জী, হাতি, ডলফিন ও অন্যান্য প্রাণীদের আচারগত কিছু আচরণকে ধর্মীয় আচরণ বলা যায়।

আধুনিক মানুষ ও তার নিকট পূর্বপুরুষের মধ্যে ধর্মের বিকাশ এর আলোচনায় আধুনিক প্রাণীদের মধ্যে আদি-ধর্মের আলোচনাটি প্রাসঙ্গিক।

নরবানরদের মধ্যে আচারগত আচরণ[সম্পাদনা]

ধর্মতাত্ত্বিক ও জীববিজ্ঞানী অলিভার পাৎজ বলেন, যেহেতু শিম্পাঞ্জীরা নৈতিক প্রতিনিধিত্বে (কোন কাজ ঠিক নাকি ভুল এসম্পর্কে ধারণায় আসা, এবং তার উপর ভিত্তি করে কাউকে দায়ী করা) সক্ষম, খ্রিস্টানরা তাদেরকে ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি হিসেবে মনে করতে পারে।[৩] এছাড়াও, ন্যান্সি আর. হাওয়েল প্রস্তাব করেন, "শিম্পাঞ্জী ও বনবোদের মধ্যে সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার আদিরূপ, যেমন সংযুক্তি, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সামাজিকতা ও কিছু মাত্রায় সাংকেতিক ক্ষমতা।[১] প্রাইমেটোলজিস্ট জেন গুডঅল আরও দূরে গিয়ে বলেন, শিম্পাঞ্জীদেরকে ঘন বৃষ্টির সময় বা যখন জলপ্রপাতের কাছে আসে তখন নাচতেও দেখা যায়। তিনি বলেন তাদের এই প্রদর্শনটি ধর্মীয় প্রথার পূর্বসুরি।[৪] যাই হোক, ধর্মতাত্ত্বিক ক্রিস্টোফার এল. ফিশার মনে করেন, গুডঅল শিম্পাঞ্জীদের উপর নরত্বারোপ করেছেন। অবশ্য তিনি বলেছেন, শিম্পাঞ্জীরা "গভীর আবেগ" প্রকাশে সক্ষম, তবে তিনি বলেন, শিম্পাঞ্জীরা আধ্যাত্মিকতার অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে না, কারণ, "ভাষা ছাড়া এর কোন অর্থ হয় না।"[৫]

অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে আচারগত আচরণ[সম্পাদনা]

রোনাল্ড কে. সিগল আফ্রিকার হাতিদের মধ্যে এই ধর্মীয় বিশ্বাসের পূর্বসুরি সম্পর্কে গবেষণা করেছেন, এবং বলেছেন, "হাতিরা প্রাকৃতিক চক্রগুলো সম্পর্কে সচেতন, কারণ তারা "চন্দ্র পূজা" এর চর্চা করে, এবং অপূর্ণ চন্দ্রের দিকে শাখা প্রশাখাকে নাড়ায়, এবং পূর্ণচন্দ্রের সময় আচারগত স্নানে অংশ নেয়।[৬]

প্রাণীদের মধ্যে অন্তেষ্টিক্রিয়ার প্রথা[সম্পাদনা]

অনেক প্রাণীর মধ্যেই মৃত পশুর জন্য দুঃখ করার ব্যাপারটি সাধারণ, কিন্তু অন্তেষ্টিক্রিয়ার আচার সকল প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। তবে আফ্রিকান হাতিরা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।[৭]

রোনাল্ড কে. সিগল লিখেছেন: "... কেউ হাতিদের বিস্তৃত অন্তেষ্টিক্রিয়ার আচরণটিকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না, যা সেই প্রজাতির প্রথাগত বা এমনকি ধর্মীয় আচরণের সংকেত দেয়। যখন মৃত হাতিদের সৎকারের বিষয়টি আসে, হাতিরা প্রায়ই তাদেরকে কাঁদা, মাটি ও পাতা দিয়ে সমাধিস্থ করে। হাতিরা হাতি ছাড়াও গণ্ডার, মহিষ, গরু, বাছুর এবং এমনকি মানুষকেও এভাবে সমাধিস্থ করে। হাতিদেরকে প্রচুর পরিমাণে ফল, ফুল এবং রঙ্গিন পাতা দিয়েও মৃতদেহকে সৎকার করতে দেখা গেছে।"[৬]

বন্য ও ধৃত শিম্পাঞ্জী, উভয়ের মধ্যেই নিজেদের দলের কোন সদস্যের মৃত্যুতে প্রথাগত আচরণ করতে দেখা যায়। এই আচরণগুলো শুরু হয় দলের বা কোন সদস্যের নীরবতার মধ্য দিয়ে, যা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিরাজমান থাকে, এবং এরপর হাতিগুলো নির্দিষ্ট কিছু শব্দ উচ্চারণ করে; এমনটা দেখা গিয়েছে। এরপর এরা মৃতদেহকে সজ্জিত করে, এরপর একে একে পবিত্রতার সহিত মৃতদেহকে দেখতে আসে, এবং মৃতদেহের দিকে তাকায়। এরা মৃতের প্রতি শোক প্রদর্শন করে, এবং এদের মধ্যে দুঃখের গোঙ্গানির স্বর শোনা যায়।[৮]

