প্রকৃতিতে বিন্যাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নামিব মরুভূমিতে বায়ুপ্রবাহের কারণে বালিয়াড়ির বালু প্রাকৃতিক বিন্যাস তৈরি করে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই অর্ধচন্দ্রাকার বালিয়াড়ি ও বালির তরঙ্গ একের পর এক তৈরি হতে থাকে।
আবরণযুক্ত গিরগিটির (Chamaeleo calyptratus) বিন্যাস ছদ্মবেশ, ভাব আদান-প্রদান ও যৌন অবস্থার সঙ্কেত বহন করে।

প্রকৃতিতে বিন্যাস হলো প্রাকৃতিক জগতে দৃশ্যমান সুষমতা। এই বিন্যাসগুলোকে বিভিন্ন অবস্থায় বারবার দেখা যায়। অনেক সময় আবার এদেরকে গাণিতিক মডেলের সাহায্যেও ব্যাখ্যা করা যায়। প্রাকৃতিক বিন্যাসের মধ্যে রয়েছে প্রতিসাম্য, বৃক্ষ, সর্পিল বিন্যাস, সর্পিল পথ, তরঙ্গ, ফেনা, টালি, ভাঙন ও ডোরা। প্রাথমিক যুগের গ্রিক দার্শনিকরা বিন্যাস নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। প্লেটো, পিথাগোরাসএম্পেদোক্লেস প্রকৃতির সুবিন্যস্ততার ব্যাখার দেওয়া চেষ্টা করেছিলেন। কালক্রমে দৃশ্যমান বিন্যাসের আধুনিক ধারণা গড়ে ওঠেছে।

ঊনবিংশ শতকে বেলজিয়ান পদার্থবিদ জোসেপ প্ল্যাতৌ সাবানের আবরণ নিয়ে পরীক্ষা চালান। এ পরীক্ষা থেকে তিনি ন্যূনতম পৃষ্ঠের ধারণা সূত্রবদ্ধ করেন। জার্মান জীববিজ্ঞানী ও শিল্পী আর্নেস্ট হেকেল প্রতিসাম্যের গুরুত্ব উপস্থাপন করার জন্যে শত শত সামুদ্রিক জীবের ছবি আঁকেন। স্কটিয় জীববিজ্ঞানী দার্চি থমসন উদ্ভিদ ও প্রাণীতে বৃদ্ধির বিন্যাস নিয়ে গবেষণার সূচনা করেন। তিনি দেখান যে সরল সমীকরণ দিয়েই সর্পিল বৃদ্ধির ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। বিংশ শতকে ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যালান টুরিং মরফোজেনেসিস প্রক্রিয়ার পূর্বাভাস দেন, যার মাধ্যমে ফোটা ও ডোরাকাটা দাগ তৈরি হয়। হাংগেরিয় জীববিজ্ঞানী আরিস্তিদ লিন্ডেনমেয়ার ও ফরাসি আমেরিকান গণিতবিদ বনোয়া মঁদেলব্রো দেখান কীভাবে ফ্রাক্টাল উদ্ভিদের বৃদ্ধির বিন্যাস তৈরি করতে পারে।

প্রকৃতির বিভিন্ন স্তরে গণিত, পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের মাধ্যমে বিন্যাসের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। জীবিত বস্তুর মধ্যে দৃশ্যমান বিন্যাস জীববিজ্ঞানের প্রাকৃতিক নির্বাচন ও যৌন নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। বিন্যাস তৈরি বিষয়ক গবেষণাগুলো কম্পিউটার নমুনা ব্যবহার করে বিভিন্ন রকম বিন্যাসের নকল তৈরি করে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

উদ্ভিদের গঠনের ফিবোনাচি ধারার বিন্যাস খুব বেশি দেখা যায়। ছবিতে সাগুর (Cycas circinalis মোচা।

