দীর্ঘেশ্বরী দেবালয়

দীর্ঘেশ্বরী দেবালয় বা দীর্ঘেশ্বরী মন্দির আসামের উত্তর গুয়াহাটি-এর ব্রহ্মপুত্র নদ-এর পারে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক শক্তি উপাসনাস্থল। আহোম স্বর্গদেউ শিবসিংহ নির্মাণ করা এই দেবালয়ক শক্তিপীঠ হিসাবে গণ্য করা হয়। এখানে অনেক পাথরের ভাস্কর্য উদ্ধার হয়েছে। দীর্ঘেশ্বরী মন্দির বার্ষিক দুর্গা পূজা-এর জন্য বিখ্যাত।
প্রবাদ
[সম্পাদনা]দক্ষের কন্যা সতীর বাবার অমতে মহাদেবের সাথে বিবাহ হয়েছিল। একবার দক্ষ একটি যজ্ঞের আয়োজন করেন। কিন্তু তাতে জামাইকে নিমন্ত্রণ করেননি। তথাপি সতী বিনা নিমন্ত্রণে বাবার যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হন। কন্যাকে দেখে দক্ষের রাগ বেড়ে ওঠে এবং মহাদেবকে ভর্ৎসনা করতে থাকেন। স্বামীর বদনাম সইতে না পেরে সতী যজ্ঞস্থলে প্রাণত্যাগ করেন। প্রিয়ার বিয়োগে শিব শোকে মুহ্যমান হন এবং সতীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে নিয়ে উন্মত্তপ্রায় বিশ্বভ্রমণ করতে থাকেন। তখন ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেন। যেখানেই এমন অংশ পড়ল, তাতেই একটি তীর্থস্থান গড়ে উঠল। নীলাচল পাহাড়ে সতীর যোনিভাগ পড়ল এবং সেখানে কামাখ্যা মন্দির প্রতিষ্ঠা হল। সেই একইসময়ে সীতাচল পাহাড়ে সতীদেবীর শরীরের অংশ পড়েছিল বলে প্রবাদ আছে। এবং তখন থেকে এই স্থল পবিত্র বলে গণ্য করে আসা হচ্ছে।
অন্য এক প্রবাদ মতে, ঋষি মার্কণ্ডেয় এই স্থানে দেবী দুর্গাকে প্রসন্ন করতে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। অবশেষে দুর্গাদেবীর আবির্ভাব হয় এবং তিনি ঋষি মার্কণ্ডেয়কে বর দেন। তখন থেকে দীর্ঘেশ্বরী মন্দির দেবী দুর্গার পবিত্র মন্দির হিসাবে পরিগণিত হয়।

ইতিহাস
[সম্পাদনা]প্রাচীন বা মধ্যযুগে দীর্ঘেশ্বরীতে কোনো দুর্গা মন্দির ছিল কিনা তা জানা যায় না। বর্তমানের মন্দিরটি আহোম স্বর্গদেউ শিবসিংহ নির্মাণ করেছিলেন। স্বর্গদেউর আদেশে নিম্ন আসাম এবং গুয়াহাটির তরুণ দুবরা বরফুকনের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘেশ্বরী দেবালয়ের নির্মাণ কর্ম চলেছিল।[১] দেবালয়টি সীতাচল পাহাড়ের শিখর ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। দেবালয়ের গর্ভগৃহ মাটির নিচের এক ছোট গুহাতে অবস্থিত এবং এখানে একটি দুর্গার প্রতিমূর্তি আছে। মন্দিরের দৈনন্দিন কার্য-কলাপের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছিল এবং মন্দির ও পুরোহিতের নামে মাটি দান করা হয়েছিল।

মন্দিরের প্রবেশদ্বারে আহোম স্বর্গদেউ শিবসিংহের নামে এক শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। এই শিলালিপিতে স্বর্গদেউর সাথে তরুণ দুবরা বরফুকনের নাম উল্লেখ আছে সাথে স্বর্গদেউর আদেশে এই মন্দির নির্মাণ করা এবং দীর্ঘেশ্বরী দেবালয়ের নামে ভূমিদানের কথারও উল্লেখ আছে। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে আহোম স্বর্গদেউ রাজেশ্বর সিংহ তাঁর রাজকীয় ভ্রমণে দীর্ঘেশ্বরী দেবালয় দর্শন করেছিলেন। এর সাথে তিনি মন্দিরটিতে আরো জমি এবং উপযুক্ত রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য মানুষ নিযুক্ত করেছিলেন। স্বর্গদেউ মন্দিরে একটি রূপোর ঝাঁপি দান করেন এবং এই ঝাঁপিটি এখনও দেবী দুর্গার মূল বিগ্রহে ব্যবহার করা হয়।[২]
বর্তমান স্থিতি
[সম্পাদনা]প্রতি বছর দীর্ঘেশ্বরী দেবালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া বার্ষিক দুর্গা পূজায় অগণিত ভক্তের সমাগম হয়। দুর্গা পূজায় এখানে মোষ বলি দেওয়া হয়। বর্তমানে এর পরিসর বৃদ্ধি করা হয়েছে। মন্দিরের পরিসরে একটি পুষ্করিণী আছে। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে গণেশ-এর বৃহৎ ভাস্কর্য আছে। এখানে দুটি পায়ের ছাপের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে এবং স্থানীয় লোকেরা এই পায়ের ছাপ দেবী দুর্গার বলে গণ্য করেন। এখানে পাথরের এক আকৃতি পাওয়া গিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা একে অপ্সরাদের নৌকা বলে বিশ্বাস করেন। দীর্ঘেশ্বরী দেবালয় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থল হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
চিত্র ভাণ্ডার
[সম্পাদনা]-
দীর্ঘেশ্বরী দেবালয়ে থাকা এই পায়ের ছাপকে দেবী দুর্গার পায়ের ছাপ বলে বিশ্বাস করা হয়
-
গণেশের ভাস্কর্য
-
দীর্ঘেশ্বরী পাহাড়ে পাথরে কাটা গণেশর মূর্তি
-
অপ্সরার নাও, স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করে যে স্বর্গের অপ্সরারা এই নৌকাতে উঠে পুষ্করিণীতে নৌকাবিহার করে