নারায়ণগঞ্জের সাত খুন
নারায়ণগঞ্জের সাত খুন হলো ২০১৪ সালের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত একটি আলোচিত হত্যাকাণ্ড, যাতে সাতজন ব্যক্তিকে প্রথমে জোরপূর্বক গুম এবং শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হয়। এই সাতজনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের একজন প্যানেল- মেয়র এবং একজন আইনজীবী রয়েছেন। [১][২] এই অপহরণ এবং হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর সদস্যরা এবং র্যাব-১১ এর তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তা।[৩]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সাথে মেয়র ড. সেলিনা হায়াৎ আইভীর ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি তার তিন সহযোগী এবং চালকসহ ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। তার আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার যিনি নজরুল ইসলামের গাড়ি অনুসরণ করছিলেন, তিনিও একই দিন তার ড্রাইভারসহ একই জায়গা থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে, শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের মৃতদেহ ভাসতে দেখা গিয়েছিল। [৪] খুনের ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ছয় জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। ছয়জনের মধ্যে রয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং কাউন্সিলর [৫] নূর হোসেন। একইসময়ে চন্দনের জামাই বিজয় কুমার পাল, নাজমুল হক নামক একজন ইন্জিনিয়ারিং ফার্মের অংশীদার এবং কিছু অজ্ঞাত মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। নজরুলের শ্বশুর শহিদুল ইসলামের অভিযোগ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে নজরুলকে অপহরণ এবং হত্যা করেছে। [৬]
তদন্ত
[সম্পাদনা]হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকার, পুলিশ এবং র্যাব কর্তৃক একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সিআইডিকে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে মামলাটি তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে সরকার পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিল। ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট অ্যাটর্নি জেনারেলের একটি আবেদনের শুনানি করে সিআইডিকে এই মামলার তদন্ত থেকে অব্যাহতি দেয়। [৭] এক বছরেরও বেশি পরে, ২০১৫ সালের ৪ জুনে হাইকোর্ট , সরকারের সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি, পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং সিআইডিকে তাদের তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। [২] র্যাব প্রশাসন, এই ঘটনায় জড়িত র্যাব ১১ ইউনিটের তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ কিছু র্যাব সদস্যকে শনাক্ত করেছিল। [৮] অভিযুক্ত র্যাব কর্মীরা ছিলেন: হামিদুল হক, হীরা মিয়া, বেলাল হোসেন, আবু তৈয়ব এবং আরিফ হোসেন, যাদের সবাই র্যাব ১১ এর সদস্য ছিলেন।
র্যাব ১১ ইউনিটের তিন শীর্ষ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা এবং মেজর আরিফ হোসেন মামলায় তাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল। [৯][১০] ওই সময়ে খাদ্য ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাই তারেক সাঈদসহ র্যাবের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে দেশের সামরিক বাহিনী জোর করে অবসরে পাঠিয়েছিল। [৮] শহিদুলের মতে, কিছু শ্রমিক নারায়ণগঞ্জের শিবু মার্কেটের কাছে কয়েকজন র্যাব সদস্য, নূর হোসেন, নাজমুল হক এবং আরও কয়েকজন মিলে নজরুলকে অপহরণ করতে দেখেছে বলে দাবি করেছে। হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে পালিয়ে যাওয়া এই মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ১লা জুন ২০১৫ তারিখে কলকাতায় গ্রেফতার করা হয়। অন্য একজন আসামি (নাজমুল হক) ২০১৫ সালের নভেম্বরের পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর ভারত সরকার নূর হোসেনকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে। [২]
বিচার এবং রায়
[সম্পাদনা]এক বছর তদন্তের পর, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল, ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। [১১] ৮ ফেব্রুয়ারি, বেশ কয়েকটি শুনানির পর, নারায়ণগঞ্জ আদালত চারটি খুনের ঘটনায় চার্জশিটে ৩৫ টি নাম অভিযুক্ত করে। [১২] নারায়ণগঞ্জে হত্যাকাণ্ড মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়।[১৩] ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের একটি আদালত সাত খুনের মামলায় সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, তারেক সাইদ, আরিফ হোসেন এবং মাসুদ রানা, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা সহ মোট ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ে নূর হোসেনের নয়জন সহযোগী এবং সাবেক র্যাব সদস্যদেরও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। [১৪] বিচারক রায়ে বলেন, অপহরণ, হত্যা, লাশ গোপন করা, ষড়যন্ত্র এবং প্রমাণ নষ্ট করার অভিযোগ কোন সন্দেহ ছাড়াই প্রমাণিত হয়েছে। [১৫]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Murdered brutally, dumped into river"। দ্য ডেইলি স্টার। ১ মে ২০১৪। ৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ ক খ গ "Five cops testify in seven-murder case"। ঢাকা ট্রিবিউন। ১৬ আগস্ট ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "Narayanganj seven-murder verdict due Jan 16"। ঢাকা ট্রিবিউন (ইংরেজি ভাষায়)। ৩০ নভেম্বর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১৬।
- ↑ "Shitalakkhya: River of the floating dead"। দ্য ডেইলি স্টার। ৩ মে ২০১৪। ৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "Nur Hossain: From trucker's helper to mafia don"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ১৭ জানুয়ারি ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২৯ জানুয়ারি ২০১৭।
- ↑ "A Chandpur MP's son brokered it"। দ্য ডেইলি স্টার। ৬ মে ২০১৪। ৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "Only DB to investigate 7-murder"। দ্য ডেইলি স্টার। ৪ নভেম্বর ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ ক খ "Rab finds 21 of its men involved"। দ্য ডেইলি স্টার। ১০ ডিসেম্বর ২০১৪। ৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "Confession, finally"। দ্য ডেইলি স্টার। ১৯ জুন ২০১৪। ৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "Maj Arif makes confession"। দ্য ডেইলি স্টার। ৫ জুন ২০১৪। ৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "RAB's Tareq among 35 charged with Narayanganj seven murders"। ঢাকা ট্রিবিউন। ৯ এপ্রিল ২০১৫। ৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "35 indicted in Narayanganj 7-murder cases"। দ্য ডেইলি স্টার। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "Formal trial begins"। The Independent। Dhaka। ১ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "Ex-AL men, Ex-RAB officials among 26 handed death penalty"। দৈনিক প্রথম আলো। ১৯ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জানুয়ারি ২০১৭।
- ↑ "Former RAB man blames ex-commander for consequences after conviction for seven murders"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জানুয়ারি ২০১৭।