হাতি ও শিম্পাঞ্জি ছাড়াও ডলফিনদেরকেও মৃতের প্রতি মনোযোগ প্রতি আলাদাভাবে মনোযোগী হতে দেখা গিয়েছে। ডলফিনকে কয়েকদিন যাবৎ মৃত সদস্যের সাথে থাকতে দেখা যায়, আর ডুবুরীদের কাছাকাছি আসতে তারা বাধা দেয়।[৯] তাদের আচরণের কারণ এখনও অস্পষ্ট। গবেষকগণ এদের কাজগুলোকে পর্যবেক্ষণ করছেন, চিন্তার কোন প্রক্রিয়াগুলো তাদেরকে এই কাজে উৎসাহ দান করে তা বর্তমান গবেষণাগুলো থেকে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।[১০]

প্রাথমিক আধুনিক মানুষ নিয়ে গবেষণায় প্রাসঙ্গিকতা[সম্পাদনা]

প্রাণীদের আচারগত জীবন প্যালিওএনথ্রোপলজিস্টদের কাছে আগ্রহের বিষয়, কারণ এগুলো তাদেরকে এই বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি দান করে যে, কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষের মাঝে ধর্মীয় বিশ্বাসব্যবস্থা বিকশিত হয়েছিল। "ক্রো-ম্যাগনন মানবের কঙ্কালের ধ্বংসাবশেষ ভ্রূণীয় অবস্থানে (ফিটাল পজিশনে) রাখা, কারণ আদি লোকধারণা অনুসারে এই অবস্থান পুনর্জন্মে সুবিধা দান করে। অ-মানব প্রাণীদের মধ্যে আত্মীয়দের নিয়ে আচরণ আমাদেরকে মানুষের প্রকৃতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে বুঝবার সুযোগ দান করে।"[১১] এদিকে, কেউ কেউ আফ্রিকার হাতি ও নিয়ান্ডারথালদের অন্তেষ্টিক্রিয়া প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু অগভীর সাদৃশ্য লক্ষ করেছেন।[১২]

বিবর্তনগত মনোবিজ্ঞানী ম্যাট রসানো তত্ত্ব দেন যে, ধর্ম তিনটি পর্যায়ে বিবর্তিত হয়েছে: প্রাক-উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগে, পরমানন্দদায়ক আচার দ্বারা ধর্মকে চিহ্নিত করা যেত যা সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। পরবর্তীতে উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগে শামানীয় চিকিৎসা আচার বিকশিত হয়। শেষে, গুহাচিত্র, আচারগত মূর্তি, পূর্বপুরুষ পূজা এবং পুরাকাহিনী ও নৈতিক বিধানের অন্তর্ভূক্তির মধ্য দিয়ে ধর্মীয় প্রকাশ বিকশিত হয়।[১৩] এটা যদি সত্য হয় তাহলে গুডঅল বর্ণিত শিম্পাঞ্জীদের আচরণকে প্রাক-উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের ধর্মের সদৃশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। অবশ্য ডি ওয়াল বলেন, বনোবোদের থেকে (শিম্পাঞ্জী গণের একটি প্রজাতি) এরকম আচারগত আচরণের কোন সাক্ষ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু তারা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং তারা নৈতিক প্রতিনিধিত্ব প্রদর্শন করে। এটি নৈতিকতাপ্রাক-ধর্ম এর সহবিকাশের সম্ভাবনার সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি করে।[১৪]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Harrod JB. (2014). "The Case for Chimpanzee Religion" Journal for the Study of Religion, Natural and Culture (8.1)
  2. Harrod, JB. (২০১১)। "A Trans-Species Definition of Religion"। Journal for the Study of Religion, Nature and Culture5 (3): 327-353। ডিওআই:10.1558/jsrnc.v5i3.327 
  3. Putz O (2009). "Social Apes in God's Image: Moral Apes, Human Uniqueness, and the Image of God" Journal of Religion and Science, August
  4. Goodall J () "Primate spirituality" The Encyclopaedia of Religion and Nature. edited by B. Taylor. Thoemmes Continuum, New York. Pp. 1303-1306
  5. Fisher CL (2005). "Animals, Humans and X-Men: Human Uniqueness and the Meaning of Personhood" Theology and Science Volume 3 Issue 3 pp.291-314
  6. Siegel RK (1980). "The Psychology of Life After Death" American Psychologist, Vol. 35(10), October pp.911-931
  7. Bekoff M (2009). "Grief in Animals" Psychology Today, October
  8. Harrod, James B. (২০১৪)। "The Case for Chimpanzee Religion"। Journal for the Study of Religion, Natural and Culture8 (1): 16–25। 
  9. Ritter F (2007). "Behaviour Responses of Rough-toothed Dolphins to a Dead Newborn Calf" Marine Mammal Science April pp.429-433
  10. Dudzinski KM; Sakai M; Masaki K; Kogi K; Hishii T; Kurimoto M (2003). "Behavioural Observations of Bottle Nose Dolphins Towards Two Dead Conspecifics" Aquatic Mammals 29.1, pp.108-116
  11. Siegal RK (1981). "Accounting for 'Afterlife' Experiences" Psychology Today, January p.4
  12. Sapolsky, Robert M. (2006) Monkeyluv: And other Essays on Our Lives as Animals. Scribner Book Co. p.189 আইএসবিএন ০-৭৪৩-২৬০১৫-৫.
  13. Rossano MJ (2006). "The Religious Mind and the Evolution of Religion" Review of General Psychology, Vol 10(4) December pp346-364
  14. De Waal, Frans (2013) The Bonobo and the Atheist. W.W. Norton & Co., আইএসবিএন ৯৭৮-০-৩৯৩-০৭৩৭৭-৫