নরহত্যা
অপরজনের মৃত্যুর জন্য দায়ী মানুষের কৃত কর্মকে নরহত্যা বলে। কেবল অপরজনকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবৃত্তির দ্বারা নরহত্যা সম্পন্ন করা যায়। সুতরাং আঘাত করার কোনো ইচ্ছা না থাকলেও আকস্মিক, বেপরোয়া বা অমনোযোগী কর্মের জন্যও নরহত্যা সম্পন্ন হতে পারে।[১] অন্যদিকে, আত্মহত্যা সাধারণত ঐচ্ছিক হয়, যেখানে কোনো মানুষ নিজেই নিজেকে হত্যা করে।
আইনশাস্ত্রে মৃত্যুর পরিস্থিতি অনুসারে নরহত্যা বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়, যেমন খুন (ইচ্ছাকৃত নরহত্যা), অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা, ন্যায্য নরহত্যা, গুপ্তহত্যা, রণহত্যা (যুদ্ধের আইন মেনে বা যুদ্ধ অপরাধ হিসাবে), ইচ্ছামৃত্যু ও মৃত্যুদণ্ড। সমাজে এই বিভিন্ন ধরনের নরহত্যাকে বিভিন্নভাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে কিছু হত্যা অপরাধ আবার কিছু হত্যা বৈধ বা বিচারের রায়ের অনুসারী।
অপরাধমূলকতা
[সম্পাদনা]নরহত্যাকারীর মানসিক অবস্থা ও উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে অপরাধমূলক নরহত্যাকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়: খুন (ইচ্ছাকৃত নরহত্যা) ও অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা।[২]
২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত জাতিসংঘ মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে প্রায় ৪ লক্ষ ৬৪ হাজার ব্যক্তি নরহত্যায় মৃত, যা ঐ একই সময়কালে সশস্ত্র দ্বন্দ্বে ৮৯ হাজার মৃত্যুর তুলনায় বেশি।[৩]
খুন
[সম্পাদনা]খুন বা ইচ্ছাকৃত নরহত্যা অভিযোগ করার মতো সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ। অনেক এখতিয়ারে খুন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের শিকার হতে হয়।[৪] যদিও এখতিয়ার-ভেদে খুনের শ্রেণিবিভাগ বিভিন্ন, তবুও খুনের অভিযোগকে দুটি ভিন্ন শ্রেণি বা পর্যায়ের অন্তর্জত করা হয়:
- প্রথম পর্যায়: কোনো ব্যক্তির পূর্বপরিকল্পিত, বেআইনি ও স্বেচ্ছাপ্রসূত হত্যা।
- দ্বিতীয় পর্যায়: কোনো ব্যক্তির বেআইনি ও স্বেচ্ছাপ্রসূত হত্যা, যা পূর্বপরিকল্পিত নয়।
কিছু এখতিয়ারে কোনো ভয়ংকর অপরাধ করার সময় ঘটা নরহত্যাও খুন বলে বিবেচিত হয়, যদিও অপরাধীর প্রকৃত উদ্দেশ্য ভিন্ন।[৫]
অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা
[সম্পাদনা]অনিচ্ছাকৃত নরহত্যার ক্ষেত্রে হত্যাকারী হয় শিকারকে হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল না, কিংবা যে পরিস্থিতিতে কোনো যুক্তিপরায়ণ ব্যক্তি আবেগপ্রবণভাবে বা মানসিকভাবে বিশৃঙ্খল হয়ে নিজের কর্মের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় সেই পরিস্থিতির জেরে শিকারকে হত্যা করেছে।[৬] খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে গ্রিসের এথেন্সের আইনপ্রণেতা ড্রেকো প্রথম ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত নরহত্যার মধ্যে পার্থক্য করেন বলে মনে করা হয়। খুনের শাস্তির তুলনায় অনিচ্ছাকৃত নরহত্যার শাস্তি সাধারণত কম হয়। অনিচ্ছাকৃত নরহত্যাকে দুই ভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:[৬]
- স্বেচ্ছাপ্রসূত নরহত্যা: বিশৃঙ্খল মানসিক অবস্থায় কোনো ব্যক্তির স্বেচ্ছাপ্রসূত অথচ অপূর্বপরিকল্পিত হত্যা।
- অস্বেচ্ছাপ্রসূত নরহত্যা: অন্যের জীবন ও নিরাপত্তার প্রতি উদাসীনতা প্রকাশ করে এবম বেপরোয়া কর্মের দ্বারা, কিংবা মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এমন অসতর্কতার দ্বারা কোনো ব্যক্তির অস্বেচ্ছাপ্রসূত ও হত্যা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে যে কর্মের ফলে মৃত্যু হয়েছে সেটা স্বেচ্ছাপ্রসূত হতে পারে (যেমন রাগে কাউকে ধাক্কা দেওয়া), কিন্তু মৃত্যুটা স্বেচ্ছাপ্রসূত নয় (যেমন ধাক্কার ফলে নিচে পড়ে গিয়ে মাথায় মারণ আঘাত পাওয়া)।
কিছু এখতিয়ারে "গঠনমূলক নরহত্যা" স্বীকৃত। এক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা আইন বা বিধি লঙ্ঘন করে কোনো ব্যক্তির অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু হলে বিধি লঙ্ঘনকারী গঠনমূলক নরহত্যায় অভিযুক্ত হয়।[৭][৮]
