নোয়াখালীর ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে প্রধানত বাংলাদেশের বর্তমান নোয়াখালী, ফেনী এবং লক্ষ্মীপুর জেলাসমূহ অন্তর্ভুক্ত, যদিও ঐতিহাসিকভাবে সন্দ্বীপ, ভারতের ত্রিপুরার দক্ষিণাঞ্চল এবং দক্ষিণ কুমিল্লার কিছু অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে অনেকে মনে করেন। প্রাচীন বাংলার সমতট জনপদের অন্তর্ভূক্ত এই নোয়াখালী অঞ্চলের ইতিহাস শুরু হয় শিলুয়া ও ভুলুয়া গ্রামে সভ্যতা থেকে। বাংলার পুন্ড্র, হরিকেল এবং সমতট জনপদের বৌদ্ধ এবং হিন্দু রাজাদের রাজত্বের সময় ভুলুয়া বঙ্গের একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। প্রাচীনকাল থেকেই ভুলুয়া বঙ্গের বিভিন্ন হিন্দুবৌদ্ধ সাম্রাজ্য দ্বারা শাসিত হয়ে এসেছে। বাংলায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর এই অঞ্চল বঙ্গের গৌড় সাম্রাজ্য, খড়গ সাম্রাজ্য, ভদ্র রাজবংশ, প্রথম দেব সাম্রাজ্য, পাল সাম্রাজ্য, চন্দ্র সাম্রাজ্য, সেন সাম্রাজ্য, দ্বিতীয় দেব সাম্রাজ্য দ্বারা শাসিত হয়।[১] হিন্দু বৈষ্ণব দ্বিতীয় দেব সাম্রাজ্যের পর মধ্যযুগে এই অঞ্চলে মহারাজ বিশ্বম্ভর সুর রাজত্ব করেন। এই সময়ে ভুলুয়া গ্রামের নামানুসারে বর্তমান নোয়াখালী অঞ্চল ভুলুয়া নামে পরিচিত হয়। মধ্যযুগীয় ভুলুয়া রাজ্য মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে যাওয়ার আগে ত্রিপুরা রাজ্য এবং বাংলা সালতানাতের অধীনে কিছু স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে, সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেসের নেতৃত্বে পর্তুগিজ জলদস্যুরা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু পরে মোগল সুবাহদার শায়েস্তা খানের কাছে পরাজিত হয়। বন্যার পানি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, অঞ্চলটির রাজধানী দ্রুত একটি নতুন জায়গায় সুধারাম/নোয়াখালী নামে স্থানান্তরিত হয়, যেখান থেকে এই অঞ্চলটি বর্তমানে এর নাম নেয়। ১৭৫৬ সালের মধ্যে, বিলাতী পূর্ব ভারত কারবার আধিপত্য বিস্তার করে এবং এই অঞ্চলে তারা বেশ কয়েকটি কারখানা স্থাপন করে। ১৯৫১ সালে নোয়াখালী শহর উষ্ণ ক্ষয়ের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায়, যার ফলে সদর দপ্তরটি আবার স্থানান্তরিত হয়, এবার মাইজদীতে[২]

প্রাচীন এবং মধ্যযুগের প্রথম দিকে[সম্পাদনা]

বর্তমান নোয়াখালী অঞ্চলের সভ্যতা প্রায় ৩০০০ বছর আগের, এটি বাংলার কনিষ্ঠতম উপ-অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। বিলাতী ইতিহাসবিদ ওয়েবেস্টার বোধ করে যে এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা মূলত বাংলার নমশূদ্র, চণ্ডাল অথবা যোগী সম্প্রদায়ের বাঙালিরা ছিলেন; যারা এই অঞ্চলের প্রধান হিন্দু জাতি ছিলেন। হিন্দু পৌরাণিক কেচ্ছা অনুসারে, এই অঞ্চল হতে পারে সুহ্ম রাজ্যের একটি অংশ। হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে ভীম সুহ্মের রাজাকে পরাজিত করে। পঞ্চম শতাব্দীর সংস্কৃত লেখক কালিদাসের রঘুবংশ গ্রন্থে সুহ্মরাজ্যের সবুজতা ও তালগাছগুলি উল্লেখ করেছিলেন।[৩] শিলুয়া গ্রামে মৌর্যশুঙ্গ যুগের একটি অজ্ঞাত ব্রাহ্মী শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। রূপালী প্রোটো-বাংলা মুদ্রার আবিষ্কার থেকে বোঝা যায় যে নবম শতাব্দীর মধ্যে এই অঞ্চলটি হরিকেল এবং আকারা অঞ্চলের একটি অংশ ছিল। অঞ্চলের সদর ঐতিহাসিকভাবে মাইজদী থেকে কয়েক মাইল পশ্চিমে ভুলুয়া নামে শহর ছিল। ভুলুয়া এই সময়ের বেশিরভাগ পুন্ড্র রাজ্যের অংশ ছিল।

