চালিলাকথ কুঞ্জাহম্মদ হাজি
চালিলাকথ কুঞ্জাহম্মদ হাজি ചാലിലകത്ത് കുഞ്ഞഹമ്മദ് ഹാജി | |
---|---|
জন্ম | ১৮৬৬ |
মৃত্যু | ১৯১৯ |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
অন্যান্য নাম | চল্লিলকথ |
পেশা | ধর্মীয় শিক্ষক, ইসলামি পণ্ডিত |
পরিচিতির কারণ | ইসলামি শিক্ষাবিদ, সুন্নি পণ্ডিত [১] মালাবার মুসলিম সংস্কারক, প্রসিদ্ধ ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম ভাঝাকাদের প্রতিষ্ঠাতা |
চালিলাকথ কুঞ্জাহম্মদ হাজি (১৮৬৬-১৯১৯) ছিলেন একজন মালয়ালি সুন্নি ইসলামি পণ্ডিত[২] ও ইসলামী শিক্ষাবিদ।[৩] তিনি দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যে প্রাচীনপন্থী ইসলামের সংস্কারক[৪] এবং রাজ্যে নতুন মাদ্রাসা ব্যবস্থার জনক হিসেবে পরিচিত।[২] তার সংস্কারমূলক কাজের জন্য তিনি কেরলের স্যার সৈয়দ আহমদ নামে পরিচিত।[৫] তিনি আরবি মালয়ালম লিপির একজন অন্যতম সংস্কারক হিসেবে প্রসিদ্ধ। [২] [৬] কেরলে মুসলিম সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি দারুল উলুম ভাঝাকদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৭][৮][৯][১০]
প্রাথমিক জীবন
[সম্পাদনা]তিনি ১৮৬৬ সালে (হিজরি ১২৬৭) ভারতের কেরালার আদ্রিশেরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল কালা মুহিয়াদ্দিন কুট্টি ও মাতা ছিলেন ফাতিমা, যিনি চল্লিলকথ কুসসাই হাজির কন্যা ছিলেন এবং কুসসাই হাজি ছিলেন বিখ্যাত ইসলামি নেতা সাইয়্যিদ আলাভি সানগালের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।[৪]
শৈশবেই তার মাতা-পিতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ফলে তিনি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। তাকে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে ধর্মীয় পরিবেশে তার মা ও মামারা লালন-পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি তার মায়ের পারিবারিক নাম যুক্ত করে ‘চল্লিলকথ কুঞ্জাহম্মদ মুসলিয়ার’ নামে পরিচিত হন। তার নামের তিনিটি সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে: ‘সি.এইচ’, ‘এম.সি.সি’ ও ‘সি.এ’। ‘এম.সি.সি’ নামটি তার মাতৃ ও পিতৃ সম্পর্ক বোঝাতে ব্যবহৃত হয় (মুথাট, কালা, চল্লিলকথ)। পরবর্তীকালে তার সন্তানদেরও ‘এম.সি.সি ভ্রাতা’ নামে ডাকা হতো। [৪]
শিক্ষাজীবন
[সম্পাদনা]চলিলকথ হাজি নিজের প্রাথমিক শিক্ষা কুরআনের তাজবিদ (কুরআন তিলাওয়াতের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও আরবি উচ্চারণ শাস্ত্র) দিয়ে শুরু করেন। তিনি নিজের মায়ের কাছ থেকেই এই বিষয়ে গ্রহণ করেন। তার মা ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ও বিদুষী মহিলা। উচ্চশিক্ষার বয়স হলে তার মা তাকে পড়াশোনার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন। তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই ধর্মীয় জ্ঞানচর্চায় পারদর্শী ছিলেন। যদিও সে সময়ের মুসলিম উলামাগণ ব্রিটিশ বিরোধী ফতোয়া জারি করে ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে কোনো শিক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তবুও তার ভাই কুটিয়াম্মা সাহেব তাকে ক্যালিকাটের একটি স্কুলে ভর্তি করান। সেখানে তিনি মালায়ালাম, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শেখেন। [১১]
