গোপিকাবাই

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

গোপিকাবাই (ডিসেম্বর ২০, ১৭২৪ - ১১ আগস্ট, ১৭৭৮)[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ছিলেন মারাঠা সাম্রাজ্যের পেশোয়াইন (পেশোয়ার পত্নী)। মারাঠা ইতিহাসে তিনি পেশোয়া বালাজি বাজি রাওয়ের (নানাসাহেব পেশোয়া নামেও পরিচিত) স্ত্রী হিসেবে পরিচিত। কঠোর গোঁড়া ধর্মীয় মানসিকতার মধ্যে তার লালনপালন হয়েছিল যা তার মনে কঠোর ধর্মীয় মনোভাবের বীজ বপন করে। নানাসাহেব পেশোয়া মৃত্যুর পর, তিনি পেশোয়ার সাম্রাজ্য এবং প্রশাসনের উপর তার ক্ষমতা প্রসারিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নিজের ছেলে মাধব রাও পেশোয়াকে প্রভাবিত করেছিলেন, এবং মাধব রাও তার অনুরোধে রঘুনাথ রাও -কে অগ্রাহ্য করে রাজ্যের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। প্রশাসনিক বিষয়ে অনধিকার হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করার পরে, বিশেষতঃ তার ভাইকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, শাস্তিস্বরূপ তাকে নাসিকে বন্দি করা হয়। ১৭৭৩ সালে মাধবরাওয়ের মৃত্যুর পর তিনি মুক্ত হন এবং পুনে ফিরে যান। পরে, গোপিকাবাই মারাঠা সাম্রাজ্যের পুরোহিত শ্রেণীর অংশ হয়ে ওঠেন। তিনি পেশোয়া পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন মারাঠা সাম্রাজ্যের পুরুষানুক্রমে পদপ্রাপ্ত তিন পেশোয়ার মাতা।

বাল্যজীবন[সম্পাদনা]

গোপিকাবাই ছিলেন পুনের নিকটবর্তী ওয়াই অঞ্চলের অধিবাসী ভিকাজি নায়েক রাস্তের কন্যা। পেশওয়া বাজি রাও প্রথমের মা রাধাবাই যখন রাস্তে পরিবারে অতিথি হিসাবে গমন করেছিলেন তখনই তিনি প্রথম গোপিকাবাইকে লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি গোপিকাবাইয়ের ধর্মীয় উপবাস ও আচার-অনুষ্ঠান পালনে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং নিজের সন্তান বাজি রাও প্রথমের বড় ছেলে অর্থাৎ তার নাতি বালাজি বাজিরাও (নানাসাহেব) -এর হবু পত্নি হিসাবে তাকে চয়ন করেন। গোপিকাবাই সমস্ত ধর্মীয় বিষয়ে এবং পুরোহিত ব্রাহ্মণ পরিবারে প্রচলিত রীতিনীতিতে পারদর্শী ছিলেন। ১১ জানুয়ারী ১৭৩০ খ্রীস্টব্দে নানাসাহেবের সাথে তার বিবাহ হয়।[১][২] তখন গোপিকাবাইয়ের বয়স ছিল ৬ বছর এবং নানাসাহেবের বয়স ছিল ১০ বছর।

বিবাহ পরবর্তী জীবন[সম্পাদনা]

গোপিকাবাই তার পরবর্তী জীবনে গুরুতর অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন কারণ তিনি আদালতের প্রশাসনিক বা সামরিক বিষয়গুলি পরিচালনা করার জন্য কখনই সঠিক প্রশিক্ষণ পাননি। তার গোঁড়া ধর্মীয় লালন-পালন তার উদ্ধত আচরণ এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রধান কারণ বলে মনে করা হয় এবং সেই কারনে তিনি নিজের জীবনে অনেক অযাচিত কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেমন নিজের দ্বিতীয় পুত্র মাধবরাওয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ইত্যাদি। গোপিকাবাই শাহু এবং নানাসাহেবের পেশোয়া দরবারের রাজনীতি বুঝতে অক্ষম ছিলেন এবং তার অন্যতম কারন হল তার গোঁড়া ধর্মীয় লালন-পালন ও মানসিকতা।

