নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়
নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় | |
---|---|
এখন যৌবন যার | |
হেলাল হাফিজ রচিত | |
রচনা | আনু. ২০ জানুয়ারি–১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ |
প্রথম মুদ্রণ | লিটল ম্যাগাজিন (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) |
দেশ | বাংলাদেশ |
ভাষা | বাংলা |
উৎস | যে জলে আগুন জ্বলে |
উপজীব্য | ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান |
ধরন | গদ্য কবিতা |
প্রকাশক | দিব্য প্রকাশ |
প্রকাশের তারিখ | ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ |
মাধ্যম | ছাপা কাগজ |
পঙক্তি | ১৮ |
নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় ১৯৬৯ সালে হেলাল হাফিজ রচিত একটি কবিতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এই কবিতার উপজীব্য ছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি সংযোজিত হয়। কবিতাটিতে আন্দোলনে সশস্ত্র যুদ্ধের আহবান জানানো হয়েছে।
দৈনিক পাকিস্তান সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য কবিতাটি সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে রাষ্ট্রবিরোধী হওয়ায় তা প্রকাশে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এরপর আহমদ ছফা আর হুমায়ূন কবির কবিতাটির প্রথম দুটি পঙক্তি কাগজে লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেওয়ালগুলোতে লাগিয়ে দেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে এই কবিতা পরিবেশন করা হতো। স্বাধীনতা-পরবর্তী মুজিবী আমল থেকে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক কবিতাটি বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছিল।
পটভূমি
[সম্পাদনা]জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে[১] ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় কবি হেলাল হাফিজ পুরান ঢাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে গুলিস্তানে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদস্যদের দমনপীড়ন চালাতে দেখেছিলেন। সেই সময় এক রিকশাওয়ালা আন্দোলনকারীদের পালটা লড়াইয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করে বলেছিল যে দেশপ্রেমের জন্য হত্যা করা বৈধ। তার কথাটি শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে কবি কবিতাটি লেখা সম্পন্ন করেছিলেন। এরপর আহমদ ছফা আর হুমায়ূন কবিরের সাথে হেলাল হাফিজ দৈনিক পাকিস্তান সংবাদপত্রের সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের কাছে কবিতাটি প্রকাশের জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু কবিতাটি পড়ে রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দিয়ে এটা ছাপানো হলে চাকরি চলে যাবে এবং সংবাদপত্রটি বন্ধ হয়ে যাবে জানিয়ে এটি প্রকাশে সাহিত্য সম্পাদক অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সংবাদপত্রে কবিতাটি প্রকাশে ব্যর্থ হওয়ার পর আহমদ ছফা ও হুমায়ূন কবির কবিতার প্রথম দুটি পঙক্তি কাগজে লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেওয়ালগুলোতে লাগিয়ে দিয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে একটি লিটল ম্যাগাজিনে কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়।[২] ১৯৮৬ সালে হেলাল হাফিজের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ "যে জলে আগুন জ্বলে"-এ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এটি ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি ও হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।[৩]
উপজীব্য
[সম্পাদনা]বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত এই কবিতার উপজীব্য ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। কবিতাটি আন্দোলনে সশস্ত্র যুদ্ধের আহবান জানায়।[১] পাশাপাশি কবিতাটিতে কাব্যে প্রকাশিত বেদনার বিপরীতে স্বাধীনতাকে সমাধান হিসেবে ব্যক্ত করা হয়েছে।[৪]
অভ্যর্থনা