এরপর তিনি কোডানচেরির আহমদ কুট্টির তত্ত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহণ আরম্ভ করেন, যিনি মক্কার মুফতি আহমদ জাইনির শিষ্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি তিরুরাঙ্গাদির আম্মু মুসলিয়ারের কাছ থেকেও আত্মিক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তিনি কালিকটের ‘মাকাদী মসজিদ' ও ‘তিরুরাথাঙ্গুর’ মসজিদে পড়াশোনা করেন এবং তিনি সেখানে বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত আবদুল আজিজ মুসলিয়ারের শিষ্য হন। আবদুল আজিজ মুসলিয়ার ‘বাদর মাওলুদের’ (বাদর যোদ্ধাদের জীবনী) রচয়িতা ছিলেন এবং কেরালার ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। এরপরে তিনি বাকিয়াথ আরবিক কলেজে ভর্তি হন, যেখানে তিনি যুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন ও জ্যামিতিতে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি ফিকহ (ইসলামী আইন) ও সুন্নাহ (হাদিস সম্পর্কিত জ্ঞান) বিষয়ে বিশেষ খুবই পারদর্শী ছিলেন। [১১]
পরে তিনি আরেকটি বিখ্যাত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান লতফিয়া আরবিক কলেজে ভর্তি হন, যা তামিলনাড়ুর ভেলোরে অবস্থিত। সেখানে থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি আব্দুল হালিমর অধীনে জ্যোতির্বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। তামিলনাড়ুতে অবস্থানকালে তিনি উর্দু, পার্সি (ফারসি) ও তামিল ভাষাও শেখেন। [১১]
রচনাবলী
[সম্পাদনা]চালিলাকাথ হাজির সংস্কার শুধু ধর্মোপদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি একই সাথে তাঁর কর্মের মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে একাধিক বই রচনা করেছেন; যেমন তাঁর প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের জন্য উদ্দীপক গ্রন্থ ও সংস্কারক পণ্ডিতদের জন্য অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। [১২]
চলিলকাঠের কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা
[সম্পাদনা]ক্রমিক | বাংলা নাম | আসল নাম | শিরোনামের অর্থ | মূল বিষয় |
---|---|---|---|---|
১ | হাশিয়াহ আলা রিসালা মুরাদাইন | حاشية على رسالة المرادين | রিসালাতুল মুরাদাইনের টীকা | জ্যোতিষশাস্ত্রে আহমেদ হালিম কর্তৃক রচিত গ্রন্থের উপর টীকা |
২ | তুফাতুল আদাব | تحفة الاداب | পদ্ধতির উপস্থাপনা | আচরণ ও পদ্ধতি |
৩ | তাসহিলুল আযনিল ইকওয়ান ফি থালিমি সাবানি হিন্দুথান | تسهيل الاذهان الاخوان في تعليم زبانالهندوستان | ভারতীয় ভাষা অধ্যয়নের জন্য মনকে সরলীকরণ | ব্যাকরণ ও ভাষার বই |
৪ | আদ্দওয়াহ ফি কিবলা | الدعوة في القبلة | কিবলায় যুক্তি | কিবলার সঠিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে ফিকহি আলোচনা |
৫ | কিতাবুল হিসাব ফি ইলমিল মীকাত | كتاب الحساب في علم الميقات | সময়ের গাণিতিক জ্ঞান | জ্যোতিষশাস্ত্র |
৬ | কিতাবুস সরফ | كتاب الصرف | রূপবিদ্যা | আরবি ব্যাকরণ |
৭ | আন্নাহুল কবির | النحو الكبير | বড় ব্যাকরণ | আরবি ব্যাকরণ |
৮ | মাদারুল কিরাআহ | مدار القراءة | তেলাওয়াতের ভিত্তি | কুরআন তেলাওয়াতের বিধান |
৯ | আল-লুগাতুল আরবিয়া | اللغة العربية | আরবি ভাষা | আরবি ভাষা |
১০ | আদ্দিনিয়াত | الدينيات | ধর্ম-সম্পর্কিত বিষয়াদি | ইসলামি বিশ্বাস |
১১ | আল-আমালিয়াত | العمليات | কাজকর্ম | আচরণ |
১২ | তা'লিমুল কুরআন | تعليم القران | কুরআন সম্পর্কে অধ্যয়ন | কুরআনের উপর টীকা |