তার স্বামী পেশোয়া হওয়ার পর, গোপিকাবাই পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের সাথে সখ্যতা করতে অক্ষম হন এবং তার খুড়তুতো বোন আনন্দীবাই, যিনি পেশোয়ার ভাই রঘুনাথরাওয়ের স্ত্রী ছিলেন, তার সাথে শত্রুতা গড়ে তোলেন। পেশোয়ার খুড়তুতো ভাই সদাশিব রাও -এর স্ত্রী পার্বতীবাই এবং গোপিকাবাইয়ের মধ্যেও বিরোধ দেখা দেয়, যখন শাহু এবং নানাসাহেব পেশোয়া তার বড় ছেলে বিশ্বাস রাও -এর সংগে বিয়ে দেওয়ার জন্য পার্বতীবাইয়ের ভাইঝি রাধিকাবাইকে বেছে নিয়েছিলেন। গোপিকাবাই সদাশিব রাও এর সাথে বিশ্বাস রাওকে আবদালির বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানোর জন্য জোর দিয়েছিলেন কারণ তিনি চান নি যে আবদালিকে পরাজিত করার পর ভাওসাহেব (সদাশিব রাও) সমস্ত প্রশংসার ভাগী হোক এবং বিশ্বাস রাও ও যেন কৃতিত্বের সিংহভাগ অংশীদারী পায়। বিশ্বাস রাও যাতে নানাসাহেবের পর পরবর্তী পেশোয়া হন তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি এটি করেছিলেন। তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে নানাসাহেব ভাওসাহেবকে পরবর্তী পেশোয়া বানানোর পরিকল্পনা করছেন।[৩]

গোপিকাবাই পার্বতীবাইয়ের বোন রাধিকাবাইকে অপয়া সাব্যস্ত করে দোষারোপ করেছিলেন এবং পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সময় নিজের ছেলে বিশ্বাস রাও-এর মৃত্যুর কারণ হিসাবে তাকে দায়ী করেছিলেন। মানসিক সমর্থন দেওয়ার পরিবর্তে, গোপিকাবাই ক্রমাগত নানাসাহেবকে তার ছেলের মৃত্যুর জন্য দোষ দিতেন যার ফলে নানাসাহেব ক্রমাগত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও তার মৃত্যু হয়।

মাধবরাওয়ের উত্থান ও রাজত্ব[সম্পাদনা]

নানাসাহেবের মৃত্যুর পর পরবর্তী পেশোয়া নিয়োগ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ছত্রপতি সাহুর মৃত্যুর পর পেশোয়া পদটি বংশপরম্পরাগত হয়ে উঠেছিল। গোপিকাবাই, তার ভাইয়ের পরামর্শে, প্রশাসনিক বিষয়ে নিজেকে জড়িত করার চেষ্টা করেছিলেন। যেহেতু নানাসাহেবের প্রথম পুত্র এবং আইনি উত্তরাধিকারী বিশ্বাস রাও ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছিলেন, তাই নানাসাহেবের দ্বিতীয় পুত্র, মাধবরাও এবং নানাসাহেবের ছোট ভাই রঘুনাথরাও এইসকল দাবীদারদের মধ্যে কে পেশোয়া পদে আরোহণ করবেন তা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। রঘুনাথরাও-এর স্ত্রী আনন্দীবাইয়ের সঙ্গে গোপিকাবাইয়ের তিক্ত সম্পর্ক এই বিরোধে আরও ইন্ধন দেয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে রঘুনাথরাওয়ের ছত্রছায়ায় মাধবরাও পেশোয়া পদে আরোহণ করবেন। এই সিদ্ধান্তটি গোপিকাবাইয়ের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল যিনি তার ছেলের পেশোয়া পদে আরোহনের পর শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপুর্ন নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার আশা করেছিলেন কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পর তার উদ্দেশ্য সাধনের একমাত্র রাস্তা ছিল রঘুনাথরাওয়ের সাথে সন্ধি করা, যিনি তার স্ত্রী ও চিরশত্রু আনন্দীবাইয়ের শক্তিশালী প্রভাবের অধীনে ছিলেন। প্রসাশনিক কাজে গোপিকাবাইয়ের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব ছিল যার জন্য তিনি বেশিরভাগ সময়ে দরবারীদের কাছ থেকে দুর্বল ও ভুল পরামর্শ গ্রহন করতেন যা তার ছেলের সাথে তার সম্পর্ক নষ্ট করে। গোপিকাবাইয়ের ভাই সর্দা‌র রাস্তে, যিনি একজন প্রভাবশালী মহাজন হয়েছিলেন, তার সাহায্যে তিনি তার ছেলে মাধবরাও পেশওয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন।

