পূর্বাচল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পূর্বাচল বা পূর্বাচল প্রদেশ উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি প্রস্তাবিত রাজ্যের নাম। ভারত বিভাগের পর অসমের বাঙালি নেতৃবৃন্দ অসমের অ-অসমীয়া ভাষাভাষি অঞ্চলগুলো নিয়ে একটি পৃথক রাজ্যের পরিকল্পনা করেন। ১৯৪৮ সালে প্রথমবার পূর্বাচলের প্রস্তাব পেশ করা হয়। ১৯৫৪ সালে কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটির পক্ষ থেকে পুনরায় পূর্বাচলের প্রস্তাব পেশ করা হয় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে। প্রস্তাবিত পূর্বাচল রাজ্য প্রাথমিকভাবে অসমের কিছু পাহাড়ি ও সমতল জেলা, কিছু সীমান্ত অঞ্চল এবং দুই দেশীয় রাজ্য মণিপুর ও ত্রিপুরা নিয়ে গঠিত হওয়ার কথা ছিল।

প্রথম প্রস্তাব[সম্পাদনা]

স্বাধীনতা ও অসম বিভাগের পর, অসমের বাঙালি হিন্দু নেতৃত্ব অসমে বাঙালিদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণের আশঙ্কা করে উত্তর-পূর্ব ভারতে একটি সংযুক্ত সীমান্ত প্রদেশের প্র্স্তাব উত্থাপন করেন। সিলেট ও পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলা থেকে আগত বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের প্রসঙ্গে সংযুক্ত সীমান্ত প্রদেশের দাবী জনপ্রিয় হতে থাকে। অধ্যাপক যোগেন্দ্র কুমার চৌধুরী শিলঙসহ খাসি পার্বত্য জেলা, জয়ন্তিয়া পার্বত্য জেলা, গারো পার্বত্য জেলা, লুসাই পার্বত্য জেলা, নাগা পার্বত্য জেলা, মিকির পার্বত্য জেলা, করিমগঞ্জসহ কাছাড় জেলা, নওগাঁ জেলা ও শিবসাগর জেলার কিয়দংশ (বরপাথর ও সরুপাথর মৌজা ব্যতীত), সাদিয়া, বালিপাড়া, তিরাপ ও লখিমপুর সীমান্ত অঞ্চলসমূহের পূর্বাচলভূক্তি দাবী করেন। এছাড়াও তিনি তিন দেশীয় রাজ্য মণিপুর, ত্রিপুরা ও কোচ বিহার এবং গোয়ালপাড়া জেলার পূর্বাচলভূক্তি দাবী করেন। দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রসঙ্গে তার যুক্তি ছিল এই যে অর্থনৈতিক কারণে যেহেতু কোনো রাজ্যকেই এককভাবে ভারতের প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয় এবং ভৌগোলিকভাবে সন্নিহিত না হওয়ার কারণে যেহেতু তাদের মধ্যে সংযুক্তিকরণও সম্ভব নয়, তাদের পক্ষে পূর্বাচল প্রদেশের অন্তর্গত হওয়াই শ্রেয়।

মণিপুরের বিরোধিতা[সম্পাদনা]

মণিপুরের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে অধিকাংশই মণিপুর রাজ্যের প্রস্তাবিত অসমভুক্তি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তারা মনে করতেন মণিপুর অসমের অন্তর্গত হলে মণিপুরী ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয় তীব্র সংকটের মুখে পড়বে। সেই কথা মাথায় রেখে মণিপুরী নেতৃত্ব প্রথম দিকে পূর্বাচল প্র্স্তাবে সমর্থন জানান। কিন্তু পরবর্তীকালে, মণিপুরের সমস্ত রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।[১] মেইতেই নেতৃবৃন্দ মনে করেন প্র্স্তাবিত পূর্বাচল রাজ্যে কাছাড় ও ত্রিপুরার বাঙালিরাই হবে নিয়ন্ত্রক। মেইতেই জাতীয় পরিচয় এতে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। ২১ সেপ্টেম্বর হিজাম ইরাবত সিংহের নেতৃত্বে মণিপুর কৃষক সভা ও মণিপুর সোশালিস্ট পার্টি যৌথভাবে পুর্বাচল প্রস্তাবের বিরোধিতার ডাক দেয়। পূর্বাচলের প্রস্তাবের বিরোধীদের মণিপুর রাজ্য পুলিশ সভাস্থলে যেতে বাধা দিলে তারা একজন পুলিশকে হত্যা করে। মণিপুর রাজ্য পরিষদ মণিপুর কৃষক সভা ও মণিপুর সোশালিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে ও ইরাবত সিংহের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ইরাবত সিংহ ব্রহ্মদেশে পালিয়ে যান। কেন্দ্রও পূর্বাচল প্রস্তাবকে অবাস্তব মনে করে। পূর্বাচলের পরিবর্তে মণিপুরকে অন্যান্য দেশীয় রাজ্যের মতোই চুক্তির মাধ্যমে ভারতভূক্তির উপর জোর দেয়। ইরাবত পলায়ন করায় পূর্বাচল বিরোধী আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় প্রস্তাব[সম্পাদনা]

১৯৫৪ সালে কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটির পক্ষ থেকে পূর্বাচলের প্র্স্তাব দেওয়া হয় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনকে।[২] তাদের দাবী ছিল পূর্বাচল রাজ্যের মাধ্যমে অসমের সমস্ত অ-অসমীয়াভাষী জাতিগোষ্ঠীর বঞ্চনার ইতি ঘটবে। পূর্বাচলের দ্বিতীয় প্রস্তাবও গৃহীত হয়নি। পূর্বাচলের দাবী পূরণ না হলেও কাছাড়ের বাঙালিরা অসম সরকারের ভাষা নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন যা পরবর্তীকালে ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।

সূত্র[সম্পাদনা]

  1. দাস, গুরুদাস; সিংহ, কে জ্ঞানেন্দ্র। "Insurgency and Nationalism in Manipur" (পিডিএফ)Man and Society - A Journal of North East Studies। শিলঙ: ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশাল সায়েন্স রিসার্চ। 6। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ 
  2. ফজল, তানবীর (১৮ অক্টোবর ২০১৩)। Minority Nationalisms in South Asia। রাউটলেজ। পৃষ্ঠা 65। আইএসবিএন 9781317966470। সংগ্রহের তারিখ ২৫ জানুয়ারি ২০১৫