টাংসা জনগোষ্ঠী
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
---|---|
আসাম, অরুণাচল প্রদেশ | |
ভাষা | |
অসমীয়া ভাষা (আসামে বসবাস করারা), লেখায় ভাষা নেই | |
ধর্ম | |
হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম ইত্যাদি |
টাংসারা মূলত: ইন্দো-মঙ্গোলিয়ান ফৈদর লোক। ছানহুবাং এবং ছাঞ্জো টাংসাদের পূর্বপুরুষ বলা হয়। মাছুয়াই ছিংগ্রাপুম তাঁদের ইত্যাদি বাসভূমি। এর থেকে তাঁরা পরে ভাল স্থান চেয়ে কয়েকটি নদী দিয়ে উজানে এসে আসাম এবং অরুণাচলে বসবাস করতে থাকে।[১]
আসামে প্রবেশ
[সম্পাদনা]দিকেম কিমচিঙর মতে টাংসারা আসামে প্রবেশ করা পথটি এমনধরনের- মাছাই ছিংগ্রাপুম থেকে চানফো পুম। তারপর যথাক্রমে মুংখোম শক্ত, শক্তাই বাকরাপ মিল্ক, টাইচ্চা নদী পার হয়ে পাটকাই যায়। তারপর পাটকাই পার হয়ে আসাম, অরুণাচলে ছড়িয়ে পড়ে। এমনভাবে টাংসারা আসার সন্দর্ভে বিভিন্ন মত আছে যদিও আটা মুছাই ছিংগ্রাপুম পাহাড়কে আদি বাসভূমি বলে স্বীকার করেন।[১] তিনসুকিয়া জেলার লিডুর টিকক নামের পাহাড়টিতে অতীতের থেকেই টাংসারা কয়েকটি ফৈদে বসবাস করে আসছে এবং তাঁদের নামেই পাহাড়টির নাম টিকক হয়।[২]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]বর্তমানের টাংসারা অতীতত নাগা বলে পরিচিত ছিলেন। এই নাগা শব্দটির আরো কতগুলি কারণ ছিল। কানে বহল বেঁধে থাকার কারণে এদের নাখা বলা হত। পরে মানুষের মুখ মুখে তা নাগা বলে প্রচলন হল। ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে বিপিন বরগোহাঁই নামের একজন অফিসার তখনকার নেফা শাসনের জন্য মার্ঘেরিটায় এসে কার্যভার গ্রহণ করেন। এর কার্যকালে ব্রিটিশদের অন্তর্গত নাগা (পরে ভারতীয় গ্রামবুঢ়া হিসাবে পরিচিত)রা টাংসা নামটি গ্রহণ করেন। টাংসাদের প্রায় ৫০টা মত বংশ আছে। এই অনেকগুলি বংশের কথিত ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। প্রত্যেকটি বংশের আবার উপবংশ অনেক। এবং টাংসাদের এখনও কোনো লেখার ভাষা নেই। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এদের মধ্যে ভাষাগত দিকে থাকা পার্থক্য।[১]
উৎসবসমূহ
[সম্পাদনা]টাংসারা বিভিন্ন উৎসব পালন করেন। এদের পালন করা উৎসবসমূহ মূলত: কৃষিভিত্তিক। উৎসবসমূহ সাধারণত চাষ করার আগে, চাষ করার পর এবং চাষ শেষের পর পালন করা হয়। টাংসাদের যেহেতু বিভিন্ন বংশ আছে, বিভিন্ন বংশের পালন করা উৎসবসমূহও ভিন্ন ভিন্ন। টিখাকদের বছরের প্রথম বিহুর নাম পক-চক। তদুপরি এরা মায়ুং, চ্চাখু-চিয়াট, হালিআহ-টুন উৎসব পালন করেন। রাংপাংরা চাম্ফা কুক, ফায়ুং টক, চানজক টক, চানজ’হ টাহ, তামরে’, বাহ-বান উইহাও কক উৎসব পালন করেন। মুকলুমদের ধান তোলার উৎসব হল কুংটং ম’ল। লুংচাং বংশে মে মাসে পালন করা উৎসবটি হল ম’হজুং। এই উৎসবটি লুংচাংদের বড়ো উৎসব। তারপর জুলাই মাসে তাঁরা পালন করে পারং ম’ল। টিখাক, য়ংকুক, কেটে বংশ মার্চ মাসে পক-চক উৎসব পালন করেন। টাংসাদের সমস্ত উৎসবে মদ এবং গাহরি মাংসের প্রয়োজন হয়।