মাধবরাও পেশওয়া প্রশাসনিক বিষয়ে সক্রিয় অংশ নিতে শুরু করেন এবং বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। গোপিকাবাই তাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে এবং তার প্রশাসনিক কাজে রঘুনাথরাওয়ের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে পরামর্শ দেন। সেইসময় রঘুনাথরাওয়ের পক্ষ থেকে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত প্রশাসনে ব্যাপক ফাটল সৃষ্টি করে। রঘুনাথরাওয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে পুনে আক্রমণের সময় সর্দার রাস্তে হায়দ্রাবাদের নিজাম এবং নাগপুরের ভোঁসলের সহযোগিতা করেছিলেন।

নাসিকে বন্দিদশা[সম্পাদনা]

রঘুনাথরাওকে অগ্রাহ্য করে মাধবরাও পেশোয়া প্রশাসনের উপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জারি করেন। তার প্রথম কাজগুলির মধ্যে একটি ছিল নিজামকে যারা সহায়তা করেছিল তাদের শাস্তি দেওয়া, যাদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন সর্দা‌র রাস্তে। গোপিকাবাই, যিনি তার ভাইয়ের জন্য করুণার আবেদন করেছিলেন, তাকে এই ধরনের কাজের পরিণতি সম্পর্কে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয় এবং প্রশাসনিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু পুনরায় তিনি যখন জেদ করেন, তখন তিনি শাস্তিস্বরূপ নাসিকে বন্দিদশা প্রাপ্ত হন। গোপিকাবাই নাসিকে থেকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে দিন যাপন করতে থাকেন এবং মাধবরাওয়ের মৃত্যু অবধি সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। ১৭৭৩ সালে যক্ষ্মা রোগে মাধবরাওয়ের মৃত্যু হয়। মাধবরাও উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান, রঘুনাথরাও আবার আনন্দীবাইয়ের পীড়াপীড়িতে পেশোয়া প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের দাবি করেন।

পুনেতে পুনরায় আগমন[সম্পাদনা]

গোপিকাবাইয়ের তৃতীয় পুত্র নারায়ণরাও পেশোয়া নিযুক্ত হন। পেশোয়া পদে নারায়ণরাওয়ের নিয়োগের পর, গোপিকাবাই পুনে ফিরে আসেন এবং আবার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। এই সময়ে, গোপিকাবাই নিজেকে ক্রমবর্ধমানভাবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে জড়িত করতে থাকেন। তখন সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি তুংগে ছিল এবং ধর্মীয় আচার পালনের জন্য বিশাল আর্থিক অনুদান দেওয়া হত। পুরোহিত শ্রেণী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত ছিল। আর্থিক ঋণের কারনে নারায়ণরাওয়ের প্রশাসন দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। এইসকল কারন এবং রঘুনাথরাও এবং আনন্দীবাই -এর সাথে তার ক্রমবর্ধমান শত্রুতা তার হত্যার কারণ হয়ে ওঠে। এই ঘটনাটি গোপিকাবাইয়ের জন্য আরেকটি ধাক্কা ছিল, এবং দেড় বছর ধরে প্রশাসনের উপর তিনি যে নিয়ন্ত্রন অর্জন করেছিলেন তিনি আবার তা হারিয়ে ফেলেন এবং তাকে নাসিকে ফিরে যেতে হয়।


তথ্যসুত্র[সম্পাদনা]

  1. https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.120817  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  2. Misra, Anand Swarup (১৯৬১)। Nana Sahab Peshwa And The Fight For Freedom 
  3. Patil, Vishwas। Sambhaji