জগৎ শেঠ

জগৎশেঠ বাংলার একটি মর্যাদাকর পদবী, যা একজন ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তিকে নির্দেশ করতো। তবে এই পদবীধারী “মহাতপ চাঁদ” নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়ে একজন বিশেষ ক্ষমতাধর রাজন্য ছিলেন। তৎকালীন সময়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী ছিলেন তিনি। এমনকি জমিদার ও নবাবরা পর্যন্ত কর পরিশোধের ক্ষেত্রে তার অর্থের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন ।রবার্ট ওর্ম লিখেছেন যে, এ হিন্দু ব্যবসায়ী পরিবারটি মুগল সাম্রাজ্যে সর্বাধিক ধনবান ছিল; মুর্শিদাবাদ সরকারের উপর এ পরিবার প্রধানের ছিল প্রচন্ড প্রভাব।[১] তিনি অধিকাংশ জমিদারের পক্ষে নিরাপত্তা জামিনদার হতেন এবং তার প্রতিনিধিরা ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতেন। এর আয়ের উৎস ছিল বহুমুখী। এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল সরকারি রাজস্ব জমা গ্রহণকারী ও জিম্মাদার। জমিদারগণ এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারে রাজস্ব জমা দিতেন এবং নওয়াবরাও এর মাধ্যমেই তাদের বার্ষিক প্রদেয় অর্থ দিল্লিতে প্রেরণ করতেন। এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠান মুদ্রা তৈরি করত এবং বাংলায় আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ সোনারুপা ক্রয় করত। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রচুর মুনাফা করত। [১] যাঁদের চক্রান্তের শিকার হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন, তাঁদের একজন হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়। শুধু চক্রান্তই না পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের অর্থসাহায্যের সাথেও জড়িত ছিলেন জগৎ শেঠ । পরবর্তীতে বক্সার যুদ্ধে মীর কাশেমের পরাজয়ের পিছনেও তার হাত আছে বলে অনুমান করা হয়। মীর কাশেম তাঁকে সুউচ্চ এক ভগ্নপ্রায় দূর্গ থেকে নীচের নদীতে ফেলে হত্যা করেন। তার বড়ো ছেলে মানিকচাঁদ ঢাকায় মহাজনি কারবার শুরু করেন এবং এরপর বাংলার তৎকালীন নবাব মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে সুসম্পর্কের জন্য তিনি মুর্শিদাবাদে ব্যাবসা শুরু করেন। এই মানিকচাঁদেরই ভাগ্নে ছিলেন ফতেহচাঁদ। দিল্লির মুঘল সম্রাটের দরবারে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেলে মুঘল সম্রাট ফতেহচাঁদকে জগৎ শেঠ উপাধি প্রদান করেন যার প্রকৃত অর্থ হল জগতের শেঠ। এই উপাধি পরবর্তীকালে পারিবারিক উপাধিতে পরিণত হয়।
মানিক চাঁদ
[সম্পাদনা]আনুমানিক ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্য পরীক্ষার উদ্দেশ্যে মারোয়ারি ব্যবসায়ী হিরাপদ শাহ রাজস্থান থেকে পাটনায় চলে আসেন। জগৎ শেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিক চাঁদ। তিনি আঠারো শতকের প্রথম দিকে পাটনা থেকে ঢাকা আসেন এবং এখানে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মুর্শিদাবাদে ছিলেন নওয়াবের খুবই প্রিয়ভাজন এবং পরে নওয়াবের ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ লাভ করেন। ১৭১২ সালে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের পর সম্রাট ফররুখ সিয়ার মানিক চাঁদকে ‘নগর শেঠ’ (নগরের ব্যাংকার) উপাধি প্রদান করেন। [১]
ফতেহ চাঁদ