প্রকৃতির সুবিন্যস্ততার আধুনিক ধারণাগুলোর জন্ম হবার আগেই প্রাথমিক যুগের গ্রিক দার্শনিকরা এগুলোর ব্যাখার দেওয়া চেষ্টা করেছিলেন। পিথাগোরাস (খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০-৪৯৫) সংখ্যা থেকে আসা সঙ্গীতের ঐকতানের মতো করে প্রকৃতির বিন্যাস ব্যখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, সংখ্যাই অস্তিত্বের মৌলিক উপাদান। জীবের গঠন বিষয়ক ডারউইনের বিবর্তনগত ব্যাখ্যার কিছু অংশ এম্পেদোক্লেস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪-৪৩৪) বুঝতে পেরেছিলেন। প্লেটো (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭-৩৪৭) বিশ্বাস করতেন প্রাকৃতিক বস্তুসমূহের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তাঁর মতে, বৈশিষ্ট্যগুলো আদর্শ আকৃতি (εἶδος এইদোস: "আকৃতি") নিয়ে গঠিত। আর ভৌত বস্তুসমূহ এর ত্রুটিপূর্ণ নকলের চেয়ে বেশি কিছু নয়। অতএব, একটি ফুলের আকৃতি বৃত্তের কাছাকাছি হতে পারে, কিন্তু কখনোই নিখুঁত বৃত্ত নয়।

থিওফ্রাস্টাস (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-২৮৭) খেয়াল করেছিলেন, যে উদ্ভিদদের চ্যাপ্টা পাতা আছে তাদের পাতাগুলো একটি ধারা মেনে বিন্যস্ত থাকে। প্লিনি (২৩–৭৯ খ্রিস্টাব্দ) এদের বৃত্তাকার বিন্যাস লক্ষ করেন। বহু শতাব্দী পরে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি পাতার সর্পিল সজ্জা পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়াও দেখেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাছের কাণ্ডে একের পর এক বলয় তৈরি হয়। প্রকৃতিতে ফিবোনাচি সংখ্যার উপস্থিতি দেখান জোহানেস কেপলার (১৫৭১–১৬৩০)। এর মাধ্যমে তিনি কিছু ফুলের পঞ্চভুজাকার আকৃতির ব্যাখ্যা দেন। ১৭৫৪ সালে চার্লস বনেট লক্ষ করেন, উদ্ভিদের সর্পিল বিন্যাসে ডান ও বামাবর্তী দুই ধরনের সোনালী অনুপাত ধারাই খুব বেশি দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৮৩০ সালে কার্ল ফ্রেদরিক শিম্পার ও তার বন্ধু আলেকজান্ডার ব্রোন উদ্ভিদের পাতার বিন্যাসের গাণিতিক পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেন। ১৮২৭ সালে অগুস্ত ব্রাভে ও তাঁর ভাই লুই উদ্ভিদের পাতার বিন্যাসের অনুপাতের সাথে ফিবোনাচি ধারার সম্পর্ক দেখান। একই সম্পর্ক দেখান পাইন গাছের মোছা ও আনারসেও। জার্মান মনোবিদ অ্যাদলফ জেইসিং তাঁর ১৮৫৪ সালের বইয়ে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ, প্রাণীর খুলি, শিরা ও স্নায়ুর শাখায় এবং স্ফটিকের সজ্জায় সোনালী অনুপাতের উপস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করেন। এ. এইচ. চার্চও তাঁর ১৯৫৪ সালের বইয়ে উদ্ভিদের পাতার বিন্যাস নিয়ে পর্যালোচনা করেন। ১৯১৭ সালে দার্চি থম্পসন প্রকাশ করেন অন গোথ অ্যান্ড ফর্ম। তাঁর উদ্ভিদের পাতার বিন্যাস ও ফিবোনাচি ধারার বিবরণ তথা উদ্ভিদের সর্পিল বৃদ্ধির বিন্যাসে গাণিতিক সম্পর্ক থেকে দেখা যায় পশুর শিং ও শামুকজাতীয় প্রাণীর খোলসের সর্পিল বৃদ্ধির বিন্যাস সরল গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

১২০২ সালে লিওনার্দো ফিবোনাচি তাঁর বই লিবের আবাচি' প্রকাশ করে পশ্চিমা বিশ্বকে ফিবোনাচি ধারার সাথে পরিচিত করান। তিনি আদর্শায়িত খরগোশের বৃদ্ধি নিয়ে একটি চিন্তন পরীক্ষা উপস্থাপন করেন।

