বিষয়বস্তুতে চলুন

প্যারাফিন মোম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

প্যারাফিন মোম (বা পেট্রোলিয়াম মোম) মূলত পেট্রোলিয়াম, কয়লা কিংবা তৈলাক্ত নরম শিলাখণ্ড থেকে প্রাপ্ত এক প্রকার নরম, বর্ণহীন কঠিন পদার্থ যা ২০টি থেকে ৪০টি পর্যন্ত কার্বন পরমাণু দ্বারা গঠিত হাইড্রোকার্বনের সংমিশ্রণে গঠিত। এটি কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে এবং ৩৩° সে. (৯৯° ফা.)[] তাপমাত্রায় গলতে শুরু করে। এর স্ফুটনাঙ্ক ৩৭০ °সে. (৬৯৮° ফা.)[]। প্রধানত লুব্রিকেন্ট, তড়িৎ অন্তরক এবং মোম তৈরিতে প্যারাফিন মোমের ব্যবহারের প্রচলন দেখা যায়; তাছাড়াও রঙিন প্যারাফিন মোম ছবি রং করার অন্যতম হাতিয়ার ক্রেয়ন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।[][]

সাধারণত প্যারাফিন মোমে কোনো গন্ধ থাকে না এবং তা নীলাভ-সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। ১৮৩০ সালে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল রাইখেনবাখ প্যারাফিন মোম উদ্ভাবন করে মোম শিল্পে যুগান্তকারী অবদানের সূচনা করেন। এটি একদিকে যেমন তখনকার প্রচলিত পশুর চর্বি থেকে পাওয়া মোম (ট্যালো মোম) এর তুলনায় অধিক স্বচ্ছভাবে জ্বলতে পারে তেমনি এটি কম খরচে অধিক উৎপাদন করা যায়।[]

রসায়নশাস্ত্রে এটি অ্যালকেনের সমার্থকরূপে ব্যবহৃত হয় যার সংকেত CnH2n+2। প্যারাফিন (paraffin) শব্দটি লাতিন parum + affinis থেকে উদ্ভূত হয় যেখানে parum এর অর্থ খুবই কম আর affinis এর অর্থ সক্রিয়তা। অর্থাৎ প্যারাফিন শব্দের আভিধানিক অর্থ কম সক্রিয়। এর দ্বারা প্যারাফিনের নিষ্ক্রিয় অবস্থাকে ইঙ্গিত করা হয়[]

বৈশিষ্ট্য

[সম্পাদনা]

প্যারাফিন মোম অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাদা বর্ণের, বর্ণহীন, গন্ধহীন, কঠিন অবস্থায় পাওয়া যায় যার গলনাঙ্ক সাধারণত ৪৬ থেকে ৬৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে।[] এর ঘনত্ব ৯০০ kg/m3[] এটি পানিতে অদ্রবণীয় কিন্তু ইথার, বেনজিন ও নির্দিষ্ট কিছু এস্টারে দ্রবণীয়। প্যারাফিন অধিকাংশ রাসায়নিক রিএজেন্টের সাথে বিক্রিয়া না করলেও অধিক দাহ্য হয়ে থাকে।[] এর দহনতাপ প্রতি কেজিতে ৪২ মেগাজুল (৪০ MJ/kg)।[]

প্যারাফিন মোম খুবই কার্যকরী তড়িৎ অপরিবাহী, যার রোধক্ষমতা ১০১৩ থেকে ১০১৭ ওহম মিটার।[] এটি কিছু প্রকার প্লাস্টিক (যেমন পলিটেট্রাফ্লোরোইথিলিন: PTFE) ছাড়া অন্য সকল পদার্থের তুলনায় তড়িৎ রোধকরণে ভালো কাজ করে। এটি একটি কার্যকরী নিউট্রন মডারেটর যা ১৯৩২ সালে জেমস চ্যাডউইকের নিউট্রন আবিষ্কারে ব্যবহৃত হয়।[১০][১১]

