তিরুমালা রাম বিগ্রহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বসন্তোৎসবের সময় তিরুমালা ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে স্ত্রী সীতা (বাম) এবং ভাই লক্ষ্মণ (ডান) সহ ভগবান রামের (মাঝখানে) মূর্তি

তিরুমালা রাম বিগ্রহ হল ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের তিরুমালা শহরের বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহগুলির অন্যতম। উক্ত মন্দিরটি হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অবতার বেঙ্কটেশ্বরের মন্দির হলেও, এই মন্দিরে বিষ্ণুর অপর দুই অবতার রামকৃষ্ণের বিগ্রহও প্রতিষ্ঠিত। তিরুমালা রাম বিগ্রহের সঙ্গে তার পত্নী সীতা, ভ্রাতা লক্ষ্মণ ও দাস হনুমানের বিগ্রহও দেখা যায়।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

বাশিষ্ঠ রামায়ণ অনুসারে, রাম বৈগৈ নদীর তীরে ঋষি বিশ্বম্বরের সামনে আবির্ভূত হন। ঋষি বিশ্বম্বর রামদের দর্শন পাওয়ার জন্য তপস্যা করছিলেন। তিনি দেখলেন, রাম ও লক্ষ্মণ ধনুক নিয়ে সুগ্রীব, অঙ্গদ ও হনুমানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন। এই দৃশ্যে তিনি দেখেছিলেন, রাম রাবণের ভ্রাতা বিভীষণকে রক্ষা করছেন। রাম তার বন্ধু বানররাজ সুগ্রীবকে বলছেন, তিনি বিভীষণকে রক্ষা করবেন এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাবেন। দৃশ্যে ঋষি দেখলেন, সুগ্রীব হাতজোড় করে রামকে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানাচ্ছেন। কারণ, বিভীষণ বারের ‘ভয়ংকর শত্রুর ভ্রাতা’। হনুমানকে ঋষি দেখলেন, ডান হাত মুখে চাপা দিয়ে রামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। বানর রাজকুপার অঙ্গদ দক্ষিণ দিকে আঙুল দেখিয়ে বিভীষণের আগমন সূচিত করছিলেন।[১]

এই দৃশ্য দেখার পর ঋষি বিশ্বম্বর তার দর্শিত রাম, লক্ষণ, সুগ্রীব, হনুমান ও অঙ্গদের যেমন মূর্তি তিনি দেখেছিলেন, তেমন পঞ্চলোহা বিগ্রহ নির্মাণ করাতে দিলেন এবং সেই বিগ্রহগুলি নদীতীরে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করলেন। দীর্ঘদিন সেখানে পূজিত হওয়ার পর রাম এক ভক্তকে স্বপ্নাদেশে জানালেন, বিগ্রহগুলি যেন তিরুবেঙ্গদমে (তিরুমালার তৎকালীন নাম) নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ, বৈগৈ শহরে অশান্তি দেখা দিয়েছে। বিগ্রহগুলি তিরুবেঙ্গদমের পাদদেশে নিয়ে এনে রামানুজতিরুমালাই নাম্বিকে দেখানো হয়। তারা সেই সময় রামায়ণ অধ্যয়ন করছিলেন। কাকতালীয়ভাবে ঠিক সেই সময় তারা বিভীষণের রামের আশ্রয় গ্রহণের অধ্যায়টি পড়ছিলেন।[২]

এই কাকতালীয় ঘটনা দেখে তারা আশ্চর্য হয়ে যান এবং সীতার একটি বিগ্রহ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। রাম ও সীতার দিব্য বিবাহ অনুষ্ঠানের পর বিগ্রহগুলি তিরুমালা মন্দিরের নবগঠিত ‘রামর মেডাই’তে (রামের বেদী) প্রতিষ্ঠা করা হয়।[৩]

রাম বিগ্রহ[সম্পাদনা]

তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের রাম বিগ্রহটির নাম ‘শ্রীরঘুনাথ’। এই বিগ্রহে রামকে ‘স্তনক’ (দণ্ডায়মান) ভঙ্গিতে দেখা যায়। তিনি মধ্যম তল ও ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন।[৪] বিগ্রহের বাঁ হাতটি ধনুক ধরার জন্য উত্তোলিত ভঙ্গিতে এবং ডান হাতটি নিচে তীর ধরে আছে। মুখটি ডান দিকে সামান্য বাঁকানো। মাথায় মুকুটটিও মুখের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বাঁকানো। পা-দুটি পদ্মের আকারবিশিষ্ট বেদীতে স্থাপিত। বাঁ পা-টি সামনের দিকে প্রসারিত।

বিগ্রহটির বাঁ হাতে ধনুক এবং ডান হাতে অর্ধচন্দ্র ও তীর দেখা যায়। ধনুকটির প্রান্তভাগ বাঁকানো ও উপরের দিকে পাঁচটি ঘণ্টা-যুক্ত।

সীতা বিগ্রহ[সম্পাদনা]

সীতার বিগ্রহটি সর্বদা রাম বিগ্রহের বাম পাশে দেখা যায়। এই বিগ্রহটিও পদ্মের আকারবিশিষ্ট বেদীর উপর স্থাপিত। বিগ্রহের ডান হাতটি পাশে লম্বিত এবং বাঁ হাতে একটি পদ্ম ধরা আছে। সীতা বিগ্রহে কোনো মুকুট নেই।

লক্ষ্মণ বিগ্রহ[সম্পাদনা]

লক্ষ্মণের বিগ্রহটি সর্বদা রাম বিগ্রহের ডান পাশে দেখা যায়। এই বিগ্রহটি আকারে ছোটো, কিন্তু দেখতে অবিকল রাম বিগ্রহের মতো। বিগ্রহের ভঙ্গিমা (মধ্যম তাল ও ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা) রাম বিগ্রহের অনুরূপ হলেও, দুই বিগ্রহের মধ্যে কয়েকটি পার্থক্য আছে। লক্ষ্মণ বিগ্রহের মাথা সোজা, বাঁকানো নয়। পা দুটি পরস্পরের নিকটবর্তী এবং সম্পূর্ণই বেদীর উপর স্থাপিত। এই বিগ্রহের মস্তক সামনের দিকে সামান্য ঝোঁকানো। যা রামের প্রতি লক্ষ্মণের শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষণ।

হনুমান বিগ্রহ[সম্পাদনা]

হনুমানের বিগ্রহটি সাধারণত রাম বিগ্রহের ডান দিকে পাশ ফিরিয়ে রাখা থাকে। বিগ্রহটি একটি বেদীর উপর দণ্ডায়মান। এটির চোখ বড়ো বড়ো। যা রামের প্রতি হনুমানের সদা-সেবাপরায়ণতার থাকার প্রতীক। সেই সঙ্গে বিগ্রহের ডান হাতটির কনুই ভঙ্গিল অবস্থায় রেখে তালু মুখে চাপা দেওয়া থাকে। এটি রামের প্রতি হনুমানের শ্রদ্ধানিবেদনের প্রতীক। বিগ্রহের বাঁ হাতটি ‘কাত্যাবলম্বিত’ ভঙ্গিতে (বাঁ তালু মুঠো অবস্থায় এমনভাবে কোমরে ঠেকানো যেন দর্শক তালুটি দেখতে পান) আছে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

রাম বিগ্রহ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার সঠিক তারিখ জানা না গেলেও শিলালিপিতে বিগ্রহের প্রাচীনতম যে উল্লেখ পাওয়া যায় সেটি ১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দের।[৪] যদিও সাধারণভাবে মনে করা হয় ১২৪৫ সালে নির্মিত ‘রামর মেডাই’তে (রাম কক্ষ) বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগ্রহের নামানুসারেই এই কক্ষের নামকরণ করা হয়েছিল।

অপর একটি মত অনুসারে, বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেন রামানুজ[৪]

সেবা[সম্পাদনা]

