গঙ্গা (উপন্যাস)
![]() মৌসুমী প্রকাশিত সংস্করণের প্রচ্ছদ | |
লেখক | সমরেশ বসু |
---|---|
প্রচ্ছদ শিল্পী | সত্য চক্রবর্তী |
দেশ | ![]() |
ভাষা | বাংলা |
বিষয় | সামাজিক (মৎস্যজীবী সম্প্রদায়), নদীকেন্দ্রিক |
ধরন | উপন্যাস |
প্রকাশক | মৌসুমী প্রকাশনী |
প্রকাশনার তারিখ | ১৯৫৭ (প্রথম প্রকাশ) মে, ১৯৭৪ (মৌসুমী প্রথম প্রকাশ) |
মিডিয়া ধরন | বই |
পৃষ্ঠাসংখ্যা | ১৯১+২৪+৪ |
গঙ্গা সমরেশ বসু রচিত একটি ধ্রুপদী বাংলা উপন্যাস। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত নদীকেন্দ্রিক এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয় দক্ষিণবঙ্গ, বিশেষত অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের (মাছমারা) জীবনসংগ্রামের কাহিনি। এই উপন্যাসখানি লেখক তথা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা বলে বিবেচিত হয়। দেশ পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ২৪টি বাংলা উপন্যাসের তালিকাতেও স্থান পায় গঙ্গা।
রচনার ইতিহাস[সম্পাদনা]
গঙ্গা উপন্যাসটি রচনার পূর্বে সমরেশ বসু কয়েক বছর ধরে অধুনা উত্তর ২৪ পরগনার হালিশহরে যাতায়াত করে ক্ষেত্রসমীক্ষা চালান। এই বিষয়ে তাঁকে সহায়তা করেন হালিশহর রামপ্রসাদ লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক নিমাইচাঁদ অধিকারী। নিমাইবাবুর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, এই সময় প্রায় তিন-চার বছর ধরে গঙ্গার তীরে মাছমারাদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের জীবিকা, জীবন, সমাজ ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য নোট করে নেন। এমনকি তাদের নিজস্ব উপভাষা ও বিভিন্ন প্রকৌশলগত শব্দের (যেমন বাঁধা ছাঁদি, টানা ছাঁদি, কোণা জাল, খুঁটে জাল, সাংলো জাল ইত্যাদি) সঙ্গেও সম্যক পরিচিত হন। অবগত হন মাছ ধরার বিভিন্ন কৌশল ও সংস্কার সম্পর্কেও। এই সব মৎস্যজীবীদের ঋণ তিনি স্বীকার করেছিলেন গ্রন্থের মুখবন্ধে।
১৯৫৭ সালে জন্মভূমি পত্রিকার শারদ সংখ্যায় উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে সমরেশ বসু এটিকে উৎসর্গ করেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে। পরে দীর্ঘকাল অমুদ্রিত থাকার পর ১৯৭৪ সালে লেখকের অনুমতিক্রমে মৌসুমী প্রকাশনী বিস্তারিত গ্রন্থপরিচয় ও গবেষণা-সমীক্ষণ সহ গঙ্গা উপন্যাসের একটি সমৃদ্ধ সংস্করণ প্রকাশ করে। বর্তমানে এই সংস্করণটিই পৃথক গ্রন্থাকারে বাজারে প্রাপ্ত হয়।
কাহিনি-সারাংশ[সম্পাদনা]
গঙ্গা উপন্যাসের নায়ক তেঁতলে বিলাস (অর্থাৎ, তেঁতুলতলার বিলাস)। তার বাপ নিবারণ সাঁইদার ছিল দুঃসাহসী মালো মাছমারা। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে নিবারণ প্রাণ হারায়। বিলাস তখন মাতৃগর্ভে কিংবা সদ্যোজাত। বড় হয়ে বিলাসের চেহারাও হয় তার বাপের মতো সুদর্শন সুপুরুষ:
কালো কুচকুচে রঙ, পেটানো শরীর। নেহাইয়ের মতো শক্ত। যেন নিমকাঠের কালো রঙ মাখা চকচকে মূর্তি। নাকটি ছোট। চোখদুটি ঈষৎ গোল। ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলে তাকালে মনে হয়, কেউটে সাপ যেন ফণা ধরে আছে। …সবাই জানে, রগচটা আর গোঁয়ার। গায়ে শক্তিও তেমন।
সে মাছ মারতে শেখে তার কাকা পাঁচুর কাছ থেকে। সুন্দরবন অঞ্চল থেকে প্রতি বছর বর্ষায় কলকাতা-সন্নিহিত অঞ্চলে হুগলি নদীতে মাছ ধরতে আসত তারা। এখানে পাইকার দামিনীর সঙ্গে আলাপ হয় বিলাসের। ভালবাসা হয় দামিনীর নাতনি হিমির সঙ্গে। উভয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন ও মাছমারাদের সুখদুঃখের কর্মজীবনের ধারা বেয়ে প্রবাহিত হয় কাহিনি। নদীবক্ষেই মৃত্যু হয় পাঁচুর। মৃত্যুর পূর্বে সে হিমি ও বিলাসের মিলনে সম্মতি জানিয়ে যায়। তারপরেই ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধেয়ে আসে নদীতে। সেবারের জন্য কপাল খুলে যায় মাছমারাদের। অবশেষে মিলন হয় হিমি ও বিলাসের। কিন্তু বিলাসকে ধরে রাখতে পারে না হিমি। বিলাস বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রযাত্রার উদ্দেশ্যে। উপন্যাস শেষ হয় এইভাবে:
- ঢেউ লেগেছে রাইমঙ্গল আর ঝিল্লের মোহনায়। কালীনগর গঞ্জ থেকে চাল ডাল নুন তেল যোগাড়যন্ত্র হয়েছে। সাঁইদারের অপেক্ষা।
- - সাঁইদার কে?
