নান্বান বাণিজ্য
জাপানের ইতিহাস |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
নান্বান বাণিজ্য (南蛮貿易? নান্বান বোওএকি, "দক্ষিণী বর্বরদের বাণিজ্য") বা নান্বান বাণিজ্যের যুগ (南蛮貿易時代 নান্বান বোওএকি জিদাই, "দক্ষিণী বর্বরদের বাণিজ্যের যুগ) বলতে জাপানের ইতিহাসে জাপানে প্রথম ইউরোপীয় অর্থাৎ পোর্তুগীজ আবিষ্কারক, মিশনারী ও ব্যবসায়ীদের আগমনের সময় অর্থাৎ ১৫৪৩ খ্রিঃ[১] থেকে ১৬১৪ খ্রিঃ জাপান দ্বীপপুঞ্জে তাদের আগমন প্রায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া অবধি সময়কে বোঝায়। এই নিষেধাজ্ঞাটি বলবৎ করা হয়েছিল 'সাকোকু' নামক বিচ্ছিন্নতার নীতি অনুযায়ী।[২]
নান্বান (南蛮, "দক্ষিণী বর্বর") একটি চীনা-জাপানি শব্দ। উৎসগতভাবে এর দ্বারা চীনের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজনকে বোঝাত। জাপানিতে ১৫৪৩ খ্রিঃ পোর্তুগীজ ও ক্রমে অন্যান্য ইউরোপীয়দের বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হতে হতে কথাটির মানে পালটে যায়।
সাংস্কৃতিক মোলাকাত
[সম্পাদনা]জাপানিদের চোখে ইউরোপীয়রা
[সম্পাদনা]১৫৪২ খ্রিঃ তানেগাশিমায় পোর্তুগীজদের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হওয়ার পর জাপানিরা সতর্ক হয়ে নবাগত বিদেশীদের উপর নজর রাখতে থাকে। জাপানি জনমানসে এই মোলাকাতের সাংস্কৃতিক চমক ছিল শক্তিশালী। এর কারণ ছিল বিশেষত ইউরোপীয়দের চিত্রাক্ষর সম্পর্কে অজ্ঞতা ও খাওয়ার সময় চপস্টিক ব্যবহারের অনভ্যাস।
ওরা আমাদের মত চপস্টিক দিয়ে না খেয়ে আঙুল দিয়ে খায়। কোনও আত্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়াই নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করে। লেখা অক্ষরের মানে বুঝতে পারে না। (বক্সারের খ্রিশ্চান সেঞ্চুরি বই থেকে)
জাপানিরা অনেক নতুন প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক প্রথার সংস্পর্শে আসে (ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রেও এ'কথা প্রযোজ্য)। সামরিক কৌশল (আরকেবুসে, ইউরোপীয় কুয়ের্যাস, ইউরোপীয় জাহাজ), খ্রিস্টধর্ম, পাশ্চাত্য শিল্পকলা, ভাষা এবং খাদ্য: পোর্তুগীজরা জাপানে তেম্পুরা নিয়ে আসে, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, তারাই সে'দেশে নিয়ে আসে পরিশ্রুত চিনি, যার ফলে নান্বাংগাশি (南蛮菓子 "দক্ষিণী বর্বরদের মিষ্টি") গোত্রের বহু খাবারের আবিষ্কার হয়, যেমন কাস্তেলা, কোম্পেইতোও, আরুহেইতোও, কারুমেরা (কার্মেল), কেইরান সোওমেন, বোওরো এবং বিসুকাউতো (বিস্কুট)।
জাপানি শাসকরা অনেক বিদেশীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন, এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের প্রতিভার যোগ্য সমাদর করেন। উদাহরণ হিসেবে উইলিয়াম অ্যাডাম্সের কথা বলা যায়, যিনি সামুরাই হয়েছিলেন এবং এদো নগরের দক্ষিণে মিউরা উপদ্বীপে একটি জমিদারিও পেয়েছিলেন।
ইউরোপীয়দের চোখে জাপানিরা
[সম্পাদনা]রেনেসাঁস ইউরোপে জাপানের মূল্যবান ধাতুর অগাধ ভাণ্ডারের প্রতি মোহ ছিল। এর একটি কারণ যদি হয়ে থাকে মার্কো পোলোর বর্ণনায় সোনা বাঁধানো মন্দির ও প্রাসাদের বিবরণ, তাহলে অপরটি ছিল প্রাক্-শিল্পবিপ্লব সভ্যতায় গভীর খনি খননের প্রযুক্তির অভাবে জাপানের মত আগ্নেয় শিলা অধ্যুষিত দেশে অগভীর মাটিতেই ধাতু আকরিকের অপেক্ষাকৃত আধিক্য। এই সময় থেকে জাপান অন্যতম প্রধান রূপো ও তামা রফতানিকারক দেশ হয়ে ওঠে।
এছাড়া জাপান সমসাময়িক যে কোনও ইউরোপীয় দেশের তুলনায় অধিক জনবহুল ও নগরায়িত দেশ হিসেবেও ইউরোপীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ষোড়শ শতাব্দীতে জাপান, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২.৬ কোটি, ১.৬ কোটি ও ৪৫ লক্ষ।[৩] জাপানের বৌদ্ধ বিদ্যালয়গুলি ইউরোপের সালামাঙ্কা বা কোইম্ব্রার বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বড় ছিল। কোনও কোনও ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক জাপানের মহিমায় অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যান। আলেসান্দ্রো ভালিন্নানো লেখেন, জাপানিরা "কেবল অন্যান্য প্রাচ্যজাতিকেই ছাপিয়ে যায় না, তারা ইউরোপকেও ছাপিয়ে যায়।"[৪]
জাপানি কারুশিল্প ও ধাতুবিদ্যার উৎকর্ষ প্রথম আগত ইউরোপীয়দের চোখে পড়েছিল। এর কারণ জাপান লোহা ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে ইউরোপের তুলনায় অনেক কম সমৃদ্ধ। ফলে যেটুকু সম্পদ তাদের কাছে উপলভ্য হত, তার ব্যবহারে তাদের মিতব্যয়িতা ছিল বিখ্যাত।
জাপানের সমরশক্তিও ইউরোপীয়দের নজর এড়ায়নি। নোয়েল পেরিনের "গিভিং আপ দ্য গান" বই অনুযায়ী "১৬০৯ এর এক স্পেনীয় রাজকীয় আদেশে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্পেনীয় কমান্ডারদের 'জাপানি সেনার বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্রের উপযোগিতা যাচাইয়ের ঝুঁকি' না নিতে বলা হয়।" পরবর্তীকালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালুকু দ্বীপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় হল্যান্ড, সামুরাই বাহিনীর সাহায্য নিয়েছিল।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Arnold Pacey, "Technology in world civilization: a thousand-year history", আইএসবিএন ০-২৬২-৬৬০৭২-৫
- ↑ Straelen, H. van (1952) Yoshida Shoin, Forerunner of the Meiji Restoration. Leiden: E.J. Brill. pp. 7-8
- ↑ Noel Perrin, "Giving up the gun"
- ↑ Valignano, 1584, Historia del Principio y Progreso de la Compañía de Jesús en las Indias Orientales.