বিষয়বস্তুতে চলুন

চোখের বদলে চোখ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

চোখের বদলে চোখ ( প্রাচীন হিব্রু: עַיִן תַּחַת עַיִן, ʿayīn taḥaṯ ʿayīn; [] আরবি: العين بالعين; al ayin bil ayin) হল একটি ইব্রাহিমীয় ধর্মীয় আদেশ, যা পুরাতন নিয়মের যাত্রাপুস্তকের ২১:২৩-২৭ পদ ও কুরআনের আয়াত ৫:৪৫-এ পাওয়া যায়। আইনটি পারস্পরিক ন্যায়বিচারের নীতিকে প্রকাশ করে, যার মূলভাব হল অপরাধ ও শাস্তি সর্বদা সমান হতে হবে। এই নীতির প্রাচীনতম ব্যবহার দেখা যায় হাম্মুরাবির বিধি-তে, যা তিনি হিব্রু বাইবেল লেখার আগে প্রণয়ন করেন। তবে এটি মৌখিক ঐতিহ্যগুলোর চেয়েও পুরোনো কিনা তা নিশ্চিত নয়। []

সঠিক প্রতিশোধের আইন (লাতিন: lex talionis) [] বা পারস্পরিক ন্যায়বিচার একই নীতি বহন করে, যা বোঝায় যে, যে ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে আহত করে তাকে আহত ব্যক্তি কর্তৃক একই পরিমাণে শাস্তি দেওয়া হবে। সহজ ব্যাখ্যায় এর অর্থ হল, ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ হিসেবে আঘাতের সমান [আনুমানিক] মূল্য পাবে। [] এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল ক্ষতিপূরণকে কেবল ক্ষতির পরিমাণেই সীমাবদ্ধ রাখা। []

সংজ্ঞা ও পদ্ধতি

[সম্পাদনা]

লেক্স ট্যালিওনিস শব্দটি কেবল "চোখের বদলে চোখ" ধরনের শাস্তি বোঝায় না (যেমন দেখুন: প্রতিবিম্ব শাস্তি সম্পর্কিত ধারণা) বরং এটি এমন আইনব্যবস্থা বুঝায়, যেখানে নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণ করা হয়, যা অপরাধের মাত্রার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এর লক্ষ ছিল অতিরিক্ত শাস্তি প্রতিরোধ করা, যা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ হিসেবে বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হতে পারে। [] এ ধরনের আইনি ব্যবস্থার সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ হল "চোখের জন্য চোখ" নীতি, যার অর্থ হলো, শাস্তি অপরাধের সমান হওয়া উচিত। অর্থাৎ অপরাধের পরিমাণ অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারণ করা হয়, যাতে শাস্তি অতি গুরুতর বা অতিরিক্ত না হয়। []

বাইবেলীয় আইনে

[সম্পাদনা]

হাম্মুরাবির বিধিতে চোখের বদলে চোখ নীতিটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ অন্য কাউকে হত্যা করত, তাহলে তার হত্যার বদলে সেই হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। []

এই আইনের উৎপত্তি নিয়ে নানা মতামত রয়েছে। তবে একটি প্রচলিত ধারণা হল, যখন বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক আইনগত কাঠামো ছিল না। এর পরিবর্তে ছিল ব্যক্তি বা গোত্রভিত্তিক প্রতিশোধপ্রবণতা; যেমন: রক্তের বদলে রক্ত, বিবাদ বা ব্যক্তিগত শত্রুতা। এই ধরণের প্রতিশোধপ্রবণতা সামাজিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছিল। ফলে লেক্স টালিওনিস বা প্রতিশোধমূলক আইন চালু হয়, যাতে প্রতিশোধ একটি সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তা রাষ্ট্রের (তৎকালীন সমাজে রাষ্ট্রের আদিম রূপ) হাতে ন্যস্ত হয়। এই ধরনের প্রতিশোধের নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগই ছিল আইনগত ব্যবস্থার সূচনা। এই নীতিটি শুধু হাম্মুরাবির আইনে নয়, বরং আরো প্রাচীন উর-নাম্মুর বিধিসমূহ ও লিপিত-ইশ্তার আইনেও পাওয়া যায়, যা মেসোপটেমীয় আইনব্যবস্থার আগের যুগের দলিল। []

বাইবেলীয় আইনের মূল বক্তব্য এমন ছিল যে, [][] কোন আইনহীন সমাজে যখন কেউ আহত হত, তখন আহত ব্যক্তি বা তার আত্মীয়রা ঔ অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতো এবং এই প্রতিশোধ প্রায়ই অপরাধের তুলনায় অনেক কঠিন হত; এমনকি তা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত, যার ফলে অনেকাংশে ন্যায়বিচার হত না। কিন্তু বাইবেলীয় আইন প্রতিশোধপ্রবণতাকে সীমাবদ্ধ করেছে। অপরাধের শাস্তি যেন অপরাধের চেয়ে বেশি না হয় — এই শর্তে প্রতিশোধের অনুমতি ছিল। তবে এই সীমাবদ্ধতা তখনই প্রযোজ্য হতো, যখন অপরাধী ও ভুক্তভোগী সমাজে একই স্তরের বা মর্যাদার হতেন। সমাজে কারো মর্যাদা যদি অপর জনের চেয়ে বেশি হতো (যেমন রাজা বা ধর্মীয় নেতা), তবে তার বিরুদ্ধে অপরাধ করলে শাস্তি আরও কঠোর হতো এবং যদি অপরাধ সমাজের উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে সংঘটিত হতো, তাহলে এই আইনটি একই ধরনের অপরাধের ভিন্ন ভিন্ন বিচার করত ; যেমন: ধর্মনিন্দা বা রাজদ্রোহ।

প্রাচীন গ্রিক আইনে

[সম্পাদনা]

দার্শনিক পিথাগোরাসের শিক্ষক প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক আনাক্সিমান্দ্রোস বলেন যে, প্রকৃতির মহান চক্রগুলো প্রতিশোধমূলক ন্যায়ের ধারায় আবর্তিত হয়, অর্থাৎ প্রকৃতি নিজেই একটি চক্রের মাধ্যমে এমন অপরাধের প্রতিশোধ নেয়। তবে সক্রেটিস এমন প্রতিশোধমূলক আইনপ্রণালীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, ন্যায়বিচার প্রতিশোধের ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়; বরং তা হবে যুক্তি ও নৈতিকতার ভিত্তিতে। [১০]

হিব্রু আইনে

[সম্পাদনা]

হিব্রু আইনে এই আইনকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল এবং এর পরিবর্তে হিব্রু বাইবেলে কোফের (অর্থদণ্ড) দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল, যা শরীরিক শাস্তির বিকল্প হিসেবে প্রযোজ্য ছিল; হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য ছিল না। [১১] তবে কোথাও এটা স্পষ্ট করা হয়নি যে, এই অর্থদণ্ড বেছে নেওয়ার অধিকার কাদের ছিল—ভুক্তভোগী, অভিযুক্ত না কি বিচারকের।

বাইবেলে ব্যবহৃত হিব্রু বাক্যাংশ আইন তাখাত আইন (হিব্রু: "עין תחת עין" ) যাত্রাপুস্তকলেবীয় পুস্তক গ্রন্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যার আক্ষরিক অর্থ হল, এক চোখের পরিবর্তে এক চোখ। অন্যদিকে ডিউটারোন্মির একটি অংশে কিছুটা ভিন্নভাবে বলা হয়েছে: "עַיִן בְּעַיִן שֵׁן בְּשֵׁן"—অর্থাৎ চোখের জন্য চোখ, দাঁতের জন্য দাঁত—যা মিথ্যা সাক্ষীর ক্ষেত্রে আদালতের প্রতিশোধমূলক সাজা দেওয়ার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। [১২][১৩][১৪] বলা হয় যে, "চোখের বদলে চোখ" আইনটি মূলত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নয়; বরং ক্ষতিপূরণ সীমিত রাখার জন্য প্রণীত হয়েছিল অর্থাৎ যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, ততটুকুই ক্ষতিপূরণ আবশ্যক হবে। []