এই অঞ্চলের প্রাথমিক রাজারা পশ্চিমবঙ্গের কায়স্থ ছিলেন বলে জানা গেছে। হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে, আদিশূরের নবম পুত্র বিশ্বম্ভরশূর সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চন্দ্রনাথ মন্দিরে তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন। সীতাকুণ্ড থেকে ফিরে, বিশ্বম্ভরশূর বর্তমান নোয়াখালীর মধ্য দিয়ে গেলেন যেখানে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে সে যদি হিন্দুপ্রভু বরাহীকে পূজা করে তবে তাকে এই অঞ্চলের সার্বভৌম করে তুলবে। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে একটি মেঘলা দিনে, বিশ্বম্ভরশূর বরাহীর জন্য একটি বেদী তৈরি করেছিলেন এবং একটি ছাগল বলি দিয়েছিলেন। যখন মেঘ সরে গেল, বিশ্বম্ভরশূর বুঝতে পারল যে তিনি ছাগলকে পশ্চিম দিকে বলি দিয়েছেন, যা হিন্দু ধর্মে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলস্বরূপ, সে ভুল হুয়া চিৎকার করে, যেখান থেকে ভুলুয়া নামটি এসেছে বলে বলা হয়। আজ, নোয়াখালীর হিন্দুরা পশ্চিমে ছাগল বলি দিয়ে এই স্থানীয় ঐতিহ্য অব্যাহত রাখে। পূর্বপুরুষ রাজপুত হলেও বিশ্বম্ভরশূর একটি কায়স্থ পরিবারে বিয়ে করেন, যার সাথে তার রাজবংশের পরিচয় অব্যাহত থাকে। সোনাইমুড়ির অমিশাপাড়ার একটি মন্দিরে এখনও বরাহীর একটি পাথরের মূর্তি রয়েছে। লোক ঐতিহ্য অনুসারে, ভুলুয়ার কল্যাণপুর প্রথম রাজধানী হয়ে ওঠে।[৩]

এই সময়ে, এই অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠী মঙ্গোলয়েড ভূত উপাসক ছিল বলে বলা হয়, সেই সময়ে পশ্চিম ও উত্তর বাংলার ইন্দো-আর্যদের বিপরীতে। এর আগে এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত ছিল।[৪] :৪০

মুসলমানদের আগমন[সম্পাদনা]

শর্শাদী শাহী মসজিদে সুলতানী যুগের খোদাই।

১২৭৯ সালে তুগরল তুগান খান নিকটবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যকে সহায়তা করার সময় ইসলাম প্রথম এই অঞ্চলে পৌঁছেছিল বলে জানা যায়। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ, যিনি প্রাথমিকভাবে সোনারগাঁয়ের সুলতান ছিলেন, তিনিও এক পর্যায়ে ত্রিপুরায় অভিযান চালান, তাই সম্ভবত তিনি ভুলুয়া পৌঁছেছেন। ভুলুয়ার হিন্দু রাজ্য বিশ্বম্ভর শূর রাজবংশের হাতে রয়ে গেল। ভুলুয়ার চতুর্থ রাজা শ্রীরাম খাঁন উপাধিটি গ্রহণ করেছিলেন যা থেকে বোঝা যায় যে এই সময় মুসলিম প্রভাব শুরু হয়েছিল। শ্রীরাম খাঁন শ্রীরামপুর গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে তিনি একটি প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন যা আজও ধ্বংসস্তূপে বিদ্যমান। ষষ্ঠ রাজা নিজেদেরকে খাঁন উপাধিকরণের ঐতিহ্যের অবসান ঘটান এবং রায় উপাধি গ্রহণ করেন। তবে তার পুত্র মানিক্য উপাধিটি গ্রহণ করেছিলেন যা থেকে বোঝা যায় যে ভুলুয়া হয়তো ত্রিপুরার মানিক রাজবংশের সাথে ভুলুয়া রাজড়া হয়েছিল। দুই রাজ্যের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, ত্রিপুরার রাজারা তাদের রাজ্যাভিষেকের সময় তাদের কপালে রাজ টিকা (রাজকীয় চিহ্ন) রাখার জিম্মাদারী দিয়েছিলেন ভুলুয়া রাজাদের।[৩]

রাজগঞ্জের সৈয়দ আলম পরিবারের জমিদার প্রাসাদ।

মগদের আক্রমণ থেকে ভুলুয়া রাজ্যের সীমান্তের হেফাজত জোরদার করার জন্য, ভুলুয়ার রাজা রাজবল্লভ এলাহাবাদ ও দাঁদরা পরগনার সামন্ত গভর্নর হিসেবে একজন মুসলিম সেনাপতি নিযুক্ত করেন। এর ফলে এই অঞ্চলে মুসলিম অভিবাসীদের আগমন ঘটে। এই সময়ের মধ্যে, বগদাদ থেকে একজন সৈয়দ বংশীয় সুফী পীর একটি বাঘের উপরে চড়ে ভুলুয়ায় এসেছিলেন এবং এইভাবে স্থানীয় লোকদের কাছে শের আলম নামে পরিচিত হন। রাজবল্লভ সৈয়দ শের আলমকে দুই দ্রোণ জমি ও একটি বড় লাখেরাজ বাড়ি উপহার করেন দানাইকোটে। শের আলম কিছুক্ষণ দানাইকোটে অবস্থান করেন, কিন্তু বাদে রাজগঞ্জের কাছাকাছি দিলিলপুর/টাঙ্গিরপাড় বসবাসকারী মুসলমানদের সাথে বসবাস শুরু করেন যেখানে তাকে তাদের সরদার হিসেবে গ্রহণ করা হয়।[৫] আলম রাজগঞ্জের সম্ভ্রান্ত সৈয়দ আলম পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিলেন যারা নোয়াখালীর রাজনৈতিক ইতিহাসে জরূরী ভূমিকা পালন করেছিলেন। সৈয়দ নূর আলম চৌধুরী ছিলেন এই পরিবার থেকে।[৬]