১৩ | সুরতুল হুরুফ | صورة الحروف | শব্দের ছবি | কুরআনের শব্দের ব্যাখ্যা |
১৪ | আত্তাহদিতুল বালিগা ফি খতা দাওয়াবেরিতুল ফিরকাতুল কাদিয়ানিয়া | التحدية البليغة في خطإ دوابرة الفرقة القاديانية | কাদিয়ানী গ্রুপের ভুলের উপর কঠোর সতর্কীকরণ | কাদিয়ানী মতবাদের উপর খণ্ডন |
১৫ | তুহফাতুল আক্বতাব | تحفة الاقطاب | দিগন্ত উপস্থাপনা | আইনুল কিবলা বিতর্ক সম্পর্কে তার যুক্তি |
১৬ | তাহসিলুল ফুরুক | تحصيل الفروق | বিভিন্ন অর্জন | আরবি মালায়ালাম |
রিসালাতুল মুরাদাইনের ব্যাখ্যায় তিনি স্থানীয় ভারতীয় ও বিদেশী আলেমগণের রায় সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। ম্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা তার শিষ্য সুলাইমান এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন। বর্তমান আত্তদাহদিয়াতুল বালেগা ফি খতা দাওয়াবেরিল ফিরকাতুল কাদিয়ানিয়ার মতো তার মাত্র কয়েকটি কাজ টিকে আছে।
শিক্ষাদান
[সম্পাদনা]জ্ঞান অর্জনের পর চালিলাকথ শিক্ষাক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন, যেন তিনি তার অর্জিত বিদ্যা অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে পারেন। তাকে লতিফিয়া আরবি কলেজে শিক্ষকতার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরিবর্তে, তিনি "থারাম্মাল মসজিদে" (যার আক্ষরিক অর্থ: খেজুর পাতায় ছাওয়া মসজিদ) শিক্ষাদান শুরু করেন। পরে তিনি মায়্যাজি, ভেলাপট্টনম, পুলিক্কাল, ভাঝাক্কাদ ও মান্নারক্কাডের মতো বিভিন্ন স্থানে পাঠদান করেন।[১২]
দারুল উলূম
[সম্পাদনা]১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে কায়াপ্পাথোথি পরিবারের সহায়তায় ভাঝাকদে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি প্রতিষ্ঠান, যার নাম ছিল "তানমিয়াতুল উলূম"। চালিলাকথ এই প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তন করে "দারুল উলূম" রাখেন। তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি বিশিষ্ট মর্যাদা লাভ করে এবং তা কেরালার ইসলামি মাদ্রাসাগুলোর কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিতি পায়। তিনি প্রতিষ্ঠানে একাধিক সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং পার্থিব জ্ঞানের পাঠদানে উৎসাহ প্রদান করেন।[১৩] এই প্রতিষ্ঠানে তার জীবনের কিছু বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছিল; যেমন কিবলা নির্ধারণ সংক্রান্ত ইস্যু, মাদ্রাসা সংস্কার আন্দোলন ও আরবি-মালয়ালম লিপির সংস্কার ইত্যাদি।
শিষ্যবৃন্দ
[সম্পাদনা]চালিলাকথ হাজি কেবল তাঁর গুণী শিক্ষকদের দ্বারাই সম্মানিত হননি, বরং তাঁর নিজস্ব সাহিত্যকর্ম ও ধার্মিক শিষ্যদের মাধ্যমেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি নিজেকে কঠোর অনুশীলনে প্রবৃত্ত করে শিক্ষকদের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেছিলেনন। ফলস্বরূপ তিনি কেরলের একজন দীপ্তিমান নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।[১২]
দারসের (শিক্ষাদান) স্থানসমূহ
[সম্পাদনা]তিনি তিরুরাঙ্গাডি, মায়্যাজি, ভেলাপট্টনম, পুলিক্কাল, মান্নারক্কাড, ভাঝাক্কাদ, থারাম্মাল ও নাল্লানামে ধর্মীয় দারস প্রদান করেছিলেন। [১২]
প্রধান শিষ্যগণ
[সম্পাদনা]- চালিলাকথ মুহাম্মদ হাজী
- কুতুবি মুহাম্মদ মুসলিয়ার