লেবীয় পুস্তকের অনুচ্ছেদ ২৪:১৯-২১– এর ইংরেজি অনুবাদ হল: "যদি কেউ তার স্বদেশবাসীকে আঘাত করে, তবে যেমনটা সে করেছে, তেমনটিই তার ওপর প্রয়োগ করা হবে—ভাঙনের জন্য ভাঙন, চোখের জন্য চোখ, দাঁতের জন্য দাঁত। যেভাবে সে অন্য ভাইকে আঘাত করেছে, সেভাবে তাকেও করা হবে। [১৫] এখানে তাখাত শব্দটি 'অন্তর্গত' বা 'পরিবর্তে' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে বাইবেলের লেভিটিকাস ২২:২৭ অংশে এর প্রথাগত অর্থ 'অধীনে' হিসেবেও একটি উদাহরণ রয়েছে: "যখন কোনো ষাঁড়, ভেড়া বা ছাগল জন্মায়, তখন সেটি তার মায়ের অধীনে থাকবে এবং অষ্টম দিবস থেকে সেটি উৎসর্গযোগ্য হবে।

যাত্রাপুস্তকের ২১:২২–২৪ অংশের ইংরেজি অনুবাদ এমন, "যদি পুরুষরা লড়াই করে এবং গর্ভবতী নারীকে আঘাত করে এবং এর ফলে তার গর্ভপাত ঘটে; কিন্তু অন্য কোনো ক্ষতি না হয়, তাহলে সেই পুরুষ অবশ্যই শাস্তি পাবে, যে শাস্তি নারীর স্বামী নির্ধারণ করবে এবং বিচারকরা তা অনুমোদন করবে। কিন্তু যদি অন্য কোন ক্ষতি হয়, তবে জীবনের বিনিময়ে জীবন, চোখের জন্য চোখ, দাঁতের জন্য দাঁত, হাতের জন্য হাত, পায়ের জন্য পা দিতে হবে।"

ইহুদিধর্ম

[সম্পাদনা]

আইজ্যাক কালিমি বলেন, লেক্স টালিওনিস ("চোখের বদলে চোখ") শাস্তিকে রাব্বিরা মানবিক রূপে ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বাক্যাংশটির আক্ষরিক অর্থের পরিবর্তে এটিকে একটি যুক্তিসঙ্গত আর্থিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। যেভাবে বাইবেলীয় লেক্স টালিওনিসেও দেখা যায়, সেভাবেই ইহুদি ধর্ম ও ইহুদি বিচারব্যবস্থা লিখিত তোরাহের পেশাতকে (আক্ষরিক অর্থ) ছাড়িয়ে গিয়ে আরো মানবিক ব্যাখ্যা দেয়। [১৬] প্যাসাকফ ও লিটম্যান বলেন, এই ব্যাখ্যার পরিবর্তনটি দেখায় যে, ফারিসীয় ইহুদি ধর্ম কিভাবে পরিবর্তনশীল সামাজিক ও বৌদ্ধিক চিন্তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম। [১৭]

তালমুদ

[সম্পাদনা]

তালমুদ ব্যাখ্যা করে যে, "চোখের জন্য চোখ" জাতীয় বাক্যাংশ আসলে অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয় [১৮] এবং তা সাদুকি সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে যুক্তি দেয়, যারা এসব বাইবেলীয় আয়াতকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করে শরীরিক প্রতিশোধের কথা বলে। তালমুদের যুক্তি হল, এমন ব্যাখ্যা জন্মগত অন্ধ অথবা যাদের চোখই নেই, তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না; অথচ তোরাহর দণ্ডনীতি সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। তাই এর আক্ষরিক ব্যাখ্যা সঠিক নয়।

