বিষয়বস্তুতে চলুন

কেনিয়ায় ইসলাম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
গেদির (পুরনো) জামে মসজিদ।

কেনিয়ায় ইসলাম খ্রিস্ট ধর্মের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, যা কেনিয়ার জনসংখ্যার ১১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। ২০১৯ সালের আদমশুমারি অনুসারে প্রায় ৫.২ মিলিয়ন মুসলিম কেনিয়ায় বসবাস করে।[] কেনিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগই মুসলিম অধ্যুষিত। নাইরোবিতে বেশ কয়েকটি মসজিদ ও উল্লেখযোগ্য মুসলিম বসতি রয়েছে। কেনিয়ায় সর্বপ্রথম সোয়াহিলি উপকূলে আসা বণিকদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচলন ঘটে, যাদের দাওয়াতে স্থানীয়রা ইসলাম গ্রহণ করে। এর ফলে পরবর্তীতে এ অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশ কয়েকটি মুসলিম রাজনৈতিক সত্তার উত্থান ঘটে। [][]

কেনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হলেন সুন্নি ইসলামের অনুসারী, যারা মোট মুসলিম জনসংখ্যার ৮১% এবং তাদের ৭% শিয়া ইসলামের অনুসারী। [] এছাড়াও ইবাদিকুরআনবাদী মতবাদের অনুসারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। [] শিয়া মুসলমানরা মূলত ইসমাইলি, যারা মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতীয় সমুদ্রবন্দরের ব্যবসায়ীদের বংশধর অথবা তাদের দ্বারা প্রভাবিত। এই শিয়াদের মধ্যে দাউদি বোহরা নামে একটি গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের সংখ্যা দেশে প্রায় ৬,০০০-৮,০০০। [] কেনিয়ায় দ্বাদশ শিয়াদের একটি ক্ষুদ্র উপস্থিতিও পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীর পাকিস্তানি পণ্ডিত মুহাম্মদ লতিফ আনসারী স্থানীয় খোজা সম্প্রদায়ের ধর্মান্তরিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। [][]

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

সোয়াহিলি উপকূলে ইসলামের আগমন

[সম্পাদনা]

মুসলিম বণিকরা অষ্টম শতাব্দীর দিকে সোয়াহিলি উপকূলে এসে পৌঁছায়। নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর সৃষ্ট অস্থিরতা ও পারস্য উপসাগর ও সোয়াহিলি উপকূলের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক তাদের আগমনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল। [][]

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী, দশম শতাব্দীর মধ্যে মান্ডা দ্বীপে একটি সমৃদ্ধশালী মুসলিম শহরের অস্তিত্ব ছিল। ১৩৩১ সালে মরক্কোর মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা সোয়াহিলি উপকূল ভ্রমণের সময় সেখানে শক্তিশালী মুসলিম উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এখানকার অধিবাসী মুসলিমরা ধার্মিক, সম্মানীয় ও ন্যায়পরায়ণ এবং তারা সুন্দর কাঠের মসজিদ নির্মাণ করেছে। []

মুসলিমরা উপকূলে বসতি স্থাপন করে এবং বাণিজ্যে জড়িত হয়। শিরাজিরা স্থানীয় বান্টু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং এর ফলেই সোয়াহিলি জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ ইসলাম গ্রহণ করে। ফলে সোয়াহিলি ভাষার জন্ম হয়, যা গঠনগতভাবে একটি বান্টু ভাষা হলেও এতে প্রচুর আরবি শব্দ সংযোজিত হয়েছে। []

প্রাথমিকভাবে, ইসলাম ব্যক্তি পর্যায়ের যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। আরব মুসলিমরা ছোট ছোট গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করত এবং তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চর্চা বজায় রাখত। যদিও তারা বিভিন্ন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসেছে, তবে ইসলামকে বান্টু সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত করা হয়নি। বরং নতুন গড়ে ওঠা আফ্রো-আরব মুসলিম সম্প্রদায়ে ব্যক্তিগতভাবে লোকজন অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। ফলে ইসলামিকরণের চেয়ে ‘সোয়াহিলিকরণ’ বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলির অধিকাংশ সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কারণ ইসলাম গ্রহণ ছিল একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, যা তাদের সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে গিয়ে গোত্রবিচ্ছিন্নতা ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পথ সুগম করত এবং এটি তাদের প্রচলিত সামাজিক জীবনের পরিপন্থী ছিল। সোয়াহিলি উপকূলে ইসলাম অন্যান্য আফ্রিকীয় অঞ্চলের তুলনায় ভিন্ন ছিল। পশ্চিম আফ্রিকায় যেখানে ইসলাম স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, সেখানে সোয়াহিলি অঞ্চলে এটি ছিল একটি বহিরাগত ধর্ম। আরব মুসলিমরা এমনভাবে জীবনযাপন করতেন, যেন তারা মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছেন। []