[১] তাঁদের মধ্যে জ্যোন ব', চি থে ব', চে ইউ লোবম, মইব' ইত্যাদি লোকনৃত্যের প্রচলন আছে। এগুলির সাথে সঙ্গতি রেখে তাঁরা কতগুলি লোকগীতও পরিবেশন করেন। পরম্পরাগত লোকগীতসমূহের মধ্যে চাপল' গান, ক্র গ, ঙ চায়, নাও লেম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।[২]
বিবাহ পদ্ধতি
[সম্পাদনা]টাংসাদের মধ্যে অতীতে কেবল জারকালিতে বিয়ে হত। আজকাল সেই নিয়ম নেই। সাধারণত দুই ধরণে বিয়ে হয়। বরের মা-বাবা মেয়ের বন্দোবস্ত করেন। সাধারণত মামার ভাগিনী বিয়ে করেন না। জরিমানা দিতে হয়। এমনধরণে যদি বিবাহ হয় তাকে ’খকরুং কিং’ বলে। যদিও মামার কন্যার সম্পর্কে বিয়ে হয় না তবে নতুন ফৈদের সাথে সম্পর্ক করতে চায় এবং বিয়ের বন্দোবস্তও হয় তেমন হলে তাকে ’লামতান’ বলে। এই সম্পর্কই স্থায়ী রূপ পাওয়া পর্যন্ত ১৪০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে মেয়ের সম্মতি নেন। টাংসা সমাজটিতে ডেকা-কুমারীর অবাধ মেলামেশায় কোনো বাধা নেই যদিও কোনোধরনের অসামাজিক আচরণ এরা করতে পারে না। মরং ঘরে প্রেম করে যদি কোনো মেয়ে গর্ভবতী হয় দুইপক্ষের মানুষে শুভদিন দেখে মেয়েকে সামাজিকভাবে বিয়ে করে নিয়ে যায়। প্রেম এদের জন্যে পবিত্র এবং প্রাকৃতিক নিয়ম বলে মেনে চলতে দেখা যায়।[১]
বেশভূষা
[সম্পাদনা]টাংসারা নিজেদের সাজ-পোশাক ঘরে তৈরি করে নেন। টাংসা তিরোতাই সাধারণত গাঢ় নীলা, লাল কালো এবং সাদা রঙের সুতোয় দৈর্ঘ্যে দৈর্ঘ্যে আঁক-বাঁক থাকা মেখেলা (এরা দুইমাথা চিলায় না) খোছা বা খাটছা পরে। কুমারীরা কালো মেখলা বা অন্য রঙের মেখেলা পরে। গায়ে ব্লাউজ এবং (খুপক) চাদর নেয়। অলংকার হিসাবে ক'প'বি (গোটা পইছায় নির্মিত মালা), তিদুং (পরম্পরাগত খারু) এবং নাচুং (পরম্পরাগত কাণফুলি) আদু পরিধান করে। পুরুষরা বিভিন্ন রঙের সুতোয় বোনা লুঙি, চোলা এবং মূ্রত পাগুড়ি (খুপাপ) মারে। টিকক পাহাড়ের টাংসারা চ্যমতুঙ্গ (পরম্পরাগত চোলা' পরে। টাংসাদের বিভিন্ন বংশের লোকদের সাজ-পোশাকে কিছু বিভিন্নতা দেখা যায়। টাংসা নারী কানে জাংফাই কেরু, কাঠ বা বেতে নির্মিত ফিনরং (ছাগলের শিংয়ের আকৃতির কাণফুলি), কড়ির মালা, বিভিন্ন রঙের মণিতে, কখনো রুপার টাকায় ডিঙিতে মালা পরে। আগের সময়ে কাঠ এবং বাঁশ থেকে নির্মাণ করা মালা, কাণফুলি, খারুর প্রচলন ছিল। পুরুষরা মাথার চুল ওপরে তুলে খোপার মতো বাঁধত যদিও আজকাল এমনভাবে খোপা দেখা যায় না। বেতের টুপীতে সুন্দরকরে ধনেশ চরাইর পাখি (বারা), বরা গাহরির দাঁত (ভঅঅ প্পা) লাগিয়ে উৎসব-পার্বণে পরতে দেখা যায়।[১][২]