১৬৫৮ সালে ইংরেজ শারীরবিদ ও দার্শনিক থমাস ব্রাউন তাঁর দ্য গার্ডেন অব সাইরাস বক্তব্যে আলোচনা করেন কীভাবে প্রকৃতির জ্যামিতিকায়ন হচ্ছে। এতে তিনি ৫ বিষয়ক পিথাগোরীয় গণনাবিদ্যা ও কুইনকাংক্স বিন্যাসের প্লেটোনিং ফর্মের কথা উল্লেখ করেন। বক্তব্যের শেষে ছিল উদ্ভিদবিদ্যায় কুইনকাংক্সের উদাহরণ ও পর্যবেক্ষণের কথা।

বেলজিয়ান পদার্থবিদ জোসেফ প্ল্যাতৌ (১৮০১–১৮৮৩) একটি নির্দিষ্ট সীমানার ন্যূনতম পৃষ্ঠের উপস্থিতির গাণিতিক সমস্যাকে সূত্রবদ্ধ করেন। তিনি সাবানের আবরণ নিয়ে নিবিড় অনুসন্ধান চালান। সূত্রবদ্ধ করেন প্ল্যাতৌর সূত্র, যা দিয়ে ফেনায় আবরণের কাঠামো ব্যাখ্যা করা যায়।

আর্নেস্ট হেকেল (১৮৩৪–১৯১৯) সামুদ্রিক জীবের, বিশেষ করে রেডিওলাইরার দৃষ্টিনন্দন ছবি আঁকেন। এর মাধ্যমে তিনি এ জীবগুলোর প্রতিসাম্য দেখিয়ে বিবর্তন বিষয়ক তাঁর নকল-ডারউইনীয় তত্ত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন।

১৮৮৫ সালে আমেরিকান আলোকচিত্রী উইলসন বেন্টলে তুষারফলকের প্রথম আণুবীক্ষণিক ছবি তোলেন।

অ্যালান টুরিং (১৯১২–১৯৫৪) কম্পিউটার ও কোড ভাঙা বিষয়ক কাজের জন্য বেশি পরিচিতি পেলেও ১৯৫২ সালে দ্য কেমিকেল বেসিস অব মরফোজেনেসিস নামে একটি নিবন্ধ লেখেন। এখানে তিনি মরফোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় জীবের মধ্যে বিন্যাস তৈরির কৌশল বিশ্লেষণ করেন। তিনি স্পন্দনশীল রাসায়নিক বিক্রিয়া, বিশেষ করে বেলৌসভ-জাভোতিন্সকি বিক্রিয়ার পূর্বাভাস দেন। টুরিং বলেন, এই সক্রিয়ক-বাধাদানকারী কৌশল ডোরা ও প্রাণীর গায়ে দাগের বিন্যাস (যেগুলোকে টুরিং বিন্যাস বলা হয়) তৈরি করতে পারে এবং উদ্ভিদের পাতায় সর্পিল বিন্যাসেও ভূমিকা রাখে।

দার্চি থমসন তাঁর ১৯১৭ সালের বইয়ে বৃদ্ধি ও আকার বিষয়ক বিশ্লেষণের সূচনা করেন।

১৯৬৮ সালে হাংগেরীয় তাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানী আরিস্তিদ লিন্ডেনমেয়ার (১৯২৫–১৯৮৯) এল-ব্যবস্থা তৈরি করেন। এটি একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাকরণ যা দিয়ে ফ্রাক্টালের রীতিতে উদ্ভিদের বৃদ্ধির বিন্যাসকে মডেল করা যায়। এল-ব্যবস্থাগুলোতে কিছু চিহ্ন নিয়ে গঠিত একটি বর্ণমালা আছে, যেগুলোকে আনুষ্ঠানিক ব্যাকরণের সাহায্যে মিশ্রিত করে চিহ্নের আরও বড় গুচ্ছ তৈরি করা যায়। এছাড়াও তৈরিকৃত এ গুচ্ছগুলোকে জ্যামিতিক কাঠামোতে রূপ দেওয়ার কৌশলও আছে। কয়েক শতাব্দী ধরে গট‌ফ্রিড লাইব‌নিৎস, গেয়র্গ কান্টর, হেলগ ভন কচ, ওয়াকলো সিয়েরপিন্সকি ও অন্যান্যরা বিন্যাসের গণিত নিয়ে ধীরে ধীরে কাজ করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে বনোয়া মঁদেলব্রো হাউ লং ইজ দ্য ব্রিটেন? স্ট্যাটিস্টিকেল সেলফ-সিমিলারিটি অ্যান্ড ফ্র্যাক্টাল ডিমেনশন শিরোনামে একটি বিখ্যাত গবেষণাপত্র লেখেন। এর মাধ্যমে ফ্র্যাক্টালের ধারণা গাণিতিক চিন্তার সাথে যুক্ত হয়।