মৌখিক আইন অনুসারে, বাইবেলের এসব আয়াত মূলত একটি পাঁচ স্তরবিশিষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ-ব্যবস্থার নির্দেশ দেয়। এই পাঁচটি স্তর হলো ক্ষতির আর্থিক মূল্য, ব্যথা-বেদনার জন্য ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ব্যয়, অক্ষমতার ক্ষতিপূরণ ও মানসিক যন্ত্রণার জন্য ক্ষতিপূরণ। এই কাঠামো আধুনিক অনেক আইনি-ব্যবস্থার ভিত্তি। কিছু রাব্বিনীয় সাহিত্য ব্যাখ্যা করে যে, "চোখের বদলে চোখ" বলতে আসলে বোঝানো হয়েছে যে, অপরাধীর নিজের চোখ খোয়ানোরও সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বাইবেল তার প্রতি সহনশীল আচরণ করে এবং তা বাস্তবে কার্যকর না করে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করে। [১৯]

তবে তোরাহ কয়েক জায়গায় সরাসরি প্রতিশোধমূলক বিচারের ধারণাও দেয়। যেমন, "আইন তাখাত আইন" (চোখের বদলে চোখ) বাক্যটি একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পুনরায় দেখা যায়—সেটি হলো মিথ্যা সাক্ষীর বিরুদ্ধে। এখানে তোরাহ বলে, "যেমন সে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, আদালতও তার সঙ্গে তেমনটাই করবে। [২০] [২১]

তবে এটা কার্যকর করার আগে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়; যেমন: অভিযুক্তের রায় কার্যকর হওয়ার আগেই ষড়যন্ত্রকারীর মিথ্যা ধরা পড়া। যদি সম্ভব হয় অপরাধীকে একই দণ্ডে দণ্ডিত করা (এমনকি মৃত্যুদণ্ড হলেও); তবে আদালত তা কার্যকর করবে। অন্যথায় তাকে কশাঘাত দেওয়া হবে। [২২][২৩]

তোরাহতে এমন কোনো শাস্তির বিধান নেই, যেখানে কাউকে অঙ্গহানি (যেমন চোখ, দাঁত, হাত বা পা কেটে দেওয়া) করতে বলা হয়েছে। তবে একটি মাত্র আয়াত আছে যেখানে বলা হয়েছে: "...তার হাত কেটে দাও..."। তবে তালমুদের পণ্ডিতরা বুঝিয়েছেন, এটি এমন এক পরিস্থিতির কথা বলে, যেখানে কোনো একজন নারী প্রাণঘাতীভাবে আক্রমণ করছে। অর্থাৎ প্রাণ রক্ষার উদ্দেশ্যে কাউকে হস্তক্ষেপ করা আবশ্যক; তবে যদি আক্রমণকারীকে কম আঘাতে নিরস্ত করা যায়, তবে তাকে হত্যা করা যাবে না। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, চোখ, দাঁত বা পাতে আঘাত করার কোন বিধান তোরাহ দেয় না। [২৪] [২৫][২৬][২৭]

গণনাগিরন্থ ৩৫:৯–৩০-এ এমন একমাত্র ঘটনা বলা হয়েছে, যেখানে আদালত সরাসরি শাস্তি দেয় না, বরং “রক্তের মুক্তিদাতা” নামক এক আত্মীয় অপরাধীকে হত্যা করতে পারে; যদি সে দুর্ঘটনাজনিত হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হয়। এই অবস্থায় দোষীকে নির্ধারিত আশ্রয় নগরীতে পালিয়ে যেতে হয় এবং যতক্ষণ সে সেখানে থাকে, রক্তের মুক্তিদাতা তাকে হত্যা করতে পারে না। কিন্তু যদি সে বেআইনিভাবে সেই শহর ত্যাগ করে, তখন আদালতের পক্ষ থেকে রক্তের মুক্তিদাতা তাকে হত্যা করতে পারে।

