পশ্চিম সাহারায় ইসলাম

দ্য ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের তথ্য অনুসারে পশ্চিম সাহারার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০০ শতাংশই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। [১][২] সাহারা অঞ্চলে মূলত ৮ম শতাব্দীতে ইসলামের আগমন ঘটে এবং এটি মাগরেব অঞ্চলের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলামের আগমনের ফলে এর বাণিজ্য আরও প্রসারিত হয় এবং অঞ্চলটি বিশেষ করে মারাকেশ ও টিমবুক্টুর মধ্যে কাফেলা চলাচলের অন্যতম পথ হয়ে ওঠে। সাহারায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা স্থানীয়দের ধর্মীয় জীবনে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। পোলিসারিও ফ্রন্ট এবং অন্যান্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ডেও ইসলামি মূল্যবোধের প্রভাব রয়েছে।[৩][৪] পশ্চিম সাহারার মুসলমানরা মূলত সুন্নি ইসলাম (মালিকি মাজহাব) অনুসরণ করে।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]পশ্চিম সাহারায় ইসলাম ৮ম শতকে উত্তর আফ্রিকার মাধ্যমে প্রবেশ করে, যখন আরব মুসলিমরা মাগরেব অঞ্চলে ইসলামের প্রচার শুরু করে। এখানে ইসলামের বিস্তার মূলত উমাইয়া খেলাফতের সময়ে ঘটে এবং পরবর্তীতে আব্বাসীয় ও ফাতিমীয় শাসনামলে অধিক শক্তিশালী হয়। ইসলামের আগমনের ফলে সাহারান অঞ্চলের জনগণের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও সামাজিক কাঠামোতে গভীর পরিবর্তন আসে। পশ্চিম সাহারায় ইসলামের বিস্তারে সুফিবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে সেখানে মালিকি মাজহাব অনুসৃত হয়, যা উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং অধিকাংশ মালিকি অনুসারী সুফিবাদে বিশ্বাসী ছিল। ১১ শতকে মুরাবিত আন্দোলন পশ্চিম সাহারায় ইসলামী জীবনধারার ভিত্তি স্থাপন করে এবং স্থানীয় বার্বার ও আরব সম্প্রদায়কে একত্র করে একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী ইসলামি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলে। [৩] সুফি সাধকরা এখানে অনেক ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাদের মধ্যে মা আল-আইনাইন অন্যতম ছিলেন, যিনি ১৯ শতক জুড়ে ইসলামী শিক্ষা, রাজনীতি এবং স্পেনীয় উপনিবেশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সাহারার স্থানীয় জনগণের মধ্যে ইসলামী শিক্ষার প্রসার ঘটান এবং তাদের আত্মপরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেন। [৩]
ঔপনিবেশিক শাসন ও প্রতিরোধ
আধুনিক পশ্চিম সাহারায় স্পেনের উপস্থিতি ১৮৮৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। প্রথমদিকে স্পেন এই অঞ্চলকে দাস ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলেও ১৭০০ সালের দিকে তাদের কার্যক্রম বাণিজ্যিক মাছ ধরার দিকে মোড় নেয়। ১৯শ শতকের মধ্যে স্পেন সাহারার দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল দাবি করে এবং পরবর্তীকালে ১৯০৪ সালে উত্তরাঞ্চল দখল করে। ১৮৮৪ সালের বার্লিনের সম্মেলনে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির মধ্যে আফ্রিকা বিভাজনের চুক্তির পর স্পেন পশ্চিম সাহারার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং এটিকে একটি স্পেনীয় কলোনি হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত তারা অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। কারণ স্থানীয় জনগণের বিদ্রোহ ও আক্রমণের কারণে ঔপনিবেশিক বাহিনী পর্যন্ত সাহারার গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি।১৯৩৪ সালে ফরাসি ও স্পেনীয় বাহিনীর একটি যৌথ অভিযানে এই অঞ্চল অবশেষে সম্পূর্ণরূপে দখল করা হয় এবং ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অঞ্চলটি স্পেনীয় মরক্কোর অধীনে চলে যায়। তখন থেকে এই অঞ্চলটি মরক্কোর অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। [৫][৬]
আজ পশ্চিম সাহারায় প্রতিবছর বিরাট আয়োজনের মাধ্যমে নবী মুহাম্মদের জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। এখানকার স্থানীয় ধর্মীয় রীতিনীতি অন্যান্য সাহারান গোষ্ঠীর মতো প্রাক-ইসলামি বারবার এবং আফ্রিকীয় রীতিনীতি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত এবং তা শহুরে রীতিনীতি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে পৃথক। যেমন, এই অঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবেই মসজিদ ছাড়াই ধর্ম পালন করা হয়, যা স্থানীয়দের যাযাবর জীবনের সাথে খাপ খাইয়েছে। [৩]
সামাজিক জীবনে ইসলামের প্রভাব
ইসলাম পশ্চিম সাহারার জনগণের সামাজিক ভিত্তি তৈরি করেছে। এখানকার জনগণের নৈতিকতা, আইন ও সাংস্কৃতিক চর্চা ইসলাম দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। পূর্বে শরিয়া আইন সামাজিক বিচারব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি ছিল, যা পারিবারিক জীবন, বাণিজ্য ও অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করত। সাম্প্রতিক কয়েক দশক অঞ্চলটির জনগণ নিজেদের ইসলামি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে সচেষ্ট রয়েছে। যদিও আধুনিক রাজনীতি ও উপনিবেশের প্রভাবে সামাজিক পরিবর্তন এসেছে, তবে ইসলাম এখানকার জনগণের পরিচয়, ঐতিহ্য, ও নৈতিক মূল্যবোধের অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসেবে এখনো রয়ে গেছে। [৩]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "The World Factbook - Western Sahara"। CIA। ২০০৭-০৬-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১০-২১।
- ↑ "The World Factbook — Central Intelligence Agency"। www.cia.gov। জুন ১৩, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ এপ্রিল ২০১৮।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Jamil M. Abun-Nasr, The History of the Maghreb: An Interpretation।
- ↑ Nehemia Levtzion, Islam in Africa।
- ↑ "ICE Conflict Case ZSAHARA"। web.archive.org। ২০১২-০১-২৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৩-১৫।
- ↑ Besenyo, Janos. Western Sahara. Publikon, 2009, P. 49।