গিরিয়ার যুদ্ধ (১৭৪০)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
গিরিয়ার প্রথম যুদ্ধ
তারিখ৯ এপ্রিল ১৭৪০[১][২]
অবস্থান
ফলাফল আলীবর্দী খানের বিজয়[১]
বিবাদমান পক্ষ
আলীবর্দী খানের দল সরফরাজ খানের দল
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
আলীবর্দী খান
হাজী আহমদ
নওয়াজিশ মুহম্মদ খান
মীর জাফর
সরফরাজ খান [১]
হাজী লুৎফ আলী[১]
মর্দান আলী খান[১]
শক্তি
অজ্ঞাত অজ্ঞাত
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
অজ্ঞাত অজ্ঞাত

গিরিয়ার প্রথম যুদ্ধ ১৭৪০ সালের ৯ এপ্রিল বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদের গিরিয়ায় বাংলার নবাব সরফরাজ খান এবং বাংলার অধীনস্থ বিহারের নায়েব নাযিম আলীবর্দী খানের মধ্যে সংঘটিত হয়। যুদ্ধে সরফরাজ খান পরাজিত ও নিহত হন[১][২] এবং আলীবর্দী খান বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হন[১]

আকবরনগর চাকলার সীমান্ত পেরিয়ে সুতি কাছে গঙ্গার পশ্চিম পারে আওরঙ্গাবাদ থেকে চরকা বালিয়াঘাটায় শিবির বসালেন আলিবর্দি। বিহারের ফৌজদারের অগ্রগমনের সংবাদে সরফরাজ গঙ্গার পূব পাড় ধরে গিরিয়ার কাছে কোমরায় পৌঁছলেন এবং গঙ্গা পার হয়ে তারা বিশাল বাহিনী নিয়ে সেনাপতি ঘাউস খানের নেতৃত্বে আলিবর্দির শিবির থেকে দশ মাইল দূরের অবস্থান করলেন। দুই শিবির থেকেই পরস্পরকে বিপথে চালনা করার উদ্যম নেওয়া হচ্ছিল। গোপনে দল ভাঙ্গানোর খেলাও চলছিল বিশেষ করে আলিবর্দির শিবির থেকে ঘাউস খান, মর্দান আলি খানের মত প্রবীন সেনানায়কদের সম্পদ, পদ ইত্যাদির টোপ দেওয়ার বার্তা যাছিল বিপক্ষ শিবিরে। একই সঙ্গে জগতশেঠ ফতেহচাঁদ এবং অন্যান্যরা নবাবি বাহিনীর মধ্যেই আলিবর্দির পক্ষে ভাঙ্গন ধরাবার চেষ্টা করছিলেন।