প্রচলিত ইহুদি আইনে এ সকল বিধান কার্যকর করার জন্য বাইবেল অনুযায়ী নির্ধারিত আশ্রয় নগরীগুলোর অস্তিত্ব এবং ২৩ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৈধ আদালতের উপস্থিতি আবশ্যক। এই শর্তগুলো যেকোনো মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবে এসব ব্যবস্থাপনা প্রায় দুই হাজার বছর ধরে আর নেই; ফলে এসব শাস্তি এখন আর কার্যকর হয় না।

ইহুদধর্মে প্রতিশোধমূলক ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্য

[সম্পাদনা]

তালমুদের ব্যাখ্যায় দেখা যায়, মাপ অনুযায়ী প্রতিদান—এই ন্যায়বিচারের ধারণাটি সাধারণত ঈশ্বরের পক্ষ থেকে শাস্তি প্রদানের প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। তবে আদালতের মাধ্যমে যখন প্রতিশোধমূলক ন্যায়বিচার বাস্তবায়ন করা হয়, তখন তোরাহ স্পষ্টভাবে জানায় যে, শাস্তির উদ্দেশ্য হলো সমাজ থেকে বিপজ্জনক ও অপকারী উপাদানকে দূর করে দেওয়া; যেমন বলা হয়েছে: “...এবং তুমি নিজের মধ্য থেকে মন্দকে দূর করো।” একইসাথে এই শাস্তির মাধ্যমে সমাজের অন্য মানুষরা যেন ভয় পায় এবং এমন জঘন্য অপরাধ আর না করে—এটাও একটি প্রধান উদ্দেশ্য: “... এবং বাকি লোকেরা শুনে ভীত হবে এবং তারা তোমাদের মধ্যে আর কখনও এরূপ দুষ্কর্ম করবে না।”[২৮] [২৯]

এর পাশাপাশি তোরাহে ক্ষতিপূরণ-সংক্রান্ত মামলায় এই প্রতিদানমূলক ন্যায়বিচার মূলত ভুক্তভোগীর জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার এক পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে। এখানে প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার কোনো স্থান নেই; বরং তোরাহে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি তার প্রতি অন্যায়কারী কাউকে ঘৃণা করে বা প্রতিশোধ নিতে চায়—তা ঠিক নয়। এমনকি অপরাধীর বিরুদ্ধে আদালতে রায় হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও এখানে গৌণ; বরং প্রত্যেক মানুষকেই নিজের ইহুদি ভাইকে ভালোবাসার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। [৩০]

সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ও প্রতিশোধমূলক ন্যায়বিচার

[সম্পাদনা]

বাইবেলের যাত্রাপুস্তকের ২১ অধ্যায়ে হাম্মুরাবির বিধি বিধানের মতোই প্রতিশোধমূলক ন্যায়বিচার সমাজের নিম্ন মর্যাদার লোকদের মধ্যেই প্রযোজ্য বলে মনে করা হয়। [৩১] সেখানে বলা হয়েছে: “প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত, হাতের বিনিময়ে হাত, পায়ের বিনিময়ে পা, পোড়ার বদলে পোড়া, ক্ষতের বদলে ক্ষত, আঘাতের বদলে আঘাত। তবে এর পরপরই বলা হয়েছে, "যদি কোনো প্রভু তার দাসের চোখ অন্ধ করে দেয় বা তার দাঁত ফেলে দেয়, তাহলে সেই দাসকে মুক্তি দিতে হবে; কিন্তু প্রভুকে আর কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না। অন্যদিকে যদি দাস তার প্রভুর চোখে আঘাত করে, তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হতো। [৩২]

তবে একইসাথে তোরাহে বলা হয়েছে যে, বিদেশি ও স্থানীয়—উভয়ের জন্যই একই আইন থাকবে।” এই বক্তব্য একটি সামাজিক ন্যায়বিচারের ইঙ্গিত বহন করে। এখানে বুঝানো হয়েছে যে, সমাজের প্রান্তিক ও দুর্বল শ্রেণিও আইনগত দিক থেকে সমান মর্যাদা পায়। হার্ভার্ড ডিভিনিটি বিদ্যালয়ের প্রভাষক মাইকেল কুগান ব্যাখ্যা করেছেন, এই ন্যায়বিচারের লক্ষ্য হলো, মানুষকে নিজের হাতে আইন প্রয়োগ বা অতি মাত্রায় প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে বিরত রাখা এবং এটা সমাজে ভারসাম্য ও ন্যায় বজায় রাখার একটি উপায়। [৩৩]

রোমান আইনে

[সম্পাদনা]

প্রাচীন রোমান সাহিত্যে প্রতিশোধমূলক ন্যায়বিচারের পক্ষে মতামত দেখা যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিসেরোর লেখা দে লেজিবাস, যা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রচিত হয়েছিল।

তবে রোমান আইন ধীরে ধীরে প্রতিশোধের বদলে আর্থিক ক্ষতিপূরণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিশেষ করে আঘাতের ঘটনায় বিভিন্ন ধরণের শারীরিক ক্ষতির জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের জরিমানা নির্ধারণ করা হয়। তবে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে–যেমন একজন অন্যজনের অঙ্গ ভেঙে দিলে– তখনো প্রতিশোধমূলক শাস্তির সুযোগ বহাল রাখা হয়েছিল। [৩৪]

ইসলামী আইনে

[সম্পাদনা]

কুরআন (সুরা মায়িদাহ ৫:৪৫) "চোখের বদলে চোখ" ধারণাটি বনী ইসরাঈলের জন্য নির্ধারিত ছিল উল্লেখ করেছে। [৩৫] ইসলামে এই ধারণার মূলনীতি হল কিসাস (আরবি: قصاص); যেমন কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে: "হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর নিহতদের জন্যে কিসাস নির্ধারিত করা হয়েছে; স্বাধীন ব্যক্তির বিনিময়ে স্বাধীন, দাসের বিনিময়ে দাস ও নারীর বিনিময়ে নারী (হত্যা করা হবে)। কিন্তু যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করে, তার জন্য উপযুক্ত প্রতিকার এবং সদাচরণ সহকারে তাকে প্রতিদান প্রদান করা উচিত। আর এটি তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে (তোমাদের প্রতি) লাঘব ও রহমত। কিন্তু এরপরে যদি কেউ সীমালঙ্ঘন করে, তাহলে তার জন্যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।" ইরান বা সৌদি আরবের মতো ইসলামী শরিয়া আইন প্রয়োগকারী মুসলিম দেশগুলি "চোখের বিনিময়ে চোখ" নিয়মটি আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করে। এটি নবী মুহাম্মাদের যুগ থেকেই আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ হয়ে এসেছে। [৩৬][৩৭]

"আমি তাদের মাঝে [তাওরাতে] বিস্তারিত বর্ণনা করেছি যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান,দাঁতের বদলে দাঁত, শারীরিক আঘাতের প্রতিদানে শারীরিক আঘাত। তবে যে ব্যক্তি নিজের অপরাধীকে কিছু মাফ করে দেয়, সে তার পাপ থেকে মুক্তি পাবে। যারা আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে বিচার করবে না, তারা অবশ্যই জালিম।" —সূরা মায়িদা; ৫:২৫

২০১৭ সালে অ্যাসিড হামলায় আহত একজন ইরানি নারীকে শরিয়া আইন অনুসারে তার আক্রমণকারীকে অ্যাসিড দিয়ে অন্ধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। [৩৮]

প্রয়োগ

[সম্পাদনা]
  • কিছু দেশে খুনের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ করা হয়।
  • নাকাম নামে পরিচিত একটি আধাসামরিক ইহুদি দল ইহুদি গণহত্যায় (হলোকাস্ট) নিহত প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদির প্রতিশোধ নিতে ছয় মিলিয়ন জার্মানকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। [৩৯]

সমালোচনা

[সম্পাদনা]

চোখের বদলে চোখ – পুরো দুনিয়াকেই অন্ধ করে দেয়

[সম্পাদনা]

চোখের বদলে চোখ, পুরো পৃথিবীকেই অন্ধ করে দেয় — এই বিখ্যাত বাক্যটি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। এটি প্রথমে ১৯১৪ সালে জর্জ পেরি গ্রাহাম মৃত্যুদণ্ডবিরোধী বিতর্কে বলেন। [৪০] পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে লুই ফিশার মহাত্মা গান্ধীর দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এটি উল্লেখ করেন। [৪১] একইভাবে ১৯৫৮ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বর্ণবাদী সহিংসতা প্রসঙ্গে এই কথাটি তুলে ধরেন। [৪২]

আরো দেখুন

[সম্পাদনা]
  1. যাত্রাপুস্তক ২১ থেকে: ২২. যদি লোকেরা ঝগড়া করে এবং গর্ভবতী নারীর ক্ষতি করে; ফলে তার গর্ভপাত ঘটে। কিন্তু কোনো মারাত্মক ক্ষতি না হয়, তাহলে অপরাধী অবশ্যই শাস্তি পাবে, যা নারীর স্বামী নির্ধারণ করবে এবং বিচারকদের আদেশ অনুযায়ী জরিমানা প্রদান করবে। ২৩. কিন্তু যদি মারাত্মক ক্ষতি হয়, তাহলে প্রাণের বদলে প্রাণ দিতে হবে। ২৪. চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত, হাতের বদলে হাত, পায়ের বদলে পা। ২৫. দগ্ধ করার বদলে দগ্ধ করা, আঘাতের বদলে আঘাত, চাবুকের বদলে চাবুক। লেবীয় পুস্তক ২৪: ১৯. যদি কেউ তার প্রতিবেশীর দাগ বা ক্ষতি করে, তবে তার সাথেও একই রকম আচরণ করা হবে। ২০.ভাঙ্গনের বদলে ভাঙ্গন, চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত; যেমন সে অন্য কারও ক্ষতি করেছে, তার প্রতিও তেমন করা হবে। দ্বিতীয় বিবরণ ১৯: ২১. তোমার দৃষ্টি দয়ার্দ্র হবে না; প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত, হাতের বদলে হাত, পায়ের বদলে পা দিতে হবে।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. White, Mark D. (২০১৪)। "Lex Talionis"। Encyclopedia of Law and Economics। পৃষ্ঠা 1–2। আইএসবিএন 978-1-4614-7883-6ডিওআই:10.1007/978-1-4614-7883-6_18-1 
  2. Plaut 1981, পৃ. 571ff।
  3. Plaut 1981, পৃ. 572।
  4. Knight, Douglas A; Levine, Amy-Jill (2011). The Meaning of the Bible. New York: Harper Collins. p. 124.আইএসবিএন 978-0-06-112175-3 
  5. Meese III, Edwin; Larkin, Jr., Paul J. (2013). "Reconsidering the Mistake of Law Defense". Journal of Criminal Law and Criminology. 102 (3). 
  6. Hammurabi 1780 BC, §230।
  7. "Lex Talionis: An Ancient Principle Limiting Capital Punishment in Abrahamic Faiths"Abdorrahman Boroumand Center (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-১৪ 
  8. Hammurabi 1780 BC
  9. Johns, Claude Hermann Walter (১৯১১)। "Babylonian Law"। চিসাম, হিউ। ব্রিটিশ বিশ্বকোষ3 (১১তম সংস্করণ)। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা 115–121; see page 120, second para. first sentence। In the criminal law the ruling principle was the lex talionis. Eye for eye, tooth for tooth, limb for limb was the penalty for assault upon an amelu. 
  10. Vlastos, Gregory (১ এপ্রিল ১৯৮৬)। "Socratic rejection of the Lex talionis"। Cornell University Library। 
