পঞ্চানন বর্মা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পঞ্চানন বর্মার ভাস্কর্য

পঞ্চানন বর্মা (১৮৬৭-১৯৩৫) ছিলেন কোচবিহারের একজন রাজবংশী নেতা, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, এবং সমাজ সংস্কারক। ঠাকুর পঞ্চানন, পঞ্চানন সরকাররায় সাহেব নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধ ও রীতিনীতি পুনরায় জাগিয়ে তোলার জন্য একটি ক্ষত্রিয় সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। [১]

জন্ম ও মৃত্যু[সম্পাদনা]

১৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৬ তারিখে কোচবিহার রাজ্যের মাথাভাঙ্গা মহকুমার খলিসামারী গ্রামে জোতদার পরিবারে পঞ্চানন বর্মার জন্ম হয়। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় পঞ্চানন সরকার। পিতা খোসাল সরকার ছিলেন একজন জোতদার এবং মাথাভাঙ্গা মহকুমা কাচারির মোক্তার। তার মাতা ছিলেন শ্রীমতি চম্পলা সরকার। পঞ্চানন বর্মা ১৯৩৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কলকাতায় পরলোকগমন করেন। [২]

শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

তিনি ১৮৯৩ সালে সংস্কৃত ভাষায় অনার্স নিয়ে কলকাতা কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ১৮৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানসিক ও নৈতিক দর্শন বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯০০ সালে কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ থেকে তিনি এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই এমএ ডিগ্রি এবং আইন বিষয়ে স্নাতক অর্জন করেন। [৩]

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

কর্মজীবনের প্রথমদিকে তিনি রংপুর আদালতে আইন অনুশীলন শুরু করেন। রংপুরে তিনি পূর্বে ব্যবহৃত টোগা (উকিলের গাউন) ব্যবহারে উচ্চ বর্ণের আইনজীবীর অস্বীকৃতি দেখে হতবাক হয়েছিলেন। [৪]

ক্ষত্রিয় আন্দোলন[সম্পাদনা]

তিনি বাংলার বর্ণবাদী হিন্দুদের দৌরাত্ম ও নির্যাতনের শিকার রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষত্রিয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি উত্তরবঙ্গের ক্ষত্রিয়দের অবহেলিত ক্ষত্রিয় থেকে আর্য জাতির পৌন্ড্রক্ষত্রিয় হিসেবে উচ্চবর্ণের বাঙালিদের শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি অর্জন করতে এই আন্দোলন করেন। তিনি মনে করেছিলেন রাজবংশীদের অবশ্যই সংগঠিত ও শিক্ষিত হওয়া উচিত যা তিনি ক্ষত্রিয় সভার মাধ্যমে অর্জন করার চেষ্টা করেছিলেন। এই সমিতিটি প্রমাণ করে যে রাজবংশীরা রাজকীয় বংশের ক্ষত্রিয় ছিলেন এবং কোচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহের সাথে তাদের ঐতিহাসিক ভাবে যোগসূত্র রয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্য এবং ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের উপর ভিত্তি করে তারা শতাব্দী ধরে পরশুরামের ভয়ে নিজেদের সত্য পরিচয় গোপনকারী ক্ষত্রিয় বলে প্রমাণ করেছিল। এই দাবির সমর্থনে এই আন্দোলনটি একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষত্রিয়করণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। বাংলা ১৩১৯ সালের ২৭ মাঘ পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে লক্ষাধিক রাজবংশীর গণউপনয়ন করা হয় ।[৫] যার ফলে উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলিতে কয়েক হাজার রাজবংশীকে ‘ক্ষত্রিয় রাজবংশী’ হিসাবে প্রমাণ করার জন্য তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতির পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছিল। [৬]

রাজনীতি[সম্পাদনা]

ক্ষত্রিয় আন্দোলন করায় তিনি নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তাই তিনি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯২০ সালে সর্বপ্রথম তিনি সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। একই ধারাবাহিতায় তিনি ১৯২৩ ও ১৯২৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও তিনি জয়লাভ করেন। [২]

সমাজ সংস্কার[সম্পাদনা]