তিরুমালা রাম বিগ্রহটি মন্দিরের দৈনিক পূজায় কেন্দ্রীয় গুরুত্ব পায় না। এমনকি এই বিগ্রহে নৈবেদ্য নিবেদনের আগে তা প্রধান বিগ্রহে নিবেদন করা হয়। মন্দিরের কৃষ্ণ বিগ্রহের ক্ষেত্রেও একই প্রথা অনুসরণ করা হয়। বাৎসরিক কোইল অলবর তিরুমাঞ্জনম (মন্দির পরিষ্কার করার অনুষ্ঠান) অনুষ্ঠানের সময় এই বিগ্রহগুলিকে গর্ভগৃহের বাইরে আনা হয়। পরে পরিষ্কারের কাজ শেষ হলে এগুলিকে যথাস্থানে ফিরিয়ে এনে পবিত্র মশলা দ্বারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়।[৫]

যে সকল অনুষ্ঠানে রাম বিগ্রহকে গর্ভগৃহের বাইরে এনে পৃথকভাবে পূজা করা হয় সেগুলি হল:

  • তেপ্পোৎসবম: বাৎসরিক তেপ্পোৎসবম (নৌকাবিহার উৎসব) অনুষ্ঠানের প্রথম দিনটি রাম বিগ্রহের প্রতি উৎসর্গিত। এই দিন বিগ্রহগুলিকে মন্দিরের উত্তর দিকের পবিত্র হ্রদ স্বামী পুষ্করিণীতে আনা হয় এবং একটি নৌকায় চাপিয়ে হ্রদমধ্যস্থ মণ্ডপমে পূজার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।[৬]
  • বসন্তোৎসবম: বাৎসরিক বসন্তোৎসবম অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিনে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ ও হনুমান বিগ্রহগুলিকে মালায়াপ্পা স্বামী ও তাঁর দুই পত্নী এবং কৃষ্ণ বিগ্রহের সঙ্গে মন্দিরের চারপাশের রাস্তায় শোভাযাত্রায় বের করা হয় এবং পরে বসন্ত মণ্ডপমে ফিরিয়ে আনা হয়।[৭]
  • রামনবমী: রামনবমীর দিন সকালে বিগ্রহগুলির ‘স্নাপন তিরুমাঞ্জনম’ (হরিদ্রাভিষেক) পালিত হয়। বিশেষ প্রার্থনার পর রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ বিগ্রহগুলিকে হনুমান বাহনমে চাপিয়ে মন্দিরের চারপাশে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। শোভাযাত্রার পরে বঙ্গারু বকিলির বাইরে গর্ভগৃহে ‘পুরাণ প্রবচনম’ (ইতিহাস ও বংশপরম্পরা পাঠ) অনুষ্ঠিত হয়। রামনবমীর পরদিন অর্থাৎ চৈত্র শুক্লাদশমী তিথিতে ‘শ্রীরাম পট্টাভিষেকম্‌’ (রামের রাজ্যাভিষেক) অনুষ্ঠিত হয়।[৮]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. VV, Ramanujam (১৯৮০-০২-০১)। "Sri Rama in the Tirumala Temple"। TTD Sapthagiri47: 32। 
  2. VV, Ramanujam (১৯৮৯-০৫-০১)। "Sri Rama in the Tirumala Temple"। TTD Sapthagiri47: 26। 
  3. VV, Ramanujam (১৯৮৭-১১-০১)। "Sri Rama in the Tirumala Temple"। TTD Sapthagiri47: 15। 
  4. The Tirumala Temple। Tirumala: Tirumala Tirupati Devasthanams। ১৯৮১। আইএসবিএন 81-85427-95-X 
  5. "Annual Seva"TTD। ২০০৭-০৫-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-০৬ 
  6. "Annual Seva"TTD। ২০০৭-০৫-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-০৬ 
  7. "Annual Seva"TTD। ২০০৭-০৫-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-০৬ 
  8. "News in Brief: Tirumala Rama Navami Programme"The Hindu। ২০০৬-০৩-২৪। ২০১২-০৯-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-০৭