পারিজাত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পারিজাত
Erythrina variegata
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Plantae
শ্রেণীবিহীন: সপুষ্পক উদ্ভিদ
শ্রেণীবিহীন: Eudicots
শ্রেণীবিহীন: Rosids
বর্গ: Fabales
পরিবার: Fabaceae
গণ: Erythrina
প্রজাতি: E. variegata
দ্বিপদী নাম
Erythrina variegata
এল.

পারিজাত বা পারিজাত মান্দার (ইংরেজি: Erythrina variegata; বৈজ্ঞানিক নাম: Erythrina variegata) হল ইরিথ্রিনা গণভূক্ত পুষ্পবৃক্ষবিশেষ।[১][২][৩] ইরিথ্রিনা গণভুক্ত উদ্ভিদ সমূহ একত্রে মান্দার বা মাদার নামে পরিচিত। বাংলাদেশে বেশ কয়েক প্রজাতির মান্দার গাছ দেখতে পাওয়া যায়।[৪] পারিজাত মান্দার এর মধ্যে অন্যতম ।

আবাসভূমি[সম্পাদনা]

উষ্ণমণ্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলীয় উভয় পরিবেশেই এ বৃক্ষটি জন্মে। উত্তরাঞ্চলীয় আফ্রিকার দেশসমূহ, ভারতীয় উপমহাদেশ, অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চল, ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জসহ প্রশান্ত মহাসাগরতীরবর্তী পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকা থেকে শুরু করে ফিজির পূর্বাংশে পারিজাতের দেখা মেলে।[১]

বিবরণ[সম্পাদনা]

কম্বোডিয়ায় পারিজাত বৃক্ষটি রোলাস ট্রি, ওকিনাওয়ায় দেইগো, ফিজিতে দ্রালা, আসামে মদর, ফিলিপাইনে ডেপডেপ,[৫] তিব্বতে মন দা রা বা, থাইল্যান্ডে থং ল্যাং এবং ভিয়েতনামে ভং নেম নামে পরিচিত।

কাঁটাবিশিষ্ট গাছ হিসেবে এটি ২৭ মি (৮৯ ফু) পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। এর শাখাগুলো ধূসর রঙের। পাতা পালকের ন্যায় খুবই পাতলা এবং ২০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ত্রিভূজাকৃতিবিশিষ্ট প্রশস্ত হতে পারে। শীতের শুরুতে পাতাগুলো ঝরে পড়ে এবং মার্চ-এপ্রিল মাসে নতুন পাতা গজায়। পাতা ঝরে পড়ার পর ফুলের আবির্ভাব ঘটে। গন্ধবিহীন ফুলগুলো গাঢ় লাল কিংবা উজ্জ্বল লোহিত বর্ণের ১৫ সেন্টিমিটার লম্বাটে এবং বীজ ঘন বাদামী কিংবা কালচে রঙের হয়।[৬]

বীজদণ্ডটি ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ২.৫ সেন্টিমিটার প্রশস্ত হয়। মে-জুন মাসে ফল পরিপক্ব হয়। ফলগুলো কয়েক মাস পর্যন্ত গাছে ঝুলে থাকতে পারে। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৮০০ থেকে ১৫০০ মিলিমিটার, গড় তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস উপযোগী আবহাওয়ায় এটি জন্মায়। চারা গাছগুলো কুয়াশায় নষ্ট হয়ে যায়। পারিজাত আগুন প্রতিরোধক, বাতাস ও ঝড়ের বিপরীতে টিকে থাকতে সক্ষম এবং বন্যায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। মাটির গভীরে ভালভাবে জন্মায়।

ব্যবহার[সম্পাদনা]

চমকপ্রদ, মনোরম, নয়ন মনোহর ও জনপ্রিয় ফুল গাছ হিসেবে এর পরিচিতি রয়েছে। এটি ঝড়-ঝঞ্চা প্রতিরোধ করতে সক্ষম। জাপানের ওকিনাওয়া প্রিফেকচারে ১৯৬৭ সাল থেকে প্রাদেশিক ফুল হিসেবে মর্যাদা পেয়ে আসছে। ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে এ গাছ আমেরিকার উপকূলবর্তী এলাকার উদ্ভিদপ্রেমীদের চোখে পড়ে। সে সময় থেকেই আমেরিকার উপকূলবাসীরা বাসা-বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ গাছ রোপন করে আসছে।[৭] ভিয়েতনামে ভাঁজ করে মাংসের সাথে পারিজাতের পাতা ব্যবহার করা হয়। সিদ্ধ চিকিৎসায় রজঃস্রাব বা মাসিক নিয়মিতকরণে এবং লিঙ্গ উত্থানে এ গাছ ব্যবহৃত হয়। এর পাতা পশুদের অন্যতম পছন্দের খাবার হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে কৃষকরা জমির আইলে সীমানা খুঁটি এবং বাড়ির বেড়ার জন্য পারিজাত গাছ লাগিয়ে থাকে।[২][৩]

বংশবিস্তার[সম্পাদনা]

বীজ কিংবা শাখা-কলমের মাধ্যমে এ গাছ জন্মানো যায়। পূর্ব রাত্রে বীজ ১০ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে মাটিতে পুঁততে হয়। ৮ থেকে ১০ দিন পর চারা জন্মায় এবং ৮ থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যেই ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার বড় হয়।[৮] ২-৫ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের ২-৩ মিটার লম্বা শাখাকে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা পূর্বে কেটে রাখতে হয়। এরফলে মাশরুম জন্মাবে না। প্রতি দুই মিটার অন্তর খুঁটির সাথে লাগাতে হয়।

সাহিত্যে পারিজাত ফুল[সম্পাদনা]

