ক্বিবলা পরিবর্তন
ক্বিবলা পরিবর্তন (আরবী:تحويل القبلة)।ক্বিবলা আরবি শব্দ। নামাজ আদায়ের দিক-নির্দেশক শব্দই হচ্ছে ‘ক্বিবলা’। ইসলামের প্রাথমিক সময়কালে আল্লাহর আদেশে মসজিদে আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন। পরবর্তীতে কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়তে আল্লাহ আদেশ করেন। এই পরিবর্তনকে বলে ‘ক্বিবলা পরিবর্তন’।
প্রথম ক্বিবলা
[সম্পাদনা]ুআল-কুদস বলতে বোঝায় ফিলিস্তিনের জেরুজালেম পবিত্র ভূমিতে অবস্থিত পবিত্র মসজিদ। যা মসজিদুল আকসা বা ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ নামে পরিচিত। নবি ইবরাহীম কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের চল্লিশ বছর পর তার ছেলে ইসহাক এর সন্তান ইয়াকুব ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নামক স্থানে ‘আল-আকসা’ মসজিদটি নির্মাণ করেন। অতঃপর তার ছেলে ইউসুফ এর বংশধর দাউদ এর সন্তান হজরত সুলাইমান তা সংস্কার করেন। তিনি রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জেরুজালেম নগর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে ‘কাবা’ কিবলা থাকলেও মসজিদুল আকসা বা ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ স্থাপনের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এটি মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা। [১]
দ্বিতীয় ক্বিবলা
[সম্পাদনা]ইসলামের দ্বিতীয় কিবলা হলো কা’বা শরীফ। এই ক্বিবলা হলো বর্তমান মুসলমানদের ক্বিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ পরেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন। এটি সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে মসজিদুল হারামের মধ্যখানে অবস্থিত। [২]
ক্বিবলা পরিবর্তনের কারণ
[সম্পাদনা]ইসলামের প্রাথমিক যমানায় আল্লাহর আদেশে মসজিদে আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন। কিন্তু মুহাম্মাদের ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল কাবার দিকে ফিরে নামায পড়া। তাই তিনি মক্কায় থাকাকালীন এমন সমান্তরালভাবে নামাজে দাড়াতেন যেন কাবা এবং মসজিদে আকসা সম্মুখে থাকে। কিন্তু মুসলমানরা যখন মদীনায় হিযরত করেন, তখন নামাজ পড়ার সময় কাবাকে আল-আকসার মাঝে রাখার সুযোগ আর ছিলোনা। কেননা, মদীনার অবস্থান ছিল মক্কা থেকে উত্তরে। মদীনারও উত্তরে অবস্থান জেরুসালেমের। ফলে নামাজ আদায়ের সময় মক্কার দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোন সুযোগ মুহাম্মদের জন্য ছিলোনা। এছাড়াও কাবা পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম ঘর যা মানুষের দ্বারা বানানো হয়েছে।[৩]
মুহাম্মদ এই কারণে খুবই মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন। তার সর্বদাই মনে হতো, তিনি ইবরাহীম কর্তৃক নির্মিত আল্লাহর প্রথম এই ঘরকে সম্মান জানাতে পারছেন না।
তার এই অনুভূতির জন্য তিনি অবশ্য কেবলা পরিবর্তনের জন্য আল্লাহর কাছে কোন প্রার্থনা করেন নি। তবে যখন মক্কার দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ না পড়তে পারার কষ্ট কাজ করতো, তখন তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
ফলে মদীনায় হিযরতের পরের বছরই আল্লাহ কেবলা পরিবর্তনের আদেশ দিয়ে মুহাম্মদের উপর আয়াত নাযিল করেন।[৪]
ক্বিবলা পরিবর্তনের ইতিহাস
[সম্পাদনা]আকাঙ্ক্ষিত বরকতময় মূহূর্তটি ছিল হিজরি দ্বিতীয় সনের শাবান মাস। মদীনা থেকে একটু দূরে মুহাম্মদ তার সাথীদেরকে নিয়ে এক মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করছিলেন । তখনো মসজিদুল আকসা মুসলিমদের কিবলা। আল্লাহ তায়ালা কুরআনের আয়াত নাযিল করে কিবলা পরিবর্তন করতে বললেন। দুই রাকাত নামাজ আদায়ের পরই এই আয়াত মুহাম্মদের উপর নাযিল হয়। বাকী দুই রাকাত নামাজ তিনি মক্কার কাবার দিকে ফিরে আদায় করেন।[৫]
কিবলা পরিবর্তনের সময় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতানৈক্য রয়েছে- কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন : দ্বিতীয় হিজরীর রজব সালে এ ঘটনাটি ঘটে ৷ কাতাদা এবং যায়েদ ইবনে আসলামও একথা বলেন এবং এটা মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকেরও একটি বর্ণনা ৷
ইমাম আহমদ, ইবনে আব্বাস যা বর্ণনা করেন, তা থেকেও এটা প্রতীয়মান হয় ৷
বারা’ ইবন আমির-এর হাদীস থেকে, যে সম্পর্কে পরে আলোচনা আসছে এবং ওটাই স্পষ্টতর।
কেউ কেউ বলেন, ঐ বছর শাবান মাসে এ ঘটনাটি ঘটে ৷ ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ এর অভিযানের পর ৷ কেউ কেউ বলেন, মুহাম্মদের মদীনায় আগমনের ১৮ মাসের মাথায় শাবান মাসে কিবলা পরিবর্তন হয়েছিল ৷ ইবন জারীর সুত্রে এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন এবং এর সনদ ইবনে আব্বাস, ইবনে মাসউদ এবং কতিপয় সাহাবীর সুত্রে বর্ণনা করেন৷ [৬]
মসজিদে কিবলাতাইন