  11. Exodus 21:30, Numbers 35:31,35:32, 1 Samuel 12:3; see also usage in non-legal contexts in Exodus 30:12, Amos 5:12, Proverbs 6:35,13:8,21:18; Job 33:24,36:18
  12. Lv
  13. Ex
  14. Dt
  15. Lv
  16. Kalimi, Isaac; Haas, Peter J (২০০৬)। Biblical interpretation in Judaism and Christianity। Continuum। পৃষ্ঠা 2। আইএসবিএন 9780567026828 
  17. Pasachoff, Naomi E; Littman, Robert J (২০০৫)। A concise history of the Jewish people। Rowman & Littlefield। পৃষ্ঠা 64। আইএসবিএন 9780742543669 
  18. Bava Kamma, 83b–84a .
  19. "Torah", About Judaism, ou.org .
  20. Dt.
  21. Dt.
  22. Makot, 1:1 .
  23. Bab. Talmud, 2a , based on critical exegesis of Dt
  24. Dt.
  25. Sifrei.
  26. Maimonides, Yad .
  27. Hillel, "Rotze'ach u'Sh'mirat Nefesh", Nezikin, 1:7 .
  28. Dt.
  29. Dt.
  30. Lv.
  31. Ex.
  32. Coogan, Michael D (২০০৯)। A Brief Introduction to the Old Testament: The Hebrew Bible in Its Context। New York: Oxford University Press। পৃষ্ঠা 112। আইএসবিএন 978-0-19-533272-8 
  33. Coogan, Michael D (২০০৯)। A Brief Introduction to the Old Testament: The Hebrew Bible in Its Context। New York: Oxford University Press। পৃষ্ঠা 112। আইএসবিএন 978-0-19-533272-8 
  34. "Roman law: Delict and contract"। Britannica.com। 
  35. Qur'an, V: 45 .
  36. Court orders Iranian man blinded, BBC, ২৮ নভেম্বর ২০০৮ .
  37. "Acid blinding sentence postponed by Iran after international outcry", The Guardian, UK, ১৪ মে ২০১১ .
  38. Moss, Candida (১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। "Justice Is Blind: Why 'An Eye for an Eye' Never Dies In Iran" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  39. "'An eye for an eye': The Jews who sought to poison six million Germans to avenge the Holocaust"Haaretz.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৬ মে ২০২১ 
  40. Official Report of the Debates of the House of Commons of the Dominion of Canada, Third Session-Twelfth Parliament (প্রতিবেদন)। CXIII। Ottawa: Library of Parliament। ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৪। পৃষ্ঠা 496। সংগ্রহের তারিখ ১২ মার্চ ২০২৪If in the present age we were to go back to the old time of 'an eye for an eye and a tooth for a tooth,' there would be very few hon. gentlemen [sic:Honourable Gentlemen] in this House who would not, metaphorically speaking, be blind and toothless. 
  41. Fischer, Louis (জানুয়ারি ১৯৫১)। "Chapter XI – Gandhi Goes to Jail"। The Life of Mahatma Gandhi (পিডিএফ)। London: Lowe & Brydone। পৃষ্ঠা 93। Satyagraha is the exact opposite of the policy of an-eye-for-an-eye-for-an-eye-for-an-eye which ends in making everybody blind. 
  42. King Jr., Martin Luther (১৯৫৮)। Stride Toward Freedom: The Montgomery Story। New York, Evanston, and London: Harper & RowThe old law of an eye for an eye leaves everybody blind. 

উদ্ধৃত সূত্র

[সম্পাদনা]
  • Hammurabi, Code of 1780 BC .
  • Plaut (১৯৮১), The Torah: A Modern Commentary, New York: Union of American Hebrew Congregations .