দু পক্ষেরই ক্ষমতা তুল্যমূল্য বিচারে কাছাকাছি ২০০০০ পদাতিক আর ১০০০০ অশ্বারোহী। আলিবর্দির সঙ্গে ছিল ৩০০০ আফগান যোদ্ধা। সরফরাজ আর আলিবর্দির ১০ টা করে কামান ছিল। আলিবর্দি সরফরাজকে তিন দিক থেকে ঘিরে ধরার পরিকল্পনা করলেন। ঠিক হল প্রথম বাহিনীটি সেনাপতি নন্দলালের নেতৃত্বে ঘাউস খান এবং মীর সফিউদ্দিনের বাহিনীর সঙ্গে লড়বে, তিনি অন্য দুটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন। আফগান এবং বাহেলিয়া সর্দারদের নিয়ে তৈরি দুটো বাহিনী নিয়ে ৯ এপ্রিল ১৭৪০ মধ্য রাতে আলিবর্দি গঙ্গা পেরিয়ে সরফরাজের বাহিনীর পিছনে উপস্থিত হলেন সেনাপতি নাওয়াজিস মহম্মদ খানের(হাজি আহমদের পুত্র, আলিবর্দির বড় মেয়ে মেহেরুন্নিসা বা ঘসেটি বেগমকে বিয়ে করেন। আলিবর্দি নবাব হলে তিনি খাস-সম্পত্তির দেওয়ান ও ঢাকার সুবাদার হন) নেতৃত্বে আবদুল আলি খান, শামসির খান এবং অন্যান্য আফগান সেনাপতি নিয়ে। আলিবর্দি নিজে রাজশাহীর জমিদার রাজা রমাকান্তর(নাটোরের জমিদার। তিনি অপুত্রক রামজীবনের দত্তক পুত্র। রানী ভবানীকে বিবাহ করেন। জমদারিটি সে সময় বিস্তৃত ছিল রাজমহল থেকে আজকের বীরভূম, মুর্শিদাবাদের উত্তর-পূর্ব অংশ, বোগরা, পাবনা মালদার পূর্ব ভাগ, যশোরের উত্তর-পূর্ব অংশ এবং নদিয়া জেলা থেকে নাটোর) বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাত দুটোয় অগ্রসর হয়ে আগে থেকে লুকিয়ে রাখা কামান থেকে গোলা ছুঁড়ে যুদ্ধ শুরু করেন। পিছন থেকে নওয়াজিস মহম্মদ খান আরেক দিক থেকে সরফরাজের বাহিনী আক্রমন করেন, নন্দলাল ব্যস্ত রাখবেন ঘাউস খানকে। সরফরাজ নমাজ শেষ করে হাতে একটি কোরাণ নিয়ে হাতি বাহিত হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আসেন। রাত থেকে যে যুদ্ধ চলছিল সকাল হতেই নবাবের প্রবেশের সঙ্গেই ভীষণাকার ধারণ করল। সরফরাজের গুরুত্বপূর্ণ সেনানায়ক যেমন সুজাউদ্দিনের ভাইপো মীর মহম্মদ বাকির বা বাকির আলি খানের ভাই মীর কামাল, মীর গাদাই, মীর আহমদ, মীর সিরাজুদ্দিন, হাজি লুফত আলি খান, সরফরাজের বাহিনীত মীর বক্সী মির্জা ইরাজ খানের অবিবাহিত পুত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ দিল। সৈয়দ হুসেইন খান, নসরতউল্লা খান এবং অন্যান্য সেনানায়ক ভীষণভাবে আহত হলেন। আহত আলমচাঁদ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদ পৌঁছন এবং আলিবর্দি সিংহাসনে আরোহন করার পরেই মারা যান(সালিমুল্লা লিখছেন আলমচাঁদ অর্ধমৃত হয়েছিলেন কারণ তার ডান হাতে গুলি বিঁধেছিল। মানসিক কষ্টে তিনি হিরের গুঁড়ো খেয়ে আত্মহত্যা করেন। হলওয়েল লিখছেন, তিনি মুর্শিদাবাদে পালিয়ে আসার পরে স্ত্রীর গঞ্জনা সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যা করেন) সরফরাজের বাহিনীর সেনারা পালিয়ে যাওয়ার জন্যে হুটোপুটি লাগিয়ে দেয়। সম্মুখ সমরে থাকা মর্দান আলি খান স্বয়ং পালিয়ে যান। যুদ্ধ ক্ষেত্রে একা নবাব হস্তিযুথ এবং কয়েক হাজার জর্জিয় এবং আবিসেনিয় বা হাবসি দাস (ভারতচন্দ্র বর্ধমান রাজপরিবারে বহু হাবসির ভৃত্যের কথা লিখছেন। বাংলায় সে সময় অভিজাতদের বাড়িতে হাবসি দাস থাকা আভিজাত্যের বিষয় ছিল)পরিবৃত হয়ে রইলেন। মাহুত তাঁকে বীরভূমের জমিদার বাদিউসজামানের আশ্রয়ে নিয়ে যেতে চাইলে সরফরাজ পালিয়ে যেতে অস্বীকার করে বলেন তিনি গড্ডলদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। শত্রুপক্ষের