বিষয়বস্তুতে চলুন

পর্তুগালে নৈরাজ্যবাদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পর্তুগালে নৈরাজ্যবাদ প্রথম ১৮৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভূত হয়। পর্তুগালের শ্রমিক আন্দোলনে নৈরাজ্যবাদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। ১৯১৯ সালে যে জেনারেল কনফেডারেশন অফ লেবার স্থাপিত হয় তাতে বৈপ্লবিক ইউনিয়নবাদ এবং নৈরাজ্যবাদী-সিন্ডিক্যালিজমের স্থায়ী প্রভাব ছিল।

১৯২৬ সালের অভ্যুত্থানে যে জাতীয় একনায়কত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা শ্রমিকদের আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করে। এস্টাদো নভো(উক্ত সরকারের প্রচলিত নাম) যেকোন নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপকে বেআইনি ঘোষণা করে, ফলে আন্দোলন গোপনে সংগঠিত হতে থাকে। ১৯৭৪ সালে কার্নেশন বিপ্লবে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয় । ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় অন্যান্য রাজনৈতিক মতবাদের সাথে জনতোষী নৈরাজ্যবাদেরও কিছু প্রভাব ছিল। []

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

১৮৫০-এর দশকে, পর্তুগালে প্রথম শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনগুলিতে পিয়ের-জোসেফ প্রুদোঁর লেখার প্রভাব ছিল।[] ১৮৭০-এর দশকের মধ্যে, এরকম কয়েকটি সংগঠন একত্রিত হয়ে পর্তুগিজ সমাজতান্ত্রিক পার্টি (PSP) গঠন করে যা ছিল পর্তুগালের প্রথম জাতীয় শ্রমিক সংগঠন।[] ১৮৭১ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতির (International Workingmen's Association) পর্তুগিজ শাখা গঠিত হয়।[]

এই সময়কালেই, পর্তুগালের রাজতন্ত্র শাসিত দুই-দলীয় ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে শুরু করে এবং ১৮৯০-এর দশকে পুরোপুরি ধ্বংস হয়। সাংবিধানিক রাজতন্ত্র জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করলে নৈরাজ্যবাদ এবং শ্রমিক আন্দোলন শক্তি অর্জন করতে থাকে।[]

অন্তেরো দে কোয়েন্তাল

১৮৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম তাত্ত্বিক নৈরাজ্যবাদী কর্মকাণ্ড শুরু হয়। সারা দেশে কয়েক ডজন নৈরাজ্যবাদী পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। এলিসি রেকলাস এবং পিয়োতর ক্রাপোতকিনের মতবাদে প্রভাবিত হয়ে ১৮৮৬–১৮৮৭ সালের দিকে লিসবন এবং পোর্তো শহরে স্বাধীনতাবাদী সাম্যবাদ আত্মপ্রকাশ করে, কয়েকটি স্বাধীনতাবাদী পত্রিকা প্রকাশিত হয় এবং প্রচারণামূলক (agitprop) গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়।[]

পর্তুগিজ সরকার ১৮৯১ সালে ট্রেড ইউনিয়নকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকেই সরকার বিভিন্ন ভাবে নৈরাজ্যবাদীদের বিরোধিতা করতে থাকে।[] ১৮৯৬ সালে নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ দমন করার উদ্দেশ্য একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়।[] ১৮৯৮ সালে নৈরাজ্যবাদী বিরোধী সামাজিক সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক রোম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হলে পর্তুগাল তাতে অংশগ্রহণ করে।[]

পূর্বোক্ত আইন পাস হওয়ার সময় পর্তুগিজ নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনে ৩৬টি গোষ্ঠী ছিল। পোর্তো শহরেরর নৈরাজ্যবাদীরা বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফেডারেশনকে সমর্থন করেছিল, যা পিএসপি (পর্তুগিজ সমাজতান্ত্রিক পার্টি) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গঠিত হয়েছিল। সেসময় এর সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় ১৩,০০০ জন। নৈরাজ্যবাদী-বিরোধী আইন পাস হওয়ার পরে, আরও অনেক নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনকারীরা নিজেদের সিন্ডিক্যালিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত করেন এবং ফেডারেশনে যোগ দেন, যা সংগঠনের নেতৃত্বকে পুনরায় পিএসপিতে বিলীন হতে প্ররোচিত করে।[] ২০ শতকের শুরুর দিকে, পর্তুগালের অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন মূলত পিএসপি দ্বারা প্রভাবিত ছিল; অ্যানার্কিস্টদের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম ছিল।[]