[সম্পাদনা]মদিনার যেই মসজিদে কিবলা পরিবর্তন হয়েছিল তাকে মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ বলা হয়। এখনো এই মসজিদ মদীনায় অবস্থিত রয়েছে।পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদগুলোর অন্যতম এ মসজিদ আল কিবলাতাইন। দীর্ঘদিন ধরে এই মসজিদে দু’টি মিহরাব বা ইমামের দাঁড়ানোর স্থান বিদ্যমান ছিল। একটি ছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে। আর অন্যটি ছিল বাইতুল্লাহর দিকে। পরবর্তীতে মসজিদের সংস্কারের প্রয়োজনে বাইতুল্লাহ মুখী মিহরাবটি রেখে অন্য মিহরাবটি ভেঙ্গে ফেলা হয়।[৪][৭]
ক্বিবলা পরিবর্তনে কুরআনের আয়াত সমূহ
[সম্পাদনা]قَدْ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ ۖ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا ۚ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ ۗ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ
অনুবাদ: ( হে নবী!) আমি তোমার চেহারাকে বারবার আকাশের দিকে উঠতে দেখছি। সুতরাং যে কিবলাকে তুমি পছন্দ কর আমি শীঘ্রই সে দিকে তোমাকে ফিরিয়ে দেব। সুতরাং এবার মসজিদুল হারামের দিকে নিজের চেহারা ফেরাও। এবং (ভবিষ্যতে) তোমরা যেখানেই থাক (সালাত আদায়কালে) নিজের চেহারা সে দিকেই ফেরাবে। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তারা জানে এটাই সত্য, যা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এসেছে। আর তারা যা কিছু করছে আল্লাহ সে সম্বন্ধে উদাসীন নন।(সূরা বাকারা-১৪৪)
وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوْتُواْ الْكِتَابَ بِكُلِّ آيَةٍ مَّا تَبِعُواْ قِبْلَتَكَ وَمَا أَنتَ بِتَابِعٍ قِبْلَتَهُمْ وَمَا بَعْضُهُم بِتَابِعٍ قِبْلَةَ بَعْضٍ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءهُم مِّن بَعْدِ مَا جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ إِنَّكَ إِذَاً لَّمِنَ الظَّالِمِينَ
অনুবাদ: যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তুমি যদি তাদের কাছে সব রকমের নিদর্শনও নিয়ে আস, তবুও তারা তোমার কিবলা অনুসরণ করবে না। তুমিও তাদের কিবলা অনুসরণ করার নও, আর তাদের পরস্পরেও একে অন্যের কিবলা অনুসরণ করার নয়। তোমার নিকট জ্ঞান আসার পরও যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তবে তখন অবশ্যই জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৪৫)
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءهُمْ وَإِنَّ فَرِيقاً مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
অনুবাদ:আমি যাদেরকে কিতাব দান করেছি, তারা তাকে চেনে, যেমন করে চেনে নিজেদের পুত্রদেরকে। আর নিশ্চয়ই তাদের একটি সম্প্রদায় জেনে শুনে সত্যকে গোপন করে।(সুরা বাকারা, আয়াত-১৪৬)
الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ
অনুবাদ: বাস্তব সত্য সেটাই যা তোমার পালনকর্তা বলেন। কাজেই তুমি সন্দিহান হয়ো না। (সুরা বাকারা, আয়াত-১৪৭)
وَلِكُلٍّ وِجْهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَا فَاسْتَبِقُواْ الْخَيْرَاتِ أَيْنَ مَا تَكُونُواْ يَأْتِ بِكُمُ اللّهُ جَمِيعًا إِنَّ اللّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
অনুবাদ: প্রত্যেক সম্প্রদায়েরই একটি কিবলা আছে, যে দিকে তারা মুখ করে। সুতরাং তোমরা সৎকর্মে একে অন্যের অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা কর। তোমরা যেখানেই থাক, আল্লাহ তোমাদের সকলকে (নিজের নিকট) নিয়ে আসবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান।(সূরা বাকারা, আয়াত-১৪৮)
وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِنَّهُ لَلْحَقُّ مِن رَّبِّكَ وَمَا اللّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
অনুবাদ: আর তোমরা যেখান থেকেই(সফরের জন্য) বের হওনা কেন, (সালাতের সময়) নিজেদের মুখ মসজিদুল হারামের দিকে ফেরাও। নিশ্চয়ই এটাই সত্য, যা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে এসেছে। আর তোমরা যা কিছু কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ অনবহিত নন।[৮][৯]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "মুসলমানদের প্রথম কিবলা 'আল–কুদস'"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-১৬।
- ↑ "কাবা"। উইকিপিডিয়া। ২০২০-০১-২২।
- ↑ "القرآن الكريم - تفسير البغوي - تفسير سورة آل عمران - الآية 96"। quran.ksu.edu.sa। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-১৬।
- ↑ ক খ "কিবলা পরিবর্তন আনুগত্যের অনন্য নিদর্শন"। jagonews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-১৬।
- ↑ "কিবলা পরিবর্তন ও মসজিদ আল-কিবলাতাইন"। Islami Barta - ইসলামী বার্তা। ২০১৮-০৭-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-১৬।
- ↑ আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া। ইসলামিক ফাউণ্ডেশন। পৃষ্ঠা ৪৪৪।
- ↑ "تحويل القبلة"। ويكيبيديا (আরবি ভাষায়)। ২০১৯-১১-২৩।
- ↑ "সুরা বাকারা - habibur.com"। habibur.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-১৬।
- ↑ "القرآن الكريم - تفسير ابن كثير - تفسير سورة البقرة - الآية 144"। quran.ksu.edu.sa। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-১৬।