কারণ[সম্পাদনা]

অর্কিড, গুঞ্জনপাখি ও ময়ূরের লেজের মধ্যে একটি বিমূর্ত নকশা আছে, যার মধ্যে আছে আকার, বিন্যাস ও বর্ণের সৌন্দর্য। শিল্পীরা এগুলো মেলাতে গিয়ে হিমশিম খান। মানুষ প্রকৃতির যে সৌন্দর্যগুলো অনুভব করেন সেগুলোর কারণ, বিশেষ করে কোন ধরনের ভৌত আকৃতি তৈরি হবে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে কীভাবে বিন্যাসের বিবর্তন হবে সে বিষয়ক গণিতের ভূমিকা বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে।

গণিত সব ধরনের বিন্যাস ও সুষমতা আবিষ্কার ও ব্যাখ্যা করতে চায়। প্রকৃতিতে দৃশ্যমান বিন্যাসের ব্যাখ্যা বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব, ফ্রাক্টাল, লগারিদমিক পেঁচ, টপোগণিত ও অন্যান্য গাণিতিক বিন্যাস দিয়ে বোঝা যায়। উদাহরণস্বরূপ, এল-ব্যবস্থার মাধ্যমে গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন বিন্যাসের শক্তিশালী ব্যাখ্যা দেওয়া যায়।

পদার্থবিদ্যার সূত্র গণিতের বিমূর্ত ধারণাকে বাস্তব জগতের সামনে হাজির করে, অনেক সময় যাকে দেখে একদম নিখুঁত মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি স্ফটিক নিখুঁত হবে যদি এর মধ্যে স্থানচ্যূতি বা এ ধরনের কোনো গঠনগত ত্রুটি না থাকে এবং যদি এটি পুরোপুরি প্রতিসম হয়। বাস্তব কোনো বস্তু নিখুঁত গাণিতিক গুণাবলির নিকটবর্তীই শুধু হয়। প্রকৃতিতে দৃশ্যমান বিন্যাস পদার্থবিদ্যার সূত্র দ্বারা পরিচালিত হয়। যেমন, তরল পদার্থের আঁকাবাঁকা গতিকে প্রবাহী গতিবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

জীববিদ্যায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে জীবের মধ্যে বিন্যাস তৈরি হতে পারে। এর কারণ বিভিন্ন রকম হতে পারে, যেমন ছদ্মবেশ, যৌন নির্বাচন এবং অনুকরণ ও মিথোজীবিতাসহ বিভিন্ন ধরনের সঙ্কেত প্রদান। উদ্ভিদজগতে দেখা যায়, পদ্মফুলের মতো কীটের মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটা ফুলসমূহের আকৃতি, রং ও বিন্যাস এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যাতে মৌমাছির মতো কীটেরা এদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়া রং ও ডোরার বিন্যাস মধুর চিহ্ন বহন করে, যা দূর থেকে দেখা যায় এবং অনেক সময় শুধু অতিবেগুনি আলোতে দৃশ্যমান হয়।

বিন্যাসের ধরন[সম্পাদনা]

প্রতিসাম্য[সম্পাদনা]

জীবের মধ্যে প্রতিসাম্যের দেখা মেলে প্রচুর। প্রাণীতে প্রধানত দ্বিপার্শ্বিক বা দর্পণ প্রতিসাম্য দেখা যায়। উদ্ভিদের পাতা ও অর্কিডের মতো কিছু ফুলের মধ্যেও একই রকম প্রতিসাম্য দেখা যায়। উদ্ভিদের মধ্যে অনেক সময়ই ব্যাসার্ধ বা আবর্তন প্রতিসাম্যও দেখা যায়। একই রকম প্রতিসাম্য দেখা যায় বহুসংখ্যক ফুল ও সাগর কুসুমসহ কিছু কিছু প্রাণীর মধ্যে। একাইনোডার্মাটা পর্বের প্রাণীতে পাঁচভিত্তিক প্রতিসাম্য দেখা যায়। এ পর্বের প্রাণীর মধ্যে আছে তারামাছ, সামুদ্রিক শজারু ও সামুদ্রিক পদ্ম।