পারিজাত ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

মান্দার ফুল তেতুলের সাথে মিশিয়ে লবন মরিচ দিয়ে ভর্তা করে খেতে খুব স্বাদ। এই তথ্য অনেকে জানে না।
মান্দার ফুল/ পারিজাত ফুল।

পুরাণে পারিজাত[সম্পাদনা]

পুরাণে উল্লিখিত সমুদ্রমন্থনের কাহিনি অনেকেরই জানা রয়েছে। অমৃতের সন্ধানে দেবতা ও অসুররা মন্দার পর্বতকে মন্থনদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে সমুদ্র থেকে তুলে এনেছিলেন একের পরে এক আশ্চর্য সব বস্তু। সেই মন্থনে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন লক্ষ্মীদেবী, ঐরাবত হস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব, অপ্সরাকুল, কামধেনু, চন্দ্র ইত্যাদি, এবং অবশ্যই হলাহল বিষ ও অমৃত। এ সব ছাড়াও সেই মন্থনে উঠে এসেছিল এক আশ্চর্য বৃক্ষ, যার নাম পারিজাত। পরবর্তী কালে স্বর্গের বর্ণনায় বার বার পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে পারিজাতের নাম। ইন্দ্রের নন্দন কাননে প্রধান গাছটিই হল পারিজাত, এমন কথা হিন্দু পুরাণে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে উল্লিখিত। ‘হরিবংশ পুরাণ’-এ উল্লিখিত রয়েছে, পারিজাত একটি ‘কল্পতরু’, এর কাছে যা প্রার্থনা করা যায়, তা-ই নাকি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে এ কথাও বলা হয়েছে, বেশিরভাগ পারিজাত স্বর্গে থাকলেও মর্ত্যভূমে একটি মাত্র গাছ নাকি রয়ে গিয়েছে।[৯]

উত্তরপ্রদেশের বরবাঁকি জেলার পারিজাত[সম্পাদনা]

উত্তরপ্রদেশের বরবাঁকি জেলার কিন্তুরে একটি বাওবাব জাতীয় গাছকে পারিজাত বলে সম্বোধন করা হয়। কিন্তুর খুব প্রাচীন জায়গা। মহাভারত-এর অন্যতম চরিত্র পাণ্ডবমাতা কুন্তির নাম থেকে এই স্থানের নামকরণ হয় বলে মনে করা হয়। কিংবদন্তি অনুযায়ী, এখানকার অসংখ্য প্রাচীন মন্দিরের একটি নাকি স্বয়ং কুন্তি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। মনে করা হয়, কুন্তিকে এখানেই দাহ করা হয়েছিল এবং তার চিতাভস্ম থেকেই জন্ম নেয় এই পারিজাত বৃক্ষ। অন্য এক কাহিনি-মতে, কৃষ্ণ তার পত্নী সত্যভামা, মতান্তরে রুক্মিনীর জন্য এই বৃক্ষ স্বর্গ থেকে নিয়ে আসেন। এই সব কাহিনির সত্যতা নিরূপণ দুরুহ। তবে এটুকু বলাই যায়, গাছটি সত্যিই প্রাচীন। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে, এই বৃক্ষের স্পর্শে বেদনা, দুঃখ ও ক্লান্তির উপশম ঘটে। গঙ্গা দশেরা তিথি নাগাদ এই বৃক্ষে ফুল ফোটে। গাছটিতে কোনও ফল ধরে না। এই গাছ থেকে অন্য গাছও জন্মায় না। এর পাতাগুলির চেহারাও অন্য রকম। সুবিশাল এই বৃক্ষকে ঘিরে স্থানীদের অসংখ্য বিশ্বাস আবর্তিত হয়। নববিবাহিতরা এই বৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করতে আসেন। প্রতি মঙ্গলবার পারিজাতকে ঘিরে একটি মেলা বসে। গাছটিকে পুজো করতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। কেবল কিংবদন্তি নয়, পারিজাতকে ঘিরে কৌতূহল প্রকাশ করেন উদ্ভিদবিজ্ঞানীরাও। আজও বিস্তর গবেষণা চলে এই গাছটিকে নিয়ে। গাছটিকে সম্মান জানিয়েছে ভারত সরকারও। প্রকাশিত হয়েছে পারিজাতের ছবিওয়ালা ডাকটিকিটও।[১০]

চিত্রশালা[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Taxonomy - GRIN-Global Web v 1.9.8.2"। ৮ মে ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ আগস্ট ২০১২ 
  2. লুপ্তপ্রায় পারিজাত - দৈনিক ইত্তেফাক (১৩ এপ্রিল, ২০১৩)
  3. "মন্দার ফুল - দৈনিক আমাদের সময় (৪ মার্চ, ২০১৫)"। ২০ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০১৫ 
  4. কাঁটা মান্দার - দৈনিক প্রথম আলো (০৪ এপ্রিল, ২০১৬)
  5. (2011-08). "Dapdap". Philippine Medicinal Plants. Retrieved on 2012-06-12.
  6. Huxley, A., ed. (1992). New RHS Dictionary of Gardening. Macmillan আইএসবিএন ০-৩৩৩-৪৭৪৯৪-৫.
  7. Schütt et al. Trees of tropical P. 314
  8. NFTA. 1994. Erythrina variegata: more than a pretty tree. NFTA 94-02. Waimanalo[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  9. হরিবংশ পুরাণ
  10. প্রতিবেদন, নিজস্ব। "সমুদ্রমন্থনে ওঠা পারিজাত বৃক্ষ কি আজও পৃথিবীতে আছে?" 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

উইকিমিডিয়া কমন্সে Erythrina variegata সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।