তিনি রাজবংশীদের জন্য ১৩১৭ সালের ১৮ জ্যৈষ্ঠ রংপুর জেলায় ক্ষত্রিয় সমিতি তৈরি করেন । তিনি রংপুর জিলা স্কুলে রাজবংশী ছাত্রদের আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য ক্ষত্রিয় ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করেন। দরিদ্র রাজবংশীদের সহায়তা করতে তিনি কুড়িগ্রামে ক্ষত্রিয় ব্যাংক স্থাপন করেন। এছাড়াও তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ক্ষত্রিয় পত্রিকা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। রাজবংশী সম্প্রদায়ের অবস্থার উন্নতির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি চাকরিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন।

তিনি রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তার সম্প্রদায়ের মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রকাশিত রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় ১৩১৩ থেকে ১৩১৯ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। [২]

স্বীকৃতি[সম্পাদনা]

রাজবংশী সম্প্রদায়ের অধিকার আদায় এবং তাদের অবস্থার উন্নতিকল্পে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার কর্তৃক তিনি ‘রায় সাহেব’ এবং মেম্বার অফ ব্রিটিশ এম্পায়ার (এমবিই) উপাধিতে ভূষিত হন। [২]

অনেকেই তাকে রাজবংশী জাতির জনক হিসেবে অভিহিত করেন। [৩]

কোচবিহারে অবস্থিত পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি তার নাম অনুসারেই করা হয়। পঞ্চানন বর্মা ১৯৩৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মারা যান।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. জয়া, চ্যাটার্জী (২০০২) [প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৪]। Bengal divided: Hindu communalism and partition, 1932-1947। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা ১৯৮–১৯৯। আইএসবিএন 978-0-521-52328-8এই কৌশলটি বাংলার কাছে উপযুক্ত ছিল, যেখানে অনেক কম জাতি ইতিমধ্যেই তাদের নিজস্ব অনুশীলন 'শুদ্ধ' বা ব্রাহ্মণ্য করার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, বিংশ শতাব্দীর মধ্যে, রাজবংশী নেতা পঞ্চানান বর্মা তার জাতির মধ্যে ব্রাহ্মণীয় মূল্যবোধ ও অভ্যাসগুলি প্রকাশের জন্য একটি 'ক্ষত্রিয় সভা' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 
  2. মুহম্মদ মনিরুজ্জামান (২০১২)। "বর্মা, পঞ্চানন"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743। সংগ্রহের তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০২২ 
  3. ঘোষ, নমিতেশ। "বর্মা, পঞ্চানন"www.anandabazar.comআনন্দবাজার পত্রিকা। সংগ্রহের তারিখ ০২ এপ্রিল, ২০২০  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  4. রায়, শুভজ্যোতি (২০০২)। Transformations on the Bengal Frontier: Jalpaiguri, 1765-1948। Routledge। আইএসবিএন 978-0-7007-1408-7 
  5. Desk, Online। "নিশিগঞ্জে পালিত হল ক্ষাত্র দিবস | Uttarbanga Sambad | Latest Bengali News | বাংলা সংবাদ, বাংলা খবর | Live Breaking News North Bengal | COVID-19 Latest Report From Northbengal West Bengal India" (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৮-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-২৪ 
  6. সরকার, আই (২০০৬)। "The Kamatapur Movement: Towards a Separate State in North Bengal"। গোবিন্দ চন্দ্র রাথ। Tribal development in India: the contemporary debate। Sage। আইএসবিএন 978-0-7619-3423-3 

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  • ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার জীবন চরিত, লেখক: উপেন্দ্র নাথ বর্মন
  • Paschimbanga: Special Issue on Roy Saheb Panchanan Barma, Vol. 38, No. 7, February 2005. প্রকাশক: তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
  • ঠাকুর পঞ্চানন স্মারক, লেখক: ক্ষিতীশ চন্দ্র বর্মন (কলকাতা: বেহালা কেন্দ্রীয় সরকারের কোয়ার্টার, ২০০১)
  • আধিকারী, চঞ্চল (জুলাই ২০১৩)। "Upendra Nath Barman and Caste Politics Among the Rajbanshis of North Bengal"। ভয়েস অব দলিত (২): ১৩৭। ডিওআই:10.1177/0974354520130203