গিরমিটিয়া
গিরমিটিয়া (ভোজপুরি: गिरमिटिया) যারা জাহাজি নামেও পরিচিত, ছিলেন ভারতীয় চুক্তি ব্যবস্থার আওতায় ফিজি, দক্ষিণ আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলি যেমন মরিশাস, সেশেলস, রিইউনিয়ন, তানজানিয়া, কেনিয়া এবং উগান্ডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলি যেমন ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো, গায়ানা এবং সুরিনামের বাগানগুলিতে কাজ করার জন্য আগত ব্রিটিশ ভারতের মজুর।
শব্দের ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]
গিরমিট শব্দটি ইংরেজি ভাষার 'এগ্রিমেন্ট' শব্দটির ভারতীয় উচ্চারণ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো চুক্তি। এই চুক্তিটি বোঝায় ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রমিকদের সাথে ব্রিটিশ সরকারের চুক্তিকে।[১] চুক্তিতে শ্রমিকদের বিদেশী মাটিতে থাকার সময়কাল এবং ব্রিটিশ রাজে তাদের প্রত্যাবর্তন বিষয়ক শর্তাবলী উল্লেখ করা থাকতো।[২] জাহাজি শব্দটি বোঝায় 'জাহাজের লোকেরা' বা 'জাহাজের মাধ্যমে আসা লোকেরা'।[৩]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]১৮৩৩ সালে দাসত্ব চুক্তি খারিজ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। দাসপ্রথা তুলে দেওয়ায় সমস্যার মুখে পড়ল ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি। সেই সময় তৈরি হল আরকাঠিয়াস অর্থাৎ মিডিল ম্যান, যাদের কোনও ক্ষয় নেই। এর পর, উনবিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের শেষের দিকে ছিল ব্রিটিশ ভারতে আফিম চাষের রমরমা। এই ব্যাপক এবং লাগামছাড়া আফিমের চাষের কারণে জমি উর্বরতা হারাতে থাকে। ফলস্বরূপ, একটি ভুখমারির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। একই সময়ে আখের চাষের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাও দেশে শুরু হয়। এই সমস্ত ফসল হলো ‘ক্যাশ ক্রপ’, অর্থাৎ যে শস্য উৎপাদন করলে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া যাবে অদূর ভবিষ্যতে। এই ক্যাশ ক্রপের চাষ করতে প্রয়োজন ছিল বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের। শ্রমিক যোগানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন সাহায্য নেয় ক্ষুধার্থ, অসহায় শ্রমিকদের। এভাবে ভারত জুড়ে ভিন্ন রাজ্য থেকে আসা নিজের দেশের মানুষই হয় পরিযায়ী শ্রমিক। এরাই হলো মৌখিক চুক্তিবদ্ধ গিরমিটিয়া শ্রমিক। বিহার, বাংলা ও অধুনা উত্তরপ্রদেশের মানুষ জাহাজে উঠে পড়েন ব্রিটেনের অন্যান্য উপনিবেশগুলির উদ্দেশ্যে। এই এগ্রিমেন্টে ছিল শ্রমিকদের ভালো থাকার টোপ। নিরন্ন শ্রমিকদের পেট ভরানোর টোপে জাহাজে করে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও ফিজির মতো দেশগুলিতে। নর্শ লাইন কোম্পানির জাহাজে স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি দেয় ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বাচ্চা মিলিয়ে প্রায় ষাট হাজার মানুষ। কলকাতা আর মাদ্রাজ থেকে জাহাজ মূলত শ্রমিকদের বহন করে নিয়ে যেতো ফিজি, জামাইকা, গুয়েনা, মরিশাস, সুরিনাম, ত্রিনিদাদ, নতাল ও তবোগাতে। এই পরিযায়ী পরিবহন এতোটাই বড়োমাপের ছিল যে এক সময়ে এইসব জায়গাকে গিরমিটিয়া দেশ বলেও ডাকা হতো। চল্লিশটা জাহাজ প্রায় ৮২ বার মানুষদের তুলে নিয়ে যায় বিদেশের সীমানায়।[৪]
ফিজিতে, গভর্নর আর্থার হ্যামিল্টন-গর্ডন মেলানেশিয়ান ফিজিয়ানদের তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণের প্রয়াসে বৃক্ষরোপণে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করতেন।[১] অ্যাক্টিভিস্ট শানেল লালের বক্তব্য, গিরমিটিয়াদের প্রতারণামূলকভাবে ব্রিটিশদের দাস বানিয়ে রেখেছিল। [৫]
গিরমিটিয়াদের বসবাসের অবস্থা