[সম্পাদনা]মুসাররাত নওশাবার মতে এটি একটি রাজনৈতিক সচেতনতা সমৃদ্ধ কবিতা যেখানে সাবলীলভাবে দেশপ্রেমের গভীরতা প্রকাশ করা হয়েছে। তার মতে এতে পূর্ণাঙ্গতা সহ "শাশ্বত জীবনের বিবরণ" উপস্থিত।[৫] মোস্তফা হায়দার একে একটি কালজয়ী কবিতা বলেছেন যেখানে স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে যুব সমাজের উপলব্ধি তুলে ধরা হয়েছে।[৬] যুবক অনার্যের মতে এই কবিতা লিখেই কবি তখন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কবিতাটিকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছেন "কবি হেলাল হাফিজকেও যেন গ্রাস করে এক বিষণ্ণ অবসাদ। তিনি দেখতে পান সুন্দরের হাতে হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া। তবে তিনি কবিতাকে কখনো করে তোলেননি স্লোগানমুখর"।[৭] মোহাম্মদ আলীর মতে হেলাল হাফিজ কবিতায় দেশপ্রেমের সামনে ইহজগতকে তুচ্ছ করে নিজের যৌবনকে উৎসর্গকারী একজন প্রেমিককে দেশের শত্রু হত্যাকারী হিসেবে দেখিয়েছেন।[৮]
কিংবদন্তি
[সম্পাদনা]প্রাক-স্বাধীনতা যুগের বাংলাদেশে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে এই কবিতা পরিবেশন করা হতো।[১] ১৯৭১ সালে এই কবিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যুবকদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর মনোবল বৃদ্ধি করতে ব্যবহৃত হতো।[৩] স্বাধীনতা-পরবর্তী মুজিবী আমল থেকে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক কবিতাটি বহুল ব্যবহৃত হতে থাকে।[১][৩] বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রাসঙ্গিক কবিতাটি পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছিল।[৯] কবিতাটির প্রথম দুটি পঙক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত স্লোগানে পরিণত হয়।[১০] ২০১৫ সালে ছাবেদ সাথীর আয়োজনে এটি গানে রূপান্তরিত হয় এবং এর উপর মিউজিক ভিডিও নির্মিত হয় যার গায়িকা ছিলেন উত্তর আমেরিকা ভিত্তিক কণ্ঠশিল্পী কৌশলী ইমা।[১১] ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ইন্ধন আছে বলে মনে করে – এমন সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় আনিসুল হক কবিতাটি স্মরণ করে সরকারকে দ্রুত শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের জন্য আহবান করেছিলেন।[১২] ২০২০ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের তৎকালীন অধিনায়ক মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা সমর্থকদের উদ্দেশ্যে কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষাপটে ঘরে থাকতে উৎসাহিত করতে কবিতাটি প্রথম দুটি পঙক্তির অনুকরণে "এখন যৌবন যার বাসায় থাকার তার শ্রেষ্ঠ সময়..." লিখে ফেসবুকে প্রকাশ করেছিলেন।[১৩]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- হুলিয়া, একই পটভূমিতে রচিত নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ আবেদ, সিরাজুল ইসলাম (২৮ জানুয়ারি ২০১৯)। "৫০ বছরে নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়"। রূপসী বাংলা।
- ↑ হাফিজ, হাসান (২৯ জুন ২০২৩)। "যেভাবে লেখা হলো 'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'"। প্রথম আলো।
- ↑ ক খ গ নয়ন, আশরাফুল (৯ অক্টোবর ২০২৩)। "দুইটি পঙক্তি, স্বাধিকার আন্দোলন ও হেলাল হাফিজ"। সাম্প্রতিক দেশকাল।
- ↑ "বিজয়ের কবিতায় কবি-যোদ্ধা"। জনকণ্ঠ। ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮।
- ↑ নওশাবা, মুসাররাত (১০ আগস্ট ২০১৮)। "'এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'"। যুগান্তর।
- ↑ হায়দার, মোস্তফা (১২ অক্টোবর ২০১৮)। "হেলাল হাফিজ : 'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'"। নয়া দিগন্ত।
- ↑ অনার্য, যুবক (৭ অক্টোবর ২০২০)। "হেলাল হাফিজের কবিতা: অনন্ত জোছনাক্ষরণ"। দৈনিক ইত্তেফাক।
- ↑ আলী, মোহাম্মদ (২ অক্টোবর ২০২০)। "হেলাল হাফিজের কবিতা: বিষয় ও প্রবণতা"। যুগান্তর।
- ↑ "হেলাল হাফিজের ১০ কবিতা"। দৈনিক ইত্তেফাক। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪।
- ↑ "এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'- কবি হেলাল হাফিজ মারা গেছেন"। বিবিসি। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪।
- ↑ "এখন যৌবন যার' গানের ভিডিও দেখে যেতে পারলেন না কবি হেলাল হাফিজ"। আমাদের সময়। ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪।
- ↑ হক, আনিসুল (৬ জুলাই ২০১৮)। "কোটা সংস্কার 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়'"। প্রথম আলো।
- ↑ "এখন যৌবন যার..."। প্রথম আলো। ২৩ মার্চ ২০২০।