[সম্পাদনা]১৭১৪ সালে মানিক চাঁদের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র ফতেহ চাঁদের নেতৃত্বে পরিবারটি বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। ১৭২৩ সালে সম্রাট মাহমুদ শাহ ফতেহ চাঁদকে জগৎ শেঠ উপাধি প্রদান কর। এর সদর দফতর ছিল মুর্শিদাবাদে এবং ঢাকা, পাটনা ও দিল্লিসহ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বাংলার বাইরে এ ব্যাঙ্কের শাখা ছিল।
সরফরাজ খাঁ নবাব হন। এ সময়ও ফতেচাঁদ তার উপদেষ্টা ছিলেন। কিন্তু তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। আর তাই সরফরাজের পতনের উদ্দেশ্যে অন্য বিরোধীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ফতেচাঁদ আলিবর্দি খাঁ কে নবাব পদে আসীন হতে সহায়তা করেন।[২] আলিবর্দি খাঁর সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদ বাঁধলে ফতেচাঁদ সহায় হন। আলিবর্দি খাঁর সময়ে বাংলায় অনেকবার মারাঠা বর্গীর উপর্যুপুরি আক্রমণে বাংলার আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। এ সময় বাংলার আর্থিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে নবাবের প্রধান সহায় ছিলেন জগৎশেঠ ফতেচাঁদ।[৩] মহারাজা স্বরূপ চাঁদ নওয়াব আলীবর্দী খান এর সময়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন।
মাহতাব চাঁদ
[সম্পাদনা]ফতেহ চাঁদের পর তার পৌত্র মাহতাব চাঁদ ১৭৪৪ সালে উত্তরাধিকারসূত্রে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি লাভ করেন। তিনি ও তার ভাই মহারাজা স্বরূপ চাঁদ নওয়াব আলীবর্দী খান এর সময়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। মোহনলালের সঙ্গে শেঠদের শত্রুতা ছিল। মোহনলাল দায়িত্ব নেয়ার পর শেঠরা সরে আসে।ইংরেজদের ঘৃণা করতেন সিরাজ। জগৎশেঠ নবাবকে এ থেকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নবাব তাকে চড় মেরে ,তার কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছিলেন যে, জগৎশেঠ ইংরেজদের হয়ে দালালি করবেন না। [৪] মুতাক্ষরীণকার জগৎশেঠের প্রতি সিরাজউদ্দৌলার কটূক্তি-প্রয়োগের কথা উল্লেখ করছেন এবং সিয়ের উল-মুতাক্ষরীণে, মুতাক্ষরীণকার আরও বলেন যে, জগৎশেঠ সিরাজউদ্দৌলার প্রতি অসন্তুষ্ট হন ।[৫]
এ ঘটনা জগৎশেঠের মনে বেশ প্রভাব ফেলে। তিনি সিরাজ বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দেন তাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য। এ লক্ষ্যে জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, মীরজাফর, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একত্রিত হয়ে ঠিক করেন ইংরেজদের সহায়তা নেবেন তারা। মীরজাফর এর নওয়াবী আমলেও তাদের শক্তি ও প্রভাব অব্যাহত ছিল। কিন্তু মীর কাসিম যুদ্ধের সময় তার কাছে যে অর্থ দাবী করেছিল তা মেটাতে পারেননি জগৎশেঠ। তাই তিনি তাদের বন্দী হিসেবে নিয়ে যান। মীর কাসিম ১৭৬৩ সালে শেঠ পরিবারের নেতৃস্থানীয় এ দুভাইকে হত্যা করেন।
জগৎশেঠ খোসালচাঁদ
[সম্পাদনা]১৭৬৬ সালে সম্রাট শাহ আলমের ফরমান অনুযায়ী মহাতপচাঁদের বড় ছেলে খোসালচাঁদ জগৎশেঠ আর স্বরুপচাঁদের ছেলে উদায়তচাঁদ মহারাজ উপাধি পান। লর্ড ক্লাইভ খোসালচাঁদকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করেন। ১৯ বছর কাজ করার পর ১৭৮২ সালে খোসালচাঁদ মারা যান।
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- বাংলাপিডিয়ায় - ইংরেজি ভার্সন