[সম্পাদনা]দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিভিন্ন রেকর্ড থেকে এটি জানা গিয়েছে যে অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে পোকামাকড়ের মতো বেঁচে থাকতে হতো শ্রমিকদের। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের তীব্র গরমে ভোর চারটে থেকে কাজ শুরু হয়ে টানা ন’ঘণ্টা কাজ করতে হতো শ্রমিকদের। এই কষ্ট থেকে বাঁচতে পালাতে চেয়েছেন অনেকে। অনেকে আত্মহত্যাও করেছেন।
গিরমিটিয়াদের পারিশ্রমিক
[সম্পাদনা]চুক্তি অনুযায়ী ১২ আনা ৭৫ পয়সা পেতেন পুরুষ শ্রমিক এবং মহিলারা পেতেন ৯ আনা ৭৫ পয়সা। ১৫ বছরের অনূর্ধ্ব বাচ্চারা যতটা খাটতে পারতো, তার উপর মূল্য নির্ভর করতো।
গিরমিটিয়া প্রথার অবসান
[সম্পাদনা]১৯১৭ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে এই দাসত্ব চুক্তিনামা পুরোপুরি খারিজ হয়ে গেলেও গিরমিটিয়া শ্রমিকরা আর ভারতে ফিরে আসেননি। প্রথম প্রজন্ম ওখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় প্রজন্ম দেশান্তর করে চলে যায় নিউজিল্যান্ড, অ্যামেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলির দিকে। এখন গিরমিটিয়া শ্রমিকদের বংশধররা পড়ালেখা শিখে উন্নততর জীবনযাপন ছাড়াও জায়গা করে নিয়েছেন সমাজের উপরতলায়।[৬]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ "Girmit History"। www.fijigirmit.org। ২০০৬-১০-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১০।
- ↑ "Article 2"। www.fijigirmit.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১০।
- ↑ Lal, Brij V.। "Chalo Jahaji – on a journey through indenture in Fiji"। New Girmit.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০১-১৫।
- ↑ ভট্টাচার্য, নবনীতা (১৯ নভেম্বর ২০২০)। "ভুখা পেটে বাংলা থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জাহাজে"। Eisamay Gold। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
- ↑ "Shaneel Lal: The Royal Family stole my ancestors"। NZ Herald (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-২৫।
- ↑ ভট্টাচার্য, নবনীতা (১৯ নভেম্বর ২০২০)। "ভুখা পেটে বাংলা থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জাহাজে"। Eisamay Gold। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
পাদটীকা
[সম্পাদনা]- Gillion, Kenneth (১৯৬২)। Fiji's Indian migrants : a history of the end of indenture in 1920। Oxford U.P.।
- "Girmitiya"। The Pacific Islands : an encyclopedia ([Repr.]. সংস্করণ)। University of Hawai'i Press। ২০০০। পৃষ্ঠা 110–111। আইএসবিএন 082482265X।
- Lal, Brij V. (২০০৪)। Girmitiyas : the origins of the Fiji Indians। Fiji Institute of Applied Studies। আইএসবিএন 978-0-8248-2265-1।
- Gaiutra Bahadur (2014). Coolie Woman: The Odyssey of Indenture. The University of Chicago. আইএসবিএন ৯৭৮-০-২২৬-২১১৩৮-১ISBN 978-0-226-21138-1
- Carter, Marina; Torabully, Khal (২০০২)। Coolitude : an anthology of the Indian labour diaspora। Anthem। আইএসবিএন 1843310031।
- Praveen Kumar Jha (2019). Coolie Lines ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে. New Delhi: Vani Prakashan. আইএসবিএন ৯৭৮-৯৩-৮৮৬৮৪-০৪-০ISBN 978-93-88684-04-0
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- সাউথ এশিয়ান ইনডেনচার্ড লেবার - অনলাইন আর্কাইভ অফ রিসার্চ অ্যান্ড রিসোর্সেস - একটি অনলাইন আর্কাইভ এবং ভারতীয় ইন্ডেনচারশিপ সম্পর্কিত টেক্সট-ভিত্তিক রিসোর্সের লিভিং সিলেবাস, দেশ-নির্দিষ্ট সংস্থান এবং বৈশ্বিক ভারতীয় ইন্ডেনচার ডায়াসপোরা সম্পর্কিত উপাদান সহ
- ফিজিতে গিরমিটিয়াদের সম্পর্কে মহেন্দ্র চৌধুরীর সাক্ষাৎকার ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ জুন ২০২২ তারিখে