প্যারাফিন মোম তাপধারণের জন্য খুবই উপযোগী একটি পদার্থ, যার নির্দিষ্ট তাপ ধারণ ক্ষমতা ২.১৪-২.৯ Jg−1K−1 (প্রতি কেলভিন ও প্রতি গ্রামে জুল একক) এবং ফিউশনের তাপ ২০০-২২০ Jg−1। প্যারাফিন মোমের ফেজ-চেঞ্জ কুলিংয়ের সাথে লাগানো রিট্র্যাক্ট্যাবল রিয়েক্টর ১৯৭০ এর দশকে চন্দ্রযাত্রায় ব্যবহৃত নভোযানের ইলেকট্রনিকগুলোকে শীতলীকরণ করতে ব্যবহৃত হতো। মোমের গলনের ফলে তা অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে এবং এজন্য শিল্পক্ষেত্রে, দৈনন্দিন কাজে এবং বিশেষ করে অটোমোবাইল শিল্পে ওয়াক্স এলিমেন্ট থার্মোস্টেস্টে এটি ব্যবহৃত হয়।

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

১৯৩০ সালে জার্মান রসায়নবিদ কার্ল ভন রাইখেনবাখ পেট্রোলিয়াম থেকে কার্যকরী উপায়ে মোমজাতীয় পদার্থ পৃথকীকরণ ও শোধন করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে প্যারাফিন মোম উদ্ভাবন করেন। অধিক স্বচ্ছভাবে জ্বালানো আর মৌচাক ও পশুর চর্বি থেকে পাওয়া মোমের তুলনায় সহজে উৎপাদন হওয়ায় প্যারাফিন মোমবাতি শিল্পে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্যারাফিন মোম কম তাপমাত্রায় গলে যাওয়ায় তাতে স্টিয়ারিক এসিড যোগ করে স্থায়িত্ব বাড়ানো হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তেল ও মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের ব্যাপক প্রসারণ ঘটে যার ফলে তার উপজাত হিসেবে প্যারাফিন ও স্টিয়ারিক এসিড ব্যাপক হারে তৈরি হয়। এতে প্যারাফিন মোমের উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে।

উৎপাদন

[সম্পাদনা]

প্যারাফিনের মূল উপাদান স্ল্যাক ওয়াক্স, যা তেল আর মোম দ্বারা গঠিত এবং তা পেট্রোলিয়ামজাত তেল শোধনে উপজাত হিসেবে তৈ্রি হয়। প্যারাফিন মোম তৈরি প্রথম ধাপ হচ্ছে স্ল্যাক ওয়াক্স থেকে তেল অপসারণ করা। কেলাসনের মাধ্যমে তেল পৃথক হয়ে যায়। প্রচলিত পদ্ধতিতে স্ল্যাক ওয়াক্সকে তাপ দিয়ে, কিটোনের মতো বেশ কিছু দ্রাবক যোগ করে পরে তা শীতলীকরণ করা হয়। ঠাণ্ডা হওয়ার পর মোম দ্রবণ থেকে কেলাসিত হয় এবং তেল পৃথক হয়। এই মিশ্রণ পরিশ্রুত হয়ে দুটি পদার্থে পৃথক হয়, যথা- কঠিন (মোম + দ্রাবক) এবং তরল (তেল + দ্রাবক)। অভিস্রবণের মাধ্যমে মিশ্রণ থেকে পরবর্তীতে সেই কঠিন পদার্থ 'প্রোডাক্ট ওয়াক্স' এবং তরল পদার্থ 'ফুট ওয়েল' নামে পরিচিত হয়। মোমে যত কম পরিমাণে তেল থাকে, মোম তত বেশি পরিশোধিত বলে গণ্য করা হয়। প্রোডাক্ট ওয়াক্সকে বর্ণহীন আর গন্ধহীন করতে তা আরো প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। এই মোম পরবর্তীতে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য যেমন গলনাঙ্ক আর ভেদনযোগ্যতা যুক্ত করতে তা মিশ্রিত করা হয়।

ব্যবহার

[সম্পাদনা]

শিল্পক্ষেত্রে প্যারাফিন মোমে বিদ্যমান কার্বন চেইনের সাথে আরো শাখা-প্রশাখা যুক্ত করে তার কেলাস বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া EVA পলিমার, মাইক্রোক্রিস্টালিন ওয়াক্স কিংবা পলিথিনের কিছু অংশ যোগের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। এতে পরিবর্তিত প্যারাফিনের সান্দ্রতা বৃদ্ধি পায়, কেলাস গঠন হ্রাস পায় এবং এর বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়। বিশুদ্ধ প্যারাফিন মোম কক্ষ তাপমাত্রায় ভঙ্গুর অবস্থায় হওয়ায় এর ব্যবহারের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি বলে লস্ট ওয়াক্স প্রসেসের মাধ্যমে ধাতু ও অন্যান্য পদার্থ ঢালাইকরণে তা ব্যবহার বিরল। নরম ও নমনীয় মোম যেমন মৌচাকের মোম এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট কাস্টিং ওয়াক্স নামক প্যারাফিন জাতীয় মোম সেক্ষেত্রে তৈরি করা হয়।

হিস্টোলজি বা প্যাথোলজি ল্যাবরেটরিতে কোষগুচ্ছ বা টিস্যুর পাতলা অংশ খণ্ডিত করতে প্যারাফিন মোম ব্যবহৃত হয়। অ্যালকোহলের আরোহী শক্তির মাধ্যমে (৭৫% থেকে ১০০%) টিস্যু থেকে পানি অপসারণ করে পরবর্তীতে তা জাইলিনে দ্রবীভূত করে অ্যালকোহল অপসারণ করা হয়। এই টিস্যু পরে কয়েক ঘণ্টার জন্য প্যারাফিন মোমে রেখে দেওয়া হয় এবং তা শীতলীকরণ করার জন্য ছাঁচে রাখা হয়। পরে তা মাইক্রোটোম দিয়ে কাটা হয়।

