চিকন (নকশা)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

চিকন হল সাদা মসলিন কাপড়ের উপর এক অতি সূক্ষ্য সূচিকর্ম। অনুমান করা হয় ভারতে প্রথম চিকনের কাজ শুরু হয় ঢাকার মুসলিম নবাবদের আমলে। বর্তমানে চিকন কাজের জন্য লখনৌ শহরের কথা প্রথম মনে আসে বটে , কিন্তু ঢাকা হতেই এই কাজ ক্রমে লখনৌ, দিল্লী, রামপুরে ছড়িয়ে পড়ে। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঢাকায় অতি উৎকৃষ্ট চিকনের কাজ হ'ত। অনুমিত হয় নবাবেরা পারস্য হতে ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। যেহেতু আরব দেশের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল তাই আরব হতে চিকনের ভারতে আসা অসম্ভব নয়।[১] চিকন শব্দটি নানার্থ বোধক। ফারসিতে 'চিকণ'অর্থ সূচিকর্ম; তেলেগুতে 'চিককণি' অর্থে সুন্দর,[২] 'চিকণ গাঁথনে বাড়িল বেলা।'-সূক্ষ্ম,পাতলা(fine) অর্থে,[৩] এছাড়াও সংস্কৃতে 'চিক্কণ', হিন্দিতে 'চিকনা', মারাঠীতে 'চিকণ', গুজরাতীতে 'চিকণু' এবং মৈথিলীতে 'চিকন' অর্থে মসৃণ, স্নিগ্ধ বা চকচকে বোঝায়।[৪]

চিকনের ইতিহাস[সম্পাদনা]

লখনৌ শহরের চিকনের কাজ ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের পুরানো। কথিত আছে প্রখ্যাত চিকন-শিল্পী ফৈয়াজ খাঁ যিনি চিকন শিল্পের উপর উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৬৪-৬৫ সালে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন, তার জনৈক পূর্বপুরুষ ওস্তাদ মহম্মদ শের খাঁ লখনৌ শহরে আগত এক বিদেশী পর্যটক চিকন-শিল্পীর নিকট এই কাজ শেখেন। পরবর্তী কালে অযোধ্যার নবাব মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারে বিয়ে করেন এবং নবাবকে সন্তুষ্ট করতে বেগম নিজে হাতে চিকনের কাজ করা একটি টুপি নবাবকে উপহার দেন। এই ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে হারেমের অন্যান্য বেগমেরাও চিকনের কাজ শুরু করেন । এইভাবে চিকন শিল্পের বহুল প্রচলন ঘটে।[৫]

চিকনের প্রকারভেদ[সম্পাদনা]

চিকনের কাজ ছয় প্রকারের : তয়পচী, খাটোয়া, বুখিয়া, মুড়ী, ফাঁড়া ও জালি । এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর বুখিয়া ; আর সর্বাপেক্ষা সাধারণ তয়পচী । জালি কাজ মাঝারি ধরনের। আবার জালি বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে, যেমন- মাদ্রাজী জালি, সিধুরী, কলকাত্তা জালি ইত্যাদি। একখণ্ড কাপড়ের টানা ও পোড়েন উভয় দিকের সুতো সরিয়ে সূচের সাহায্যে অতি সূক্ষ্ম্য গোলাকৃতি জালি কাটা হয়। এই গোল জালির ব্যাস সাধারণ ৩/১৬ ইঞ্চি হয়ে থাকে। মাদ্রাজী জালি ১/১৬ ইঞ্চি হয়। একটি জালিতে নক্সা ও অপরটি বন্ধ করা- এইভাবে মাদ্রাজী জালি তৈরি করা হয়।[৫]

চিকনের ব্যবহার[সম্পাদনা]

নানা প্রকার পোশাক পরিচ্ছদ- রুমাল, চাদর, শাড়ি, জামা, পাঞ্জাবী, এমন কি টেবিলের ঢাকা বা চায়ের পাত্রের ঢাকা ইত্যাদিতে চিকনের কাজের ব্যবহার প্রচলিত। ঢাকার মসলিনের উপর চিকনের কাজ শাড়িটিকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে। আর এই কাজে স্ত্রী পুরুষ উভয়েই যুক্ত থাকলেও মহিলারাই এ কাজের প্রধান হোতা ।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ভারতকোষ, তৃতীয় খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ , কলিকাতা
  2. The History of Bengali Language by Bijoy Chandra Majumdar
  3. ভারতচন্দ্র-গ্রন্থাবলী। বঙ্গবাসী। ১৩০৯
  4. বঙ্গীয় শব্দকোষ, শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০০১
  5. K. S. Dongerkery, Te Romance Of Indian Embroidery Bombay, 1951; Marg, vol. XVIII, no.2, March. 1964