গোলান্দাজি, হাউই, বন্দুক, কামানের গোলা, তীর ইত্যাদির মধ্যেই বাংলার নবাব এগিয়ে চললেন। একটি মাস্কেটের গুলি তার কপালে বিঁধল(হলওয়েল লিখছেন, গুলিটা তার বাহিনীর কোনও বিশ্বাসঘাতক ছুঁড়েছিল, কিন্তু তাঁর এই মন্তব্যের সমর্থন অন্য কোনও লেখকের লেখায় পাই না। উপরন্তু সরফরাজের মৃত্যুর ভুল তারিখ লিখেছেন তিন বিদেশি হলওয়েল, ওরমে এবং স্ক্রাফটন – হলয়েল লিখছেন ২৫ জানু ১৭৪১, ওরমে আর স্ক্রাফটন লিখছেন ১৭৪১ মার্চ) তৎক্ষণাৎ তিনি হাতির হাওদা বা মিক দাম্বার, mik dambar ওপরে গড়িয়ে পড়লেন এবং ছত্রিশ বছর বয়সে বীরের মৃত্যু বরণ করলেন। ঘটনাটা দূর থেকে মীর হাবিব, সিলেটের ফৌজদার শামশির খান কুরেশি, রাজা গন্ধর্ব কাপুরুষের মত দেখছিলেন। মীর হায়দার শাহ এবং খ্বাজা বসন্ত একটি রথে চেপে মুর্শিদাবাদের দিকে পালিয়ে যান। নবাবের মৃতদেহ তার বফাদার মাহুত রাজধানীতে নিয়ে আসেন এবং গোপনে নুকতাখালিতে পুত্র হাফিজুল্লা খান এবং মুর্শিদাবাদের ফৌজদার ইয়াসিন খান কবর দেন। অন্যদিকে ভাগরথীর পশ্চিম প্রান্তে ঘাউস খান এবং মীর সরফুদ্দিন নন্দলালকে হত্যা করে বিজয়ী হলেন এবং নবাবের মৃত্যু খবর না থাকায় দূত পাঠিয়ে নবাব শিবিরে জয়ের খবর পাঠান এবারে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে যৌথ আক্রমন শানাবেন। দূত ফিরে এসে তাঁকে নবাবের মৃতুর খবর দিল। তিনি শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দুই পুত্র মহম্মদ কুতুব এবং মহম্মদ পীরকে নিয়ে সাহসীর মত আলিবর্দির বাহিনীর মধ্যে ঢুকে আসেন এবং সেনাপতি ছেদন হাজারির মাস্কেটের গুলিতে মৃত্যু বরণ করেন। তার দুই পুত্রও তার সঙ্গে মারা যায়। আরেক সহযোদ্ধা মীর দিলির উপাধিওয়ালা সরফরাজও যুদ্ধ করতে করতে মারা যান। মীর শরফুদ্দিন কয়েকজন অশ্বারোহী নিয়ে আলিবর্দির দিকে ধেয়ে যান, তার ছোড়াঁ দুটি তীরের একটি আলিবর্দির ধনুকে আঘাত করে, অন্যটি বাহুতে। দ্বিতীয়বার তাঁকে তাক করার আগে তার দুই পুরোনো বন্ধু, আলিবর্দির বাহনীর শেখ জাহানিয়ার এবং মহম্মদ জুলফিকার তাকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। সরফরাজ খানের কামান বাহিনীর প্রধান পাঁচু যুদ্ধ করতে করতে আফগানদের হাতে প্রাণ হারান। সরফরাজের বাহিনীর এক রাজপুত সেনানায় বিজয় সিং, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোমরায় যুদ্ধ করতে করতে নবাবের হত হওয়ার খবরে হাতি ছুটিয়ে আলিবর্দির পানে ধাওয়া করেন এবং তাকে বর্শা ছুঁড়ে হত্যা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু আলিবর্দির গোলান্দাজ দপ্তরের দারোগা দাতওয়ার আলি খান তাঁকে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করেন। তার নয় বছরের বালক হাতে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে শুরু করে। আলিবর্দি তার সেনাকে শিশুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বারণ করেন এবং রাজপুত রীতি অনুসারে বীরকে দাহ করা হয়।

== ফলাফল ==সরফরাজ খানের পরাজয় এবং মৃত।। মুর্শিদাবাদের নবাব হলেন নবাব আলীবর্দী খান।

আরো দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম, (বাংলাদেশের ইতিহাস), নবাব আলীবর্দী খান, পৃ. ২৯০–২৯১
  2. Nitish K. Sengupta। "Land of Two Rivers: A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib"