তোফাজ্জল হোসেন হত্যাকাণ্ড
তোফাজ্জল হোসেন হত্যা | |
---|---|
মব জাস্টিস ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহিংসতা অংশ | |
![]() তোফাজ্জল হোসেন | |
স্থান | ফজলুল হক মুসলিম হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
স্থানাংক | ২৩°৪৩′৩৩″ উত্তর ৯০°২৪′১২″ পূর্ব / ২৩.৭২৫৯° উত্তর ৯০.৪০৩৪° পূর্ব |
তারিখ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ |
হামলার ধরন | গণপিটুনি, হত্যা, মব জাস্টিস |
ভুক্তভোগী | তোফাজ্জল হোসেন |
হামলাকারী দল | ফজলুল হক মুসলিম হল শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ |
সন্দেহভাজন হামলাকারী দল | ৬ জন[১] |
মামলা | চলমান (সিআরপিসির ১৬৪ সেকশনের অধীনে জমা দেওয়া স্বীকারোক্তি , ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্তাধীন মামলা)[২] |
কারণ | মোবাইল চুরির সন্দেহ |
তোফাজ্জল হোসেন হত্যাকাণ্ড বলতে এক মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরদের দ্বারা খুনের ঘটনাকে বোঝানো হয়েছে।[৩] ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে ফজলুল হক মুসলিম হলে ঘটনাটি ঘটে।[৪][৫][৬] তাকে মোবাইল চুরির অভিযোগে আটক করা হয় এবং পরে শিক্ষার্থীরা তাকে নির্মমভাবে মারধর করে, যার ফলে তার মৃত্যু হয়।[৭][৮] হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি আটককৃত ছয়জনই ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ছিলো।[৯]
প্রেক্ষাপট
[সম্পাদনা]তোফাজ্জল হোসেন বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নে জন্মলাভ করেন।[৭] তিনি সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন।[১০] তার পিতার নাম আব্দুর রহমান, তিনি ২০১৬ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।[১১] একই বছর তার মা বিউটি বেগম ক্যান্সারে মারা যান।[১১] তার বড় ভাই নাসির উদ্দিন, যিনি বাংলাদেশ পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর, ২০২৩ সালের ৭ এপ্রিল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।[১০] তার চাচাতো ভাইদের মতে এসব মৃত্যুর পর তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতেন এবং শিক্ষার্থীদের দেওয়া খাবার গ্রহণ করতেন।[১১]
ঘটনা
[সম্পাদনা]ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন ছয়টি মোবাইল চুরির ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তোফাজ্জল হোসেনকে আটক করে। হোসেনকে ফজলুল হক মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাকে শারীরিক নির্যাতন ও নির্যাতন করা হয়।[১১][১২] ছাত্রলীগের তিনজন নেতা এবং দুই সক্রিয় সদস্যসহ ছাত্ররা তাকে ক্রিকেট ব্যাট ও স্টাম্প ব্যবহার করে আহত করে।[১৩][১৪] এসময়ে তাকে ক্রিকেট ব্যাট ও স্টাম্প দিয়ে আঘাত করা হয়। কিছুক্ষণ পর তোফাজ্জলকে হলের ক্যান্টিন থেকে খাবার সরবরাহ করা হয়, কিন্তু তার খাওয়া শেষ করার পরপরই এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমে নিয়ে সহিংসতা চালানো হয়।[১১] শিক্ষার্থীরা হোসেনের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা দাবি করে।[১৫] একটি প্রক্টর দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও হোসেনের তাৎক্ষণিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি।[১৬] হোসেনের অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্রক্টরদের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যারা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে পৌঁছালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।[১৭]
প্রতিক্রিয়া
[সম্পাদনা]স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধায়ক উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তোফাজ্জল হোসেনের মৃত্যু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি মব জাস্টিসে মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন।[১৮] সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না অবশ্য পরবর্তী ব্যবস্থা না নিয়ে শুধুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করার জন্য উপদেষ্টার সমালোচনা করেছেন।[১৮] আরেক আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মব জাস্টিস নিয়ে মন্তব্য করেছেন,
“ | "এক বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরশাসক (শেখ হাসিনা) ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, একদল লোক এখন বিশ্বাস করে যে তারা তাদের ইচ্ছামত গণবিচার ও মব জাস্টিস দিতে পারে এবং কর্তৃপক্ষকে যা বলবে, তা তারা মেনে চলবে।" | ” |
— আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া |
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার নিন্দা করেছে। ছাত্র সংগঠন ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স এবং স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট রিপ্রেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উভয় স্থানে বিক্ষোভের আয়োজন করে।[১৯] বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন এছাড়াও বাম গণতান্ত্রিক জোট অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে।[১৯][২০]
গ্রেপ্তার ও বিচার
[সম্পাদনা]এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আমানউল্লাহ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।[২১] পুলিশ ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ছয় শিক্ষার্থীকে আটক করে।[১৩] হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং দুইজন সক্রিয় সদস্য।[২২] ২০ সেপ্টেম্বর আটককৃত ছয় শিক্ষার্থী ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।[১৪] এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে অপরাধের সাথে জড়িত সন্দেহে আরও দুই শিক্ষার্থীকে হস্তান্তর করে।[২৩]
আসামিদের তালিকা