- চেরুশেরি আহমদ কুট্টি মুসলিয়ার
- কাট্টিপা রুথির মোহিয়াদ্দিন
- আন্দাথোড কুনাহম্মদ মুসলিয়ার
- আমানত হাসান মুসলিয়ার
- চেরুরের প্রবীণ আহমদ মুসলিয়ার
- পি.পি উন্নি মোহিয়াদ্দিন কুট্টি মুসলিয়ার
- এম.সি.সি আহমদ মাওলভী
- এম.সি.সি আবদুর রহমান মাওলভী
- ই.কে মোহিয়াদ্দিন মাওলভী
কিবলা নির্ধারণ বিতর্ক
[সম্পাদনা]আইনুল কিবলা বিতর্ক কেরলের ইসলামি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে তিনি সাহসিকতার সাথে নিজের অবস্থান প্রকাশ করেন। মায়্যাজিতে তার শিক্ষাদান শেষ করার পর তিনি কয়ারকুট্টি সাহেবের অনুপ্রেরণায়—যিনি ধার্মিক ব্যক্তি, আধ্যাত্মিক ইসলামি পণ্ডিত ও হাজির বিশিষ্ট শিষ্য ছিলেন—পুলিক্কাল গমন করেন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি নিজের শিক্ষক আহমদ আলীফ রচিত রিসালাতুল মুরাদাইন গ্রন্থের আলোকে কিবলার দিক নিরীক্ষা করেন।[৩]
সাবলীল অনুসন্ধানের মাধ্যমে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, সংশ্লিষ্ট মসজিদটির ভিত্তি সঠিক কিবলার দিকে স্থাপিত হয়নি। এরপর তিনি তার কিছু ছাত্রকে অন্যান্য মসজিদগুলোর কিবলার দিকও পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দেন। তারাও গভীর অনুসন্ধানের পর একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। ঘটনাটি কেরলে মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে দুইটি ভিন্ন মতাদর্শের উদ্ভব ঘটায়: একদল বলে, নামাজ আদায়ের জন্য কিবলার সঠিক দিকের দিকে মুখ করা আবশ্যক নয়; পশ্চিম দিকে (কেরলের জন্য) মোটামুটি চেহারা করলেই যথেষ্ট। অপরদিকে হাজি ও তার সমমনা পণ্ডিতরা দৃঢ়ভাবে মত প্রকাশ করেন যে, ক্যালিকট (কোঝিকোড) অঞ্চল থেকে নামাজের জন্য মুখ ২২° দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঘুরাতে হবে; তা না হলে নামাজ বাতিল বলে বিবেচিত হবে।[৪]
এই সমস্যা কেন্দ্র করে ১৯০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিক্কালে দুই দলীয় উলামাদের মধ্যে এক বিখ্যাত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়, যা কেরলের ইসলামি ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে ওঠে। কয়ারকুট্টিও–যিনি নিজেই চালিলাকথকে পুলিক্কালে আমন্ত্রণ করেন–পরে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কল্লোলি আহমদ কুট্টি মুসলিয়ার, ইউসুফ মুসলিয়ার ও থাট্টানকারার কুট্টি আহমদ মুসলিয়ারের মতো ধার্মিক নেতারাও তার বিরোধিতা করেন। তবে কাসারগোড়ের ধর্মীয় কাজি আব্দুল্লাহ মাওলভী ও হাজী সাহেবের অন্যান্য শিষ্যরা তার পক্ষে দৃঢ় সমর্থন প্রদান করেন। এই স্মরণীয় ঘটনাটি ইতিহাসে আইনুল কিবলা বিতর্ক শিরোনামে পরিচিত হয়। নিজের মতাদর্শের পক্ষে প্রমাণ হাজির করতে চালিলাকথ হাজী দু'টি গ্রন্থ রচনা করেন: আল জাহাব ইলা আইনিল কিবলা ও তুহফাতুল আকতাব।
আরবি-মালয়ালম লিপি সংস্কার
[সম্পাদনা]দারুল উলূমে ১৯০৯ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষা দান করার পর চালিলাকথ সাইয়্যেদ ইম্বিচা কোয়ার আমন্ত্রণে ভেলাপট্টনমে যান। নাল্লাথে অবস্থানকালে কেরলের সর্বত্র এক শিক্ষাবিপ্লব শুরু হয় এবং তিনি অনুভব করেন যে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক পড়ার সুবিধার্থে আরবি-মালয়ালম লিপির সংস্কার প্রয়োজন। তখন তিনি ছাত্রদের সমসাময়িক পাঠ সহজ করার জন্য ও পূর্বসূরি সংস্কারক সাইয়্যেদ সানাউল্লা মাকতী