জড়বস্তুর মধ্যে তুষারফলকের মধ্যে রয়েছে ছয়ভিত্তিক প্রতিসাম্য। স্ফটিকায়নের সময় প্রতিটি ফলকের কাঠামো বিভিন্ন রকম অবস্থার জন্ম দেয়। তুষারফলকের ছয়টি বাহুতেই বৃদ্ধির বিন্যাস প্রায় একই রকম হয়। সাধারণভাবে স্ফটিকের মধ্যে বিভিন্ন রকম প্রতিসাম্য ও বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এরা ঘনক বা অষ্টতলাকার হতে পারে। তবে প্রকৃত স্ফটিকে পাঁচভিত্তিক প্রতিসাম্য থাকা সম্ভব নয় (যেটা হতে পারে স্ফটিকসদৃশ বস্তুতে)। জড়বস্তুতে বিভিন্ন মাপের আবর্তন প্রতিসাম্য দেখা যায়। এর মধ্যে আছে মুকুটাকৃতির বিক্ষেপ বিন্যাস, যা তৈরি হয় পুকুরে পতিত কোনো ঢিল থেকে। এছাড়াও আছে উপগোলকের আকৃতি এবং শনির মতো গ্রহদের বলয়।

প্রতিসাম্য বিভিন্ন কারণে তৈরি হতে পারে। সাগর কুসুমের মতো যেসব প্রাণীতে বয়স্করা চলাচল করে না তাদের মধ্যে ব্যাসার্ধ প্রতিসাম্য দেখা যায়। এদের খাবার ও বিপদ যে-কোনো দিক থেকে আসতে পারে। তবে যেসব প্রাণীরা কোনো একদিকে চলাচল করে তাদের উপর বা নিচের দিকে বাহু, মাথা ও লেজের প্রান্ত থাকবেই। ফলে, এদের ডান ও বাম পার্শ্বও থাকবে। মুখ ও ইন্দ্রিয় নিয়ে মাথা হয়ে ওঠে বিশেষায়িত অংশ। আর দেহ হয় দ্বিপার্শ্বিকভাবে প্রতিসম (ভেতরের অঙ্গ যদি নাও হয়)। একাইনোডার্মাটা প্রাণীদের পাঁচভিত্তিক প্রতিসাম্য আরও রহস্যময়। এ পর্বের প্রাথমিক প্রাণীরা ছিল দ্বিপার্শ্বিকভাবে প্রতিসম। এদের শূককীট এখনও দ্বিপার্শ্বিকভাবে প্রতিসম। সামর‍্যাল ও রেই এর মতে, পুরানো প্রতিসাম্য হারানোর পেছনে বিকাশ ও পরিবেশগত দুই ধরনের কারণই বিদ্যমান ছিল।

গাছ ও ফ্রাক্টাল[সম্পাদনা]

ফ্রাক্টাল হলো নির্দিষ্ট মাত্রা বিশিষ্ট অসীম পর্যন্ত স্ব-সদৃশ ও পুনরাবৃত্তি ঘটা গাণিতিকি কাঠামো। প্রকৃতিতে অসীম পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয় বলে সব ফ্রাক্টাল বিন্যাসই কিছুটা অপূর্ণাঙ্গ। ফার্ন ও অ্যাপিয়াসি গোত্রের উদ্ভিদের পাতা শুধু ২, ৩ বা ৪ স্তর পর্যন্ত স্ব-সদৃশ। ব্রায়োজোয়া, প্রবাল, বায়ু ফার্নের (Sertularia argentea) মতো হাইড্রোজোয়া ইত্যাদি উদ্ভিদ ও প্রাণীতে ফার্নের মতো বৃদ্ধি দেখা যায়। আবার জড়বস্তুর মধ্যেও, বিশেষ করে ইলেকট্রন স্থানচ্যুতির মধ্যেও এমন বৃদ্ধি দেখা যায়। গাছের বিভিন্ন প্রকার বৃদ্ধির বিন্যাস লিন্ডেনমেয়ার ব্যবস্থা (এল-ব্যবস্থা) ফ্রাক্টালের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। এজন্য শুধু অল্প কয়েকটি পরামিতি পরিবর্তন করতে হয়। এর মধ্যে আছে শাখাকোণ, একাধিক শাখাবিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব (শাখা-মধ্যবর্তী দুরত্ব) ও প্রতি শাখাবিন্দুতে শাখার সংখ্যা।