বাসগৃহ
[সম্পাদনা]টাংসারা চাংঘর তৈরি করে বসবাস করেন। সাধারণত কাঠ, বাঁশ এবং বেতে ঘর তৈরি হয়। ছাউনিটির জন্য জেঙুপাত ব্যবহার করা হয়। চাংঘর তৈরিতেও স্থানটি ভাল করে নিয়ে মঙ্গল চাওয়া হয়। মঙ্গল চাওয়ার নিয়ম অনুসারে প্রথমে ঘর তৈরি করতে খোজা স্থানটি পরিষ্কার করে পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনুসারে ঘরের চাউল বাইপাতায় বেঁধে পুঁতে রেখে যায় এবং পরদিন সেগুলি এসে চায়। চাওয়াতে যদি চাউলগুলি না ভাগ করা যায় তখন সেই স্থান ঘর তৈরি করতে উপযুক্ত বলে ভাবে এবং যদি চাউলগুলি ভাগ করা যায় সেই স্থানে ঘর তৈরি হয় না। তদুপরি কয়েকজন দুটি গজালি তুলে বাঁশ সমানে সমানে চোখ থাকায় কেটে জুইতে পুরে ফোটায়। যদি বাঁশের চোখ দুটি বামদিকে ফুটে মঙ্গল হয়, না হলে স্থানটি ভাল নয় বলে ভাবে। ঘর তৈরির স্থানটি সবসময় উঁচু এবং ঘর পূর্বদিকে মুখ করে হয়। ঘর তৈরির কাঠটি লতায় পাক খেতে হবে না হলে হবে না। প্রথম কোঠাটি বড়ো ছেলের কোঠা, তারপরটি ছোটজনের, তারপর বুঢ়া-বুঢ়ী বা মা-বাবার এবং তার পরের কোঠাটি ঘরের মেয়েগুলির। তারপর থাকে ধান খুন্দা উরাল। ঘরটির সামনের দিকে ও পিছনের দিকে দুটি দরজা থাকে। পিছনের দিক দিয়ে ঘরের ভিতর ঢোকাটি চুরি করার সমান অপরাধ বলে ধরা হয়। তার জন্য জরিমানাও দিতে হয়।[১]
খাদ্যসম্ভার
[সম্পাদনা]টাংসাদের প্রধান খাদ্য হল ভাত। তাঁরা বিভিন্নধরনের ধানের চাষ করেন। তার মধ্যে কণী ধান, মরুয়া ধান, আখৈ ধান ইত্যাদি। টাংসারা কুকুর, মেকুরী, ঘোড়া, নিগনি, শগুন ইত্যাদির বাইরে সমস্ত কিছুর মাংস খায়। মাছ থেকে মাংস খেতে ভালবাসে। পাসাও এদের প্রিয় খাদ্য। পাসা শরীরের জন্য খুব উপকারী। বিশেষকরে চোখের রশ্মির জন্য এই পাসা মহৌষধ। সপ্তাহে একবারকরে একবছর যদি পাসা খাওয়া যায় চোখে না দেখা মানুষের চোখের রশ্মি ফিরে পায়। পাসা তৈরি করতে মাছটি বাকলি দেখে অল্প সময় জুইতে পুরে বাকলিখানি এড়িয়ে ফিসা এবং পেটটি ফেলে দিতে হয়। তারপর মাছটি গুড়ো করে এই গুড়োর সাথে বন্য মশলার পাতা, উরিয়াম গাছের পাতা, লঙ্কা, নুন এবং জল ঢেলে রেখে দেওয়া হয়। বাঁশের চোঙা এবং ভাপা ভাত দেওয়া হয়।[১]
শিক্ষা ব্যবস্থা
[সম্পাদনা]টাংসা উপজাতিরা আসামে বসবাস করে (যারা আসামে থাকে) অসমীয়া ভাষাও কমবেশি বলতে পারে। শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে অতি পিছিয়ে পড়া এই জাতিটির সম্প্রতি একটি উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। উঠে আসা শিক্ষিতরা উপলব্ধি করেছেন শিক্ষার গুরুত্ব। জাতীয় কলা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছে।[১]