[সম্পাদনা]ইত্তেফাক পত্রিকার বর্ণনা অনুসারে, তোফাজ্জলকে পেটানোতে প্রায় ১৫ জন ব্যক্তি অংশগ্রহণ করে।[২৪] এরা কোটা আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলো।[২৫] এরমধ্য থেকে প্রধান ৬ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়, এদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো।[২৬]
নাম | বিভাগ | সেশন | রাজনৈতিক দল |
---|---|---|---|
মো. জালাল মিয়া | পদার্থবিজ্ঞান | ২০১৮-১৯ | বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপসম্পাদক, ছাত্রলীগ |
আল হুসাইন সাজ্জাদ | ভূগোল | ২০২০-২১ | এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের দপ্তর সম্পাদক, ছাত্রলীগ |
আহসান উল্লাহ | গণিত | ২০১৮-১৯ | ফজলুল হক মুসলিম হলের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন উপসম্পাদক, ছাত্রলীগ |
সুমন মিয়া | মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ | ২০২১-২২ | সক্রিয় কর্মী, ছাত্রলীগ |
ওয়াজিবুল আলম | সমুদ্রবিজ্ঞান | ২০২১-২২ | সক্রিয় কর্মী, ছাত্রলীগ |
মো. মোত্তাকিন সাকিন শাহ | পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান | ২০২১-২২ |
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক ছয়জনের পাঁচজনই ছাত্রলীগের"। দৈনিক ইনকিলাব। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "Eight identified at DU, six give statements"। দৈনিক প্রথম আলো। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "চোর সন্দেহে যুবককে ধরে ভরপেট খাওয়ালেন ঢাকার ছাত্রেরা, তার পর গণপিটুনি, মৃত্যু! ক্ষোভ বাংলাদেশে"। আনন্দবাজার পত্রিকা। কলকাতা। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "Suspected thief killed in 'mass beating' at Dhaka University"। Bdnews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
We have learnt that he was mentally unstable.
- ↑ "Tofazzal: The man who lost everything"। Somoy TV। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "Who was Tofazzal, killed at Dhaka University?"। The Financial Express (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ "Youth suspected of theft beaten to death at DU"। The Business Standard (ইংরেজি ভাষায়)। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "Suspected thief killed in 'mass beating' at DU"। The South Asian Times (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যায় ছাত্রলীগ নেতাসহ গ্রেফতার ৬"। Jugantor। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-২৩।
- ↑ ক খ Hossain, Sohrab (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "Life lost to a mindless mob"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Mizan, Mashfiq; Rubel, Sirajul Islam (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "Savagery at DU: They beat him, fed him, then killed him"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ঢাবি প্রতিনিধি (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "ঢাবির হলে চোর সন্দেহে যুবককে পিটিয়ে হত্যা, মামলা করবে প্রশাসন"। বাংলা ট্রিবিউন। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ "Mob lynching at DU: 6 students, including ex-BCL leader, arrested"। The Business Standard (ইংরেজি ভাষায়)। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ "Six DU students accused of Tofazzal murder belong to Chhatra League"। The Daily Observer। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ বরগুনা প্রতিনিধি (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "ঢাবিতে পিটিয়ে হত্যা: ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল, দাবি স্বজনদের"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ আফ্রাদ, কুদ্দুস; মাঝি, সুমন (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "ভবঘুরেকে ভাত খাইয়ে পিটিয়ে হত্যা ছাত্রদের, খুন লিগ নেতাও"। এই সময় (সংবাদপত্র)। ঢাকা।
- ↑ নিজস্ব প্রতিবেদক (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "তিন দফায় পেটানো হয় তোফাজ্জলকে, অংশ নেন অন্তত ১৫ জন"। প্রথম আলো। ঢাকা। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ Hossain, Sajjad (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "Lynch mobs acting with impunity"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ "Protests erupt as two beaten to death at DU, JU"। New Age। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "Mob killing in DU hall: Students protest outside proctor's office"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "DU admin files murder case over mob lynching of youth on theft suspicion"। The Business Standard (ইংরেজি ভাষায়)। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "ঢাবিতে তোফাজ্জল হত্যায় আটক পাঁচজনই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী"। যায়যায়দিন। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "DU mob lynching: 'Several students' named in case, 2 handed over to police"। Bdnews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "তিন দফায় অন্তত ১৫ জন মিলে পেটান তোফাজ্জলকে"। ইত্তেফাক। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০২৪।
- ↑ কালবেলা (২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "আটক ছয়জনের পাঁচজনই ছাত্রলীগ ছেড়ে আন্দোলনে যোগ দেন"। কালবেলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-২৩।
- ↑ "ঢাবিতে তোফাজ্জল হত্যার দায় স্বীকার করা ৬ জনই ছাত্রলীগ কর্মী"। Jugantor। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-২৩।