থাঙ্গালের (১৮৪৭–১৯৩২ খ্রি.) কিছু ভুল সংশোধনের উদ্দেশে আরবি-মালয়ালম লিপি সংস্কারের কাজ শুরু করেন। তার আগে সানাউল্লা মাকতী থাঙ্গাল, সুলেমান মুসলিয়ার এবং মুহাম্মদ আবদুল কাদের মাওলভীর (১৮৭৩–১৯৩২) মত বিদ্বানগণও লিপি সংস্কারের চেষ্টা করেছিলেন। তবে আরবি-মালয়ালম লিপি সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও সুপরিচিত অবদান চালিলাকথ হাজিরই ছিল। কেরলাবাসী সর্বসম্মতভাবে তার সংস্কারকে গ্রহণ করে তাকে আরবি-মালয়ালম লিপির প্রধান সংস্কারক হিসেবে সম্মানিত করে।[১৪]
মুহাম্মদ আব্দুল করিম উল্লেখ করেছেন, হিজরি ১১৩৭ সালে চালিলাকথ হাজী লিপি সংস্কারের লক্ষ্য স্থির করেন এবং পরে এ সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম ছিল তাসহীলুল ফারুক। এই গ্রন্থটি হিজরি ১৩১২ সনে মালহারুল মুহিম্মাত প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়।
মাদরাসা আন্দোলন
[সম্পাদনা]ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেন যে, কেরলের মুসলিমরা তিনটি প্রধান মাধ্যমে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করতেন: ধারাবাহিক ধর্মীয় ভাষণ (খুতবা বা ওয়াজের মাধ্যমে); মসজিদভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষার পর উচ্চতর পড়াশোনা চলত; মাদরাসা-শৈলী শিক্ষা, যা হলো আধুনিক বিদ্যালয়ের অনুরূপ একটি ব্যবস্থা। প্রাচীন কেরালায় মুসলিমরা সাধারণত পন্নানি পদ্ধতি অনুসরণ করে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করত। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা উদ্ভবের মাধ্যমে পদ্ধতিটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে থাকে। শুরুতে স্থামীয় আলেমদের মাঝে এক ধরনের অস্বস্তি ও বৈষম্যমূলক অনুভূতি দেখা দিলেও ১৯১৩ সালের ১ জানুয়ারি চালিলাকথ হাজি দারুল উলূমের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনেন। কয়ার্পাত্তটি মুহিউদ্দীন কুট্টি হাজীর সহায়তায় দারুল উলূমের শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি নতুনভাবে গড়ে তোলেন। তিনি যে সংস্কারমূলক ব্যবস্থা চালু করেন, তা কেবল দারুল উলূমের জন্যই নয়, বরং কেরলের ইসলামি শিক্ষায় এক অনন্য ও যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসাবে বিবেচিত হয়।[১২]
দারুল উলূমের নতুন নিয়ম ও শিক্ষা ব্যবস্থা
[সম্পাদনা]তিনি দারুল উলূমের জন্য একটি নতুন পাঠ্যক্রম ও পাঠসূচি প্রণয়ন করেন, যাতে ধর্মীয় শিক্ষাকে আরও শক্তিশালী করা যায়। তিনি তাফসির, হাদিস, ফিকহ, মান্তিক (যুক্তিবিদ্যা), হিসাব (গণিত), তারিখ (ইতিহাস), ভূগোল, হায়াত (জ্যোতির্বিদ্যা), হানদাসা (জ্যামিতি), মু'নাযারা (বিতর্কশাস্ত্র), সরফ ও নাহু ( আরবি ব্যাকরণ) ইত্যাদি বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দেন। আরবি ভাষায় বক্তৃতা ও লিখনী দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তিনি শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করেন। পাশাপাশি তিনি মালয়ালম থেকে আরবি অনুবাদের অনুশীলন করতেও উদ্বুদ্ধ করেন।
পাঠ্যসূচির সাথে তিনি নিয়মিত উপস্থিতি যাচাইয়ের জন্য উপস্থিতি রেজিস্টার চালু করেন এবং ছুটির ব্যবস্থা করেন। দারুল উলূমে তিনি একটি লাইব্রেরি স্থাপন করেন, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে সেখানে পড়াশোনা করতে পারে। সমস্ত ধরণের শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের জন্যও তিনি উৎসাহ প্রদান করেন। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের ভাষাগত সমস্যা দূর করার জন্য তিনি মালয়ালম ব্যাকরণ পাঠেরও ব্যবস্থা করেন।[১২]