প্রকৃতিতে ফ্রাক্টালের মতো বিন্যাস প্রচুর দেখা যায়। মেঘ, নদী, ভূতাত্ত্বিক ফল্ট লাইন, পাহাড়, উপকূলীয় রেখা, প্রাণীর রঞ্জন প্রক্রিয়া, তুষারফলক, স্ফটিক, রক্তের ধমনীর শাখা, মাইক্রোফিলামেন্ট ও সামুদ্রিক তরঙ্গের মতো নানাবিধ ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ বিদ্যমান।

সর্পিল আকৃতি[সম্পাদনা]

উদ্ভিদ ও কিছু প্রাণী, বিশেষ করে শামুক জাতীয় প্রাণীতে (মোলাস্কা পর্ব) সর্পিল আকৃতি খুব বেশি দেখা যায়। যেমন, সেফালোপড মোলাস্কের নোটিলাস প্রাণীর খোলসের প্রতিটি প্রকোষ্ঠ পরবর্তী প্রকোষ্ঠের খুব ভালো নকল। একটি ধ্রুব হারে ও লগারিদমিক পেঁচের সজ্জায় এটি প্রসারিত হয়। ফ্রাক্টালের আধুনিক ধারণা বিবেচনা করলে বৃদ্ধির সর্পিল আকৃতিকে স্ব-সাদৃশ্যের একটি বিশেষ রূপ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

উদ্ভিদের পাতার বিন্যাসেও সর্পিল আকৃতি দেখা যায়। এছাড়া অন্যান্য অংশ যেমন ফুলের যৌগিক শীর্ষ এবং সূর্যমুখীর বীজের শীর্ষ বা আনারস ও সালাকের মতো ফলের কাঠামোতেও এমন আকৃতি চোখে পড়ে। দেখা যায় পাইন গাছের মোচায়ও, যেখানে একাধিক পেঁচ ডান ও বামাবর্তী হয়ে ঘুরে আসে। এই সজ্জাগুলোর ব্যাখ্যা বিভিন্ন শাখা থেকে পাওয়া যায় – গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা – প্রতিটি শাখাই নিজস্বভাবে সঠিক, তবে সবগুলো একইসাথে। গাণিতিকভাবে ফিবোনাচি অনুপাত দিয়ে উদ্ভিদের পাতার বিন্যাস তৈরি করা যায়। ফিবোনাচি ধারার সংখ্যাগুলো হলো ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ... (প্রতিটি সংখ্যা পাওয়া যায় আগের দুটি সংখ্যাকে যোগ করে)। উদাহরণস্বরূপ, গাছের কাণ্ডের নীচ থেকে উপরের দিকের পাতাগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিটি সর্পিল আকৃতির একটি আবর্তন দুটি পাতাকে স্পর্শ করে। অতএব, বিন্যাস বা অনুপাত হলো ১/২। ঝাড়-গাছে এ অনুপাত ১/৩, খুবানি ফলে ২/৫ ও কাঠবাদামে ৫/১৩। সূর্যমুখী ও ডেইজির মতো চাকতিসদৃশ বিন্যাসে পুষ্পিকার বিন্যাস ফিবোনাচি ক্রমে ফার্মা পেঁচ মেনে চলে, অন্তত যখন ফুলের শীর্ষ বয়স্ক হয় এবং সবগুলো উপাদান সমান আকার পায়। ফিবোনাচি অনুপাতগুলো সোনালী কোণের (137.508°) খুব কাছাকাছি হয়। আর সোনালী কোণই ফার্মা পেঁচের বক্রতা নিয়ন্ত্রণ করে।