চতুর্দশ শতাব্দীতে বগদাদের সৈয়দ আহমদ তন্নূরী তাওয়াক্কুলী ইসলাম প্রচারের নিয়তে কাঞ্চনপুরে চলে আসেন। স্থানীয়দের কাছে তিনি মীরান শাহ নামেও পরিচিত।[৭] উনার সঙ্গে ছিলেন মজ্জুবা বিবি সালেহা, বখতিয়ার মাইসূরী (রোহিণী বসবাসকারী), শাহ মুহম্মদ ইঊসুফ (কিতাবপুর), শাহ মুহম্মদ ফজলুল্লাহ (রায়পুর), শাহ নূরুদ্দীন (ভাটুইয়া), শাহ বাদশাহ মিঞা (দিলালপুর টাঙ্গিরপাড়), মিঞা সাহেব বগদাদী (হরিচর), এবং শাহ আব্দুল্লাহ এবং শাহ ইয়াকূব নূরী (সদর)। ১৩০৩ সালে শ্রীহট্ট বিজয়ের বাদে শাহ জালালের কিছু শিষ্য নোয়াখালীতে চলে আসেন, যেমন শেখ জলালউদ্দিন যিনি নন্দনপুরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মুসলিম প্রচারক যারা নোয়াখালীতে বসতি স্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে আহসান হাসন শাহ, আজম শাহ এবং শাহ আমীরুদ্দীন।[৮]

লক্ষ্মণ মানিক ছিলেন ভুলুয়ার অষ্টম এবং বিশিষ্ট রাজা। তিনি দুটি সংস্কৃত বই লিখেছিলেন এবং ষোড়শ শতকের বাংলার বারো ভূঁইয়াদের সদস্য ছিলেন। শত শত ব্রাহ্মণকে ভুলুয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে, যাদেরকে সে চাপালী, কিলপাড়া, বরাহীনগর এবং শ্রীরামপুর এলাকায় জমি দিয়েছিলেন। মানিক্য প্রায়ই চন্দ্রদ্বীপের তরুণ শাসক রামচন্দ্রকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন, যার ফলে শেষ পর্যন্ত রামচন্দ্র তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। মেঘনা নদী অতিক্রম করে তাকে একটি দাওয়াত জানিয়েছিলেন যেখানে তার লোকজন মানিক্যকে ধরে এনে চন্দ্রদ্বীপে তাকে কতল করেছিল। লক্ষ্মণের তখতে তার ছেলে, বলরাম মানিক্য, ভুলুয়ার নবম রাজা হন। ভুলুয়ার সাবেক রাজাদের মতো, বলরাম সম্পূর্ণ আজাদীর ঘোষণা দিয়ে ১৫৯৭ সালে ত্রিপুরা রাজা অমর মানিক্যের রাজ্যাভিষেকে যোগ দিতে ইংকার করেন। তার ফলে, অমর মানিক ভুলুয়ায় অভিযান চালান এবং বলরাম শেষ পর্যন্ত আবারও একজন রাজড়া শাসক হতে বাধ্য হন।[৩] বলরাম মানিক্যের দরবারী কবি ছিলেন বেদরাবাদের বালুকিয়ার আব্দুর রাজ্জাক। আব্দুর রাজ্জাক ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে সাইফুল মুলুক ও লাল বানু লিখেছিলেন[৪]

মোগল আমল[সম্পাদনা]

১৭০১ সালে জমিদার চাঁদ গাজী ভূঁইয়া ছাগলনাইয়ায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
আমান উল্লাহ ১৭৪১-৪২ সালে মোগল সম্রাট মুহম্মদ শাহের শাসনামলে বজরা শাহী মসজিদটি তৈরি করেছিলেন।

সম্রাট হুমায়ূনআকবরের আমলে বাংলায় মোগল আক্রমণ ও বিজয় শুরু হয়। নোয়াখালী অঞ্চলটি সরকার-ই-সোনারগাঁওয়ের একটি অংশ ছিল।[৯] ১৫৭৬ সালে রাজমহলের জঙ্গের ফলে দাঊদ খাঁন কররানীর ওফাৎদন্ড কার্যকর হয়, যার ফলে কররানী সালতানাতের অবসান ঘটে। জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ১৬১২ সাল নাগাদ সুবাহ বাংলা নামে পরিচিত একটি মোগল সুবাহ হিসেবে বাংলা সম্পূর্ণরূপে একীভূত হয়।[১০]

মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে, বাংলার সুবাহদার ইসলাম খাঁ ভুলুয়া দখলের জন্য একটি বাহিনী পাঠান, যেটি বিশ্বম্ভরশূর রাজবংশের অনন্ত মাণিক্য দ্বারা শাসিত হয়েছিল। এই অভিযানে মীর্জা নূরউদ্দীন, মীর্জা ইসফান্দিয়ার, হাজী শামসউদ্দীন বগদাদী, খাজা আসল, আদিল বেগ এবং মীর্জা বেগের বাহিনী ছাড়াও সুবাহদারের অশ্বারোহী বাহিনীর ৫০০ জন সদস্য ছিল। খাঁন আব্দুল ওয়াহিদকে পুরো অভিযানের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন, যা মোট ৫০টি হাতি, ৩০০০ ম্যাচলকার এবং ৪০০০ অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে গঠিত ছিল। অনন্ত মাণিক্য ডাকাতিয়া তীরে এগিয়ে যাওয়ার আগে মগ রাজার সহায়তায় ভুলুয়ার চারপাশে প্রতিরক্ষা স্থাপন করেছিলেন যেখানে তিনি একটি কেল্লা তৈরি করেছিলেন। মোগলরা কয়েক দিনের মধ্যে কেল্লায় পৌঁছেছিল এবং একটি জঙ্গ শুরূ হয় যার ফলে উভয় পক্ষের অনেক লোক মারা যায়। ভুলুয়া বাহিনীও রাতে আকস্মিক আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল। মানিক্যের মুখ্যমন্ত্রী মীর্জা ইঊসুফ বরলাস মোগল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং আবদুল ওয়াহিদ তাঁকে ৫০০ সৈন্য ও ৩০০ ঘোড়ার মনসবদার হিসাবে পুরস্কার করেন। তবে বরলাসকে হারানোর পর, মাণিক্য আত্মসমর্পণ করেননি এবং মধ্যরাতে ভুলুয়ায় পশ্চাদপসরণ করেন কেল্লাকে মজবূৎ করার জন্য। পশ্চাদপসরণের খবর দুই পহর পরে মোগলদের কাছে পৌঁছায় এবং তাই তারা ভুলুয়া বাহিনীর অনুসরণ শুরু করে। খোদহেফাজতের কোন সময় না থাকায় মাণিক্য মগ রাজার কাছে পানা নিতে আরও পিছু হটে কিন্তু ফেনী নদীর তীরে পরাজিত হন। মোগলরা মানিক্যের সমস্ত হাতি দখল করে নেয় এবং আব্দুল ওয়াহিদ সফলভাবে ভুলুয়ার নিয়ন্ত্রণ নেন।

কাসিম খাঁন চিশতীর সুবাহদারীর সম​য়, ভুলুয়ার আব্দুল ওয়াহিদ সুবাহদারের সাথে দেখা করতে জাহাঙ্গীরনগরের দিকে চলা শুরু করেন। সফর শুরূ করার আগে, আব্দুল ওয়াহিদ তাঁর ছেলেকে ত্রিপুরা হানা দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং ভুলুয়ায় দেখাশোনার জন্য একজন মুতসদ্দী রেখে যান।

আব্দুল ওয়াহিদের সফরের খবর পেয়ে, মগ রাজা এটিকে ভুলুয়া আক্রমণের সুযোগ হিসাবে দেখেছিলেন এবং তাই তিনি অশ্বারোহী, হাতি, কামান, পদাতিক বাহিনী এবং একটি নৌবহর নিয়ে গঠিত আরাকান থেকে একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে ভুলুয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। অভিযানের বিষয়ে ভুলুয়ার মুতসদ্দী জাহাঙ্গীরনগরকে সতর্ক করতে একজন বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সুবাহদার কাসিম খাঁন চিশতী মনে করেছিলেন এটি সম্ভবত আবদুল ওয়াহিদের উপস্থিতি ত্যাগ করার জন্য একটি অজুহাত ছিল। বিক্রমপুর ও শ্রীপুরের থানাদারদের আরও সতর্কতার পর কাসিম খাঁন চিশতী সর্বশেষে আব্দুল ওয়াহিদকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন। চিশতী নিজে খিজিরপুরের দিকে অগ্রসর হন যেখানে তিনি আদেশ দিলেন যে ভুলুয়া থেকে খিজিরপুর সংযোগ সব নদীগুলো পাতিলা এবং ভদিয়ার মত বৃহৎ পণ্যসম্ভার জাহাজের সঙ্গে অবরোধ করা হোক। তিনি সৈয়দ আবূ বকরকে আসাম অভিজান বাতিল করার বার্তা পাঠান, এবং মগদের দমন করার জন্য নৌবহরকে বাংলায় ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বার্তাও পাঠান। চিশতী ভুলুয়া জঙ্গের তৈয়ারীতে মীর্জা মক্কী ও শেখ কামালের ফউজকে জাহাঙ্গীরনগরে নিয়ে আসার জন্য সজাবলদেরকে নিয়োগ করেন। এরপর চিশতী তার নিজের ৪০০০ ম্যাচলকার এবং ২০০০ ঘোড়সওয়ারের একটি ফউজ পাঠান, যেগুলিকে তার ছেলে, শেখ ফরীদ এবং জেনারেল আব্দুন্নবীর নেতৃত্বে লক্ষা নদী দিয়ে নিরাপদে ভুলুয়া অভিমুখে পাঠানো হয়েছিল।

১৬২০ সালের মধ্যে, মুসলমানরা ভুলুয়া গ্রামের কাছে একটি ফাঁড়ি স্থাপন করেছিল যাকে তারা ইসলামাবাদ ডাকতেন। ইতিহাসবিদরা এটিকে বর্তমান লক্ষ্মীপুরের সাথে চিহ্নিত করেছেন।[১১] বাংলার সুবাহদার ইব্রাহীম খাঁন ফতেহ-ই-জঙ্গের সাবেক বখশী মীর্জা বাকী ৪০০ ঘোড়াসহ ৫০০ সৈন্যের মনসবদারী দেওয়ার পাশাপাশি ভুলুয়ার থানাদার হিসাবে নিযুক্ত হন।[১১] ১৬৬০ এর দশকে ত্রিপুরা পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর বন্যার জলে উত্তর-পূর্ব ভুলুয়ার কৃষি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৬৬০ সালে ডাকাতিয়া থেকে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ীচৌমুহনী হয়ে মেঘনা নদীফেনী নদীর সংযোগস্থলে পানির প্রবাহ প্রবাহিত করার জন্য একটি খাল খনন করা হয়। এই দীর্ঘ খালটি খননের পর একটি নতুন শহর গড়ে ওঠে যাকে স্থানীয়রা "নোয়াখালী" বলে ডাকতে শুরু করল, যদিও একালে ভুলুয়া নামটি প্রচলিত ছিল। ১৬৬১ সালে, ভুলুয়ায় ওলন্দাজ নাবিকরা জাহাজ ভেঙে পড়েছিল এবং ভুলুয়া শাসকদের দ্বারা তাদের যত্ন নেওয়া হয়েছিল।[৩]

১৭৭০ সালে দোসরা শাহ আলমের শাসনামলে শেখ নূরউল্লাহ চৌধুরী এবং শেখ মুজীরউল্লাহ চৌধুরী রমজান মিঞা মসজিদটি নির্মাণ করেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ভুলুয়া একটি পরগনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, ও ফরহাদ খাঁন ১৬৬৫ থেকে ১৬৭০ ভুলুয়ার থানাদার হিসেবে জিম্মাদারী পালন করেন[১২] ১৬৬৫ সালে নিকটবর্তী চাটগাঁর মোগল বিজয়ের সময়, ক্যাপ্টেন মুরের নেতৃত্বে ফিরিঙ্গীরা আরাকানী নৌবহরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ভুলুয়ায় পালিয়ে যায় যেখানে ফরহাদ খাঁন তাদের পানা দেন। ফরহাদ খাঁন পরে তাদের জাহাঙ্গীরনগরে বাংলার সুবাহদার শায়েস্তা খাঁনের কাছে পাঠিয়ে দেন।[১৩][১৪][১৫] শায়েস্তা খাঁনের সুবাহদারীর আমলে ভুলুয়াকে চাকলা-ই-জাহাঙ্গীরনগরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভুলুয়া গ্রামে ১৭তম শতকের মোগল দুর্গের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।[১১] রাজা কীর্তি নারায়ণ ১৭২৮ সালে ভুলুয়ার জমিদার হন।

মোগল সম্রাট মুহম্মদ শাহের শাসনামলে, ঈরান থেকে পীর মিঞা আম্বর শাহ, যিনি উমর শাহ নামেও পরিচিত, নৌকায় করে এই অঞ্চলে এসেছিলেন।[১৬] তার বন্দোবস্ত এবং প্রচারের সুবিধার্থে, সম্রাট মুহম্মদ শাহ একটি তাম্রশাসন তৈরি করেছিলেন যাতে তার জন্য বজরা একটি লাখেরাজ বন্দোবস্ত ছিল।[১৭] বজরা শব্দটি বড়নৌকা শব্দ থেকে আসছে, এবং এটি উমর শাহের নৌকা থেকে নামকরণ করা হয়েছে।কথিত আছে যে পীর প্রথমে তাঁর নৌকাতেই বাস করতেন এবং নৌকা থেকেই স্থানীয়দের কাছে ইসলাম প্রচার করতেন।[১৮] উমর শাহ ছনগাঁও থেকে স্থানীয় এক বিধবার দুই ছেলে আমানুল্লাহ ও ছানাউল্লাহকেও বড় করেন। উমর শাহের নির্দেশে আমানুল্লাহ বজরা শাহী মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছানাউল্লাহ মসজিদের সামনে ৩০ একর জলাধার খনন করেন। ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ শুরু হয় এবং এটি ১৭৪১ সালে শেষ হয়।[১৯] ইসলাম প্রচারের জন্য এই অঞ্চলে হিজরত করা আরেক ওলী হলেন পীর আহমদ খন্দকার যিনি বাবুপুরে বসতি স্থাপন করেছিলেন।[৩]