প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিমদের মূল লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য এবং ইসলামের প্রচার তাদের জন্য গৌণ বিষয় ছিল বলে ধারণা করা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের আগমনের ফলে ইসলাম প্রচারের এ সামান্য প্রচেষ্টাও বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বের ফলে ইসলামের প্রচারের পরিবর্তে সেখানে স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। [১০]

অভ্যন্তরে ইসলামের প্রসার

[সম্পাদনা]

ইসলাম সোয়াহিলি উপকূলের কেবল একটি শহুরে ও উপকূলীয় বিষয় হিসেবে ছিল। ইসলামের বিস্তার ছিল খুবই সীমিত এবং স্থানীয় অ-সোয়াহিলি আফ্রিকীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। এর কারণ ছিল যে, আফ্রিকার স্থানীয় সমাজে ইসলাম গ্রহণের জন্য কোনো মধ্যস্থ আফ্রিকীয় ব্যক্তি ছিল না, যারা এই ধারণা দিতে পারত যে, ইসলামি গ্রহণ করার ফলে সমাজে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা বিপর্যয় ঘটবে না। [১১]

ইসলামের অভ্যন্তরে বিস্তার বাধাগ্রস্ত হয়েছিল বিভিন্ন কারণে; যেমন বান্টু সমাজের বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস এবং তাদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাসের কারণে অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলোতে ইসলামের বিস্তার স্লথ হয়ে পড়েছিল। এর পাশাপাশি কঠোর জলবায়ু পরিস্থিতি, মসাইদের মতো বিক্ষুব্ধ উপজাতি, তাদের ভূমির ওপর যাতায়াত নিষিদ্ধকারী উপজাতীয় আইন, স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং সহজ পরিবহন ব্যবস্থার অভাবও ইসলামের বিস্তারে অন্তরায় ছিল। ট্রিমিঘাম বলেছেন যে, ওই অঞ্চলে যে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল, সেটিও বিস্তারকে বাধাগ্রস্ত করেছিল।[১০][১২]

মুসলিম বণিকরা স্থানীয় সমাজের কাঠামোর মধ্যে স্বীকৃত ছিল না, যার ফলে ইউরোপীয় উপনিবেশের আগমন না হওয়া পর্যন্ত ইসলামের ব্যাপক বিস্তার সম্ভব হয়নি। অভ্যন্তরে ইসলামের বিস্তারে আরও কিছু বাধা ছিল; যেমন: দাসপ্রথার সময় মুসলিমদের দ্বারা সৃষ্ট নৃশংসতার ফলে স্থানীয়দের ইসলাম গ্রহণে অনীহা ছিল। তবে উনবিংশ শতাব্দীতে উপকূলীয় উপজাতির বড় একটি অংশ যখন ইসলাম গ্রহণ করে, তখন এটি ইসলামের বিস্তারকে সাহায্য করেছিল।

এছাড়া স্থানীয় মুসলিম ধর্মপ্রচারক এবং শিক্ষকরা ধর্ম ও কুরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা কুরআন স্কুল ও মসজিদের সাথে সংযুক্ত মাদ্রাসায় শিক্ষা দিত।

১৯ শতাব্দীতে দ্বিতীয় দফায় ইউরোপীয় উপনিবেশের আগমনের সময় উপকূলীয় মুসলিমদের মধ্যে গর্ব ও নিজেদের অস্তিত্বের অনুভূতি অনেকটাই কমে যায়। তাদের প্রচেষ্টা তখন নিজেদের সমাজের সাথে মানিয়ে চলার দিকে আবদ্ধ ছিল। [১৩]

লামু দ্বীপের একটি মসজিদ।

ইউরোপীয় উপনিবেশিক শাসকেরা যখন কেনিয়ায় নিজেদের প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করে, তখন তারা মুসলিম শ্রমিকদের তাদের সহকারী হিসেবে কাজে নিয়োগ দেয়। এই সকল মুসলিম শ্রমিক ও প্রশাসনিক সহকারী উপনিবেশ স্থাপনের কাজে সহায়তা করার পাশাপাশি ইসলামের প্রভাবও ছড়িয়ে দেন। এর ফলে প্রতিটি ইউরোপীয় সামরিক শিবির, সরকারি কেন্দ্র ও চাষাবাদ প্রকল্পাধীন এলাকাগুলো ইসলামের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়। অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলিমরা স্থানীয় সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে খুব বেশি মেলামেশা করত না। তবে অসোয়াহিলি আফ্রিকীয়রা তাদের জীবনযাত্রা ও ব্যবসার ধরণে আকৃষ্ট হতে শুরু করে। ব্যবসার কাজে তারা সোয়াহিলি ভাষাও শিখতে শুরু করে, যা ইসলাম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। [১৪]

আফ্রিকীয়দের ইসলামধর্ম গ্রহণের প্রধান কারণ ছিল ব্যবসা ও সাংস্কৃতিক মেলামেশা। ব্যবসার প্রয়োজনে আফ্রিকীয়রা মুসলিমদের সংস্পর্শে আসত এবং এতে তাদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করত। আন্তঃবিবাহও তাদের ইসলাম গ্রহণের একটি বিশেষ কারণ ছিল। মুসলিমদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে কিছু স্থানীয় লোকজন ইসলাম গ্রহণ করে। এছাড়াও মুসলিমদের সুশৃঙ্খল জীবনধারা, পরিচ্ছন্নতা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান দেখেও স্থানীয়রা আকৃষ্ট হয়। এদিকে ইউরোপীয় উপনিবেশিক শাসনের ফলে সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে স্থানীয় ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে যায় এবং নতুন বিশ্বদৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।[১৫]

কেনিয়ার উপকূলীয় মুসলিম শাসকরা সরাসরি ধর্মপ্রচারকদের দেশের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে পাঠাননি। তবে স্থানীয় আফ্রিকীয়রা মুসলমানদের জীবনধারা ও ধর্মীয় রীতিনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করত। মুসলমানদের সাথে মেলামেশা ও বসবাসের ফলে অনেক আফ্রিকীয় ইসলামে দীক্ষিত হয়। কিন্তু বান্টু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ঐতিহ্য খুব শক্তিশালী ছিল। তাই সেখানে ইসলাম ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শক্তিশালী বাহ্যিক প্রভাবের প্রয়োজন ছিল। ১৮৮০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে কেনিয়ায় ইসলামের উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটে। এই সময়ের মধ্যে কেনিয়ার অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে মানুষ নতুন ধর্ম ও জীবনদর্শনের প্রতি আগ্রহী হয়। যদিও বেশিরভাগ ইসলাম গ্রহণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘটেছিল; তবে কিছু সম্প্রদায় একসঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে দিগো ও পোকোমো জনগোষ্ঠী বিশেষ উল্লেখযোগ্য, যারা নিম্ন তানা অঞ্চলে ইসলামে দীক্ষিত হয়। এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের মাধ্যমে ইসলাম ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়। [১৬]

সংগঠিত মিশনারি কার্যক্রম

[সম্পাদনা]
২০২২ সালে মোম্বাসানাইরোবির মধ্যবর্তী রেলপথে একটি মসজিদ।

কেনিয়ার অভ্যন্তরীণ অঞ্চলের মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা মূলত তানজানিয়ার নাগরিক ছিলেন, যারা নিজেদের ধর্মপ্রচারের সাথে ব্যবসাকেও সংযুক্ত করেছিলেন। তারা প্রধানত রেললাইন সংলগ্ন কেন্দ্রগুলোতে কাজ শুরু করেন; যেমন কিবওয়েজি, মাকিন্দু ও নাইরোবি। তাদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন মালিম এমতোনদো, যিনি নাইরোবির প্রথম ইসলাম ধর্মপ্রচারক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মূলত উনবিংশ শতকের শেষের দিকে তিনি নাইরোবিতে পৌঁছান এবং উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আগত অন্যান্য মুসলমান ও উদ্যমী ধর্মপ্রচারকদের নেতৃত্ব দেন। তারা বর্তমান পুমওয়ানি এলাকায় একটি 'সোয়াহিলি গ্রাম' স্থাপন করেন। সেখানে একটি ছোট মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যা তখন ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। []

