জাঁতাকল
বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জাঁতাকল | |
| অন্য নাম | জাঁতা |
|---|---|
| শ্রেণীবিভাগ | হাতচালিত কল |
| ব্যবহার | শস্য, ডাল ও মসলা ভাঙানো কিংবা ছিলানো। |
| ধরন | ঐতিহ্যবাহী পাথরের কল |
| এর সাথে ব্যবহৃত | কাঠের দণ্ড বা হাতল |
| উদ্ভাবক | প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত |
| প্রস্তুতকারক | স্থানীয় কারিগর |
| সম্পর্কিত | চাকতি, আটা কল |
জাঁতাকল বা জাঁতা একটি প্রাচীন হাত চালিত কল, যা বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশে শস্য, ডাল ও মসলা গুঁড়ো করার জন্য ব্যবহৃত হতো।[১] দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাঁতাকল শুধু খাদ্য প্রস্তুতির যন্ত্রই ছিল না, এটি গ্রামীণ জীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অংশ ছিলো। [২]
গঠন ও ব্যবহার
[সম্পাদনা]জাঁতাকল সাধারণত দুটি গোলাকার পাথরের চাকতি নিয়ে গঠিত। নিচের চাকতি স্থির থাকে। উপরের চাকতি কাঠের হাতল বা দণ্ড দিয়ে ঘোরানো হয়।[১]
দুই খন্ড পাথর গোলাকৃতিতে কেটে খুবই মসৃণ করে বানানো হয় জাঁতাকল। সেই খন্ড দুটির ভিতরের অংশে লোহার পাত বা ধারালো যন্ত্র দ্বারা ছোট্র ছোট্র গর্ত করে এটি কিছুটা ধার করা হতো। যাতে ধারালো অংশের ঘর্ষণে ডাল জাতীয় শস্য ভাঙানো কিংবা ছিলানো যায়।[২]
পাথরের দুই অংশের মাঝামাঝি উপর-নিচ ছিদ্র করা হয়। আর সেই ছিদ্রের ভিতরে গাছের ঢাল, কাঁঠ বা বাঁশ কাঠির মতো হাতল তৈরী করে লাগানো হতো। যাতে পাথর দুটি জাঁতার সময় আলাদা না হয় বা দুই অংশ এক জায়গায় রাখতে সাহায্য করে। উপরের পাটের মাঝে আরো একটি ছিদ্র থাকে যা দিয়ে ডাল জাতীয় শস্যকে ভিতরে দেয়া হয় পিষানোর জন্য।[২]
এছাড়া পাশে ক্ষুদ্র একটি ছিদ্র করা হয় যার মধ্যে হাতল দিয়ে শুধু উপরের পাথরকে ঘুরানো হতো। এতে করে নিচের পাথরের উপর ঘুরতে থাকে উপরের পাথর। এই দুই পাথরের ঘর্ষণে ভেতরে দেয়া শস্য ভেঙে-ছিলে জাঁতাকলের চারপাশ দিয়ে পড়তে থাকে। আর শস্যকে সংগ্রহের সুবিধার্থে জাঁতাকলের নিচে একটি কাপড় বা ছাটাই জাতীয় কিছু রাখা হতো।[২] [৩]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে জানা যায় যে সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতায় খাদ্য প্রস্তুতির জন্য অনুরূপ হাতচালিত কল ব্যবহৃত হতো।[৪] বাংলার গ্রামীণ সমাজে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জাঁতাকল ছিল প্রতিটি গৃহস্থালির অপরিহার্য অংশ। তবে বিশ শতকে যান্ত্রিক মিল ও বিদ্যুৎচালিত কলের প্রসারের ফলে জাঁতাকলের ব্যবহার কমে আসে।[৫]
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাঁতাকল শুধু খাদ্য প্রস্তুতির যন্ত্রই ছিল না, এটি গ্রামীণ জীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও বহন করত। ওইসব অঞ্চলের গৃহবধূরা একসাথে বসে চাল বা ডাল ভানা এবং মসলা গুঁড়ো করার সময় আড্ডা ও গান গাইতেন।[৬] বাঙালি লোকগান ও প্রবাদে জাঁতাকলের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা গৃহস্থালি শ্রমের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী জাঁতা এখন প্রায় বিলুপ্ত। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলার গ্রাম-গঞ্জে জাঁতাকলের ব্যবহার ছিলো। যা প্রয়োজনীয় গৃহস্থলি উপকরণের অংশ ছিলো। একটি বাড়িতে জাঁতা থাকলে আশপাশের বাড়ীর নারীরা মটর কলাই, মাশ কলাই, খেসারী, মসুরসহ নানা ধরণের ডাল ভাঙানোর জন্য লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতেন।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে নববধুরা উপহার হিসেবে তার বাবার বাড়ি থেকে জাঁতা নিয়ে বরের বাড়িতে যেতেন।
বর্তমানে ব্যবহার
[সম্পাদনা]বর্তমানে জাঁতাকলের ব্যবহার প্রায় বিলুপ্ত। তবে কিছু গ্রামীণ পরিবারে মসলা গুঁড়ো করার জন্য এখনো এটি ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যবাহী প্রদর্শনী ও জাদুঘরে বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে জাঁতাকল সংরক্ষিত রয়েছে।[৭]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- 1 2 Sen, Sudipta (২০১৯)। Ganges: The Many Pasts of an Indian River। Yale University Press। আইএসবিএন ৯৭৮-০৩০০১১৯১৬৯।
- 1 2 3 4 "হারিয়ে যাচ্ছে গাঁও গ্রামের মহিলাদের ঐতিহ্য জাঁতাকল"। রুপালি বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
{{ওয়েব উদ্ধৃতি}}: উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: ইউআরএল-অবস্থা (লিঙ্ক) - ↑ Ghosh, Amalananda (১৯৯০)। An Encyclopaedia of Indian Archaeology। Brill। আইএসবিএন ৯৭৮৮১২১৫০০৮৭৬।
- ↑ Possehl, Gregory L. (২০০২)। "The Indus Civilization: A Contemporary Perspective"। Journal of World Prehistory। ১৬ (4): ২৭৮–২৮১। ডিওআই:10.1023/A:1020934309405।
- ↑ Banerjee, Sumanta (১৯৯৮)। The Parlour and the Streets: Elite and Popular Culture in Nineteenth Century Calcutta। Seagull Books। আইএসবিএন ৯৭৮৮১৭০৪৬০৯৯২।
- ↑ Sarkar, Sumit (১৯৯৮)। Writing Social History। Oxford University Press। আইএসবিএন ৯৭৮০১৯৫৬৪১৯৩৬।
- ↑ "Traditional Tools of Bengal"। The Asiatic Society। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫।