কিরগিজস্তানে ইসলাম
ইসলাম কিরগিজস্তানের বৃহত্তম ও সর্বাধিক প্রচলিত ধর্ম। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যার ৯০% ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিল। [১][২] কিরগিজস্তানের মুসলিমরা সাধারণত সুন্নি ইসলামের অনুসারী এবং ফিকহে অধিকাংশই হানাফি মাযহাব মেনে চলে, যা অষ্টম শতাব্দীতে এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। বেশিরভাগ কিরগিজ মুসলমান শামানীয় উপজাতীয় রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট পন্থায় নিজেদের ধর্ম পালন করে। স্বাধীনতার পর থেকে কিরগিজস্তানে ইসলামী রীতিনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় নেতারা কেবল ধর্মীয় বিষয়গুলি নিয়েই কাজ করেন এবং তাবলীগের মাধ্যমে তা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছান না; বরং তারা কেবল মসজিদে আসা লোকদের সেবা প্রদান করেন। তবে দেশে আঞ্চলিক পার্থক্য রয়েছে; দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দারা অধিক ধার্মিক। কমিউনিজমের পতনের পরও কিরগিজস্তান বর্তমান একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই বহাল রয়েছে। কিরগিজস্তান যখন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ছিল, তখন সমাজে ধর্ম প্রায় প্রভাবহীন ছিল এবং রাষ্ট্র নাস্তিকতায় বিশ্বাসী ছিল। কিরগিজস্তানের রুশ জনসংখ্যার বেশিরভাগই রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান। উজবেকরা– যারা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৪.৯%– সাধারণত সুন্নি মুসলিম। [৩]
ইসলামের প্রবর্তন
[সম্পাদনা]
অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে কিরগিজ উপজাতিদের কাছে ইসলামের পৌঁছেছিল। তবে সপ্তদশ শতাব্দীতে ইসলাম ধর্মের সাথে কিরগিজদের নতুন করে পরিচিতি ঘটে, যখন জুংগাররা থিয়েন শান অঞ্চলের কিরগিজ জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক ফারগানা উপত্যকায় স্থানান্তরিত করে। ফারগানা উপত্যকার জনগণ পুরোপুরি ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিল, যার ফলে কিরগিজদের ওপর ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে। তবে জুংগারদের হুমকি কমে গেলে কিরগিজদের একটি অংশ আবারও তাদের পুরনো গোত্রীয় রীতিনীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। এরপর যখন অষ্টাদশ শতাব্দীতে কোকন্দ খানাত উত্তর কিরগিজিস্তানে তাদের শাসন বিস্তার করে, তখন উত্তর কিরগিজদের অনেক গোত্র আনুষ্ঠানিক ইসলামি রীতিনীতি অনুসরণ করা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সমগ্র কিরগিজ জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের গোষ্ঠীগুলি সুন্নি ইসলামে দীক্ষিত হয়। কিরগিজস্তানের মুসলিম জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রত্যেকেরই নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী আইন ও রীতি রয়েছে। কিরগিজরা ইসলাম গ্রহণের পরও কিছু প্রাচীন প্রথা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করেছে, যা ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থী নয়। এটি অনেকটাই ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমদের মতো, যারা ইসলাম গ্রহণের পরও নিজেদের কিছু স্থানীয় রীতিনীতি বজায় রেখেছে। [৪]
উপজাতীয় প্রভাব
[সম্পাদনা]
ইসলাম গ্রহণের আগে কিরগিজ জনগণের ধর্ম ছিল টেংরিবাদ, যা প্রকৃতির আত্মা, পূর্বপুরুষ, পৃথিবী ও আকাশের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি নির্দিষ্ট প্রকারের প্রাণীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক আত্মীয়তার স্বীকৃতি প্রদান করত। ইসলামের সংস্পর্শে আসার আগেই এই বিশ্বাস মতে কিরগিজ গোত্ররা সাধারণত বল্গা হরিণ, উট, সাপ, পেঁচা ও ভাল্লুককে পূজার বস্তু হিসেবে গ্রহণ করত। আকাশ, পৃথিবী, সূর্য, চাঁদ ও তারাগুলিকেও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো। যাযাবর কিরগিজদের প্রকৃতির ওপর শক্তিশালী নির্ভরশীলতা তাদের মধ্যে এসব বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করে এবং ওঝাবাদের প্রতি তাদের বিশ্বাসী করে তোলে। এই ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাসের কিছু চিহ্ন এখনো উত্তর কিরগিজিস্তানের অনেক মানুষের ধর্মীয় কার্যক্রমে দেখা যায়। কিরগিজ সমাজবিজ্ঞানী রাখাত আচিলোভা আলোচনা করেছেন যে, কীভাবে টেংরিবাদের কিছু উপাদান কিরগিজ ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। [৫]
উত্তরের তুলনায় দক্ষিণে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান ও আগ্রহ অনেক বেশি। উত্তরে ধর্মীয় কার্যক্রম সাধারণত সর্বপ্রাণবাদী ও স্থানীয় ওঝাবাদী রীতিনীতির সাথে মিশ্রিত হয়েছে, যার ফলে সেখানকার মুসলিমদের ধর্মীয় উপাসনা অনেকটা সাইবেরিয়ার ধর্মীয় অনুশীলনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়।