২০ মার্চ ১৮৭৪ সালে ভুলুয়া রেজিস্ট্রার অফিসের একটি সীলমোহর।
ছাগলনাইয়ার শমসের গাজী কয়েক বছর ধরে ত্রিপুরা রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হন।

ভুলুয়া শহর হয় অতি দিব্যস্থান
সেই সে শহর হয় অতি ভাল জান
সৈয়দ কাজী আছে যত মুসলমান
নানা জাতি আছে যত ব্রাম্মন সজ্জন

 – ভুলুয়ার শেখ সাদীর একটি কবিতা।[২০]

১৭৫৬ সালের মধ্যে, বিলাতী পূর্ব ভারত কারবার জাগদিয়ায় ফেনী নদীর কাছে তাঁত কারখানা তৈরি করেছিল। ভুলুয়া ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে আসে এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ঢাকা বিভাগের একটি অংশ করা হয়। সন্দ্বীপফেনীকে চট্টগ্রামের কালেক্টরের অধীনে রাখা হয়। ১৭৮৭ সালের মধ্যে, ভুলুয়া একটি জেলায় পরিণত হয় যার নিজস্ব কালেক্টর এবং সহকারী কালেক্টর ছিল। সেই বছরের শেষের দিকে, টেইনমাউথের জন শোর ভুলুয়াকে ময়মনসিংহের কালেক্টরের জিম্মাদারীতে থাকার নির্দেশ দেন। ১৭৯০ সালে টিপ্রা (কুমিল্লা) জেলা গঠিত হলে, নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ড ভুলুয়া পরগনা শাসন করে ড্যান্ড্রিজ সাহেবের সাথে সেই জেলায় যোগ দেয়। নোয়াখালীতে ড্যান্ড্রিজের কার্যালয় তিন বছর ধরে, যেখানে কারখানার মালিক এবং লবণের এজেন্টদের সাথে তার খারাপ সম্পর্ক ছিল। টিপ্রার কালেক্টরের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের আগে অবশেষে তিনি থম্পসন সাহেব দ্বারা প্রতিস্থাপিত হন।

১৮২০ সালে, কারখানার মালিকরা, লবণ এজেন্টরা এবং সংগ্রাহকদের মধ্যে ভুলুয়াতে প্রচলিত সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য ক্যালারি কমিটি একটি সভা করেছিল। প্লোডেন সাহেব, নোয়াখালীর সল্ট এজেন্ট, ভুলুয়াকে নিজস্ব জেলা করার ও তাকে ভুলুয়ার কালেক্টরের জিম্মাদারী দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। গভর্নর-জেনারেল ফ্রান্সিস রডন-হেস্টিংস ১৮২১ সালে এই সুপারিশ কবুল করেন। ২৯ মার্চ ১৮২২ সালে, হেস্টিংস এই বিষয়ে একটি আদেশ জারী করেন এবং তদনুসারে একটি নয়া জেলা গঠন করা হয় যার অধীনে ছিল: দক্ষিণ শাহবাজপুর, সুধারাম, বেগমগঞ্জ, রামগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, পরশুরাম, টিপ্রা জেলার এলাহাবাদ পরগনা এবং চাটগাঁ জেলার হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও বামনী।

১৯তম শতকের মাঝামাঝি, মৌলভী ইমামউদ্দীন নোয়াখালীতে ফরায়েজি আন্দোলনের মতো একটি ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন যার মধ্যে বেদাত থেকে বিরত থাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৩]

জমিদারী পরাধীনতার পাশাপাশি বিলাতী পূর্ব ভারত কারবারের "শোষণ ও নিপীড়ন" আবির্ভাব কৃষক ও কৃষকদের জীবনকে কঠিন ও হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। শমসের গাজী নামে একজন জমিদার কৃষকদের অব্যাহতি দিয়েছিলেন এবং একজন মজবূৎ নেতা হয়ে ওঠেন, পরে ত্রিপুরা পর্যন্ত তার শাসন ছড়িয়ে পড়ে।[২১] টিপ্রা জেলা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিলাতী গ্রন্থে তাকে একজন "কুখ্যাত লুণ্ঠনকারী" হিসাবে দেখা হয়[২২] তার বাড়াবাড়ির জন্য পরে তাকে মীর কাসিম দ্বারা আটক করা হয় এবং একটি কামান দিয়ে কতল করা হয়।

বিলাতী রাজ[সম্পাদনা]

শ্যামপুরের দায়রা শরীফ।

ভুলুয়া ১৮২৯ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে গঠিত হয়েছিল। পার্বত্য ত্রিপুরা থেকে কুকিদের একটি বড় দল ছাগলনাইয়া সমভূমিতে (তৎকালীন টিপরা/কুমিল্লায়) প্রবেশ করে যেখানে তারা ১৮৫ জন বিলাতী আশখাসকে কতল করে, তাদের মধ্যে ১০০ জনকে অপহরণ করে এবং এক বা দুই দিন সমতল ভূমিতে অবস্থান করে। বিলাতী সৈন্য ও পুলিশ সদস্যদের তাদের দমন করার জন্য পাঠানো হয়েছিল কিন্তু কুকিরা ইতিমধ্যেই দেশীয় রাজ্যের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল এবং তারা আর কখনও ফিরে আসেনি।[৩]