কিছুদিন পর তার প্রচারের ফলে কিকুয়ু ও ওয়াকাম্বা সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার শিষ্য হন। স্থানীয় মুসলমানরাই পরে ধর্মীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খামিস এনগিগে, যিনি মালিম এমতোনদোর কাছে শিক্ষা গ্রহণের পর পুমওয়ানি মসজিদের ইমাম হন। ১৯০০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে অনেক দায়ী কেনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন এবং পার্বত্য কেনিয়া, মুরাঙ্গা, এম্বু, মেরু, নিয়েরি ও কিতুই অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। তবে এটি বেশিরভাগই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হয় এবং এর প্রভাব স্থানীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। খুব কমসংখ্যক আফ্রিকীয় ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ছিল সীমিত। []

শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রচারের অন্যতম উদাহরণ হল বিশ শতকের পাকিস্তানি পণ্ডিত খ্বাজা মুহাম্মদ লতিফ আনসারির প্রচেষ্টা। তিনি ১৯৫০-এর দশকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে কেনিয়ায় যান, যেখানে তিনি দূরবর্তী শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে ইসলাম প্রচার করেন। তিনি তখন খ্যাতিমান আলেম ছিলেন; তবুও দক্ষিণ এশিয়া থেকে অন্যান্য পণ্ডিতদের সাথে যোগ দিয়ে কেনিয়ার অপেক্ষাকৃত ছোট শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে কাজ শুরু করেন। []

একজন আলেম হিসেবে আনসারী শিয়া সম্প্রদায়কে সংগঠিত ও সমৃদ্ধ করেন। ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত আরুশা সম্মেলনে দেওয়া তার ভাষণ আজও স্মরণীয় হিসেবে রয়েছে, যেখানে আনসারী তাবলীগের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তার প্রচেষ্টার বেশিরভাগ অংশই খোজা সম্প্রদায়ের দিকে নিবদ্ধ ছিল। যার ফলে তারা পরবর্তীতে একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।[][১৭]

পশ্চিম কেনিয়ায় ইসলাম

[সম্পাদনা]

মুসলিম ব্যবসায়ীরা ১৮৭০ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে কেনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে ইসলাম প্রচার করে। নাবোঙ্গো অঞ্চলের প্রধান মুমিয়া তখন সাহিলীয় ব্যবসায়ীদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান। এক আন্তগোত্রীয় যুদ্ধে মুসলিমরা প্রধান মুমিয়াকে শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়লাভে সহায়তা করেন এবং কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে এক ঈদের দিনে প্রধান মুমিয়া, তার পরিবার ও অধীনস্থ রাজদরবারের কর্মকর্তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই ইসলাম আশপাশের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে; যেমন: কাকামেগা, কিসুমু, কিসি ও বুঙ্গোমা। [১৮]

যদিও কেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল, তবে এতে মুসলিমদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে খুবই কম তথ্য পাওয়া যায়। তবে কেনিয়া স্বাধীন হলে এর সংবিধানে কাজী আদালত অন্তর্ভুক্তির জন্য কিছু মুসলিম নেতা আলোচনায় অংশ নেন বলে জানা যায়, যা স্বাধীনতায় মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে ইঙ্গিত করে। ১৯৯০-এর দশক থেকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা—সংকট, ব্যর্থতা, শক্তি ও সাফল্যের অভিজ্ঞতা— সকল মুসলিম দেশে একটি নতুন ধর্মীয় গণজাগরণের সূচনা করে, যা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইসলামের পুনরুত্থান ঘটায়। এর প্রভাব কেনিয়ার মুসলিম সমাজেও পড়ে। [১৯][২০]

বিখ্যাত ইসলামবিদ জন এসপোসিটো বলেন যে, এই জাগরণের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজে ইসলামি সংস্কার আনা এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামি চেতনার গঠন করা। এই ধর্মীয় জাগরণ ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে। এর ফলে নামাজ, রোজা, মসজিদ নির্মাণ, ধর্মীয় প্রোগ্রাম, প্রকাশনা বৃদ্ধি, বিশেষ ধর্মীয় পোশাক ও মূল্যবোধের ওপর জোর বাড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামপন্থীদের কাজী আদালতের উন্নয়নের মতো দাবি উত্থাপন তাদের প্রকাশ্য জীবনে ইসলামের দৃঢ় উপস্থিতির প্রমাণ দেয়। [২১]