ধর্ম ও রাষ্ট্র
[সম্পাদনা]
কিরগিজস্তানে ধর্ম সাধারণত রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে বড় কোন ভূমিকা রাখে না। তবে দেশের জাতীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও ইসলামি মূল্যবোধ ও ইসলামের ঐতিহ্যবাহী দিকগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। যদিও সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে কোনো মতাদর্শ বা ধর্মের হস্তক্ষেপ চলবে না, তথাপি অনেক জনপরিচিত ব্যক্তি ইসলামি ঐতিহ্যকে উৎসাহিত করার পক্ষে মত দেন। মধ্য এশিয়ার অন্যান্য অংশের মতো কিরগিজস্তানের ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী এক ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, তারা আশঙ্কা করছে, ইরান বা আফগানিস্তানের মতো একটি ‘ইসলামি বিপ্লব’ হতে পারে, যা ইসলামকে সরাসরি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে নিয়ে আসবে এবং এর ফলে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর ক্ষতি হতে পারে। যদিপ কিরগিজস্তানের ৯০ শতাংশের অধিক মানুষ নিজেদের মুসলিম হিসেবে উল্লেখ করে।[৬]
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আসকর আকায়েভ বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন, যেন দেশের রুশ জনগোষ্ঠী আশ্বস্ত হয় যে, কিরগিজস্তানে কোনো ইসলামি বিপ্লব ঘটবে না। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিশকেকের প্রধান রুশ অর্থোডক্স গির্জা পরিদর্শন করেন এবং ওই গির্জা নির্মাণ তহবিলে এক মিলিয়ন রুবেল রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বরাদ্দ দেন। তিনি জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের জন্যও অর্থ ও অন্যান্য সহযোগিতা বরাদ্দ করে। তবে স্থানীয় সরকার দেশের বিভিন্ন এলাকায় মসজিদ ও ধর্মীয় বিদ্যালয় নির্মাণে সহায়তা প্রদান করেছে।[৭]
আরও উল্লেখযোগ্যভাবে কিরগিজস্তানে সম্প্রতি এমন কিছু বিল প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বহুবিবাহকে বৈধ করার জন্যে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কর-মুক্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে হজ পালনে পাঠানোর বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।[৭]
২০১৬ সালের আগস্টে মাসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আলমাজ্বেক আতামবায়েভ মন্তব্য করেন, “মহিলারা যখন ইসলামি পোশাক পরিধান করেন, তখন তারা চরমপন্থায় ঝুঁকে সন্ত্রাসী হয়ে উঠতে পারেন।” তার এই মন্তব্য এমন এক সময় প্রচারিত হয়, যখন রাজধানী বিশকেকে সরকার-সমর্থিত বিলবোর্ড ও ব্যানার লাগানো হয়েছিল, যাতে নারীদের হিজাব, নিকাব ও বোরকা পরিধান না করার আহ্বান জানানো হয়। এই ব্যানারগুলো কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।[৮]
বর্তমান অবস্থা
[সম্পাদনা]রাষ্ট্র বর্তমান দুইটি ইসলামি উৎসবকে সরকারি ছুটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়: ঈদুল ফিতর ( স্থানীয় ভাষায় ওরোজ আইত), যা রমজানের শেষে পালিত হয় এবং ঈদুল আজহা (কুরবান আইত), যা ইব্রাহিম নবির ত্যাগের স্মরণে উদযাপিত হয়। এ ছাড়া দেশটি রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের বড়দিন ও ঐতিহ্যবাহী ফারসি উৎসব নওরোজকেও সরকারি ছুটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
২০১৫ সালের হিসেবে কিরগিজস্তানে দুই হাজারেরও বেশি মসজিদ ছিল।[৯]
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Kyrgyzstan - United States Department of State"।
- ↑ "Archived copy" (পিডিএফ)। ২০১১-০৫-১৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১১-২৭।
- ↑ Gendering Ethnicity: Implications for Democracy Assistance By L. M. Handrahan, pg. 100-10।
- ↑ Gendering Ethnicity: Implications for Democracy Assistance By L. M. Handrahan, pg. 100।
- ↑ Laruelle, Marlene (২০২১)। Central Peripheries: Nationhood in Central Asia (পিডিএফ)। UCL Press। পৃষ্ঠা 107।
- ↑ "Kyrgyzstan"। The World Factbook (ইংরেজি ভাষায়)। Central Intelligence Agency। ২০২৫-০৪-২৩।
- ↑ ক খ "ISN Security Watch - Islam exerts growing influence on Kyrgyz politics"। web.archive.org। ২০০৮-০৩-১৬। ২০০৮-০৩-১৬ তারিখে আসল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৪-২৯।
- ↑ "Kyrgyzstan president: 'Women in mini skirts don't become suicide bombers'"। BBC News। ১৩ আগস্ট ২০১৬।
- ↑ "More Mosques Than Schools Being Built in Kyrgyzstan"। Voice of America (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৫-১১-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৪-০৪।