১৮৬৮ সালে ভুলুয়া জেলার নাম বদল করে নোয়াখালী রাখা হয়। পরের বছর দক্ষিণ শাহবাজপুর বাকেরগঞ্জ জেলায় দেওয়া হয়। ১৮৭৫ সালের ৩১ মে তারিখে টিপরা (কুমিল্লা) ও নোয়াখালীর মধ্যে সীমানা সমন্বয় করা হয় যাতে নোয়াখালী ৪৩টি গ্রাম লাভ করে এবং ২২টি গ্রাম হারায়। ১৮৭৬ সালে, নোয়াখালী জেলাকে দুটি মহকুমায় বিভক্ত করা হয়; সদর ও ফেনী। ফেনী মহকুমা নিয়ে গঠিত হয়েছিল: ছাগলনাইয়া থানা (পূর্বে টিপরা/কুমিল্লা), মীরসরাই থানা (পূর্বে চাটগাঁও), ফেনী পরগনা, পরশুরাম এবং সোনাগাজী। ১৮৭৮ সালে, মীরসরাই চাটগাঁও জেলায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ১৮৮১ সালে ফেনী নদীকে নোয়াখালী ও চাটগাঁও জেলার মধ্যে বিভাজক রেখায় পরিণত করা হয়, যার ফলে নোয়াখালী চারটি গ্রাম লাভ করে।

১৮৯৩ সালে, একটি ঘূর্ণিঝড় এই অঞ্চলের ফসলের পাশাপাশি এই অঞ্চলের সুপারি খেজুরের অর্ধেককে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিপুল পরিমাণ গবাদি পশুও ডুবে যায় যদিও মানুষের ওফাত ঘটেনি। ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় যার ফলে সুপারি খেজুর ব্লাইটে আক্রান্ত হয়। এর ফলে হাজার হাজার নোয়াখাইল্লার ওফাত হয়। ১৮৯৬ সালে অস্বাভাবিকভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল যা এই অঞ্চলে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল এবং ফসলের ক্ষতি করেছিল। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাই হোক না কেন, এই অঞ্চলের বার্ষিক পয়দাহার বার্ষিক ওফাতের হারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল; ১৮৮১ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত জনসংখ্যা ২৩% বৃদ্ধির সাথে। এই অঞ্চলের পশ্চিমাঞ্চল, রামগঞ্জ উপজেলার মতো স্থানগুলি, ঘূর্ণিঝড়ের তেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি যদিও মেঘনা নদীর মাধ্যমে দুর্যোগ ছড়িয়েছিল।

১৯০১ সালের আদমশুমারীতে, জেলার আয়তন ছিল ১,৬৪৪ মা (৪,২৬০ কিমি) এবং এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় 1,141,728 জন। বামনী নদী কোম্পানীগঞ্জের একটি বড় অংশকে ডুবিয়ে দেয়, যার ফলে জালিয়া কৈবার্তা সম্প্রদায় সন্দ্বীপে চলে যায়। সুধারামের দক্ষিণ অংশও ভূমি ক্ষতির শিকার হয় এবং ছাগলনাইয়াবাসীর বেশ কিছু সংখ্যক বাসিন্দা তাদের বিলাতী দখলের দেশ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে, পরবর্তীতে ত্রিপুরা চলে যায়। জেলার সীমানার মধ্যে বেশ কিছু চর আবির্ভূত হয়েছে, যা অভিবাসনের কারণও হয়েছে।[৩] এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মুসলমান ছিল সুধারামে, সম্ভবত এটি নোয়াখালী অঞ্চলের ঐতিহাসিক মোগল কেল্লা হওয়ার কারণে। ছাগলনাইয়াতে সর্বাধিক হিন্দু ছিল, সম্ভবত এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনে ছিল এবং সম্প্রতি বিলাতী জেলায় যোগ দিয়েছে।

বঙ্গভঙ্গ বাদে[সম্পাদনা]

নোয়াখালীর সদর দপ্তর সুধারাম/নোয়াখালী শহরটি ১৯৫১ সালে মেঘনা নদীর ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এর পর মাইজদীতে নোয়াখালী জেলার সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬৪ সালে সদর মহকুমা সদর ও লক্ষ্মীপুর নামে দুটি মহকুমায় বিভক্ত হয়।

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সময় , পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলাকে ধরে রাখার জন্য নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ৩৯তম অ্যাডহক ডিভিশন তৈরি করে, সেই এলাকায় মোতায়েন করা ১৪তম ডিভিশন ইউনিট থেকে, এবং ১৪তম ডিভিশনকে হেফাজত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কেবল সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায়।[২৩] ১৯৭১ সালের ১৫ জুন সোনাপুর আহমদিয়া বিদ্যালয়ের সামনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘর্ষে নোয়াখালীতে আনুমানিক ৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী শত্রুমুক্ত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