পদার্থবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সর্পিল আকৃতি হলো সবচেয়ে নিম্ন-শক্তির সজ্জা, যা গতিশীল ব্যবস্থায় স্ব-সংগঠন প্রক্রিয়ায় স্বতস্ফূর্তভাবে তৈরি হয়। রসায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিক্রিয়া-ব্যাপন প্রক্রিয়ায় সর্পিল আকৃতির উদ্ভব ঘটে, যে প্রক্রিয়ায় সক্রিয়করণ ও বাধাপ্রদান দুটিই ঘটে। উদ্ভিদের হরমোন অক্সিনের ঘনত্ব পরিবর্তন করা প্রোটিনই পাতার বিন্যাস নিয়ন্ত্রণ করে। অক্সিনই কাণ্ডের চারপাশে কুঁড়ির আপেক্ষিক কোণ নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য কৌশলসহ ভাজক কলার বৃদ্ধি সক্রিয় করে। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনো নির্দিষ্ট স্থানে পাতার সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিন্যাসের পক্ষে, কারণ এর মাধ্যমে সম্পদের, বিশেষ করে সালোকসংশ্লেষণের জন্য সূর্যালোকের সবচেয়ে ভালো ব্যবহার সম্ভব।

বিশৃঙ্খলা, প্রবাহ ও সর্পিল পথ[সম্পাদনা]

গণিতে একটি গতিশীল ব্যবস্থাকে বিশৃঙ্খল বলা হয় যদি এটি প্রাথমিক অবস্থার প্রতি (খুব বেশি) সংবেদনশীল হয় (তথাকথিত প্রজাপতি প্রভাব)। এর জন্য প্রয়োজন টপোগাণিতিক মিশ্রণ ও ঘন পর্যায় কক্ষপথ।

ফ্রাক্টালের পাশাপাশি বিশৃঙ্খলা তত্ত্বও আবশ্যকীয়ভাবে প্রকৃতির বিন্যাসে সার্বজনীন ভূমিকা রাখে। বিশৃঙ্খলা ও ফ্রাক্টালের মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে—বিশৃঙ্খল ব্যবস্থার একটি আকর্ষকের ফ্রাক্টাল মাত্রা আছে। বিন্যাস তৈরিকারী সরল গাণিতিক নিয়মের গুচ্ছ বা সেলুলার অটোম্যাটায় বিশৃঙ্খল আচরণ দেখা যায়। এর অন্যতম ভালো উদাহরণ হলো স্টিফেন উলফ্রামের ৩০-এর নিয়ম।

ঘূর্ণি সড়ক হলো ঘুরপাক খেতে থাকা বস্তুর আঁকাবাঁকা বিন্যাস, যা বাধাদানকারী বস্তুর ওপর প্রবাহীর গতির অস্থিতিশীল বিচ্ছেদের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রবাহী হিসেবে থাকে বায়ু বা পানি। প্রবাহীর সান্দ্রতার তুলনায় বাধাদানকারী বস্তুর আকার বা প্রবাহের গতি বেড়ে গেলে শান্ত (ল্যামিনার) প্রবাহ ভেঙে যেতে শুরু করে।

সর্পিল পথ হলো নদী বা অন্যান্য জলপথের আঁকাবাঁকা গতি, যা প্রবাহীর আকারে গড়ে ওঠে ও বাঁককে ঘিরে প্রবাহিত হয়। বেশিভারগ ক্ষেত্রে প্রবাহী হিসেবে থাকে পানি। পথ কিছুটা বেঁকে যাওয়া মাত্রই প্রতিটি লুপের আকার ও বক্রতা বেড়ে যায়। এর কারণ হলো হেলিকেল প্রবাহ নদী থেকে বালু ও নুঁড়িকে বাঁকের মধ্যে টেনে আনে। লুপের বাইরের দিকটা ফাঁকা ও অসুরক্ষিত থাকে। এর ফলে ক্ষয়ের হার বেড়ে যায়। ফলত, শক্তিশালী ধনাত্মক পুনঃপ্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সর্পিল গতি আরও বেশি করে হয়।

তরঙ্গ, বালিয়াড়ি[সম্পাদনা]