১৯০০ সালের শুরুর দিকে ধর্মঘটের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যার চূড়ান্ত পরিণতি হয় কোইম্ব্রায় শ্রমিক বিদ্রোহ এবং পোর্তোতে একটি সাধারণ ধর্মঘটে। আরও অনেক স্থানীয় ইউনিয়ন গঠিত হতে থাকে। ১৯০৯ সালের জুলাই মাসে লিসবন এবং পোর্তোতে জাতীয় শ্রমিক কংগ্রেস আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়। কংগ্রেসের বেশিরভাগ অংশ পিএসপি দ্বারা প্রভাবিত ছিল, যারা শ্রমিক কংগ্রেসকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের সাথে যুক্ত করার একটি প্রস্তাব পাস করে।[] বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিস্ট সংখ্যালঘুরা কংগ্রেস ত্যাগ করে এবং ১৯০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিজেদের আলাদা কংগ্রেস আয়োজন করে। এতে লিসবন এবং দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা ৩১টি ট্রেড ইউনিয়ন এবং অন্যান্য কয়েকটি সমবায় সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এই কংগ্রেসদিনে সর্বাধিক আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি জানায়, উৎপাদনের ওপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং অ্যামিয়েন্সের চার্টারের নীতিকে ভিত্তি করে একটি সাধারণ শ্রমিক কনফেডারেশন (CGT) গঠনের আহ্বান জানায়। পোর্তোতে, সিন্ডিক্যালিস্টরা শ্রমিকদের সাধারণ ইউনিয়ন (UGT) গঠন করে, প্রায় ১১,০০০ শ্রমিক এর সদস্যপদ গ্রহণ করে। ১৯১১ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সিন্ডিক্যালিস্ট কংগ্রেস, যা লিসবন এবং পোর্তো উভয় শহরেই সমর্থন পায়, সেখানে নৈরাজ্য-সিন্ডিক্যালিজম আন্দোলনের প্রধান নীতি হয়ে ওঠে।[] এই সময়কালে ১,০০,০০০ পর্তুগিজ শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, যার প্রায় অর্ধেকজনই ছিলেন মহিলা ও শিশু।[]

১৯১০ সালের ৫ অক্টোবর যে বিপ্লব সংঘটিত হয় তার ফলে পর্তুগালে রাজতন্ত্র উৎখাত হয়, প্রথম পর্তুগিজ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্তুগিজ প্রজাতন্ত্রের প্রথম বছরে ২৫০টিরও বেশি ধর্মঘট সংঘটিত হয়েছিল। অননুমোদিত ধর্মঘট (ওয়াইল্ডক্যাট স্ট্রাইক) বহু কারখানা, দোকান এবং খামারকে স্থবির করে দেয়, আর রেলওয়ে এবং কর্কশ্রমিকরা কোম্পানির সম্পত্তি ধ্বংস করার মাধ্যমে সরাসরি পদক্ষেপ নেয়।[১০] ইভোরায়, শ্রমিক এবং জমির মালিকদের মধ্যে বিরোধ ২০,০০০ শ্রমিকের একটি ব্যাপক ধর্মঘটে পরিণত হয়। পর্তুগিজ সিন্ডিক্যালিস্ট আন্দোলন কৃষকদের সমর্থন করে, যারা একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়, যার ফলে দেশের বেশিরভাগ অংশ অচল হয়ে পড়ে; লিসবনে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত হয় যা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য শহরটিকে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। তবে সরকার কৃষি ইউনিয়নগুলোকে মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে এবং গ্রেফতারকৃত কৃষিশ্রমিকদের মুক্তি দিয়ে আন্দোলনকে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়, অন্যদিকে লিসবনের ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।[১১]

CGT-র লোগো
ম্যানুয়েল জোয়াকিম দে সৌসা
বন্দী অবস্থায় CGT সদস্যগণ[১২]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Freire, João (২০১৭)। "Panorama des mouvements sociaux : le Portugal, XIXe, XXe siècles." (পর্তুগিজ ভাষায়)। ডিওআই:10.4000/variations.838অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  2. Bayerlein ও van der Linden 1990, পৃ. ১৫৬-১৫৭।
  3. Bayerlein ও van der Linden 1990, পৃ. ১৫৬।
  4. Da Fonseca, Carlos (২০১৭)। Introduction à l'histoire du mouvement libertaire au Portugal (পিডিএফ) (ফরাসি ভাষায়)। Éditions ArqOperaria / Vosstanie। 
  5. Lei contra os anarquistas (পর্তুগিজ ভাষায়)। Centro de Estudos do Pensamento Político। ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬। 
  6. Bigotte Chorão, Luís (২০১৫)। Para uma História da Repressão do Anarquismo em Portugal no Século XIX (পর্তুগিজ ভাষায়)। Letra Livre। 
  7. Bayerlein ও van der Linden ১৯৯০, পৃ. ১৫৭।
  8. Damier ২০০৯, পৃ. ৭।
  9. Bayerlein ও van der Linden ১৯৯০, পৃ. ১৫৫-১৫৬।
  10. Bayerlein ও van der Linden ১৯৯০, পৃ. ১৫৭-১৫৮।
  11. Bayerlein ও van der Linden ১৯৯০, পৃ. ১৫৮।
  12. Inconnu, Arquivo Histórico-Social (১৯৩৪)। "Militantes cegetistas presos em Peniche"mosca-servidor.xdi.uevora.pt (পর্তুগিজ ভাষায়)।