সমসাময়িক ইসলামি কার্যক্রমের অনেকটাই মিশরীয় মুসলিম ব্রাদারহুড (ইখওয়ান এবং এর নেতা হাসান আল-বান্নাসাইয়্যেদ কুতুবের আদর্শে অনুপ্রাণিত বলে উল্লেখ করা হয়। এভাবে জামায়াতে ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা মৌলবি আবুল আ'লা মওদুদীর চিন্তাধারাও বিশ্বজুড়ে ইসলামী পুনর্জাগরণে প্রভাব রেখেছে। তাঁরা সবাই বিশ্বাস করতেন যে, পশ্চিমারা মুসলিম নেতাদের ভুলপথে পরিচালিত করেছে এবং নেতারা ইউরোপীয় পথ অনুসরণে অন্ধ হয়ে পড়েছেন। [২০]

যদিও কুরআনহাদিস ইসলামি জীবন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি, তথাপি আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলনগুলি "সত্যিকারের ইসলামের" পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘস্থায়ী সচেতনতা ইসলামের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করে এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে একধরনের আত্মসম্মানবোধের জন্ম দেয়। সাম্প্রতিক ইসলামিকরণ প্রক্রিয়ার পদ্ধতি দুই ধরনের: একটি মুসলমানদের জন্য, অপরটি অমুসলিমদের দিকে লক্ষ্য রেখে। সমাজসেবামূলক কাজ; যেমন: স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণ, খাদ্যসামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি ইসলামি দাওয়াতের জন্য প্রিন্ট মিডিয়া, রেডিও-টেলিভিশন সম্প্রচার, মিশনারি সংগঠন গঠন ও প্রকাশ্য বিতর্ক বা "মুহাযারার" আয়োজন করা হচ্ছে।

— জোসেফ এম. মুটেই; সেন্ট পলস বিশ্ববিদ্যালয়, কেনিয়া

শিয়া ইসলাম

[সম্পাদনা]

কেনিয়ায় শিয়া মুসলিমরা প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য ও ভারত থেকে আগত মুসলমান বণিকদের বংশধর বা তাদের দ্বারা প্রভাবিত। এ সকল বণিক মূলত চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে বা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে এসেছিলেন । কেনিয়ার প্রধান শিয়া উপদল হলো ইসনা-আশারিয়া (দ্বাদশ ইমামপন্থী), যাদের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত খোজা সম্প্রদায় ও স্থানীয় কেনীয় মুসলমানরা অন্তর্ভুক্ত। অপরদিকে শিয়াদের ইসমাইলি উপদলটি দাউদি বোহরা, মুস্তালি ইসমাইলি ( দাউদি বোহরার অন্তর্গত) ও খোজা ইসমাইলিদের অন্তর্ভুক্ত করে। এ সব উপদলীয় সদস্যের অধিকাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। [২২]

ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিয়ারা ১৯ শতকে পূর্ব আফ্রিকায় আগমন করেন এবং তারা প্রথমে জাঞ্জিবার ও লামুতে পৌঁছান। তারা প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই এসেছিল। পরবর্তীতে তারা হার্ডওয়্যার, কাচের ব্যবসা এবং ধীরে ধীরে ভূসম্পত্তি ও নির্মাণ শিল্পে প্রসারিত হন। বর্তমান তারা কেনিয়ার অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ; বিশেষত টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, উৎপাদন শিল্প, সরবরাহ, আমদানি ও রপ্তানি খাতে। খোজাদের ইসনা-আশারিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা আনুমানিক ২,০০০ জন, যারা মূলত মোম্বাসানাইরোবিতে বাস করেন। স্থানীয় কেনীয় শিয়া মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ৩০,০০০, যারা নাইরোবি, মোমবাসা, নাকুরু ও লামুতে বসবাস করে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হলেন শায়খ আব্দিল্লাহি নাসির, যিনি সুন্নি থেকে শিয়া ইসলামে রূপান্তরিত একজন কেনীয় মুসলমান এবং তিনি মোমবাসায় বসবাস করেন। অন্য একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেন লামুর সৈয়্যেদ আইদারুস আলাবি। তবে খোজা ইসমাইলি সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা খুব সীমিত এবং দাউদি বোহরাদের সংখ্যা কেনিয়াতে আনুমানিক ৬,৫০০ থেকে ৮,০০০ জনের মধ্যে, যাদের মধ্যে প্রায় ২,৫০০ জন নাইরোবিতে এবং ৩,০০০ জনেরও কম মোমবাসায় বাস করেন। এছাড়াও নাইরোবিতে দাউদি বোহরা সম্প্রদায় থেকে পৃথক হওয়া প্রগতিশীল দাউদি বোহরা নামের একটি গোষ্ঠীর প্রায় ২০০ জন সদস্য রয়েছেন। [২২]