অন্যান্য ব্যবহার

[সম্পাদনা]
  • হিস্টোলজিতে নমুনা পরীক্ষার মাধ্যম হিসেবে।
  • এন্টি-কেকিং এজেন্ট, মসৃণ প্রতিরোধক, জৈব সারের ডাস্টবাইন্ডিং আবরণ হিসেবে।
  • এন্টি-ওজোনেন্ট এজেন্ট, প্যারাফিন ও মাইক্রোওয়াক্সের মিশ্রণ, রাবার শিল্প উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
  • সাইকেলের চেইন তৈলাক্তকরণে।
  • বুলেট লুব্রিকেন্ট।
  • মোমবাতি তৈরিতে।
  • মোমজাতীয় কাগজ বা তুলার আবরণ তৈরিতে।
  • সার্ফবোর্ড ওয়াক্স, স্কি ওয়াক্স এবং স্কেটবোর্ড ওয়াক্সের প্রধান উপকরণ।
  • ছবি রং করার ক্রেয়ন।
  • ফুড গ্রেড প্যারাফিন ওয়াক্স:
    • ক্যান্ডি তৈরির কোটিং তৈরিতে ব্যবহৃত; অপরিপাকযোগ্য,
    • এডাম চিজের মতো বিভিন্ন প্রকার কঠিন পনির বা চিজের আবরণ তৈরিতে।
    • জার, ক্যান কিংবা বোতলের ছিপি সিলিং করতে।
    • চুয়িংগামের এডিটিভ।
  • ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশনে নাইট্রেট ও নাইট্রাইট শনাক্তকরণে।
  • আগুনের বিরাট ফ্লেম তৈরিতে।
  • ইনভেস্টমেন্ট কাস্টিং।
  • লাভা বাতি তৈরিতে।
  • সেদ্ধ পশুর চামড়া দিয়ে সৌখিন জিনিস তৈরিতে ও বই তৈরিতে।
  • মেক্যানিকাল থার্মোস্ট্যাট এবং অ্যাকুয়েটরে।
  • মাইক্রোওয়াক্স, ফুড অ্যাডিটিভ ই৯০৫।
  • টয়েলেট্রিজ ও ভ্যাসলিন তৈরিতে।
  • নিউট্রন রেডিয়েশন শিল্ডিং।
  • থার্মাল এনার্জি স্টোরেজের জন্য ফেজ চেঞ্জ পদার্থ।
  • ফ্লেগমাটাইজিং এজেন্ট; আরডিএক্স এর মতো বিস্ফোরক পদার্থকে নিষ্ক্রিয়করণে।
  • পালিশকৃত ধাতব স্টিলকে অক্সাইডেশন থেকে রক্ষা কাজে।
  • থার্মাল প্রিন্টারের কালির মোম তৈরিতে।
  • হাইব্রিড রকেট মোটরের জন্য সলিড প্রোপেলেন্টরূপে।
  • টেক্সটাইল উৎপাদন প্রক্রিয়ায়।
  • পেইন্টবলে থিকেনিং এজেন্টরূপে।
  • কসমেটিক ট্রিটমেন্টের জন্য ওয়াক্স বাথে।
  • মোমের আকার গঠনে।
  • উড ফিনিশিং কাজে।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Freund, Mihály; Mózes, Gyula (১৯৮২)। Paraffin products: properties, technologies, applications। Jakab, E. কর্তৃক অনূদিত। Amsterdam, the Netherlands: Elsevier। পৃষ্ঠা 121। আইএসবিএন 978-0-444-99712-8 
  2. Raw materials and candles production processes ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২১ মার্চ ২০২০ তারিখে, AECM
  3. "History of Candles"National Candle Association। সংগ্রহের তারিখ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ 
  4. "Paraffin, n"। Oxford English Dictionary। Oxford, England: Oxford University Press। মার্চ ২০০৯। 
  5. Nasser, William E (১৯৯৯)। "Waxes, Natural and Synthetic"। McKetta, John J। Encyclopedia of Chemical Processing and Design67। New York: Marcel Dekker। পৃষ্ঠা 17। আইএসবিএন 978-0-8247-2618-8  This can vary widely, even outside the quoted range, according to such factors as oil content and crystalline structure.
  6. Kaye, George William Clarkson; Laby, Thomas Howell"Mechanical properties of materials"Kaye and Laby Tables of Physical and Chemical ConstantsNational Physical Laboratory। ১১ মার্চ ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১৩ 
  7. Seager, Spencer L.; Slabaugh, Michael (১৯ জানুয়ারি ২০১০)। "Alkane reactions"। Chemistry for Today: General, Organic, and Biochemistry। Belmont, California: Cengage। পৃষ্ঠা 364। আইএসবিএন 978-0-538-73332-8 
  8. Wiener, Harry (জানুয়ারি ১৯৪৭)। "Structural Determination of Paraffin Boiling Points"Journal of the American Chemical Society69 (1): 17–20। আইএসএসএন 0002-7863ডিওআই:10.1021/ja01193a005পিএমআইডি 20291038 
  9. "Electrical insulating materials"Kaye and Laby Tables of Physical and Chemical Constants। National Physical Laboratory। ১৯৯৫। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১৩ 
  10. "Attenuation of fast neutrons: neutron moderation and diffusion"Kaye and Laby Tables of Physical and Chemical Constants। National Physical Laboratory। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১৩ 
  11. Rhodes, Richard (১৯৮১)। The Making of the Atomic Bombবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। New York: Simon and Schuster। পৃষ্ঠা 163আইএসবিএন 978-0-671-44133-3