- - বিলেস। তেঁতলে বিলেস।
- তেঁতলে বিলেস সমুদ্রে যায়।
প্রতিক্রিয়া[সম্পাদনা]
গঙ্গা উপন্যাসের মূল্যায়ণনে গবেষক সোহারাব হোসেন মন্তব্য করেছেন,
নদীর প্রতিকূলতার সঙ্গে জড়িত মৃত্যুবোধ গঙ্গা উপন্যাসের মূল চেতনা। সামাজিক উপন্যাসের এ এক ভিন্ন মূর্তি – ভিন্ন রূপ। গঙ্গা–তে দেখি আরও একবার আমাদের সাহিত্যপাঠকের নায়ক-সংস্কার ভেঙে যেতে।[১]
শিশিরকুমার দাশের মতে, এই উপন্যাসটি
দক্ষিণবঙ্গের নদীনালা এবং মৎস্যজীবী মানুষের সুখদুঃখ জীবনযাপনের সংগ্রাম, প্রকৃতির কঠোরতা এবং সামাজিক জীবনের বৈষম্য নিয়ে স্থির, নিশ্চিত মধ্যবিত্ত জীবনের নিরাপত্তার এক বিপরীত আখ্যান। এর একদিকে আছে বাস্তব তথ্যের প্রতি নিষ্ঠা, অন্যদিকে আছে মৃত্যু ও অস্তিত্বের সংগ্রামের এক মানবিক উপলব্ধি। গঙ্গা সমরেশ বসুর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম।[২]
আর্থ-সামাজিক কাহিনির সঙ্গে প্রচুর উপকথা-মিথের ব্যবহার এই উপন্যাসকে বিশিষ্টতা দান করেছে। সম্পর্কের বিভিন্ন জটিলতা ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু বেশ দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপনা করেছেন। পাঁচুর সঙ্গে বিলাসের সম্পর্ক, দুলাল-আতরবালা সম্পর্ক, অমৃতর বউয়ের সঙ্গে বিলাসের সম্পর্ক প্রভৃতি সম্পর্কগুলি আশ্চর্য রকম পরিমিত ও পরিণত। এমনকি গবেষক সৌমিত্র বসু বিলাস ও সয়ারামের সম্পর্কের মধ্যে সূক্ষ্ম সমকামিতারও আভাস পেয়েছেন।[৩]
গঙ্গা উপন্যাসটি শুধু সমালোচক সমাজেই নয়, লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যমহলেও সমাজেও যথেষ্ট প্রশংসিত হয়। উপন্যাসের ভূয়সী প্রশংসা করেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি-সমালোচক বিষ্ণু দে ও সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত তিতাস একটি নদীর নাম ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত পদ্মানদীর মাঝি এবং ইংরেজি সাহিত্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে রচিত দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি উপন্যাসের সঙ্গে এই উপন্যাসের তুলনা করা হয়। ''দেশ'' পত্রিকা বিশেষ শতাব্দীনির্মাতা সংখ্যায় (২৩ জানুয়ারি, ১৯৯৯) গঙ্গা উপন্যাসটিকে বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের ২৪টি শতাব্দীনির্মাতা উপন্যাসের অন্যতমের মর্যাদা দেয়।
চলচ্চিত্রায়ণ[সম্পাদনা]
১৯৫৯ সালে রাজেন তরফদারের পরিচালনায় গঙ্গা চলচ্চিত্রায়িত হয়। এই ছবির মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন নিবারণ রায় (বিলাস), রুমা গুহঠাকুরতা (হিমি), সন্ধ্যা রায় (গামলি পাঁচী), জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় (পাঁচু) প্রমুখ। ১৫১ মিনিট দৈর্ঘের এই সাদাকালো ছবিটির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সলিল চৌধুরী। ছবিটি সমালোচকদের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হলেও পরিচালক রাজেন তরফদার তাঁর কর্মজীবনে আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি। রাজেন তরফদার নির্মিত চলচ্চিত্র "গঙ্গা" মুক্তিপায় ১৯৬০ সালের ২৭ নভেম্বর। কলকাতার রাধা, পূর্ণ ও প্রাচী প্রেক্ষাগৃহে এটি রিলিজ করে। এরপর পরিচালক আরো সিনেমা নির্মাণ করেছেন। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশে গিয়ে নির্মাণ করেন যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র "পালংক"। পরিচালকের প্রথম সিনেমা হলো "অন্তরীক্ষ" যেটি ১৯৫৭ সালে মুক্তি পায়।
টীকা[সম্পাদনা]
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- গঙ্গা, সমরেশ বসু, মৌসুমী প্রকাশনী
- প্রবন্ধ: বাংলা সামাজিক উপন্যাস, সোহারাব হোসেন, প্রবন্ধ সঞ্চয়ন, সম্পাঃ ডক্টর সত্যবতী গিরি ও ডক্টর সমরেশ মজুমদার, রত্নাবলী, কলকাতা, ২০০৬
- লোককথার নায়ক আবিষ্কার, সৌমিত্র বসু, দেশ, ২৩ জানুয়ারি, ১৯৯৯ সংখ্যা