মৃত্যু
[সম্পাদনা]চালিলাকাথ জীবনের শেষ সময়ে মানারক্কাদ মসজিদে কাজ করার জন্য কল্লাডি মইদু কুট্টি সাহেবের কথায় উৎসাহিত হন। মইদু কুট্টি তাঁকে শারীরিক ও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর থেকে চালিলাকথ হাজী মানারক্কাদ মসজিদে অবিরাম কাজ করে যান এবং মসজিদটির সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে ১৩৩৮ হিজরি সালের সফর মাসের ৫ তারিখে (১৯১৯ খ্রি., শনিবার) তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পর মরদেহ বলগাড়িতে করে মানারক্কাদ থেকে তার জন্মভূমি তিরুরাঙ্গাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাকে তার চাচা আলী হাসান সাহেবের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে তার কবর তিরুরাঙ্গাড়ির থারাম্মাল মসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত। তার মৃত্যুর পর, তার কবরের সামনে ৪০ দিন পর্যন্ত পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা হয়।[১২]
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ কেরলে তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বই পড়ার ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা দূর করার উদ্দেশ্যে আরবি-মালয়ালম লিপির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তিনি তার শিক্ষার্থীদের সমসাময়িক বিষয় পড়ার অসুবিধা দূর করতে এবং সেইসঙ্গে সৈয়দ সানাউল্লা মক্তি সানগালের দ্বারা সংঘটিত কিছু ভুল সংশোধন করতে আরবি-মালয়ালম লিপির সংস্কার শুরু করেন। সৈয়দ সানাউল্লা মক্তি সানগাল (১৮৪৭–১৯৩২), আলাপ্পুঝার সুলাইমান মুসলিয়ার ও ভাক্কমের মোহাম্মদ আবদুল খাদির মৌলভিসহ (১৮৭৩-১৯৩২) আরও অনেকে আরবি-মালয়ালম লিপির সংস্কারের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। তবে এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ সংস্কার চল্লিলকথ কুঞ্জাহম্মদ হাজিরই ছিল। কারণ কেরালাবাসীরাই তার সংস্কারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং তাকে আরবি-মালয়ালম লিপির সংস্কারক হিসেবে অভিহিত করেছিল। মুহাম্মদ আবদুল করিম বলেন, হিজরি ১১৩৭ সালে চল্লিলকথ এই সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্য স্থির করেন। তিনি এটি একটি বইয়ে লিখে নাম দেন 'তাসহীল উল ফারুক'। এটি ১৩১২ হিজরিতে 'মালহারুল মুহিম্মাথ'-এ মুদ্রিত হয়েছিল।
- ↑ ক খ গ U. Muhammed (২০০৭)। Educational Empowerment of Kerala Muslims: A Socio-historical Perspective। পৃষ্ঠা 33। আইএসবিএন 9788190388733। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০২০।
- ↑ ক খ Abdul Razack P P। Colonialism and community formation in malabar a study of muslims of malabar (পিডিএফ)। পৃষ্ঠা 114। সংগ্রহের তারিখ ১১ নভেম্বর ২০১৯।
- ↑ ক খ গ ঘ Abdul Rehman H। Vakkom Moulavi and the Renaissance Movement among the Muslims। University of Kerala-Shodhganga। পৃষ্ঠা 257। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০২০।