১৯৮৪ সালে, নোয়াখালী জেলাকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে আরও তিনটি জেলায় বিভক্ত করা হয়; নোয়াখালী জেলা, লক্ষ্মীপুরফেনী। দেশভাগের ফলে ফেনী নদীর পানি উত্তোলন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০২১ সালে, তিনটি জেলা চট্টগ্রাম বিভাগ ছেড়ে প্রস্তাবিত মেঘনা বিভাগের অধীনে আসে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Sailendra Nath Sen (১ জানুয়ারি ১৯৯৯)। Ancient Indian History And Civilization। New Age International। পৃষ্ঠা 277। আইএসবিএন 978-81-224-1198-0। সংগ্রহের তারিখ ১৮ এপ্রিল ২০১২ 
  2. "View of Noakhali (Bengal)"দ্য ব্রিটিশ লাইব্রেরি। ২৩ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০২১ 
  3. ওয়েবস্টার, জন এডওয়ার্ড (১৯১১)। Eastern Bengal and Assam District Gazetteers [পূর্ব বাংলা ও আসাম জেলা গেজেটিয়ার্স]। দ্য পাইওনিয়ার প্রেস। 
  4. Bangladesh District Gazetteersবাংলাদেশ সরকার। ১৯৭৭। 
  5. Mitra, Naliniranjan (১৯৬৫)। "ইলাহাবাদ ও দাঁদরা পরগণা"। নোয়াখালির ইতিকথা 
  6. Sen, Pyarimohan। নোয়াখালীর ইতিহাস। পৃষ্ঠা 18 and 52। 
  7. মাওলানা নুর মুহাম্মদ আজমি। "২.২ বঙ্গে এলমে হাদীছ"। হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস। এমদাদিয়া গ্রন্থাগার। পৃষ্ঠা ২৪। 
  8. ইসলামী বিশ্বকোষইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। ১৯৮৬। পৃষ্ঠা ২৩৮। 
  9. Jarrett, Henry Sullivan। The Ain I Akbari of Abul Fazl 'Allami (Vol 2)Bibliotheca Indica। পৃষ্ঠা 128। 
  10. Hasan, Perween (২০০৭)। Sultans and Mosques: The Early Muslim Architecture of Bangladesh। I.B. Tauris। পৃষ্ঠা 18। আইএসবিএন 978-1-84511-381-0 
  11. M. I. Borah (১৯৩৬)। Baharistan-I-Ghaybi – Volume II 
  12. Population Census of Noakhali। Bangladesh Bureau of Statistics, Statistics Division, Ministry of Planning। ১৯৭৪। পৃষ্ঠা 12। 
  13. "3. The Feringhees of Chittagong"। The Calcutta ReviewUniversity of Calcutta। ১৮৭১। পৃষ্ঠা 74। 
  14. M Noorul Haq (১৯৭৭)। বৃহত্তর চট্টলা। পৃষ্ঠা 66। 
  15. Ghulam Husain Salim (১৯০২–১৯০৪)। Riyazu-s-salatin; a history of Bengal. Translated from the original Persian by Maulavi Abdus Salam। Calcutta Asiatic Society। পৃষ্ঠা 230–231। 
  16. Thompson, W. H. (১৯১৯)। "24"। Final Report on the Survey and Settlement Operations in the District of Noakhali, 1914–1919। Bengal Secretariat Book Depot। পৃষ্ঠা 60–61। 
  17. Eaton, Richard M (১৯৯৩)। "Bengal under the Mughals: Islam and the Agrarian Order in the East: Charismatic Pioneers on the Agrarian Frontier"। The rise of Islam and the Bengal frontier, 1204-1760University of California Press। পৃষ্ঠা 211। 
  18. Muhammad Badrur Huda, additional subdivisional officer, Revenue, Noakhali District Collectorate, 17 June 1982
  19. Hasan, Dr Syed Mahmudul (১৯৭১)। Muslim Monuments of Bangladesh। পৃষ্ঠা 101। 
  20. "উপজেলার পটভূমি"সেনবাগ উপজেলা। ১ নভেম্বর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০২১ 
  21. Rāẏa, Suprakāśa (১৯৯৯)। Peasant Revolts And Democratic Struggles In India। ICBS (Delhi)। পৃষ্ঠা 24। আইএসবিএন 978-81-85971-61-2। সংগ্রহের তারিখ ২৯ অক্টোবর ২০১৫ 
  22. Sharma, Suresh Kant; Sharma, Usha (২০০৫)। Discovery of North-East India: Geography, History, Culture, Religion, Politics, Sociology, Science, Education and Economy. Tripura. Volume eleven। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 24। আইএসবিএন 978-81-8324-045-1। সংগ্রহের তারিখ ২৯ অক্টোবর ২০১৫ 
  23. Salik, Siddiq, Witness to Surrender, pp126

আরও পড়[সম্পাদনা]

  • ইটন, রিচার্ড দ্য রাইজ় অফ ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার, ১২০৪-১৭৬০ (ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যাল​য় ছাপাখানা, ১৯৯৩)