নাসখ (তাফসীর)
![]() কুরআনের একটি পৃষ্ঠা | |
নাসখ (نسخ) একটি আরবি শব্দ, যা সাধারণত "বাতিলকরণ" হিসাবে অনূদিত হয়। তাফসির বা ইসলামিক আইন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে, নাসখ নির্দেশ করে যে কোনো নির্দিষ্ট বিধান সব পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। প্রচলিত[১] এবং "প্রচলিত ধরণের" নাসখ অনুযায়ী,[২][৩] একটি হুকুম (আইন) বাতিল করা হয় এবং এর পরিবর্তে নতুন বিধান আনা হয়, তবে সংশ্লিষ্ট মূল পাঠ (গ্রন্থ) রহিত হয় না।[৪]
ইসলামি আইন অনুযায়ী কিছু বিধান নাসখ-এর ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন:
- মদের নিষিদ্ধকরণ ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হয়েছিল—প্রথমে একে অনুমোদিত রাখা হয়, পরে জানানো হয় যে মদের ক্ষতিকর দিক ইতিবাচক দিকের তুলনায় বেশি, এবং শেষে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।
- কিবলার পরিবর্তন—প্রথমে মুসলিমরা জেরুজালেম অভিমুখে নামাজ আদায় করত, পরে এটি পরিবর্তন করে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।[৫]
তবে, খুব কম ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া, ইসলামী গ্রন্থগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি কোন কুরআনের আয়াত বা হাদিস বাতিল হয়েছে। মুসলিম তাফসিরকারক ও আইনজ্ঞরা এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন এবং কুরআনের কতগুলো আয়াত বা হাদিস বাতিল হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ আছে।[৬][৭] মতানৈক্য এতটাই বিস্তৃত যে কারো মতে এই সংখ্যা ১০টিরও কম, আবার অন্যদের মতে ৫০০-এরও বেশি।[৮][৯]
অন্য একটি বিতর্ক হলো সুন্নাহর মাধ্যমে কুরআন বাতিল হতে পারে কি না, অথবা কুরআনের কোনো বিধান সুন্নাহ দ্বারা পরিবর্তিত হতে পারে কি না। সুন্নি ইসলামে শাফেয়ি ও হানাফি মাজহাবের মধ্যে এই বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে।[১০] এছাড়াও, কিছু পণ্ডিত পুরোপুরি বাতিল করার পরিবর্তে কুরআনের আয়াতকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করাকেই সমর্থন করেন।[১১]
কুরআনের কিছু আয়াত ও নবীর সাহাবিদের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী কিছু বিধান নতুন বিধান দ্বারা পরিবর্তিত হয়েছে। নাসখ-এর এই ধারণা শরিয়াহ্তে ৯ম শতকের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[১২][১৩][১৪] তবে, ১৯শ শতক থেকে আধুনিকতাবাদী ও ইসলামপন্থী পণ্ডিতরা নাসখ ধারণার বিরোধিতা করেছেন এবং কুরআনের চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে মত দিয়েছেন।[১৫]
একটি বাতিলকৃত বিধানকে বলা হয় মানসুখ (বাতিলকৃত), এবং যে বিধান সেটিকে বাতিল করে তাকে বলা হয় নাসিখ (বাতিলকারী)।[১৬]
সংজ্ঞা
[সম্পাদনা]ইসলামি শাস্ত্রে, **নাসখ** অর্থ হল পূর্ববর্তী কোনো বিধান বা আইনকে নতুন বিধান দ্বারা রহিত করা। এই পদ্ধতিটি কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে ইসলামের আইনি ও সামাজিক বিধানসমূহকে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়।
নাসখের ধরন
[সম্পাদনা]তাফসীরবিদরা সাধারণত নাসখকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন:
- **আয়াতের পাঠ ও বিধান উভয়ই রহিত (নাসখ আল-তিলাওয়া ওয়াল-হুকুম)**: যেমন, একটি আয়াত সম্পূর্ণভাবে কুরআন থেকে অপসারিত হয়েছে এবং তার বিধানও রহিত হয়েছে।
- **শুধুমাত্র বিধান রহিত, কিন্তু আয়াত বজায় আছে (নাসখ আল-হুকুম)**: আয়াত পাঠ করা হয়, কিন্তু তার বিধান আর কার্যকর নয়।
- **শুধুমাত্র পাঠ রহিত, কিন্তু বিধান বহাল (নাসখ আল-তিলাওয়া)**: আয়াত কুরআনে আর পাওয়া যায় না, কিন্তু তার বিধান কার্যকর রয়েছে।
নাসখের উদাহরণ
[সম্পাদনা]নিম্নলিখিত কিছু আয়াতকে সাধারণত নাসখের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়:
- **মদ্যপানের বিধান** – প্রথমদিকে ইসলাম মদ্যপান সম্পূর্ণ হারাম করেনি, বরং নামাযের সময় মদ্যপান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল (সূরা আন-নিসা ৪:৪৩)। পরে এটি সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করা হয় (সূরা আল-মায়িদা ৫:৯০)।
- **কিবলার পরিবর্তন** – প্রথমদিকে মুসলিমরা নামাযে **বাইতুল মুকাদ্দাসের** দিকে মুখ করে নামায পড়তেন, পরে আল্লাহ তা'আলা কিবলা পরিবর্তন করে কাবাকে নির্ধারণ করেন (সূরা আল-বাকারাহ ২:১৪৪)।
ইসলামি পণ্ডিতদের মতভেদ
[সম্পাদনা]নাসখের বিষয়ে ইসলামি পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কিছু পণ্ডিত নাসখের ব্যাখ্যায় কঠোর অবস্থান নেন, আবার কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে এটি সীমিতসংখ্যক আয়াতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
- **ইমাম শাফি’ (রহ.)** – তিনি নাসখের ব্যাখ্যায় বলেন যে, আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন সময় মানুষের প্রয়োজন অনুসারে বিধান পরিবর্তন করেছেন।
- **ইবনে হাজম (রহ.)** – তিনি নাসখের ধারণাকে সীমিত করে দেখেছেন এবং বলেছেন যে কুরআনের অনেক আয়াতকে ভুলভাবে নাসখ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি
[সম্পাদনা]আধুনিক ইসলামি গবেষকদের মধ্যে কেউ কেউ নাসখের ধারণাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা বলেন, নাসখ হলো বিধানসমূহের **ধাপে ধাপে পরিবর্তন** যা সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Burton, "Those Are the High-Flying Cranes", JSS, 15, 1970, পৃ. 250।
- ↑ Hazimi, Abu Bakr. Al-I'tbar, 5-6।
- ↑ Burton, Islamic Theories of Abrogation, 1990, পৃ. 56।
- ↑ Burton, "The Exegesis of Q.2:106", BSOAS, 48, 1985, পৃ. 456।
- ↑ Dogan, Recep (২০১৩)। "Naskh (Abrogation)"। Usul al-Fiqh: Methodology of Islamic Jurisprudence। Tughra Books.। আইএসবিএন 9781597848763। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুলাই ২০১৮।
- ↑ Jane McAuliffe; Barry Walfish; Joseph Goering (২০১০)। With Reverence for the Word: Medieval Scriptural Exegesis in Judaism, Christianity, and Islam। New York Oxford: Oxford University Press। পৃষ্ঠা 448–450। আইএসবিএন 978-0-19-975575-2।
- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;dspp246
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ Fatoohi, Louay (২০১৩)। Abrogation in the Qur'an and Islamic Law। Routledge.। পৃষ্ঠা 3। আইএসবিএন 9781136217272। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুলাই ২০১৮।
- ↑ Burton, Islamic Theories of Abrogation, 1990, পৃ. 184।
- ↑ Burton, Islamic Theories of Abrogation, 1990, পৃ. 37।
- ↑ Mohammed, Khaleel (ডিসেম্বর ২০, ১৯৯৯)। "Muhammad Al-Ghazali's View on Abrogation in the Qur'an"। forpeoplewhothink.org। সংগ্রহের তারিখ ২৬ আগস্ট ২০১৮।
- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;hmot
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;wbha
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ Burton, Islamic Theories of Abrogation, 1990, পৃ. 43-44, 56-59, 122-124।
- ↑ Johanna Pink Sunnitischer Tafsīr in der modernen islamischen Welt: Akademische Traditionen, Popularisierung und nationalstaatliche Interessen BRILL, 11.11.2010, আইএসবিএন ৯৭৮৯০০৪১৮৫৯২০, পৃ. 114-115।
- ↑ Roslan Abdul-Rahim 'NASKH Al-QUR'AN A Theological and Juridical Reconsideration of the Theory of Abrogation and Its Impact on Qur'anic Exegesis' (PhD thesis, Temple University 2011)।