- ↑ Muhammed Rafeeq, T। Development of Islamic movement in Kerala in modern times (পিডিএফ)। পৃষ্ঠা 3। সংগ্রহের তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০১৯।
- ↑ M. Usman। "Chapter 4"। The role of voluntary agencies in human resource development a case study of orphanages in Malappuram district (পিডিএফ)। University of Calicut-Shodhganga। পৃষ্ঠা 109। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ Journal of Kerala studies Volume 9 University of Kerala - 1982 - Page 84 Chalilakath Kunhahammad Haji is rightly called the father of modern Arabic Madrasas and Arabic Colleges in Kerala. Vakkam Abdul Qadir Moulavi and his Reforms While the Islamic educational reforms of Moulana Chalilakath ..."
- ↑ U. Muhammed (২০০৭)। Educational Empowerment of Kerala Muslims: A Socio-historical Perspective। পৃষ্ঠা 33। আইএসবিএন 9788190388733। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০২০।
In the field of Madrasa reformation in Kerala, the name of Moulana Chalilakath Kunhahamed Haji (d. AD 1919) can never be forgotten. His experiments centred round Darul Uloom of Vazhakkad.This institution was originally established in ...
- ↑ Yōgīndar Sikand - Bastions of the Believers: Madrasas And Islamic Education in India 2005- Page 124 "in Kerala, and one of their aims was the reform of the Islamic education system. One of the pioneers in the field of Islamic educational reform in Kerala was Moulavi Chalilakath Mun Muhammad Haj i. In 1909 he was appointed headmaster of ..."
- ↑ M. Usman। "Chapter 4"। The role of voluntary agencies in human resource development a case study of orphanages in Malappuram district (পিডিএফ)। University of Calicut-Shodhganga। পৃষ্ঠা 109। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ ক খ গ "Official Website of MALIK DEENAR Islamic ACADEMY"। ২০১৩-০৯-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-১১-২৩।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ "ചാലിലകത്ത് കുഞ്ഞഹമ്മദ് ഹാജി"। ചാലിലകത്ത് കുഞ്ഞഹമ്മദ് ഹാജി | Islam Kavadam (মালায়ালাম ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৪-২৯।
- ↑ U. Muhammed (২০০৭)। Educational Empowerment of Kerala Muslims: A Socio-historical Perspective। পৃষ্ঠা 59। আইএসবিএন 9788190388733। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০২০।
The name of this eminent educationist and reformer will always be remembered with respect in the history of Muslim education in Kerala. He revolutionized the stereotyped, traditional Dars system that was in vogue at his time and introduced new methods and techniques in the teaching of Arabic, Quran, traditions and Islamic History. Unlike the orthodox Ulama he encouraged his students to read newspapers and literary works by reputed authors which made them conversant in current topics.
- ↑ "Official Website of MALIK DEENAR Islamic ACADEMY"। ২০১৩-০৯-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-১১-২৩।