খ্যাতনামা কেনীয় মুসলিম ব্যক্তিত্ব

[সম্পাদনা]
  • হাবিব সালিহ – একজন প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত
  • খ্বাজা মুহাম্মদ লতীফ আনসারী–ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক।
  • দেখা ইব্রাহিম আবদি – শান্তি আন্দোলনকর্মী ও সামাজিক সংগঠক।
  • ইউসুফ হাসান আবদি –রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক, সমাজকর্মী ও সাংবাদিক।
  • নাজিব বালালা–প্রভাবশালী কেনীয় রাজনীতিবিদ
  • মুহাম্মদ ইউসুফ হাজি –রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা।
  • আলি কোরান–কেনিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় একজন ব্যক্তি।
  • আবদুল মাজিদ ককার – আইনজীবী ও কেনিয়ার সাবেক প্রধান বিচারপতি।
  • আসিফ করিম – কেনিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন খেলোয়াড়।
  • রাগিব আগা – ক্রিকেটার।
  • ইরফান করিম–কেনীয় ক্রিকেটার ও জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্বকারী ক্রীড়াবিদ।
  • বারাক ওবামা সিনিয়র – মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পিতা; তিনি খ্রিস্টান থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন; তবে পরবর্তীতে ধর্মত্যাগ করে নাস্তিক হন।
  • ওমর আহমেদ – বক্সার ও ক্রীড়াজগতের পরিচিত মুখ।
  • শেহজানা আনোয়ার–কেনিয়ার জাতীয় তীরন্দাজ।
  • সৌদা রাজাব–ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা।
  • রামা সালিম –পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়।
  • আওয়ায সালেহ শারম্যান – একজন খ্যাতনামা ব্যবসায়ী।
  • আমিনা মুহাম্মদ–রাজনীতিবিদ ও কেনিয়ার বিভিন্ন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত এক নারী।

আরো দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "2019 Kenya Population and Housing Census Volume IV: Distribution of Population by Socio-Economic Characteristics"Kenya National Bureau of Statistics। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মার্চ ২০২০ 
  2. Nkirote., Maingi, Anne। The diversity factor in the history of Islam in Nairobi, 1900–1963ওসিএলসি 61571423 
  3. Ayubi, Shaheen; Mohyuddin, Sakina (১৯৯৪-০১-০১)। "Muslims in Kenya: an overview": 144–156। আইএসএসএন 0266-6952ডিওআই:10.1080/02666959408716313 
  4. "Chapter 1: Religious Affiliation"The World’s Muslims: Unity and DiversityPew Research Center's Religion & Public Life Project। আগস্ট ৯, ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩ 
  5. "The World's Muslims: Unity and Diversity" (পিডিএফ)। Pew Forum on Religious & Public life। আগস্ট ৯, ২০১২। অক্টোবর ২৪, ২০১২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৪, ২০১২ 
  6. Helene Charton-Bigot, Deyssi Rodriguez-Torres. Nairobi Today. the Paradox of a Fragmented City. African Books Collective, 2010. আইএসবিএন ৯৯৮৭-০৮-০৯৩-৬, আইএসবিএন ৯৭৮-৯৯৮৭-০৮-০৯৩-৯. Pg 239
  7. "E-Book of 12 Personalities" (পিডিএফ)dewani.ca 
  8. "Synopsis of the Khoja Shia Ithna Asheri – BILAL OF AFRICA"coej.org। ২০১৫-০৪-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  9. Quraishy:1987:154 
  10. Trimingham:1983:53 
  11. Quraishy:1987:157 
  12. Lodhi:1994:1 
  13. Lodhi:1994:10 
  14. Quraishy:1987:182 
  15. Trimingham:1983:57 
  16. Trimingham:1983:59 
  17. "isbn:997695607X - Google Search"www.google.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৩-১৩ 
  18. "Role played by Nabongo Mumia in the spread of Islam in Western Kenya."www.kenyaplex.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৪-২৪ 
  19. "Islam in Kenya - Islam in Western Kenya | Islam Western Kenya"www.liquisearch.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৪-২৪ 
  20. "Discuss the role played by Nabongo Mumia in the spread of Islam in Western Kenya. - EasyElimu Questions and Answers"www.easyelimu.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৪-২৪ 
  21. Esposito: 1999:9 
  22. Teymoori, Ali (২০১৯-১২-০৯)। "Kenyan Shiite Community: A Socio-Historical Perspective"Ijtihad Network (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৪-২৪