ন্যায্য অজুহাত
[সম্পাদনা]সমস্ত নরহত্যা অপরাধ বা ফৌজদারি অভিশংসনের বিষয় নয়।[৯] কিছু ধরনের নরহত্যাকে আইনের বলে বিশেষাধিকার দেওয়া হয়, অর্থাৎ সেগুলো অপরাধ বলেই বিবেচিত নয়। অন্যান্য ধরনের নরহত্যা এমন পরিস্থিতিতে হতে পারে যা বিবাদীকে ফৌজদারি অভিশংসন থেকে সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রতিরক্ষা প্রদান করে। এধরনের ন্যায্য অজুহাতের মধ্যে রয়েছে:
- আত্মরক্ষা: যদিও বেশিরভাগ বেসামরিক নরহত্যা ফৌজদারি অভিশংসনের বিষয় হতে পারে, তবুও আত্মরক্ষার অধিকার বহুল স্বীকৃত, যার জন্য এমনকী মারণ বল প্রয়োগ হতে পারে।
- মানসিক অক্ষমতা: বিবাদী এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারে যে মানসিক ব্যাধির জন্য সে নরহত্যায় ফৌজদারিভাবে দায়বদ্ধ নয়। কিছু এখতিয়ারে এওজে ফৌজদারি মামলায় মানসিকভাবে অক্ষম হত্যাকারী অস্বেচ্ছাপ্রসূতভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। দণ্ড দেওয়ার সময় অনেকসময় মানসিক স্বাস্থ্য ও বিকাশকে ধরা হয়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৌদ্ধিক অক্ষমতা থাকলে অভিযুক্ত খুনিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না।
- নাবালকত্ব: ফৌজদারি দায়িত্বের বয়সের নিচে শিশুরা ফৌজদারিভাবে দায়বদ্ধ নয়। কিশোর আদালতে ফৌজদারি দায়িত্বের বয়সের উপরে কিন্তু সাবালকত্বের বয়সের নিচে বিবাদীদের বিচার করা হয়, তবে নরহত্যা একপ্রকার গুরুতর অপরাধ হওয়ায় কিছু কিশোর নাবালকদের সাবালক বিচার ব্যবস্থায় অভিযোগ করা হয়। ফৌজদারি দায়িত্ব থাকার মতো বয়স থাকলেও দণ্ড দেওয়ার সময় কম বয়সকেও কখনো কখনো ধরা হয়।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Melenik, Judy (৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। "7 Common Mistakes Regarding Autopsy Reports"। Advantage Business Media। Forensic News Daily। ১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ নভেম্বর ২০১৭।
- ↑ "Chapter 9: Criminal Homicide"। Criminal Law: Criminal Homicide। University of Minnesota। ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫। ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- ↑ "Homicide kills far more people than armed conflict, says new UNODC study"। unodc.org। ৩ মে ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-০৯।
- ↑ "Federal Laws Providing for the Death Penalty"। Death Penalty Information Center। ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- ↑ Fletcher, George P. (১৯৮০)। "Reflections on Felony Murder"। Southwestern University Law Review। 12: 413। ৮ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- ↑ ক খ "9.6 Manslaughter"। Criminal Law: Manslaughter। University of Minnesota। ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- ↑ Slapper, Gary (১ ডিসেম্বর ১৯৯৩)। "Corporate Manslaughter: an Examination of the Determinants of Prosecutorial Polic" (পিডিএফ)। Social & Legal Studies। 2 (4): 423–443। এসটুসিআইডি 1337567। ডিওআই:10.1177/096466399300200404। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুন ২০১৯।
- ↑ e.d. fatal accidents with alpinists Condamnation de deux alpinistes pour « homicide involontaire » ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে L’avocat du syndicat des guides dérape sur l’arête du Goûter ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে
- ↑ Stevens, T.L. (ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭)। "Manslaughter and Negligent Homicide"। Judge Advocate General Journal। 1957। ৮ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
আরও পড়ুন
[সম্পাদনা]- Lappi-Seppälä, Tapio, and Martti Lehti. "Cross-comparative perspectives on global homicide trends". Crime and Justice 43.1 (2014): 135–230.
- Pinker, Steven. The Better Angels of Our Nature: Why Violence Has Declined (2011).