তরঙ্গ হলো এক ধরনের আন্দোলন যা চলার সময় শক্তি বহন করে। যান্ত্রিক তরঙ্গ চলাচল করে বায়ু বা পানির মতো কোনো একটি মাধ্যমের ভেতর দিয়ে। ফলে তরঙ্গ এগিয়ে যাবার সময় মাধ্যম আন্দোলিত হয়।[১] বায়ু তরঙ্গ হলো পৃষ্ঠ তরঙ্গ, যা যে-কোনো বিশাল জলরাশিতে এলোমেলো স্বতন্ত্র বিন্যাস তৈরি করে। অবশ্য বায়ু তরঙ্গ মডেল দিয়ে তাদের পরিসংখ্যানিক বৈশিষ্ট্যের পূর্বানুমান করা যায়।[২] পানিতে বা বায়ুতে বালির ওপর দিয়ে তরঙ্গ এগিয়ে যাবার সময় মৃদু হিল্লোলের নকশা তৈরি হয়। বিশাল বালিরাশির ওপর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হলে তৈরি হয় বালিয়াড়ি। এতে করে অনেক সময় বড় আকারে বালিয়াড়ির প্রান্তর গড়ে ওঠে, যেমনটা হয়েছে তাকলামাকান মরুভূমিতে। বালিয়াড়ি থেকে বিভিন্ন ধরনের নকশা তৈরি হতে পারে, যেমন অর্ধচন্দ্র, দীর্ঘ সরল রেখা, তারকা, গম্বুজ, পরাবৃত্ত ও দীঘল বা অনুদৈর্ঘ্য বা সেইফ (তলোয়ার) আকৃতি।[৩]

মরুভূমির বালিতে ক্রিয়াশীল বায়ুর প্রভাবে বারখান বা অর্ধচন্দ্রাকার বালিয়াড়ি তৈরি হয়। অর্ধচন্দ্রের দুই প্রান্ত ও বালির আচ্ছাদিত অংশের নিচের দিকে মুখ করে থাকে। বায়ুর গতির উল্টো দিকে বালু প্রবাহিত হয়, অনুভূমিকের সাথে যা ১৫ ডিগ্রি কোণ করে থাকে। এটি আচ্ছাদিত অংশের ওপর পতিত হয়ে ক্রমশ বালির সবচেয়ে খাড়া কোণের শীর্ষে গিয়ে পৌঁছে। সবচেয়ে খাড়া কোণ প্রায় ৩৫ ডিগ্রি। আচ্ছাদিত অংশের কোণ সবচেয়ে খাড়া কোণের বেশি হয়ে গেলে বালিধ্বস ঘটে, যা একটি অরৈখিক আচরণ। অল্প পরিমাণ বালির সংযোজনে তেমন কিছু না ঘটলেও আরও নতুন কিছু বালির আগমনে বড় আকারের বালিধ্বস ঘটে যায়।[৪] এই অরৈখিকতা বাদ দিলে বারখানকে বিচ্ছিন্ন তরঙ্গ বলা চলে।[৫]

বুদ্বুদ, ফেনা[সম্পাদনা]

টালির বিন্যাস[সম্পাদনা]

ফাটল[সম্পাদনা]

দাগ, ডোরা[সম্পাদনা]

বিন্যাসের গঠনপ্রণালী[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. French, A.P. Vibrations and Waves. Nelson Thornes, 1971.
  2. Tolman, H.L. (২০০৮), "Practical wind wave modeling", Mahmood, M.F., CBMS Conference Proceedings on Water Waves: Theory and Experiment (পিডিএফ), Howard University, USA, 13–18 May 2008: World Scientific Publ. 
  3. "Types of Dunes"। USGS। ২৯ অক্টোবর ১৯৯৭। সংগ্রহের তারিখ মে ২, ২০১২ 
  4. Strahler, A. & Archibold, O.W. Physical Geography: Science and Systems of the Human Environment. John Wiley, 4th edition 2008. Page 442.
  5. Schwämmle, V.; Herrman, H.J. (২০০৩)। "Solitary wave behaviour of sand dunes"। Nature426 (Dec. 11): 619–620 Abstractডিওআই:10.1038/426619aপিএমআইডি 14668849বিবকোড:2003Natur.426..619S (সদস্যতা প্রয়োজনীয়)